ডিম রুটি
ডিম রুটি


আমরা যখন পৌঁছলাম তখন বেলা দশটা। সামনের লোহার গেট পেরিয়ে সরু একটা গলি সেই গলির শেষে সদর দরজা। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে সামনেই লোহার রেলিং দেওয়া চওড়া বারান্দা। সেই বারান্দার শেষে যেখানে শীতের রোদ এসে পড়েছে, সেখানে একটা ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। পরনে নীল পাড় সাদা শাড়ি আর আলোয়ান। মাথার চুল ধবধবে সাদা। ওনার পায়ের কাছে শতরঞ্চির ওপর বসে আছে গোটা ছয়েক নানা বয়সী মেয়ে। তাদের বেশীর ভাগই আমার চেয়ে বয়সে ছোট। সবাই মন দিয়ে অঙ্ক কষতে ব্যস্ত। যার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে সে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ওনার সামনে , উনি হাসি মুখের তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল পাড়ার মিতাদি। আমার ক্লাস টেনের অঙ্ক বুঝতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। মিতাদি শুনে বলল,” আমাদের প্রণতিদি থাকতে চিন্তা কি?”
ব্যাস পরের রবিবারই গিয়ে হাজিরে হলাম। আমরা গিয়ে দাড়াতেই উনি হেসে আমাদের হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন। মিতাদি এগিয়ে গিয়ে ঢক করে প্রণাম করলো, দেখাদেখি আমিও।
সব কথা শুনে উনি বললেন ,” ঠিক আছে, বসে পড়। যেটা পারবে না আমাকে দেখিয়ে নিও।“
আমিও শীতের রোদে পিঠ দিয়ে শতরঞ্চির ওপর বসে পড়লাম বই খাতা নিয়ে। বেশ মজার ব্যবস্থা। সবার জন্য অবারিত দ্বার। কোনও বকাবকি নেই, হোম ওয়ার্ক নেই।
এরপর এলো আসল চমক। একটি কাজের মেয়ে অদ্ভুত কায়দায় হাতে একসঙ্গে অনেকগুলো থালা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলো। সে ওই থালাগুলো মেয়েদের হাতে দিতে লাগলো। আমার হাতেও একটা থালা দিল। সেই থালার ওপর রয়েছে একটা ডিম রুটি আর পাশে খানিকটা টমেটো সস। ডিম রুটি হল ‘এগ রোলের’ ঘরোয়া ভার্সান। একটা বেশ বড় আকারের আটার রুটির সঙ্গে ডিম দিয়ে ভাজা। তাতে প্রভূত পরিমানে পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা। দেখেই আমার জিভে জল এসে গেল। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম বাকিদেরও আমার মতই অবস্থা। কাজের মেয়েটি প্রণতিদিকেও একটি থালা দিল।
উনি বলে উঠলেন,” সবাই হাত ধুয়ে এসো।“
বারান্দার এক কোনে একটা বেসিন লাগানো। আমরা সবাই লাইন করে হাত ধুয়ে এসে খেতে বসলাম। ওই শীতের সকালে গরম গরম ডিম রুটি, আহ্ যা খেতে লাগছিল না, কি আর বলব!
আসলে ডিমের ওপর আমার চিরকালীন দুর্বলতা। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়িতে একটা পুরো ডিম আমাদের ভাগ্যে জুটতো না। দুটো ডিম আর আলু একসাথে সিদ্ধ করে মা ডিম আলু ভাতে মেখে ভাইবোনেদের ভাগ করে দিতেন। আর তাই দিয়ে আমরা এক থালা ভাত খেয়ে নিতাম। ডিম ভাজা করলে মা খুন্তি দিয়ে কেটে ভাগ করে দিতেন ।
বাড়িতে কোনও নামী দামী অতিথি এলে তাদের জন্য ‘মামলেট’ ভাজা হত। ভাজার কায়দা ছিল, পেঁয়াজ, লঙ্কা খুব পাতলা পাতলা কেটে তাতে ডিম মেশানো হত। তারপর খুব ভালো করে ফেটিয়ে ডিমে ফেনা করতে হত। তারপর খুব সাবধানে ডিমকে ঢালতে হত তাওয়ায় । একটা পিঠ হয়ে যাবার পর আরও ধীরে ওলটাতে হত যাতে ফেনা গুলো মরে যাবার আগেই অন্য দিকটা ভাজা হয়। তাতে এমন ফুলো ফুলো মামলেট হত যে একটা ডিমের হলেও, দেখে মনে হত ডবল ডিমের মামলেট।
মা আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিল, এই রকম করে মামলেট ভাজা। যাকেই খাইয়েছি সেই প্রশংসা করেছে। আমার নিজের কখনো খাওয়া হয়নি। প্ল্যান বহুবার করা হয়েছে।
“ খাবি খাবি পরের মাসের মাসকাবারির বাজারে বাবা কে বলব একটু বেশী করে ডিম আনতে। তারপর তোদের ......।“
কিন্তু ওই পর্যন্তই পরের মাসে আর আমাদের মনে থাকতো না। একবার আমার ছোট বোন ফুলি আমায় বলেছিল,” যখন বড় হয়ে অনেক টাকা রোজগার করবো, তখন বুঝলি রোজ ডবল ডিমের মামলেট বানিয়ে খাব।“
প্রণতিদির বাড়ী খুব বেশীদিন যাওয়া হয়নি। মাধ্যমিক পরীক্ষা কাছে এসে যাওয়াতে বাবা একজন মাস্টার মশাই রাখলেন যিনি দু মাসের মধ্যে সিলেবাস শেষ করে দেবেন।
মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবার পর একদিন মিনিবাসে প্রণতিদির সঙ্গে দেখা। প্রণাম করে আমার রেজাল্ট বললাম । খুব খুশী হলেন। তারপর আর কোনোদিন ওনার সঙ্গে দেখা হয়নি।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে। আমি শিক্ষকতাকে আমার পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছি। আজকাল স্কুলে ব্ল্যাক বোর্ডের চেয়ে স্মার্ট বোর্ডের ব্যবহার বেশী। ছেলে মেয়েরা কোচিং ক্লাসে পড়তে যায়। শিক্ষক ছাত্রদের মধ্যে সেই প্রাণের সম্পর্কটা কি আর হয় ? জানিনা।
ছোটবেলার গল্প বলছিলাম ছেলেকে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল প্রণতিদির কথা। ওকে গল্প বললাম , ডিম রুটির।
“ চল না মা আমরা দুজনে মিলে ডিম রুটি বানাই।“
পরের রবিবার আমরা মায়ে পোয়ে লেগে পড়লাম ডিম রুটি অভিযানে। সঙ্গে আমাদের রান্নার মাসি। আধঘণ্টা পর যখন ডাইনিং টেবিলে টমেটো সসের সঙ্গে সাজিয়ে দিল মাসি সেই ডিম রুটি, আমি প্রথমে গন্ধটা শুঁকলাম। আহা একদম সেই রকম।
কিন্তু মুখে দিয়ে তো সেই স্বাদ পেলাম না! বয়সের সঙ্গে কি স্বাদও বদলায়? নাকি স্মৃতির স্বাদ বেশী মধুর।
মনের ভাব গোপন করে ছেলের দিকে তাকালাম, “ কিরে কেমন লাগছে?”
“ওকে। তবে রুটিটা আটার জায়গায় ময়দার হলে আর ডিমের বদলের ডিমের মাকে মানে চিকেনকে পুর হিসেবে দিলে আরও টেস্ট হত।“ বলল ছেলে।
সমাপ্ত