pallab kumar dey

Abstract Drama Romance

3  

pallab kumar dey

Abstract Drama Romance

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-52 -মাধবীর প্রস্থান

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-52 -মাধবীর প্রস্থান

5 mins
4



 মা তো অন্তর্যামী। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হইছে তর? টিউশন থিকা ফিইরা মুখ প্যাঁচার মতো কইরা রাখছস? কি নিয়া দুশ্চিন্তা করতাছস?

 ‘না, কিছু তো না!’

 ‘কিছু তো হইছে। খুকন তুই দিবি আমায় ফাঁকি? আমি তরে পেটে ধরছি না তুই আমারে ধরছস?’ সন্দিগ্ধ মা। 

  অবশেষে বলেই দিলাম কথাটা, মা ওই যে মাধবী, যে মেয়েটাকে হাতিখুলি থেকে নিয়ে এসে নবাঙ্কুর অ্যাংকেলদের বাড়িতে কাজে ঢুকিয়েছিলাম, সে আর ওখানে থাকতে চাইছে না। কান্নাকাটি শুরু করেছে। বলছে বাড়ি দিয়ে আসতে!   

 ‘ক্যান কী হইছে?...আর তুই যাইবি কেমনে কইরা? তুই তো ওইদিন কইলি সামনে নাকি তর পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা?’

 ‘সেটাই তো ভাবছি? কিন্তু না নিয়ে গেলেই নয়! কয়টা টাকা দেবে মা আমাকে?’ বিগলিত অনুরোধ জানিয়ে বসলাম মাকে। 

 রেগে গেলেন মা আর বিচলিত হয়ে বলে উঠলেন, তখনই তোরে কইছিলাম খুকন, কি আপদ লইয়া তুই আইছস? এখন এই জ্বালা কে পোহাইব? সত্যি কইরা ক তো, কী হইছে ছেঁড়ির?

 মায়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আমি বললাম, কিছু না। ও ওখানে আর থাকবে না বলছে।

 মায়ের সন্দেহ তবুও যায় না। আবার বলে উঠলেন, লাউয়ের কচি ডগার মতো যেরকম সুন্দর বাইড়া উঠছে মাইয়াডা! আর নবাঙ্কুর যেরকম গু খাওয়া মাছি! তারে কোনও বিশ্বাস আছে? 

  তবে এইটুকে বলেই থেমে গেলেন মা। আর ঘাঁটালেনও না আজ আমাকে। আমি মায়ের কাছে লুকোতে চাইলেও বা কি! দু’একদিনের মধ্যেই কানাঘুষো এবাড়ি থেকে ওবাড়ি। এমনকি মাধবীকে নিয়ে অশান্তিও চরমে উঠল অ্যাংকলদের বাড়িতে। নবাঙ্কুর অ্যাংকলের স্ত্রীও চলে এলেন আমাদের বাড়িতে মায়ের কাছে নালিশ জানাতে। মাকে বলছিলেন, দিদি মাধবীকে আর আমাদের বাড়িতে রাখা যাবে না। ওইটুকু মেয়ে যা শুরু করেছে! মুখে ওসব উচ্চারণ করতেও ঘেন্না হয়! খোকনকে বলে দেখেন না, মাধবীকে ওদের বাড়িতে যদি দিয়ে আসতে পারে?

 মা উচিত কথা বলতে ছাড়লেন না, ওই মেয়ে শুরু করছে, নাকি নবাঙ্কুররে তুমি সামলাইতে পারতাছ না? 

 ‘ধরে নেন, আপনি যা ভাবছেন ওটাই। তারজন্যেই তো বলছি, খোকন যদি ওকে ওদের বাড়িতে দিয়ে আসতে পারে?’ গম্ভীর হয়ে বললেন নবাঙ্কুরের স্ত্রী। 

  আমিও মনে মনে তো সেরকমই চাইছিলাম! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাধবীকে আমি পৌঁছিয়ে দিয়ে আসতে পারি ওদের গাঁয়ের বাড়িতে। মাধবীকে নিয়ে দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণা আর পারছিলাম না আমি সহন করতে। বিবিকে দংশিত হচ্ছিলাম, আতঙ্কে ভুগছিলাম, ফুলের মতো নিষ্পাপ সুন্দর মেয়েটাকে রাক্ষসটা কুচলে না ফেলে! 

 কিন্তু আমি চাইলেই বা কি। আবারও আমার মায়ের বাধা। মা আমায় বললেন, তুই এক কাজ কর। তোর বড়দির বাড়ির পাশেই তো মাধবীর কিরকম দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা থাকে না? তাগোরে গিয়া কইয়া দেখ, তারা যদি গ্রামে মাইয়ার মায়ের কাছে একটা খবর পাঠাইতে পারে? মাধবীর গুরুতর অসুখ, মায়ে তাড়াতাড়ি আইসা তারে লইয়া যাউক!

 মাথায় বুদ্ধি থাকলে কেউ ঘরজামাই থাকে? তাই তো? এটাই তো সহজ রাস্তা। সেই মুহূর্তেই দৌড়ে গেলাম আমি মাধবীরদের দূর সম্পর্কের সেই আত্মীয়দের বাড়িতে। আর পেয়েও গেলাম দূর সম্পর্কের সেই আত্মীয় মিলনদাকে। মিলনদাকে বললাম, সেই যে মাধবীকে নিয়ে এসেছিলাম আপনাদের গ্রাম থেকে, মনে আছে? সে যেখানে কাজ করছে সেখানে আর থাকতে চাইছে না। তার শরীর খুব খারাপ। সে তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাইছে। যদি মাধবীর মাকে একটা খবর পাঠিয়ে দিতে পারেন মিলনদা খুব উপকার হয়!.. 

 ‘তাই নাকি? তাহলে আমি আজই খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওদিককার বাসের ড্রাইভার সব তো আমার চেনা। চিন্তা নেই ভালো ছেলে, সন্ধ্যের আগেই খবর পৌঁছে যাবে।’ বলে মিলনদা স্নেহের হাতে পিঠ চাপরে দিলেন আমার।  

 মিলনদা বরাবরই বড় পরোপকারী ছেলে। নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে এলাম বাড়ি। আর সেইদিনই মাধবীর খবর পৌঁছে গেল মাধবীর মায়ের কাছে। মাধবীর শরীর খুব খারাপ! মাধবী তার মায়ের কাছে চলে যেতে চাইছে। তিনি যেন অতি শীঘ্র এসে তার মেয়েকে নিয়ে যান। 

 খবর পেয়ে একদিনের মধ্যেই চলে এলেন মাধবীর মা। মেয়েকে সুস্থ দেখে তিনি প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও পরে কিছুই আর জানতে বোধহয় ওনার বাকি রইল না। বোধকরি মাধবীই তার মাকে সবটা জানিয়ে দিয়েছে। নবাঙ্কুর, এমনকি নবাঙ্কুরের স্ত্রীও তাকে ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করতে পারেননি। মাধবীর মা হতচকিত হয়ে গেলেন সবটা শুনে। কিন্তু কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার মতো ক্ষমতা তো তাদের নেই। দারিদ্র পীড়িত অসহায় গ্রামের লোক। নবাঙ্কুরের স্ত্রী বুদ্ধিমতী মহিলা। টাকাপয়সা দিয়ে মাধবীর মায়ের সঙ্গে রফা করে নিলেন। 

 মাধবীর মা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি মেয়েকে নিয়ে চলে যাবেন। যাওয়ার আগে পোঁটলা হাতে মাধবীকে নিয়ে এলেন তিনি আমাদের বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে আসার পরেই মাধবীর অন্য রূপ। সে তাদের গাঁয়ে ফিরে যাবে না। সে আমাদের বাড়িতে থাকবে।

 কান্না শুরু করে দিল হাউহাউ করে। 

 আর ওদিকে সেই দৃশ্য, ভাস্বতী ওদের বাড়ির কোণার দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে, আর কটমট চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। 

 এদিকে মাধবী এমন জেদ করছিল যে, বাধ্য হয়ে মেয়ের গায়ে হাত তুলতে হল তার মাকে। 

  আমার মা হতভম্ব হয়ে যাচ্ছিলেন মাধবীর গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেতে না চাওয়ার নাছোড় বায়না দেখে। আচমকা তিনি মাধবীর মাকে বলেই ফেললেন, যে আগুন হইয়া উঠছে আপনের মাইয়া, এরে আপনের কাছেই রাখেন, ছাইড়েন না! আমার ঘরে যে ‘হবি’(হোমের ঘৃত) আছে, এই আগুন রাইখ্যা আরও মরি! আমরার পাশের দাদার ঘরের এক আগুনের জ্বালায় আমি আমার হবিরে নিয়া এমনিই যে অস্থির, আরও? এই আগুন রাইখ্যা গেলে আমার ‘হবি’ও গইল্যা যাইব। লইয়া যাইন আপনের এই আগুনরে। 

  ভাস্বতী বোধহয় দূর থেকে মাধবীকে আমাদের বাড়িতে রাখা নিয়ে আমার মায়ের আপত্তির কিছু আন্দাজ করতে পারছিল। খুব খুশি খুশি লাগছিল তাকে। যেন সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু আমি আন্দাজ কিছু করতে পারলেও অতটা বুঝতে পারছিলাম না মায়ের মুখ থেকে উচ্চারিত সেই ‘হবি’টা কে? সেই ‘হবি’টা তবে আমিই? ‘হবি’ বলতে কি মা আমাকেই বোঝাতে চাইছেন? আর আমি ছাড়া এই মুহূর্তে কোনও ‘হবি’ই বা বাড়িতে আছে এখন? 

 মাধবী এবার আমার দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কাঁদছিল আর খোকনদা..খোনকদা বলে চিৎকার করছিল, খোকনদা মাকে বলে দাও, আমি তোমাদের বাড়িতে থাকব! আমি তোমাদের বাড়িতে থাকব! আমি যাব না! আমি এখানে থাকব!.. 

 তার মা তাকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু আচমকা আমার ভেতর থেকে অগ্ন্যুৎপাতের লাভার মতো যেন বেরিয়ে আসছিল অজানা এক বেদনার হাহাকার। যেন আচম্বিতে শূন্য হয়ে গেল আমার বুকের ভেতরটা। অসহায়, দারিদ্র, পীড়িত, অবহেলিত, পুষ্প কোরকের মতো নিষ্পাপ মাধবী পাষান শহরে ছেড়ে আবারও তার গাঁয়ে ফিরে যাচ্ছিল! আর আমিও অসহায়ের মতো ওর চলে যাওয়ার দিকে শুধু তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। 

বিঃ দ্রঃ- নিয়ম আনুযায়ী এখানে সমাপ্তি দিতে হলেও এই ধারাবাহিক ক্রমশ চলবে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract