STORYMIRROR

pallab kumar dey

Drama Romance Others

3  

pallab kumar dey

Drama Romance Others

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-43-কামিনী

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-43-কামিনী

5 mins
3


 আবারও ইতিহাসের এক পট পরিবর্তন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তথা প্রবাদ প্রতীম রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবর রহমান সে দেশের এক রক্তাক্ত অভ্যুথানে আততায়ীদের গুলিতে নিহত। ভারত তো বটেই স্তম্ভিত সারা বিশ্ব। ভারত নাকি একবার শেষ চেষ্টা করেছিল বাঁচানোর জন্যে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার নাকি রওনাও হয়েছিল ঢাকার ধানমণ্ডির ওনার বাসভবনের দিকে। তার আগেই সব শেষ। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, সেই বজ্রনিনাদ কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল চিরতরে।

 পত্রিকা থেকে মুখ না তুলেই পিতৃদেব বললেন, কী লাভ হইল ইন্দিরার বাংলাদেশ বানাইয়া? সেই তো আবার রাজাকারদের হাতেই গেলগা দেশটা। হিন্দুরা আর থাকতেই পারব না ওইদেশে! বাহাত্তরের ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি, হুম্‌ আর কি মূল্য আছে এই চুক্তির? 

 মা কোমরের যন্ত্রণায় কাতর। মুজিব মরলেন কি বাঁচলেন কিচ্ছু যায় আসে না মায়ের। একটু বাদেই মাকে যেতে হবে রান্নাঘরে। বাবা দশটার মধ্যে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যাবেন কোর্টে।

  আমাদের পাড়ার শ্যামাপদর হঠাৎ একদিন রক্তবমি। মদ্য পানের অভ্যেস তার বহুদিনের। ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন থেকেই। সিরোসিস অফ লিভার। তিনচারদিনের মতো ছিলেন হাসপাতালে। বাড়ি আর ফিরে আসতে পারেননি। হাসপাতাল থেকেই একেবারে ইহজন্মের মতো বিদায় নিয়ে শ্মশানঘাটে।

 শ্যামাদা মারা গেছেন বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল। এর মধ্যেই ওনার স্ত্রীর অবস্থাও খুব খারাপ। তিনিও নাকি হাসপাতালে ভরতি।

 মায়ের সঙ্গে গল্প করছিলেন মাসি, শ্যামার বউয়ের কি যে হইছে কে জানে? কিছু বোধহয় খাইছিল? রক্ত আর বন্ধ হয় না, সমানেই যাইতাছে!

 পাশেই দাঁড়ানো আমাদের পাশের বাড়ির বড়মামি। বললেন, শ্যামাটা তো মরছে দশ মাসের ওপরে হইয়া গেছে বোধহয়?

 ‘দশ মাস কি কও বউদি? এক বছর হইয়া গেল প্রায়!’ বললেন মাসি।

 ‘না না, এক বছর বোধহয় হয় নাই অহনও।’ বললেন মামি।

 ‘না হইলেই বা কি! শ্যামা মারা যাওনের সময় হিসাব করলে তো অহন দশ মাসের ভরা পোয়াতি! তা হইলে এরকম কইরা রক্ত যাইব ক্যান? আর দশ মাসের পোয়াতি হইলে পেট দেইখ্যা বুঝা যাইত না?’

 ‘দেখতে যেরকম দুর্গা প্রতিমার মতো রূপ! কী হইছে, ক্যার লাইগ্যা হইছে, মানুষের মুখে তো কত রকমের কথা!’ বললেন মা।

 সেই দুর্গা প্রতিমার লড়াই মাত্র দুইতিনদিনের। চলে গেলেন তিনিও। শ্যামাদা গেছেন রক্ত বমি করতে করতে আর স্ত্রী চলে গেলেন কিজানি হয়তো কোনও অবৈধ গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে। দুর্গা প্রতিমার মতো রূপের শরীর চিতার আগুনে পুড়ে হয়ে গেল একমুঠি ছাই মাত্র। হায়রে রূপ যৌবনের অহংকার মানব শরীরের!

  আমার মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে চলে যায়। ইচ্ছে থাকলেও যেন পারি না কিছুতে। রূপবতী কামিনীর বড় কঠিন বেড়ি যে আমার পায়েও। যদিও কাঞ্চনে তখনও অতটা আসক্ত হয়ে উঠিনি আমি। তবে আজকাল কামিনী যে বড় টানে আমাকে। অগ্নিশিখার মতো রূপ নিয়ে সে তো আছেই পাশের বড়মামার বাড়িতে প্রায় তো আমার চোখের সামনেই! যদিও পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রয়েছে আমাদের দুজনের ওপরেই। তবুও কখনও কখনও আমাদের দুজনের দেখা হয়ে যায় সকলের অজান্তেই। 

 সম্পর্কে সে তো আমার এক মামাতো দাদার মেয়ে। তাতেই বা কি? প্রেম ভালোবাসা কোনও বয়স মানে না, কোনও আত্মীয়-সম্পর্ক, বৈধ-অবৈধ, ধনী-গরিব জাতি-ধর্ম কিচ্ছু মানে না। প্রেম অন্ধ। প্রেম আর কাম অবিচ্ছেদ্য।

 কিছু একটা রোজগার না করতে পারলেই আর নয়। আআরও যেন তাই মনের ইচ্ছে। পিতৃদেব আমর জন্যে টিউশন পড়ানোর ব্যবস্থা করলেন একটা। প্রখ্যাত আইনজীবী ভবেশ সমাদ্দারের বাড়িতে। বাবার অনেক সিনিয়ার আইনজীবী তিনি। ওনার এক ছেলে ডাক্তারি পড়ে গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজে। আগের পক্ষের ছেলে আইএএস অফিসার। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে ওনার। মেয়েরা এক একজন যেমন খেলাধুলায় তেমন পড়াশোনায়। যমজ দুই ছেলে বাপন আর টুপনের পড়ানোর দায়িত্ব পড়ল আমার ওপরে।

 মধ্যে উঠোন, চারপাশ ঘেরা অসম প্যাটার্নের টিনের একতলা বিশাল বাড়ি। অনেকগুলো ঘর। ভেতরে বাইরে দুদিকেই বারান্দা। রান্নাঘরটাও এত বড়ো যে পঞ্চাশ জনেরও বেশি একসঙ্গে বসে খেতে পারবে।

  আমি দুই পড়ুয়াকে নিয়ে পড়তে বসি ভেতরের বারান্দায়। একদিন পড়ানোর সময় রামানন্দবাবু স্যারকে দেখলাম ওদের বাড়িতে। একসময় আমাদের কলেজেই কলা বিভাগে পড়ত খগেশ্বরকেও দেখলাম ওখানে। খগেশ্বর বিএ পাশ করার পর এখন আইন পড়ছে। কথায় কথায় জানতে পারলাম খগেশ্বরও ওই বাড়ির আত্মীয়।

 রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করা হবে সমাদ্দারবাবুর বাড়িতে। আয়োজক রামানন্দবাবু স্যার। সন্ধ্যে সাতটায় শুরু হল অনুষ্ঠান। বাড়ির মেয়েরা এত সুন্দর গান গায় আগে জানতাম না। গান গাইল খগেশ্বরও।

 যে ছেলে ডাক্তারি পড়ে সেও এসেছে গুয়াহাটি থেকে। তার নাম ভাস্কর। চোখে চশমা। ফরসা, দোহারা লম্বা, বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর চেহারা। দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমি তাকে চিনি। আগে কোথাও তাকে দেখেছি। ভাস্করও এগিয়ে এসে কথা বলল আমার সঙ্গে। যেন আমার সঙ্গে তার অনেক দিনের আগের পরিচয়। তার কথাবার্তা হাবভাবের মধ্যেও কোনও অহংকার নেই, দম্ভ নেই। অত্যন্ত হাসিখুশি আর অমায়িক ছেলে।

 মনে পড়ল আমার। রামানন্দবাবু স্যারের বাড়িতে ওকে দেখেছিলাম আমি সে বেশ কয়েকবার।

 আজ রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সেও গান গাইল। আসলে এসবই জন্মগত প্রতিভা। ঈশ্বরের পক্ষপাত, যাকে দেন তো উজার করেই দেন।

 রামানন্দবাবু স্যার এবার গান গাইতে বললেন আমাকে। আমি তো অবাক। লজ্জায় জড়সড় হয়ে বললাম, স্যার আমি তো গান গাইতে পারি না!

 স্যারও অবাক, একি! তুমি তো কোনওদিন আমায় সেকথা বলোনি? তুমি যে গান জানো না, দেখে তো তা মনে নয় না? গান আবার জানতে হয় নাকি? যারা গান গায় প্রাণের আনন্দে গায়! যেকোনও গানই প্রাণের আনন্দে গাইতে হয়। যদি সুর-লয় কিছু থাকে ভেতরে তা আপনিই গান হয়ে বেরিয়ে আসে। এই যে যেমন খগেশ্বর, ভাস্কর কোনওদিন কোথাও গান শিখেছে? ওরা তো শুনে শুনেই গান গায়।

 ‘হাঁ হাঁ খোকনদা গান তোমাকে গাইতেই হবে।’ জোর দিয়ে বলে উঠল সমাদ্দারের ছোট মেয়ে ঝিমি।

 কোনও রাখঢাক নেই ঝিমির। সেইরকম তেজি তুখোড় কিন্তু একেবারে সোজাসাপটা মেয়ে। কারও নামে কোনও নিন্দা বদনাম কোনওদিন সে করে না। সব সময় সবার নামেই মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসার কথা শোনা যায় তার মুখে। 

  আমার নামেও আজ অনেকটাই বেশি বলে ফেলল সে। বলল, খোকনদা শুধু গান নয় দারুণ লেখেও! বয়েজ স্কুলের ম্যাগাজিনে খোকনদার লেখা গল্প আমি দুবার পড়েছি। কলেজেও গল্প লেখে ফার্স্ট হয়েছিল খোকনদা!

  আমার লেখা গল্প পড়ার পাগল পাঠকও তাহলে আছে এই পৃথিবীতে? তাহলে এই ধরিত্রীর অন্তত কোনও একজন ভালো মেয়ের প্রিয় লেখক আমিও?

 স্যার বুঝে গেলেন আমার দ্বারা গান গাওয়া আর হবে না। হেসে বললেন, খোকন চন্দ্র তোমায় আর গান গাইতে হবে না। তুমি বরং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু বলো।

 হায়রে! যেন অন্ধকে বলা হচ্ছে অতিকায় হস্তীকে নিয়ে বিস্তারিত একটা রচনা বলতে! রবীন্দ্রনাথের লেখা গান গাওয়াও বোধহয় সহজ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু বলা তো আরও শক্ত দুরূহ। আর তো বাহানা চলবে না। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ তো একটা ধ্রুব সংখ্যা। তারিখটা মনে থাকলেও রবীন্দ্রনাথের জন্মের বাংলা সন আমার মনে থাকে না। স্টেজে উঠে সনের কথা উল্লেখ না করে তারিখ দিয়েই শুরু করলাম বলা। স্টেজে উঠে নাটক অভিনয় করার দুইতিনবারের অভিজ্ঞতা থাকলেও দাঁড়িয়ে কোনও মহাপুরুষকে নিয়ে বলা এই প্রথম। শুকিয়ে আসছিল গলা। ঘুরেফিরে বার বার একই কথা একই বিবরণ বলে ফেলছিলাম। কখনও চলতি কখনও সাধু ভাষায়। তবুও বলা শেষে করতালি মনে হল একটু বেশিই পড়ল।

 সমাদ্দারদের বাড়িতে আমার অপরিসীম আদর। যখনই সকালে টিউশন পড়াতে বসি, চলে আসে চা বিস্কুট। খানিক বাদেই ছাত্রদের সঙ্গে তার জন্যেও আসে জলখাবার। আর মাসের শেষে আশাতিরিক্ত পারিশ্রমিক। আরও তো আরও দুই পড়ুয়াই পড়াশোনায় খুবই ভালো। পড়ে আদর্শ স্কুলে। দারুণ রেজাল্ট তাদের। আর এতেই আমি তৃপ্ত।

  

  next episode- ইন্টারভিউ


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama