STORYMIRROR

pallab kumar dey

Drama Action

4  

pallab kumar dey

Drama Action

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-47-ঘুঘুরবাসায়

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-47-ঘুঘুরবাসায়

5 mins
9


 পড়াশোনায় আর মনই বসাতে পারছি না। কেবলই মনে হয় একটা কাজের আমার খুব দরকার। কাউকে কিছু না জানিয়ে করে বসলাম রেলের চাকরির দরখাস্ত। কাটিহার রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ড। পরীক্ষাও কাটিহারে।

 পিতৃদেবের খুব একটা ইচ্ছে নেই সেই পরীক্ষাটা দিতে যাই আমি। বললেন, রেল হইল ঘুঘুরবাসা। লাখটাকার ঘুষ দিয়াও চাকরি হয় না। তারওপরে এত দূরের রাস্তা, পয়সাও নষ্ট, যাইতেও তো কত কষ্ট! দেখ তোর মা কি কয়?

 মা’র ইচ্ছে আমি যাই পরীক্ষা দিতে। মায়ের বহু দিনের স্বপ্ন তাদের কোনও এক ছেলে যেন ভারতীয় রেলে চাকরি করে। ছেলে যদি রেলে চাকরি করে তাহলে ভারতের বহু তীর্থ ভ্রমণ করার বাসনা মায়ের পূরণ হবে। সবার বড়ো ছেলে এরমধ্যেই ঢুকে পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ডিফেন্স অ্যাকাউন্টস অফিসে। মেঝো সেও চাকরি পেয়ে গেছে কেন্দ্রীয় সরকারের টেলিফোন দফতরে। বাকি রইলাম আমি, মায়ের শেষ ভরসা, যদি রেলে চাকরিটা পেয়ে যাই?

 কাটিহারে গিয়ে পৌঁছলাম পরীক্ষার আগের দিন বিকেলে। পরীক্ষার্থীদের ভিড়ে গিজগিজ করছে সব হোটেল, ধর্মশালা। কোথাও তিল ধারণের জায়গাটুকু নেই। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে অনেক কষ্টে পেলাম একটা জায়গা বারান্দার এক কোণায়। তবে খাবার অতি সুস্বাদু, বিশেষ করে রুই-কাতলের কারি। গঙ্গার এরকম টাটকা ও স্বাদের রুই-কাতল অসমে কল্পনাও করতে পারি না।

 সকালেই পৌঁছে গেলাম পরীক্ষার হলে। প্রশ্ন কিছু বিষয় ভিত্তিক, বাকি অবজেক্টিভ। পরীক্ষা চলাকালীন বাইরে থেকে আসতে শুরু হল প্রশ্নের উত্তর। পরিদর্শকরাই এনে দিচ্ছিলেন সেসব। মহা খুশি পরীক্ষার্থীরা। খুশি আমিও।

 কি ভয়ানক ছলচাতুরীর কারবার এসব, বুঝলাম না বোকা পরীক্ষার্থীরা কেউই। আমরা জেনেও যেন জানি না, বোঝেও বুঝি না - দুর্নীতি আর স্বজন-পোষণের মহাপাপের আকড়া ভারতীয় রেল। একমাত্র দুর্নীতির জন্যেই ভারতীয় রেলে উন্নয়নের হার ধার্য করা লক্ষ্যের থেকে আশি শতাংশ কম। লাখ লাখ টাকার উৎকোচ নিয়ে আগেই হয়ে গেছে প্রার্থী বাছাই। মন্ত্রী থেকে রেল বোর্ড সবাই এতে জড়িত। এসব পরীক্ষা শুধুই লোক দেখানো আই ওয়াশ মাত্র।

 কাটিহার থেকে ফেরার সময় আমি নেমে পড়লাম শিলিগুড়ি। শিলিগুড়িতে নেমে গিয়ে পৌঁছলাম ছোড়দির শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরমশায় বললেন, দোলা তো এখন শিকারপুর বাগানে!

 উপায়? কী করব তবে এবার আমি? শাশুড়ি বললেন, কী ভাবছ অত? এখানে দুদিন থেকে তারপর বাগানে যেও। কাল সকালেও যেতে পারো।

 ছোড়দির ননদ বনানী বলল, এসেছিস দুইদিন থাক না? তারপর বাগানে যাস।

 দুইদিন রইলাম শিলিগুড়ির ডাবগ্রামে। উপভোগ করলাম ভরপুর খাওয়াদাওয়া, আদর আর আনন্দ।

 শিকারপুর চা বাগানে যেতে হলে ফাটাপুকুর আর বেলাকোবা হয়ে যেতে হয়। শিলিগুড়ি থেকে অসম যাওয়ার একত্রিশ-ডি জাতীয় সড়কের ওপর ফাটাপুকুর। বাস স্ট্যান্ডের কাছেই উত্তর দিকের দোকানঘরগুলোর পেছনেই দিঘির মতো বিরাট সেই পুকুরটা। ওই পুকুর থেকেই সম্ভবত জায়গারটার নাম হয়েছে ফাটাপুকুর।

 শিলিগুড়ি থানার সামনে থেকে মিনিবাস ধরে সন্ধ্যেয় আমি পৌঁছে গেলাম ফাটাপুকুর। ফাটাপুকুর থেকে বেলাকোবা আর শিকারপুরের দিকে যাওয়ার কোনও যানবাহন নেই একমাত্র রিকশা ছাড়া। রিকশাও কয়েকটা মাত্র হাতেগোনা। এ দেশীয় এক রিকশা ভায়ের সঙ্গে কথা হল আমার। তিনি আমাকে পৌঁছে দেবেন শিকারপুর চাবাগানে।

 একেবারে সরল সোজা এক মধ্যবয়সি লোক। তার রিকশায় উঠে বসতেই প্যাডেলে পা চালিয়ে দিলেন তিনি। অন্ধকার নীরব পাকা রাস্তা। দুইপাশে দূর দূর জলভরা ক্ষেতে সদ্য রোয়ানো ধারে চাড়া। রিকশা খুব বেশি না হলেও চলছে কিছুটা গতিতেই। আকাশ ভরা কালো মেঘ, মেঘের সঙ্গে বিদ্যুৎ। ঘন ঘন চমকাচ্ছে। রিকশা এই জন্যেই জোরে চালাচ্ছেন তিনি যাতে বৃষ্টি নামার আগেই জায়গায় যাতে আমাকে পৌঁছিয়ে দিতে পারেন।

 আকাশের অবস্থা দেখে আমি জিজ্ঞেস করল, কত সময় লাগবে পৌঁছাতে?

 ‘হে তিনখান ঘন্টা ধরেন!’

 ‘তিন ঘন্টা?’ হতভম্ব হয়ে গেলাম শুনে। নাগাড়ে রিকশা চালিয়ে নিয়ে যাবেন মধ্য বয়সি এই লোকটা আমাকে? 

 ‘মুই তো কমেই কহিলু। বেশিও লাগিবার পারে?’

 নেমেই পড়ল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। কোনওরকমে কাঁধের ব্যাগটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেও ভিজে গেলাম আমি। বেলাকোবা পৌঁছতেই লেগে গেল দু’ঘন্টা। নিউজলপাইগুড়ি থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার বিজি রেলপথে বেলাকোবা রেলগেট। অঝরে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়াতে হল রেলগেটের এপাশে। রেলগেট বন্ধ। অনেকক্ষণ পরে অন্ধকারে ঝমঝম আওয়াজ তুলে যাত্রীবাহী একটা ট্রেন চলে গেল গুয়াহাটি অভিমুখে।

 গেট খোলার পর রিকশা যত এগোচ্ছে রাস্তায় জল তত যেন বাড়ছে। বৃষ্টিরও বিরামহীন। হাল ছেড়ে দিলেন রিকশাওয়ালা ভাই। 

 ‘আর তু যাবার না পারিম!’ জানিয়ে দিলেন তিনি।

 ‘কত দূরে আর?’ জিজ্ঞেস করতেই হল আমাকে।

 ‘ধরেন আরও দুইখান ঘন্টা লাগিবে।’

 বিস্ময়ের আর অবধি রইল না আমার। বললাম, তাহলে তো এখনও অনেকটাই দূর! কি যে হিসাব তোমাদের। এতটা রাস্তা এই অন্ধকারে যাবে কি করে?’

 ‘যা কহেছেন।’

  আমি বুঝলাম বিপদ আমার সন্নিকটে। রিকশাভাইও চিন্তায় পড়ে গেলেন আমিকে নিয়ে। বললেন, আপনি রাতি কোথে থাকিবেন ভাবিছু তো? চিন্তা না করিবেন, পাই গছু হাল।

 বলেই তিনি সময়ও দিলেন না আমাকে। রিকশা থেকে নেমে ভিজে ভিজেই রাস্তার পাশের এক গুদামঘরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

 চওড়া রাস্তা। দু’পাশেই খোলামেলা সব ঘরবাড়ি। যদিও বেশির ভাগই টিনের দোচালা। ছাতা মাথায় একজনকে নিয়ে এলেন রিকশাভাই। রিকশা থেকে আমাকে নামিয়ে ছাতা মাথায় ধরে নিয়ে গেলেন গুদামঘরের বারান্দায়।

 বেশ ভদ্রস্থ এক যুবক। পরিচয় হওয়ার আগেই বলল, এখন এই রাতে বৃষ্টির মধ্যে শিকারপুর যাওয়া অসম্ভব! যেতে হবে দেবীচৌধুরানি মন্দিরের সামনের মাঠ পেরিয়ে। শুরু হয়েছে হাতির আনাগোনা। নেকড়েও বেরিয়েছে দু’দিন থেকে!

 নেকড়ের কথায় আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম আমি, সর্বনাশ! কী হবে এখন তাহলে উপায়? আবার কৌতূহলও হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, দেবীচৌধুরানির মন্দির?

 ‘হাঁ, এই শিকারপুরই তো বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত উপন্যাসের পটভূমি। এখানেই তো ভবানী পাঠকের ডেরা! তা শিকারপুর যাবে কার ওখানে?’

 ‘শিকারপুর বাগানে চাকরি করেন বিমলেশদা আমার ভগ্নীপতি।’

 ‘আরে বিমলেশদা? সে কথা আগে বলবে তো?’

 তাকাল সে রিকশাভাইয়ের দিকে, আষাঢ়ু তুই যা, আর চিন্তা না করিস। বাবু রাতি ইখানে থাকিবে। তোর ভাড়া কালি মুর থিকে লই যাবি।

 অপ্রস্তুত আমি, আরে না না, এ কি!

 আষাঢ়ু নিতে না চাইলেও যা কথা হয়েছিল তাই জোর করে ওর হাতে গুঁজে দিলাম আমি। ফাটাপুকুর থেকে সে নিয়ে এসেছে আমাকে, কমেও পাঁচ-ছয় কিলোমিটার তো হবেই, তারওপর এই দুর্যোগের রাতে!  

 ভেতরে সুন্দর বাংলোর মতো একটা বাড়ি, রাস্তা থেকে বোঝাই যায় না। পরিচয়ের যেটুকু বাকি সারা হয়ে গেল এর মধ্যেই। অতিথিদের জন্যে আলাদা ঘর বাইরের দিকে। কাজের লোক দিয়ে গেল গরম জল। পেতে দিয়ে গেল সুন্দর একটা বিছানাও। খাবার দিয়ে গেল অন্য আরও একজন লোক। ভালো আয়েশেই কাটল রাতটা।

 দুর্যোগের রাতে অপরিচিতের কাছে এরকম আপ্যায়ন বিমলেশদার জনপ্রিয়তার জন্যেই।

 সকালে বেশ ভালোই রোদের ঝলক। ভেজা জামাকাপড়ও শুকিয়ে গেছে অনেকটা। চা, তারপর জলখাবার, ধন্যবাদের নিয়মরক্ষা করে আমি বেরোলাম প্রায় সকাল নয়টায়।

 অবাক আমি। আষাঢ়ু রিকশা নিয়ে আমার অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আমিকে দেখেই বললেন, কালি তো আপনাক বাগানবাবুর ঘরতে নিয়া যাইতে পারি নাই, চলেন আজি লই যামু।

 ‘বাঃ ভালোই তো, চলো।’

 উঠে বসলাম আমি ওর রিকশায়। যেতে যেতে বাগানের ভেতরে দূর দূর সবুজের হাতছানি, চোখ জুড়িয়ে যায়। দেবীচৌধুরানির প্রাচীন মন্দির, সামনে প্রশস্ত মাঠ। আশেপাশে অনেক গ্রাম্য ঘরবাড়ি।

 আষাঢ়ু আমাকে বাগানের অফিস, ফ্যাক্টরি পেরিয়ে পৌঁছে দিলেন একেবারে বিমলেশের কোয়ার্টারের দরজায়। বাগানের খানিকটা বাইরে নীরব নিরিবিলি জায়গা। একটু দূরেই একটা খরস্রোতা ঝোরা। ঝোরার ওপর সরু কাঠের সেতু। প্রকৃতির উজার করা রূপ বিছানো চারদিকে।

 বেশ কয়েকদিন কাটিয়ে দিলাম আমি আপন মনে আপনজনের থেকেও যেন বেশি প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে। প্রকৃতি যে বড়ো টানে আমাকে। আজও সুযোগ পেলেই আমি প্রকৃতির টানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। ঘুরে বেড়াই জঙ্গলে পাহাড়ে।

 ছোড়দি আমার যত্নের কোনও খামতি রাখেনি। ইতিমধ্যে পুত্র সন্তানের মা হয়ে গেছে সে। সেই সন্তানকে নিয়েই প্রকৃতির কোলে অবাধ বিচরণে তার দিন কাটে। অবশ্য কখনও কখনও নীরবতাও ক্লান্তিকর। একাকিত্ব এসে হানা দেয় অজান্তে। আর সেটাই বিষণ্ণতা হয়ে জমা হয় মনে।

 

  next episode- অবুঝ


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama