ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-49-শকুন
ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-49-শকুন
টাকা দেওয়ার পরে আচমকা পণ্ডিতজি আমিকে দেখিয়ে বলে বসলেন, আপলোগকা রিলেটিভ এ লেড়কা আমাদের বসে (বাসে) শ্রীরামপুর যাবে বলেছে। আপনার ছোট বেটিভি উসবার যেতে চাইছিল? সব লেবারলোগ যাতে হ্যায়, ইস লিয়ে মানা কিয়া থা। এবার তো যেতে পারে, এ লেড়কা যাচ্ছে!
‘না না ও যাবে না!’ যেন আঁতকে উঠে বলে উঠল ভাস্বতীর দিদি।
ভাস্বতীীর মা’ও বলে উঠলেন, না না! ঠিকই বলেছে শাশ্বতী, ওর যেতে হবে না!
তারপর শুকনো হেসে আমার দিকে তাকিয়ে ভাস্বতীর মা বললেন, খোকন যেতে চাইছে যাক। ভালোই তো, দাদা কত কষ্ট করে ওখানে থাকে দেখে আসুক।
পণ্ডিতজি কি বুঝলেন, বোকার মতো বলে বসলেন, ওহো আপকা পতিদেব নানা লাগতা হ্যায় ইসকা? তব তো বচ্চন চলো চলো! নানাজি কা সাত বহুত মৌজমস্তি হোগা।
বলে পণ্ডিতজি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, চলতি হু বলে বেরিয়ে এলেন দরজার পরদা ঠেলে।
তার মানে আমি পণ্ডিতজির বাসে অসম পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে বেড়াতে যাচ্ছি! তবে বাধ সাধলেন আমার মা। মা আমকে কিছুতেই যেতে দেবেন না। শঙ্কা জড়ানো সুরে বললেন, বুঝতে পারছি আরও একটা গন্ডগোল তুই পাকাইবি এইবার।
নাছোড় আমি। লাফ দিয়ে জেদের সুরে মাকে বললাম, গন্ডগোলের পরোয়া করি না। আমি যাব তো যাবই! কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না!
সামনে দাঁড়ানো ভাস্বতীর ঠাকুরমা, আমার বড়োমামি। অত্যন্ত স্নেহ করেন তিনি আমাকে। আমার শত দোষও ওনার চোখে যেন কোনও দোষ নয়। বললেন, হ আমিও শুনছি খুকন নবেন্দুর ওইখানে যাইব। যাউক বেড়াইয়া আসুক, গন্ডগোল লাগব কিয়ের আবার?
‘বউদি আপনে জানেন না? যে অশান্তি এরে আর ভাস্বতীরে লইয়া? কিয়ের থিকা কী ঝামেলা লাইগ্যা পড়ে কওয়া যায়?’ আশঙ্কা প্রকাশ করলেন মা।
‘আরে দুইটাই তো পুলাপান! এই দুইটা একটু বেশি মিশে। এই লইয়া এত কথা কিয়ের আমি বুঝি না!’ বললেন মামি।
‘আমিও তো সেটাই কই। বয়স বাড়লেই সব ঠিক হইয়া যাইব। কে কোন জায়গায় যাইব গা। ভাস্বতীর ঘরের এরা এগুলা লইয়া বেশি ঘাঁটায়!’
‘যাইতে দে। পুলাপান মানুষ একটু বেড়াইয়া আসুক। বাধা দিস না।’
মামির সুপারিশে পেয়ে গেলাম আমি মায়ের অনুমতি। রওনা হলাম পণ্ডিতজির সেই বিহারগামী বাসে। বাস ছাড়ল দুপুরে খড়মপট্টির বিনাপানি ক্লাবের পাশ থেকে। আমার বসার জায়গা হল ড্রাইভারের পেছনেই পণ্ডিতজির পাশেই। বিহারি ড্রাইভার, তেমনি সবল তার চেহারা। গাড়ি তো নয় যেন লাগাম ধরে ছুটিয়ে চলেছেন অশ্বমেধের ঘোড়া। চলছে খেত খামার শহর পেরিয়ে। রাস্তার পর রাস্তা আর অন্ধকার রাত চিরে। মাঝরাতের দিকে শ্রীরামপুর। অবাক আমাকে দেখে মামাতো দাদা নবেন্দু।
‘আরে তুই?’
আমি কিছু জবাব দেওয়ার আগেই পণ্ডিতজি নবেন্দুকে বললেন, আর্জি থা বিহার যানেকা। মেয়নে বোলা উহা যাকে কিয়া দেখোগে?...
পণ্ডিতজি আরও কিছু বলার আগেই নবেন্দুদাদা বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলেন, ইহা ভি কিয়া দেখেগা? আপ ভি!
দাদা নবেন্দু বোধহয় খুব একটা খুশি নন আমাকে দেখে। ভাস্বতীর সঙ্গে আমার মেলামেশার ব্যাপারটাও ওনার অবগত। তবুও এসেই যখন পড়েছি আমার থাকার ব্যবস্থা তো একটা করতেই হবে। একজন পুলিশকে ডেকে আমার জন্য বিছানা, কম্বল আর ক্যাম্পখাটের ব্যবস্থা করতে বললেন।
রাজ্য সীমান্তের ছোট পুলিশ চৌকি। চারপাঁচটা ছোট ছোট ঘর আর দুইখানা তাবু মিলে দশবারোজনের থাকার ব্যবস্থা। তাদেরই থাকার জায়গা প্রায় হয় না, তার মধ্যে আমি এক বাড়তি মানুষ চলে এসেছি। সত্যিই অনেক কষ্টে থাকেন তারা। তবুও হয় গেল ব্যবস্থা একটা তাবুর নিচে কোনও একজন পুলিশ জওয়ান ছুটিতে আছেন বলে।
দেখতে দেখতে তিনদিন। একা একাই হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই আমি শ্রীরামপুর রেলস্টেশনের কাছে। নতুন বসতি গড়ে উঠছে সেখানে। পাশেই দোকানপাট বাজার। সহজ-সরল গ্রাম্য পরিবেশ। দিনটা ভালোই কাটে। রাতের দিকটায় শুরু হয়ে যায় সরকারি লাইসেন্সে লুট ডাকাতির বেসাতি। পুলিশ, কাস্টমস, বিক্রয় কর কেউ আর বাকি থাকে না, সবাই নেমে পড়ে লুটতরাজের ময়দানে।
দাঁড়িয়ে পড়ে দূরদূরান্ত থেকে আসা ভিন প্রদেশের মালবাহী ট্রাকগুলো। এইটুকু রাস্তার ওপরে দুইতিন সারির কিলোমিটার খানেক লম্বা গাড়ির লাইন। বেশিভাগ ড্রাইভারই পাঞ্জাবি। শুরু হয় মাছের বাজারের মতো দর কষাকষি। যে যেরকম ভাবে পারে লুট করে এদের থেকে। দুই টাকা যদি সরকারি খাজানাখানায় জমা পড়ে, আটানব্বই চলে যায় অসাধু সরকারি কর্মচারীদের পকেটে।
তিনদিনের পরেও পণ্ডিতজির ফিরতি ট্রিপের কোনও খবর নেই। আর সম্ভব নয় আমার আরও কয়েকদিন এখানে থাকা। কথা দিয়ে এসেছি মাকে, ফিরব তিনদিনের মধ্যে। ঠিক হল বিকেলের দিকে আজ আমি রওনা হয়ে বাসে চলে যাব বাসুগাঁও। বাসুগাঁও খুব একটা দূরে নয়, ঘন্টা দেড়দুইয়ের রাস্তা। বাসুগাঁও থেকে ট্রেন ধরে যাব নিউবঙ্গাইগাঁও। তারপর সেখান থেকে গুয়াহাটি।
রওনা হওয়ার আগমুহূর্তে দাদা নবেন্দু দশটাকার কয়েকটা বান্ডিল হাতে নিয়ে এসে আমাকে বললেন, এখানে ছয় হাজার টাকা আছে, আমাদের ঘরে দিয়ে দিস। ব্যাগের নিচে ঢুকিয়ে দিচ্ছি। সাবধানে যাস! ব্যাগ হাতছাড়া করবি না। রাতে যদি ঘুমোস মাথার নিচে নিয়ে ঘুমোবি।
একটা খামবন্ধ চিঠিও দিলেন তিনি আমার হাতে।
‘চিঠিটা তোর বউদিকে দিয়ে দিস।’
আমি বেরোবো। তিনি আমায় বললেন, তোর কাছে যাওয়ার খরচের টাকা তো বোধহয় আছেই? তাই আর তোকে আলাদা কিছু দিলাম না।
‘হাঁ আসার সময় যেটুকু নিয়ে এসেছিলাম এখনও কিছু আছে, হয়ে যাবে। শুধু ট্রেনের ভাড়াই তো কয়েক টাকা। কাল সকালে তো পৌঁছেই যাব।’ বললাম আমি।
বাসুগাঁও থেকে রাতের দিকে একটা ট্রেন পেয়ে গেলাম আমি। উঠে পড়লাম একটা রিজার্ভেশন কামরায়। দাঁড়িয়ে আছি আমি দরজার পাশে। আরও দুইএকজন লোকও ওখানে দাঁড়িয়ে। তার মধ্যে একজন বেশ ফিটফাট ভদ্রলোক। শ্যামলা গায়ের রং, মাঝারি গড়ন, বেশ চটপটে ধার চেহারা।
চলছে ট্রেন নিয়মিত গতিতেই। টিটিইবাবু এলেন সেই ভদ্রলোকের কাছে। ভদ্রলোক কয়েকটি টাকা গুঁজে দিলেন টিটিইবাবুর হাতে। টিটিইবাবু বললেন, এগারো নম্বরে চলে যান।
কৌতূহলী আমি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল, এগারো নম্বর মানে? আপনি পেয়ে গেলেন নাকি শোয়ার জায়গা?
তিনি হাসি মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে পালটা জিজ্ঞেস করলেন, তোমারও লাগবে নাকি?
‘পেলে তো ভালোই হয়।’
একটু এগিয়ে গেছিলেন টিটিইবাবু। ডেকে উঠলেন ভদ্রলোক, স্যার আরও একটা লাগবে।
স্যার মুখ ঘুরাতেই ভদ্রলোক আমাকে দেখিয়ে বললেন, ওর জন্যে।
টিটিইবাবুও জানান দিয়ে দিলেন, বারোও খালি আছে।
বলেই চলে গেলেন তিনি। আমি অবাক। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, দক্ষিণা?
‘ও চিন্তা নেই, ঠিক চলে আসবে। মরাগোরু যেখানেই থাকুক ঠিক খুঁজে নেবে শকুন!’
অনেকটা রাত তখন। ওপরের বার্থে ব্যাগটা মাথার নিচে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। কোনও ডাকাডাকি না করে শরীরে ধাক্কা দিয়ে তুললেন আমাকে টিটিইবাবু।
‘দাও।’
আমি ঘুম জড়ানো ঢুলুঢুলু চোখে জিজ্ঞেস করলাম, ও হাঁ হাঁ.. কত?
‘চল্লিশ টাকা।’
এই রে চল্লিশটাকা তো নেই আমার পকেটে। যে কয়েকটা টাকা পকেটে আছে তা তো গুয়াহাটি থেকে নগাঁও পর্যন্ত যেতেই লেগে যাবে। অগত্যা ব্যাগ খুলতেই হল আমাকে। ব্যাগের নিচ থেকে টাকার একটা বান্ডিল টেনে বের করলাম আমি অনেক কষ্টে। পাশের ওপরের বার্থের সেই ভদ্রলোকও জেগে উঠেছেন ততক্ষণে। আমার হাতে টাকার বান্ডিল দেখে যেন লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন।
বান্ডিল থেকে চারটে দশটাকার নোট বের করে চল্লিশ টাকা মিলিয়ে দিয়ে দিলাম আমি টিটিইবাবুকে। তিনি চলে যেতেই বান্ডিল আবার ব্যাগের ভেতরে তলায় ঢুকিয়ে দিয়ে মাথার নিচে নিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি।
গভীর রাতের দিকে ঘুমের ঘোরে আমার মনে হচ্ছিল যেন কেউ টানছে ব্যাগটাকে। হাত দিয়ে দেখলাম, না, ব্যাগ তো মাথার নীচে ঠিকই আছে। মনে হল ভুল বোধহয় আমারই। ঘুমের ঘোরে মনে মনে বোধহয় ভুল আমারই হচ্ছে। হয়তো ব্যাগটা কোনও কারণে সরে গেছিল মাথার নিচ থেকে তাই ওরকম মনে হচ্ছিল। ঠিক করে নিলাম আবার আমি ব্যাগটাকে টেনেটুনে।
next episode- দুবোর্ধ্য রহস্য
