ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-48-অবুঝ
ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-48-অবুঝ
ইদানিং লুকিয়েচুরিয়ে গোপনে হলেও ভাস্বতীর আর আমার মেলেমেশা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছিল। সেইজন্যেই হয়তো অমনোযোগী হয়ে পড়ছিলাম আমি পড়শোনায়। দিনের অনেকটা সময় আমার চলে যাছিল বাড়ির পেছনের পুষ্করিণী ছাড়িয়ে দূর প্রান্তরে ভাস্বতীর সঙ্গে গোপনে দেখা করতে গিয়ে। নয়তো মাসিদের গোয়াল ঘরের পেছনে নিরিবিলি জঙ্গলের মতো জায়গাটায় সকলের চোখ এড়িয়ে ভাস্বতীর সঙ্গে দুটো কথা বলতে গিয়ে।
এরমধ্যে হঠাৎ একদিন সুদীপের থেকে আমি জানতে পারলাম বন্ধু সৌম্য অরুণাচল সরকারের বন ও বন্যপ্রাণী দপ্তরে চাকরি পেয়ে পড়াশোনার ইতি দিয়ে চলে গেছে। পোস্টিং হয়েছে ওয়ালংয়ের কাছে প্রত্যন্ত এক পাহাড়ি জঙ্গলে। ওর চলে যাওয়ায় বন্ধু বিচ্ছেদের বেদনায় মনটা যেন আমার ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। যেন আমার চারদিকে একটা শূন্যতার বেষ্টনী আরও দৃঢ় হয়ে উঠছিল। অধ্যয়ন জীবনের পুরানো সহপাঠীকে খুইয়ে নিজেকে বড় একা আর নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল। আর ওই একাকিত্বের শূন্যতাটুকুতে যেন অজান্তেই পরিপূরক হয়ে উঠল ভাস্বতীর সঙ্গ লাভ।
কিন্তু সর্বসমক্ষে ভাস্বতীর আর আমার কোনও কারণে কাছাকাছি চলে আসা তো দূর, কথা বলাও নিষিদ্ধ। অনেকদিন থেকেই পারিবারিক বিধি নিষেধ আরোপিত হয়ে আছে আমাদের উপরে। যদি কোনও অসাবধান মুহূর্তে আমরা দুজন কাছাকাছি যদি চলেও আসি অথবা কথা বলে ফেলি, আর কেউ যদি তা দেখে ফেলে, পরিণাম যেন ভয়ংকর হয়ে ওঠে। দুই পরিবারই একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। অশান্তি শুরু হয়ে যায় দুই পরিবারের মধ্যে। ওসব দেখে আমাদেরও জেদ যায় আরও বেড়ে। আর ওই জেদের কারণে নিজেদের পড়াশোনাতেও বিঘ্ন ঘটিয়ে ফেলি। অমনোযোগী হয়ে পড়ি। বুঝেও অবুঝের মত হয়ে যাই দুজনে।
আমার ফর্সা কমনীয় চেহারাটাও কেমন যেন শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। মাথার চুল বাড়তে বাড়তে মেয়েদের মতো ঘাড় অব্দি নেমে এসেছে। আমার শুকনো চেহারার সঙ্গে বেমানান বিশ্রী লাগছে জেনেও চুল ছোট করে ছাটতে যেন আমার অনীহা। ‘কুন্তি’ নামের আমাদের পারিবারিক এক নরসুন্দর সপ্তাহে একবার করে বাড়িতে হাজিরা দেয়। পিতৃদেব, মেসো, মামারা তার হাতেই চুল কাটান, দাড়ি কামান। আমার ছোট এবং বড় মেসতুতো, মামাতো ভাই ভাতিজাদেরও অনেকের ক্ষৌরকাজ তার হাতেই সম্পন্ন হয়। একমাত্র আমিই তার চিরুনি কাঁচির ছোঁয়া থেকে তফাতে থাকি।
ভালো কিছু ইদানিং যেন জন্মায়ই না আমার মনে। আসলে এই বয়সটাই বড়ো বালাই। স্বপনে শয়নে বসনে যেদিকেই চোখ মেলে তাকাই যেন শুধু ভাস্বতীকেই দেখি। ভাস্বতী এসে দাঁড়িয়ে যায় সামনে।
একজন বিহারি লোক প্রায়ই আসেন ভাস্বতীদের বাড়িতে। লোকটাকে দেখলেই ভীষণ রাগ হয়ে আমার। ভেতরটা যেন জ্বলে ওঠে। বড়ো ধূর্ত মনে হয় লোকটাকে। আসেন কোঁচানো ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে। তারওপর ফরসা ভাঙাগালে পাকানো বাহারি একটা গোঁফ তার চতুরতা যেন আরও প্রকট করে তোলে। লোকটা ওদের বাড়িতে কেন আসেন, কি জন্যে আসেন সেই নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা আমার মনের ভেতরে। হিংসেও হয় লোকটাকে দেখে। ভাস্বতীর সঙ্গে গল্প করতে দেখলেই আগুন জ্বলে ওঠে আমার অন্তরে।
এক বিকেলে মামাদের বাড়ির বারান্দার কোনায় দাঁড়িয়ে চুপি চুপি গল্প করছিলাম আমরা দুজনে। আমি আর ভাস্বতী। এই সময়েই সেই বিহারি লোকটা এসে হাজির। বারান্দায় পা রেখেই দেখে ফেললেন আমাদেরকে। সাড়া দিয়ে উঠল ভাস্বতী, ও পণ্ডিতজি আপ?
পণ্ডিতজি কোনও জবাব না দিয়ে আমার দিকে সার্চলাইটের মতো চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের চোখে জিজ্ঞেস করলেন ভাস্বতীকে, কৌন হ্যায় এ লেড়কা?
ভাস্বতী সহজ ভাবে উত্তর দিল, আমাদের পাশের বাড়ির আত্মীয়।
ভাঙা ভাঙা বাংলায় সুন্দর কথাও বলতে পারেন পণ্ডিতজি। নাসিকার নিচে মুচকি হেসে আবার সুধালেন, ও আচ্ছা আছা..বহুত আচ্ছা। তো তোমরা কি একই ক্লাসে পড়ো?
‘না না ও তো কলেজে পড়ে!’
‘ওহো আমি ভাবলাম কি তোমরা একই ক্লাসে পড়ো।’
রাগ হচ্ছিল আমার খুব। আমি কি এতই বাচ্চা দেখতে, মনে হয় না কলেজে পড়ি বলে?
‘তো তুমার মা কি বাড়িতে আছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি ভাস্বতীকে।
‘না, মা তো এখন বাড়িতে নেই।’
‘তা তোমার দিদি, মামা ওরাও কি বাড়িতে নেই?’
‘না, কেউ নেই। সবাই নেমন্তন্ন বাড়িতে গেছে।’
‘ও হো ওরাও ভি বাড়িতে নেই? তুমি অকলে ঘরে?’
বাঁকা চোখে তাকালেন পণ্ডিতজি আমার দিকে। তিনি যে কি অনুমান করছেন তার বাঁকা চোখের চাহনি দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।
আমি ওনার মনের ধন্দ দূর করতে বলে উঠলাম, ম্যায় ভাস্বতীকা পরোসি, লেকিন রিলেটিভভি হু। ম্যায় কাজিন হু উসকা।
‘ও আচ্ছা আচ্ছা...বহুত আচ্ছা। ছুনো ভাস্বতী তুমার মা দিদি ওরা কখন আসবেন? আসবেন কি এখন?’
‘ওরা কলং উসপার নেমন্তন বাড়ি গিয়া তো। ফিরতে দেরি হবে।’
‘তবে এক কাজ করো। তুমাকেই দিয়ে যাই রুপেয়াগুলো?’
বলে পণ্ডিতজি আবারও আড় চোখে তাকালেন আমার দিকে।
ভাস্বতী বলল, হাঁ দিজিয়ে।
অনেকগুলো টাকা বের করে ভাস্বতীর হাতে দিলেন তিনি। কত টাকা বললেনও না কিছু।
এতদিনে আমি বুঝতে পারলাম পণ্ডিতজি কেন আসেন ওদের বাড়িতে। ভাস্বতীর বাবার পাঠানো টাকাপয়সা ও নানা জিনিসপত্র নিয়ে এসে তিনি পৌঁছে দেন ওদের বাড়িতে। ভাস্বতীর বাবা চাকরি করেন অসম পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের শ্রীরামপুরে। যথা সম্ভব সীমান্ত থানার ওসি তিনি। সেই সুবাদেই বিহারি পণ্ডিতজির সঙ্গে ওনার পরিচয়।
গল্পে গল্পে আরও জানতে পারলাম বিহারের মজফরপুর থেকে নগাঁও অব্দি তিনখানা বাস চলে তার। সরাসরি ওখান থেকে সওয়ারি নিয়ে আসেন, আবার ফেরার সময় এখান থেকেও যাত্রী নিয়ে যান। আন্তঃরাজ্য পারমিট ছাড়া এসব বাস চালানো সম্ভব নয়। তার সেসব আছে কিনা আমি জানি না। তবে যাত্রী প্রচুর। আর সবাই বিহারের মজদুর। গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে গরু-ছাগলের মতো নিয়ে আসা যাওয়া হয় তাদের। এত দূরের রাস্তা। তবুও এরকম করে চলতেই যেন তারা অভ্যস্ত।
এরপর থেকে পণ্ডিতজি আমাকে দেখলেই আমার ঘাড়লম্বা চুলের খুব প্রশংসা করে বসেন। চতুর লোক তিনি। আবার এও বলেন, থুরা বচ্চন যেইছা আতা হ্যায় তুমহরা চেহারা।
আমিও হেসে বলি, লেকিন লম্বাই মে বচ্চনকি কোমর কি নিচে।
‘হাঁ হাঁ ও ভি ঠিক।’
বলে হাসেন তিনি ঠোঁট বাঁকিয়ে।
ভাস্বতীর ছোটমামার সঙ্গে খুব সখ্যতা পণ্ডিতজির। ছোটমামা ইলেকট্রিকের কাজ জানে বলে কলকাতা ছেড়ে ফের চলে এসেছে এখানে। এদের বাবা চাকরি করতেন আপার অসমের কোনও এক চাবাগানে। রিটায়ারের পর চলে গেছেন কলকাতার আশেপাশে শহরতলির কোনও এক জায়গায়।
উড়নচণ্ডী মন আমার। প্রকৃতিপ্রেমীও। সুযোগ পেলেই ইচ্ছে হয় দূরদূরান্তে চলে যাই। তক্কে তক্কে থেকে এক সন্ধ্যের মুখে ভাস্বতীদের বাড়িতে ঢোকার সময় পাকড়াও করে ফেললাম আমি পণ্ডিতজিকে। জিজ্ঞেস করলাম সরাসরি, আপনার তো অনেক দূর গাড়ি চলে। আমাকে নিয়ে যাবেন?
‘ও বহুত কষ্ট! বিহার গিয়ে তুমি কী দেখবে? কুচ নাই! তবে শ্রীরামপুর চলো। ভাস্বতীর পিতাজিভি আছে ওখানে। ভাস্বতী তো অন্যদিন বলল তোমরা রিলেটিভ, তাহলে আর তকলিফ কি? থাকবে ওখানে চারপাঁচদিন, ফিরতি ট্রিপে চলে আসবে আমাদের সঙ্গে। ওখানে ভি কুচ নাই, ফিরভি বর্ডার এরিয়া আচ্ছাই লাগেগা।’
পণ্ডিতজির সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দেখে ভাস্বতীর মা আর দিদি বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। গম্ভীর মুখে পণ্ডিতজিকে জিজ্ঞেস করলেন, আর পণ্ডিতজি? কখন এসেছেন?
‘এই তো আভি, গল্প করছিলাম আপনাদের রিলেটিভ এই লেড়কার সঙ্গে।’
‘আসুন, ঘরে আসুন।’
পণ্ডিতজি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো, তুম ভি চলো, ঘরে বসে বাত করি।
আমি ইতস্তত করছিলাম। পণ্ডিতজি আমার হাত টেনে ধরলেন, আরে আও তো! হিচখিচ কেন করছ?
ভাস্বতীর মা অনিচ্ছায় হলেও বললেন, খোকন পণ্ডিতজি যখন বলছেন, তুমিও আসো।
আমিও ঢুকলাম পণ্ডিতজির সঙ্গে ভাস্বতীদের ঘরে।
‘বসেন, চা বানাচ্ছি।’ বললেন ভাস্বতীর মা।
‘না না, আপনি তো জানেন আমি বাহার কিছু খাই না!’
‘ও হাঁ, ভুলেই গেছিলাম। তা আপনার স্যার...?’
‘উসবার ছোটা বেটির হাতে দিয়ে গেছিলাম, পেয়েছেন তো? ইসবার সাহাব কিছু দেননি, বলেছেন ফিরতি ট্রিপে দেবেন। তাবে আমার হিসাব দিয়ে যাচ্ছি, সাহাব বলেছেন আপনাকে দিতে।’
আমার দিকে আড় চোখে একবার তাকিয়ে অনেকগুলো টাকা এগিয়ে দিলেন পণ্ডিতজি। ভাস্বতীর মা’ও তেরচা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে টাকাগুলো হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলেন।
next episode- শকুন
