ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-17-আরশির সামনে
ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-17-আরশির সামনে
আমাদের বাড়ির পাশেই মায়ের জেঠতুতো দাদাদের বাসগৃহ। মায়ের জ্ঞাতী ভাইবোনদের মধ্যে তিনিই সর্বজ্যেষ্ঠ। তিনি আমাদের বড়মামা। সেই বড়মামার বাড়িতে নতুন অতিথিরা চলে এসেছে। নতুন অতিথি বলতে আমার মামাতো দাদা নবেন্দুর পরিবার-পরিজনরা।
নবেন্দু আমার মায়েরই সমবয়সি প্রায়। তিনি রাজ্য সরকারের চাকুরে। এতকাল তিনি উপরি অসমের গোলাঘাটে থাকতেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। এবার তার নতুন পোস্টিং হয়েছে অসম পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের শ্রীরামপুরে। সেখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকা সম্ভব নয় বলে তিনি তাদের সবাইকে পৈতৃক গৃহে এনে রেখে দিয়ে চলে গেছেন তার কর্মস্থলে।
নবেন্দুকে আমরা ছোটবেলা থেকেই সোনাদাদা বলে ডাকি। তারা দুইজন ভ্রাতা। ছোট দিব্যেন্দুকে আমরা রাঙাদাদা বলে সম্বোধন করি।
প্রাণ উল্লাসে ভরপুর হয়ে উঠল আমাদের বড়মামার এতকালের নীরব নিস্তব্ধ বাড়িটা। সেই উল্লাসের আঁচ এসে লাগল আমাদের বাসগৃহেও। আমাদের পশ্চিম পাশেই থাকেন মেসো মশায় তার পরিবার পরিজন নিয়ে। মেসো মশায়ের তিন ছেলে ও দুটি মেয়ে। আর আমাদের ঘরে ছোট বলতে আমি আর ছোড়দি। আমাদের ছোড়দাও মাঝেমধ্যেই কলেজের ছুটিছাটা পেলেই গুয়াহাটি থেকে চলে আসে বাড়িতে।
সোনাদা নবেন্দুর অনেকগুলো ছেলেমেয়ে।
এই পাড়ার মধ্যেই আমাদের বাসগৃহ থেকে খানিক দূরেই রেলগেটের ওদিকে মায়ের জ্ঞাতী খুড়তুতো ভাইদেরও বাড়ি। সেই মামারা সবাই মিলে চার ভাইয়ের জমজমাট এক একান্নবর্তী পরিবার। তাদের ছেলেমেয়েরাও সবাই এসে ভিড় জমায় পাশের বড়মামার বাসগৃহে।
বড়মামার ছোটো মেয়ে কুসুমদিদির বাড়ি সামনের রাস্তার ওপারে পেছনের পাড়ায়। লোকের মুখে মুখে সেই পাড়ার নাম হয়ে গেছে পেছনপট্টি।
কুসুমদিদিরও বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে। তারাও এসে ভিড় জমায় বড়মামার বাড়িতে। কুসুমদিদিরা দুই বোন। কুসুমদিদির বড় কেতকীদিদি যাকে আমরা রাঙাদি বলে সম্বোধন করি, তিনি থাকেন কলংসুতি নদীর ওপারে শহরের পুবপ্রান্তে বড়বাজারের কাছে। তার দুই মেয়ে, তারাও তাদের মাতামহের এই বাড়িতে প্রায় সময়েই বেড়াতে চলে আসে।
সবাই মিলে তৈরি হয় ভরপুর জমজমাট এক আড্ডা। আমরা সবাই প্রায় কাছাকাছি বয়সের, হয়তো কয়েক বছরের ছোট নয়তো বড়ো। বাধ মানে না সম্পর্কের নানা বাধ্যবাধকতার। কেউ হয়তো কারও কাকু, কেউ মামা, কেউ দাদা, ভাগিনি, ভাইপো ...ইত্যাদি।
একদিন ভর দুপুরে আমি আমাদের বাড়ির সামনের ঘরে শুয়ে গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে কবি সুকান্তর কবিতার বই পড়ছিলাম একটা। স্কুল- কলেজের পাঠ্যবই ছাড়াও অন্যান্য বই পড়ার অভ্যেস আমার বহুদিনের। সুকান্তর কালজয়ী কবিতাগুলো পড়তে বসলেই কোথায় যেন হারিয়ে যাই আমি।
কুসুমদিদির বড় মেয়ে তনিমা আর সোনাদাদা'র দ্বিতীয় মেয়ে ভাস্বতী এসে আচমকা আমার হাত থেকে কবিতার বইটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, শুধু বসে বসে কবিতার বই পড়া! চলো, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কে কত রকমের মুখের ভঙ্গি করতে পারে তার একটা প্রতিযোগিতা চলছে। চলো চলো তাড়াতাড়ি চলো!
তনিমা খুবই রূপবতী না হলেও বেশ ঢল ঢল যৌবনবতী, হাসি হাসি মুখ, ছেলেদের সম্পর্কে অনেকটা বেপরোয়া। তনিমা আমার চেয়ে বয়সে বেশ কয়েক বছরের বড়ো। আর রূপবতী তরুণী ভাস্বতী হয়তো আমার চেয়ে দুই-তিন বছরের ছোট।
কোথা থেকে যেন দৌড়ে ছুটে এল আমার সহোদরা ছোড়দিও, হাঁ ভাই চল। মামার ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ভেঙাতে হবে আমাদের। প্রতিযোগিতা চলছে মুখে ভেঙানোর। তোর সামনের দুটো দাঁত তো উঁচু, মুখ ভেঙানোয় তুই নিশ্চিত ফার্স্ট হয়ে যাবি।
বড়মামাদের গৃহে বহু বছরের পুরনো একটা বিশাল আরশি ঝোলানো আছে দেয়ালে। সম্ভবত ওই আরশিটি আনা হয়েছিল পূর্বপাকিস্থানের রাজধানী ঢাকা থেকে। আরশির জায়গায় জায়গায় ছোপ ছোপ দাগ জমে গেছে। সেই আরশি বা আয়নায় আজকাল আর ভালো করে কিছু দেখাও যায় না। তবুও সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই সকলেই প্রসাধনী কাজ সম্পন্ন করে।
আমায় কেউ উঁচু দাঁতের কথা মনে করিয়ে দিলেই খুব রাগ হয়। ক্ষোভ জন্মায়। কিছুক্ষণ বাদেই অবশ্য সেই রাগ ক্ষোভ আর থাকে না, উধাও হয়ে যায়। আজও ক্ষণিকের মধ্যেই সেই ক্ষোভ উধাও হয়ে যেতেই ভাস্বতী আর ছোড়দিদের অনুরোধে আমি কবিতার বউ গুটিয়ে রেখে চলে গেলাম মুখ ভেঙানো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে। প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগেই হাসিতে ফেটে পড়ছিল সবাই। আমার ওপরের পাটির সামনের দুটো দাঁত একটু উঁচু বলে মুখ ভেংচানোটা দারুণ চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে।
আমার মাতামহ ও মাতামহী উভয়েরই বংশে পূর্ব থেকেই উঁচু দাঁতের এক পরম্পরা চলে আসছে। সেই বংশ পরম্পরা সূত্রেই সম্ভবত আমার মায়ের উপরের পাটির দাঁতগুলো সামান্য উঁচু। আর সেই ধারা ভাইবোনদের মধ্যে চলে এসেছে একমাত্র আমার মধ্যেই। আমার ওপরের পাটির সামনের দুটো দাঁত অনেকটাই উঁচু। অথচ আমার ভাইবোনদের মধ্যে কারোরই দন্তপাটি অমসৃণ অথবা অসমান নয়। ছোড়দার দাঁতগুলো তো টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন দেওয়ার মতো। অবধারিত পিতৃধারা পেয়েছে সে। আমাদের পিতৃদেবের দাঁতগুলো তো খাঁজে খাঁজে বসানো মসৃণ সুন্দর আর ঝকঝকে মুক্তোর মতো। তিনি আজও এই বয়সেও সূর্যোদয়ের পূর্বে নিদ্রা থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্যের পর নিমের ডাল চিবিয়ে ছিবড়ে বানিয়ে তারপর দন্ত মঞ্জন করেন।
আমার মাতামহীর সামনের দুটো দাঁত অনেকটাই উঁচু ছিল। ওনার বেশির ভাগ দাঁত পড়ে গেলেও সামনের একটা উঁচু দন্ত আজও যেন যৌবনের সাক্ষী হয়ে অক্ষত রয়ে গেছে। তবে আজকাল সেটা ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক করে নড়ে।
আরশির সামনে দাঁড়িয়ে এক এক করে সবার নানা রকম ভঙিতে দাঁত কেলিয়ে ভেঙানো শুরু হয়েছে মাত্র। তখনি কুসুমদির বর মণিশঙ্করবাবু এসে হাজির। এসেই তিনি কন্যা তনিমাকে বকে জিজ্ঞেস করলেন, কীরে তনি কয়টা বাজে দেখছস? ঘরে যাইবি কোন সময়? কাজকম্ম নাই পড়াশুনা নাই সারাদিন এইখানে আইসা আড্ড মারস!
বলতে বলতেই মণিবাবু দেখলেন আমি তখনও আয়নার সামনে দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি।
মণিজামাইবাবুর অনেকগুলো দাঁত অনেকদিন আগেই খসে গেছে। ফোকলা দাঁতে হেসে দিয়ে তিনি বললেন, বাঃ বাঃ পুঁচকা শালা দাঁত কেলাইয়া মুখের তো ভালো ভঙ্গি করতে পারস! শরীরে তো কিসছু নাই, দাঁত দুইটাই তো তোর আছে একমাত্র সম্বল। চালাইয়া যা।
আমার শরীর স্বাস্থ্যের কথা নিয়ে কেউ কিছু বললেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। হীনমন্যতায় ভুগি। অথচ অসংযমী জীবনধারা তখনও জীবনে কণামাত্রও আপ্যায়ন জানাইনি। যৌনতার সামান্য কিছু ঝিলিক মনে একবার মাত্র উদয় হয়েছিল বড়দিদিদের প্রতিবেশী সেই ললনা রুমির বিস্ফারিত যৌবন অবলোকন করে। কিন্তু সে তো ক্ষণিকের তরে। এছাড়া মন আমার এখনও ইঁচড়ে পেকে যায়নি। আমাদের এক আত্মীয়া ভগ্নি রাতে ঘুমের ঘোরে আমার যৌনাঙ্গ ধরে বেপরোয়া ভাবে কচলিয়ে দিলেও আমি আজও কোনও তনয়ার গুপ্ত অঙ্গ স্পর্শ করেও দেখিনি। আমার মনে যৌনতার কিছু যদি অঙ্কুরিত হয়েও থাকে শরীরে অঙ্কুরোদ্গমের আভাস এখনও যেন অনুভব করিনি। হস্তমৈথুন বা অন্য কোনও উপায়ে স্বমেহন বিষয়ে সহপাঠীদের থেকে মাঝেমধ্যে কর্ণগোচর হয়ে থাকলেও এখনও পোক্ত হতে পারিনি।
তবুও শরীরে কেন যে এত মাংস ও পেশীর ঘাটতি তার কোনও যুক্তিই খুঁজে পাই না আমি মনে মনে। তবে কারণ তো অবশ্যই নিশ্চয়ই কিছু আছে। আর সেই কারণটা আর কিছু না হলেও শুধুই যে পেটের রোগ নিশ্চিত রূপে তা বলা যেতে পারে। ছোটবেলা থেকেই পেটরোগা আমি। প্রায়ই পেটের অসুখে ভুগি। তার ওপরে এখন অসম দেশের টিউব ওয়েলের জল পেটে পড়ে অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে পড়েছে। ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ায় ভরতি সেই জল আমার পেটে সহ্যই হচ্ছিল না কিছুতে।
তাছাড়া অভিভাবকদের তরফ থেকেও সচেতনতার সেরকম কোনও পাঠ নেই। তাদের অনীহা ও নির্বুদ্ধিতাও একটা সমস্যা। শরীর আর গড়বে কী করে? এই শরীরের জন্যেই আমার যত হীনমন্যতা। খানিকটা লম্বা সুঠাম শরীরের অধিকারী না হতে পারলে একটা পরিণত বালকের সমাজ জীবনের বৃহত্তর আঙিনায় প্রবেশের কালে নিরাশার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে দেয়। সুকুমার বৃত্তিগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ঈর্ষা এসে বাসা বাঁধে মনে। তারপরেও কেউ যদি অন্যের সঙ্গে তুলনা টানে তা হয়ে ওঠে আরও অসহনীয়।
এই যেমন মণিবাবু আবারও বলে উঠলেন, তপা বোধহয় তর থিকা দুই বছরে ছোট, দেখলে তো মনে হয় তর থিকা কত বড়!
তপা মানে মণিবাবুর বড় ছেলে। যেমন লম্বা তেমনি সুদর্শন সে দেখতে। তেমনি সুন্দর সুঠাম তার স্বাস্থ্য।
আবারও বলে উঠলেন মণিবাবু, পিসিমাই তো কয় তোর নাকি খাওয়া নিয়ে খুব বায়না? এইটা খামু না ওইটা খামু না, আরে সব খাইবি, তাহইলে না শরীরটায় মাংস লাগব! ছেলে মানুষ লম্বা চওড়া স্বাস্থ্য না হইলে কি চলে?
তনিমা হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল, খোকনমামা ছেলে না মেয়ে সেটাই তো বোঝা যায় না! সবাই তো ওকে মেয়ে খোকনি মনে করে। ঠোঁট মেয়েদের মতো লাল, গালে মেয়েদের মতো হাসি। ইচ্ছে হয় গালটা টিপে দেই।
বলে তনিমা মণিবাবুর সামনেই আমার গালে তো নয়, যেন আমার ঠোঁটে চুমু দেওয়ার মতো একটা ভঙ্গি করল।
মণিবাবু ধমকে দিলেন তার মেয়েকে। এই চুপ! তোর না মামা, এইগুলা কি কস?
সবারই একই কথা রোগা হলেও আমার শরীর স্বাস্থ্য সবকিছুই নাকি মেয়েদের মতো। মেয়েদের মতো তো বলেই, কেউ কেউ আবার আরও বাড়িয়ে বলে তালপাতার সেপাই। কারও কাছে আমি খোকন নামের অপভ্রংশ হতে হতে হয়ে গেছি খোকনা, তারপর খোকনা থেকে খুকনা ও খুকনা থেকে শেষে হুকনা। আর কলেজের সহপাঠীদের কাছে আমার খোকন নামের নতুন এক অপভ্রংশ -ফুকন নামে পরিচিত। কলেজে সবাই আমায় ফুকন বলেই ডাকে।
next episode- বন্ধুর প্রেমিকা