ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-45-দয়ার সাগর
ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-45-দয়ার সাগর
পরদিন ফিরব আমি আর মিলন তৈরি। হঠাৎ হাসি মুখে এগিয়ে এলেন মাধবীর মা। মিলনদের আস্তানার পাশেই একটা কুড়েঘরে তাদের বাস। নিতান্তই দরিদ্র পরিবার। মাধবীর মা আমার কাছে একটা আবদার করলেন, আমার মেয়েটারে শহরে নিয়া যাইবা? ঠিক মতো খাইতেও দিতে পারি না গো মেয়েটারে। তোমাদের কি কাজের লোকের দরকার হয় না? নাহলে অন্য কোথাও ঢুকাইয়া দিও।
নিষ্পাপ ফুলের মতো একটি মেয়ে। ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল, ফরসা গায়ের রং, টানা টানা চোখ, রূপবতী কিশোরী। আমি তো অবাক। এই মেয়েকে নিয়ে গিয়ে আমি কার বাড়িতে কাজে ঢুকাব? মনে পড়ে গেল আমাদের পাড়ার এক বাড়ির কথা। কিছুদিন হল সেই বাড়িতে আমি টিউশনিও পড়াই। তাদের কাজের লোকের দরকার, বলেছিলেন সেই বাড়ির গৃহিণী একদিন আমাকে।
কোন দুঃসাহসের ওপর ভর করে আমি নিজেও তা জানি না, মাধবীকে নিয়ে নিলাম সঙ্গে।
মিলনদা বললেন, তোমার তো বেশ সাহস আছে খোকন!
নগাঁও পৌঁছেই মাধবীকে নিয়ে গেলাম আমি সেই টিউশন পড়ানো বাড়িতে। এরকম এক কাজের মেয়ে পেয়ে ওই বাড়ির কাকিমা খুব খুশি। কত কি দিতে হবে সেসবের তোয়াক্কা তিনি করেন না। যখন শুনলেন তিন বেলা খাওয়া আর সামান্য কিছু নগদ, জামাকাপড় যা তাদের বিবেচনা, যেন পোয়াবারো আরও।
মাধবীকে ওই বাড়িতে রেখে আমি ফিরব বাড়ি। হঠৎ কি হল আসতে দেবে না মাধবী আমাকে। আঁকড়ে ধরল আমার জামা, আমায় নিয়ে চলো, আমি তোমাদের বাড়ি যাব।
‘আমি তো তোকে এখানে থাকতে হবে বলেই নিয়ে এসেছি। আমাদের বাড়িতে তো তোকে কেন নিয়ে যাব?’ বলে আঁকড়ে ধরা জামা ছাড়িয়ে চলে আসতে চাইলাম আমি।
‘না না! আমি তোমাদের বাড়িতে যাব। আমি এখানে থাকব না।’
কেঁদে ফেলল মাধবী। আমার টিউশন পড়ানোর বাড়ির কাকিমা দিলেন বকা, এই কাঁন্দস ক্যান? এইখানে থাক, ভালো ভালো জামা পাইবি, খাওয়া পাইবি, আবার টাকাও দিমু!
জোর করে মাধবীর হাত ছাড়িয়ে আমি ফিরলাম বাড়ি। ঘরে ঢুকতেই মা রেগে আগুন। জিজ্ঞেস করলেন, হাতিখুলি থিকা কোন মাইয়ারে নাকি তুই লইয়া আইছস নবাঙ্কুরগো বাড়ির ঝির কাজের লাইগ্যা? তোর কি মাথা খারাপ হইয়া গেছে? কি যে কাজ করস তুই এক একটা?
আমি অবাক, নবাঙ্কুর আংকেলদের বাড়ির কাজের জন্যে আমি যে হাতিখুলি থেকে মাধবী নামের একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছি, মা এতসব জানলেন কী করে?
মা আবারও বলে উঠলেন, ভাস্বতী নবাঙ্কুররার বাড়িতে গেছিল কি কাজে, দেইখ্যা আইছে, ফুটফুটে সুন্দর একটা মাইয়া নাকি তুই লইয়া আইছস? হেই মাইয়া নাকি ওইখানে থাকতে চায় না! আমাদের ঘরে কাম করনের লাইগ্যা আইতে চায়? কার মাইয়া? কোন বিপদ তুই লইয়া আইলি আবার?
সব খুলে বললাম আমি মাকে। চেষ্টা করলাম মাকে বোঝানোর, আশ্বস্ত করানোর। একটুও আশ্বস্ত হতে পারলেন না মা। অল্পবিস্তর বকলেন বাবাও। বললেন, গেছস একটা ইন্টারভিউ দিতে। ওইটা তো হইলই না, লইয়া আইছস একটা বোঝা। নামছস পরোপকারে। মধুসূদন ছাইড়া অহন হইতে চাস ঈশ্বর চন্দ্র! নবাঙ্কুর কি তরে কইছিল তার বাড়ির ঝির কাজের লাইগ্যা হাতিখুলি থিকা মাইয়া লইয়া আইতে?
মা যেন ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন আমার ওই বেমক্কা কাণ্ড নিয়ে। মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, কি বিপদ জানি তুই লইয়া আইলিরে খুকন!
মা আশ্বস্ত হতেই পারছেন না দেখে আবার বললাম, মা জানো তো, এরা ভীষণ গরিব! এত নিরন্ন দরিদ্র না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না! দুইবেলা খেতেও দিতে পারে না মেয়েটাকে। নবাঙ্কুর আংকেলদের বাড়িতে এখন যদি একটু খেয়েপরে বাঁচে।
মা হতাশ হয়ে বললেন, হায়রে দয়ার সাগর, যে আগুন তুই লইয়া আইছস, কি সর্বনাশ যে তোর হইব ভগবানই জানে!
