বর্ষবরণের রাতে-২
বর্ষবরণের রাতে-২
সেবারে ডিসেম্বরের শেষে গিয়েছিলাম বোনের কাছে মাইসোরে। কদিন খুব ঘোরা বেড়ানো হল। বছরের প্রথমদিন আমাদের ফেরা। বছর শেষের দিনটিতে বিশেষভাবে সাজানো মাইসোর প্যালেস দেখার উদ্দেশ্যেই আমাদের থেকে যাওয়া ঐদিন। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরেও মাইসোর প্যালেসের উদ্দেশ্যে বের হতে বেশ রাত হয়ে গেল,সন্ধ্যা থেকেই সেখানে প্রোগ্রাম চলছিল,খুব সুন্দর প্রোগ্রাম হয় সন্ধ্যা থেকেই, কিন্তু আমরা যেতে পারিনি তাড়াতাড়ি। আমরা পৌঁছালাম তখন রাত ১১.৩৫। গাড়ি পার্ক করে এগিয়ে চললাম। অকথ্য ভিড়,গেটে সিকিউরিটি চেক করে ছাড়া হচ্ছে বলে ভিড় যেন এগোচ্ছেই না। চারপাশ থেকে চাপ,চেষ্টা করছি সবাই এক জায়গায় থাকার,ছিটকে গেলে মুশকিল। দুলছি ভিড়ের চাপে,এদিকে সময় হয়ে আসছে,সবাই অস্থির হয়ে পড়ছে। খানিক বাদে চেকিং বন্ধ করে ছেড়ে দিল,হুড়মুড়িয়ে সব ভেতরে ঢুকল। চারিদিকে আলোর মেলা,একদিকে ফ্লাওয়ার শো,তবে সেখানকার আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে,তাও আশপাশের আলোয় ভালোই দেখা গেল,ফুল দিয়ে তৈরি হাতির দল,বেশ বড় একটা মসজিদ,বেশিরভাগ সাদা ফুল দিয়ে, মাঝে মাঝে লাল ফুল দিয়ে নকশা করা,নৌকা,কাঠবেড়ালি,জিরাফ, জেব্রা,সব ফুলের,অনবদ্য।
ওদিকে প্যালেসের সামনে স্টেজে গান-বাজনা চলছে,সেখানে সামনে বসবার ব্যবস্থা করা,চেয়ার পাতা যদিও বসার জায়গা নেই। আমরা প্যালেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম,কত ইতিহাস লেখা আছে এই প্রাসাদের গায়ে গায়ে। দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম,পুলিশের ব্যান্ড বাজছিল। কিছু পরে স্ক্রিনে কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেল ২৮,২৭,২৬...১০,৯,৮....৩,২,১...১২টা বাজল,পাবলিক হৈ হৈ করে উঠল আর দু চোখ ভরে দেখলাম মাইসোর প্যালেস। প্যালেস,গেট,সর্বত্র একসাথে ঝপ করে সমস্ত আলো জ্বলে উঠল। চারিদিকে আলোর রোশনাই,আলো ঝলমল করছে। আহা,অপূর্ব অপূর্ব অপূর্ব,যেদিকে চোখ যায় শুধু ঝলমল ঝলকানি। উল্টো দিকের গেটে শুরু হয়ে গেল বাজি ফাটানো,আকাশ জুড়ে নানারকম,নানা রঙের আতসবাজি ছুটতে লাগল। মন,প্রাণ ভরে দেখলাম সে দৃশ্য,যদিও প্রতি রবিবার সন্ধ্যা সাতটায় এরকম একসাথে প্যালেসের আলো জ্বালানো হয় তবু দেখিনি কখনও
আগে আর এই বর্ষশেষের দিনটিতে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে একদিকে আলোর রোশনাই,আরেকদিকে বাজির বাহার,এমন তো আর অন্যদিনে হয় না। জানিনা আর কখনও দেখা হবে কিনা,দেখে আশ মেটে না যেন,তবু খানিকবাদে ছবি তুলে ঘরে ফিরলাম,পরদিন ভোরবেলায় বাস,প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লাগে,যদিও ১২ টায় ফ্লাইট। মাইসোরে এয়ারপোর্ট চালু হলে অনেক সুবিধা হবে। প্যালেস থেকে বোনের বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম বাইকের তাণ্ডব। এমনই নাকি হয় প্রতিবছর,সব অল্পবয়সী ছেলেরা এমন বেহেডের মতো বাইক চালাচ্ছে,মনে হচ্ছে এই বুঝি অ্যাক্সিডেন্ট হল। একেকটায় আবার তিন-চারজন করে চেপেছে,মুখে নানারকম আওয়াজ,দুটো হাত দুদিকে প্রসারিত করে দিয়ে শুরু হল তাদের ফার্স্ট জানুয়ারি সেলিব্রেশন,বর্ষবরণ। জানিনা কোথায় যাবে,তবে শহর জুড়ে বাইকের তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে গেল,সেদিন পুলিশও তাকায় না ওদিকে। মাইসোর প্যালেসে তার পরেও প্রোগ্রাম ছিল,দেখা সম্ভব হলো না।
বাড়ির কাছাকাছি এসে আর একটা জিনিস বড় নজর কাড়ল। বোনের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এক লিকারের দোকান,সেখানের ভিড় দেখার মত,উপচে পড়ছে। বুঝি এই একদিনেই মালিক তার সারা বছরের প্রফিট তুলে নিলেন।
পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় বোন,ভগ্নীপতি,বোনপো সকলে মিলে বাসস্ট্যান্ডে ছাড়তে এল। আমরা বাসে উঠে বসলাম,ওদের চোখ ছল ছল আমাদেরও। ছল ছল চোখে যতক্ষণ বাস না ছাড়ল ওরা অপেক্ষায় রইল৬.০৫ এ বাস ছাড়ল তবে ঠিক ৯.০৫এ এয়ারপোর্টে ঢুকিয়ে দিল,ভোরের রাস্তা ফাঁকা আর তাছাড়া এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে এই বাসগুলো খুব তাড়াতাড়ি যায় যদিও এয়ারপোর্ট থেকে মাইসোরে আসতে একটু বেশিই সময় নেয়। সেইজন্যই তো বাস গুলির নাম ফ্লাই বাস। কিন্তু ফ্লাইট প্রায় ৪০ মিনিট লেটে ছাড়ল। তবে দুঘন্টা পাঁচ মিনিটে কলকাতায় পৌঁছে দিল। বছরের প্রথম দিনে নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। ঘোরা বেড়ানো সবই ভালো লাগে,তবে ১০ দিনের বেশি নয়,মন আনচান করে ঘরের টানে। তবে এবারে ছোট বোনের বাড়িতে ছিলাম তো,তাই ওদের জন্য মনটা একটু খারাপ হল,হাজার হোক ছোট বোন,অনেক দূরে থাকে,ইচ্ছে হলেই দেখতে পাই না কিনা।