STORYMIRROR

pallab kumar dey

Drama Thriller

3  

pallab kumar dey

Drama Thriller

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-50-দুবোর্ধ্য রহস্য

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-50-দুবোর্ধ্য রহস্য

6 mins
11


 শেষরাতের দিকে ট্রেন এসে পৌঁছল নিউবঙ্গাইগাঁও রেলস্টশনে। তখনও নিউবঙ্গাইগাঁও অব্দিই বিজি লাইন। নিউবঙ্গাইগাঁও থেকে যেতে হবে এবার মিটারগজের ট্রেনে। বদলি ট্রেন ধরব বলে নামতে যাচ্ছি, দেখি সেই ফিটফাট ভদ্রলোক নেই তার বার্থে। আমি ভাবলাম কিজানি হয়তো নেমে গেছেন আমার আগেই। আমি প্ল্যাটফর্মে নেমে দেখি ঠিক তাই। তিনি হনহন করে অন্যে দিকে যাচ্ছেন। জোরে ডেকে উঠলাম, এই যে দাদা কোথায় যাচ্ছেন ওদিকে?

 তিনি মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিলেন, তুমি যাও, আমি একটু বাদেই আসছি।

 বদলি ট্রেনে নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। ছেড়েও দিল ট্রেন যথাসময়ে। আর দেখতেই পেলাম না আমি সেই ভদ্রলোকে। কিছুটা অবাক হতেই হল আমাকে। তিনি তো গুয়াহাটি অব্দি যাবেন বলেছিলেন। বদলি ট্রেনেও ওনার নির্ধারিত জায়গা তো আমার পাশেই! তবে কেন এলেন না তিনি কে জানে?

 সকাল সাড়ে দশটার দিকে গুয়াহাটি নেমে হাতেমুখে জল দিয়ে অভার ব্রিজ পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি। স্টেশনের পাশেই অসম স্টেটবাসের স্ট্যান্ড। নগাঁও যাওয়ার বাসও পেয়ে গেলাম একটা। নগাঁও পৌঁছে গেলাম দুপুরের দিকে। বাড়িতে না ঢুকে প্রথমেই গেলাম ভাস্বতীদের ঘরে। ডাকলাম ভাস্বতীর মাকে, বউদি দাদা ছয়হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছে। রাস্তায় চল্লিশটাকা খরচ করে ফেলেছি, বাড়ি গিয়ে মা’র থেকে এনে দিচ্ছি?

 ‘সে তুমি দিওখন, এত তাড়াহুড়ো কীসের?’ বলে তিনি খুশি মনে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি ব্যাগ থেকে টাকা বের করব সেই অপেক্ষায়।

  আমার গলা পেয়ে দৌড়ে এল শাশ্বতী আর ওদের মামাও। ততক্ষণে চিঠিটাও দিয়ে দিয়েছি বউদির হাতে। ব্যাগের জিপ টেনে সে খুলতে যাব তার আগেই মামা ভাগনি মিলে খুলে ফেলল ব্যাগটাকে। একটা একটা করে বান্ডিল বের করতে করতে বার করল পাঁচটা।

 বান্ডিল থাকার কথা তো ছয়টা? আরও একটা গেল কোথায় তবে? হতভম্ব স্তব্ধ পাথরের মতো হয়ে গেলাম আমি পাঁচটা বান্ডিল দেখে। চিঠিতেও ছয় হাজার টাকার কথাই তো লেখা আছে! বউদি বললেন, তোমার দাদাও তো ছয় হাজার লিখেছেন? আর একহাজার তাহলে গেল কোথায়?

 ‘ব্যাগেই তো ছিল? আমাকে দেখিয়েই তো দাদা ব্যাগে ভরে দিলেন?’ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আমার। কথা বলতে গিয়ে গলা যেন বুজে আসছিল।

 কোনও কূলকিনারাই করতে পারছিলাম না স্তম্ভিত হতভম্ব আমি। ব্যাগ থেকে টাকাটা গেল কোথায়? কোথায় খোয়ালো? কীভাবেই বা খোয়ালো? টাকার তো ডানা গজায়নি যে উড়ে যাবে? রাতের সেই নিপাট ভদ্রলোকটির কাজ নয়তো আদতে? সেই ভদ্রলোকের কথাও খুলে বললাম আমি সবাইকে। সেই ভদ্রলোকের কথা একবিন্দুও বিশ্বাস করল না কেউ। ভাস্বতীর মামা তো সন্দেহের তির ছুড়ে দিল আমার দিকেই, যদি সেই লোকটাই টাকা গায়েব করবে, শুধু একটাই বান্ডিল কেন নেবে? সবকটাই তো হাপিস করত?

 হাঁ এই যুক্তিও তো ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ব্যাগ থেকে টাকা চুরিই যদি গিয়ে থাকে একটা তোড়া কেন চুরি যাবে? আর কোনও কথা নয়! ভাস্বতীর মামা এবার সরাসরি সন্দেহ করে বসল আমিকেই। রেগে গিয়ে বলেও দিল ঘড়ঘড় গলায় আওয়াজ তুলে, শালা নিজেই একটা বান্ডিল হাপিস করে দিয়ে বলছিস চুরি হয়ে গেছে?

 হায় ভগবান! শেষে চুরির অপবাদও এসে জুড়ল আমার কপালে? অপমানে লাঞ্ছনায় দরদর করে ঘামতে শুরু করে দিলাম। ভাস্বতী বিস্ফারিত অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। দৌড়ে এলেন বড়মামি। হতবাক তিনিও। আমার অপকর্ম বলে ওনার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু ঘটনা প্রবাহ সবই তো আমার বিরুদ্ধে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার মতো কোনও কিছুই আর উদ্বৃত্ত নেই যে আমার কাছে।

 অসুস্থ প্রায় অথর্ব বৃদ্ধ বড়মামা শুধু একবার বললেন, চিরকাল লেবা তো লেবাই রইয়া গেল এইটা! ভালো মতোই ফাঁসাইছে লেবারে!

 খবর পেয়ে দৌড়ে ছুটে এলেন আমার মা। ব্যাকুল বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হইছে? কার টাকা চুরি গেছে?   

 ভাস্বতীর মামা গলা উঁচিয়ে বলে উঠল, আমাদের টাকা চুরি গেছে। আপনার ছেলে চুরি করেছে।

 ‘কী কও এইসব কথা?’

 ভাস্বতীর মা ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, রাঘব তো ঠিক কথাই বলেছে পিসিমা। আপনার ভাইপো টাকা পাঠিয়েছে ছয় হাজার, এই তো চিঠি! আর আপনার ছেলে বুঝিয়ে দিচ্ছে পাঁচ হাজার! আরও বলল, কোনও একটা বান্ডিলে নাকি চল্লিশ টাকা কম। আসার পথে খরচ নাকি করে ফেলেছে। বলল বাড়ি গিয়ে এনে দিচ্ছি।

 খড়কুটো ধরে বাঁচার শেষ চেষ্টায় মরিয়া আমি কান্না জড়ানো গলায় বললাম, কোনও একটা বান্ডিলে চল্লিশটাকা কম হবে। গুনে দেখো তো কোনটায় কম? তাহলে হয়তো কিছু আন্দাজ করা যাবে?

 ‘কীসের আন্দাজ?’ আবারও গর্জে উঠল ভাস্বতীর মামা রাঘব, কোনও গোনাগুনি হবে না। টাকাটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস সেটা আগে নিয়ে আয়, তারপর গোনা।

 ‘এইগুলা কী কইতাছ রাঘব? তুমার সঙ্গে আমাদের কীসের শত্রুতা?’ কাতর সুরে বলে উঠলেন মা।

 ‘আপনার ছেলে তো একটা চোর! এর চেয়ে ভালো আর কী বলব?’ উদ্ধত রাঘব।

 এই সময় ভাস্বতীর এক পিসতুতো দাদাও এসে হাজির হল ময়দানে। কি শুনল কি বুঝল বলে ফেলল, খোকনের সঙ্গে ভাস্বতীর তো খুব মিল, খুব ভালোবাসা। ভাস্বতী বলুক এবার খোকনকে, টাকা বার করে নিয়ে আসতে।

 ‘আমার সঙ্গে ভাস্বতীর মিলের এই টাকার কী সম্পর্ক?’ প্রতিবাদ করে উঠলাম আমি।

 ‘এই চোপ!’ ধমকে উঠল রাঘব।

 মা ততক্ষণে খাঁমচে ধরে ফেলেছেন আমার ঘাড় লম্বা চুলের মুঠি। গায়ের জোরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চললেন আমাকে। বাড়ি নিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের বারান্দা থেকে হাতে তুলে নিলেন চেরা কাঠের একটা শক্ত ফালি। সেটা দিয়েই অন্ধের মতো পরপর বসিয়ে গেলেন আমার পিঠে আর হাতে। এত বড়ো হয়েছি, এই প্রথম এমন ভয়ংকর ক্রুদ্ধ রূপ দেখছিলাম মায়ের। কাঁপছিলেন তিনি থরথর করে। জীবনে এই প্রথম জননীর হাতে এমন নির্মম ভাবে প্রহৃত হয়েও অবিচলিত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। নইলে আজ অব্দিও জীবনে কোনওদিন জননী আমাদের গায়ে টোকাটুকুও দিয়ে দেখেননি।  

  আমার সারা শরীরে জায়গায় জায়গায় ছড়ে গেল, ফুলে উঠল। সামান্য কিছু রক্তপাতও ঘটল। এমনকি খাবারও জুটল না দুপুরে।

 বিকেলে পিতৃদেব কোর্ট থেকে ফিরে দেখলেন আমি বিছানায় শুয়ে কোঁকাচ্ছি। জ্বরও এসে গেছে আমার গায়ে। পিতৃদেব আমার মাথায় হাত দিয়ে চমকে উঠলেন, এইডা কি! এর শরীর তো জ্বরে পুইড়া যাইতাছে! শরীরে জ্বর লইয়া ফিইরা আইছে?

 ‘জ্বরে পুড়ুক, পুইড়া মইরা যাউক!’ ধিক্কারে বলে উঠলেন মা।

 ‘কী ব্যাপার? হইছে কী? কুন সময় ফিরছে?’ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন পিতৃদেব।

 মা কিছুই গোপন করলেন না। সব বলে দিলেন পিতৃদেবকে। বাবার উকিলি যুক্তি অন্যরকম। বললেন, চিঠিতে ছয়হাজার লেইখ্যা নবেন্দু যে ছয় বান্ডিলই ঢুকাইয়া দিছে খুকনের ব্যাগে তার কী প্রমাণ? খুকন কি নিজে গইন্যা নিছে? গোনে নাই। আর এইরকম এক অল্পবয়সি ছেলের সঙ্গে এতগুলা টাকা দেয় সে কোন আক্কেলে আর কোন সাহসে? আইজ যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটত কে দায়ী হইতো? টাকা তো খুকন নিজে ব্যাগ থিকা বাইর কইরা দেয় নাই? নিজেরাই বাইর কইরা নিছে। নিজেরা কত বাইর করছে সেইটাও কে কইব?

 জ্বরের ঘোরের মধ্যেও ভাবছিলাম, ঠিক, এরকম করে কিছু তো ভাবিনি? তবে পিতৃদেবের উকিলি বুদ্ধিতে যতই যেরকম করেই আমি ভাবি না কেন, আমাকে তো চোর সাব্যস্ত করেই দিয়েছে তারা! চোর অপবাদ নিয়েই আমাকে বেঁচে থাকতে হবে! সেই অপবাদ সহজে মুছে যাওয়ার নয়! অতএব সেই অপবাদ মাথায় নিয়ে কি ভাবে বেঁচে থাকাব এই সংসারে? চলেই যাব এই সংসার ছেড়ে। বিষ খেয়ে আজ রাতেই শেষ করে দেবে নিজেকে। জ্বরের ঘোরে ভাবুক মনে এসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়েও পড়লাম আমি। অনেক রাতের দিকে মা আমায় ডেকে তুলে খেতে দিলেন দুধসাগু। জ্বর এতটাই যে আবোল তাবোল প্রলাপ বকে খেতে গিয়ে করে ফেললাম বমি।

 আমাকে এমন ভাবে মেরেছেন বলে অনুশোচনায় কেঁদে ফেললেন মা। পিতৃদেবও বকলেন খুব মাকে। কিছুই খাওয়া হল না আমার। আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম কখন যেন। সকাল হতে হতে সুস্থ হয়ে উঠলাম অনেকটাই। 

 ভাস্বতীদের বাড়ি থেকে এসব নিয়ে আর টু শব্দটি উঠল না। “বারমুডা ট্রাইএঙ্গেলের” জাহাজ ডুবে যাওয়ার রহস্যের মতো এটাও একটা রহস্য হয়ে গেল আমার জীবনেও। আর কিনারা করতে পারলাম না সেই রহস্যের। রহস্য মনের মধ্যে এসে খোঁচা দেয়। প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে। যদি ট্রেনের সেই ভদ্রলোকই একহাজার টাকা গায়েব করবে তবে পুরোটাই কেন গায়েব করল না? নাকি পুরো গায়েব করার সুযোগই পায়নি সে? নাকি দাদা নবেন্দু পাঁচ হাজার ব্যাগে ঢুকিয়ে ভুলে নয়তো ইচ্ছে করেই মুখে ও চিঠিতে ছয় বলে দিয়েছেন? যাতে আমাকে ফাঁসিয়ে ভাস্বতীর চোখেও চোর সাব্যস্ত করে দিতে পারেন? এও তো হতে পারে ভাস্বতীর মামা ব্যাগ থেকে বের করার সময় একহাজার নিজেই গায়েব করে দিয়েছে?

 এই রহস্যের আর কোনওদিনই কিনারা হবে না। দুর্বোধ্যই রয়ে গেল আজীবনের মতো।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama