ভাইরাসের কড়চা #৫|পান্তাভাতে ঘি
ভাইরাসের কড়চা #৫|পান্তাভাতে ঘি


২৯শে মার্চ
মাঝে মাঝেই ভাবি বসের বিচার বিবেচনা কতোটা নির্ভুল, যাকে বলে পারফেক্ট টু দি পাওআর এন। বেছে বেছে একদম সঠিক জায়গাতেই আমাকে পাঠিয়েছেন। বাঙালিদের যত দেখছি ততোই অবাক হচ্ছি। এদের সাথে মিলেমিশে একজায়গায় থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধে হল যে এরা মোটামুটি সবাই সব বিষয়েই একটু আধটু জানে; সারা পৃথিবীর খবর রাখে। আর তার সঙ্গে সর্বজ্ঞ ভাবটাও আছে ষোলআনা! ঐ যে, ভালো বাংলায় কি যেন একটা বলে - পল্লবগ্রাহী - সেইটা আর কি! আমার ছোঁয়ায় কতজন আক্রান্ত, কতজন মৃত, কতজন বেঁচে গেল এযাত্রায় - সব এদের ঠোঁটস্থ। খালি এদেশের সংখ্যা নয়, আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, ইংল্যাণ্ড, ইরাণ এমনকি উত্তর কোরিয়ারও সবকিছু তথ্য এদের হাতে, যাকে বলে টাটকা গরম। কেউ বাড়তে থাকা আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে চিন্তিত, কেউ আবার আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধির হার এক্সপোনেন্সিয়ালি বাড়ছে না বলে অনেকটাই নিশ্চিন্ত।
এখানে আমি সেরকম ছড়ি ঘোরাতে পারছি না বলে বস একটু হলেও ক্ষুণ্ণ। রাস্তায় সেদিন স্যাঙাৎ ফ্লু ভাইরাসের সাথে দেখা হল। সে ব্যাটার কপালটা অনেকটাই ভালো। এরকম অসম্ভব কোনো টার্গেট তাকে দেয়নি। ওই অভয় দিল, বললো, চাকরির প্রথম কিছুদিন একটু কষ্ট করে মেনে নিতে, মানিয়ে নিতে হবে। তারপর বসের চমকানি একটু একটু করে ঠিক সয়ে যাবে। দেখা যাক, কিন্তু খেয়াল করে দেখছি আমার গোড়ার দিকের রোষ এদের কলজের জোশের কাছে একটু ফিকে হয়ে গেছে! ও হ্যাঁ, এটা তো বলতেই ভুলে গেছি - আমার দাপটের খবর রাখার জন্যে এদেশের সরকার অল্প দিনের মধ্যেই তড়িঘড়ি করে একটা অফিসিয়াল সাইটও বানিয়ে ফেলেছে। আমজনতাকে নানাভাবে জানাচ্ছে -- 'ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, সঙ্গে আমরা আছি, গুজব-টুজব মিথ্যে জেনো, খেলবে কানামাছি'। এদের সরকারি হিসেবে সারা দেশে আক্রান্ত নশো চুয়াত্তর, পরলোকে গেছে সাতাশ। এরাজ্যে তো মাত্র আঠেরোজন আক্রান্ত। কি, আপনাদের কি মনে হচ্ছে! অনেকটা জল মেশানো মনে হয় না এসব সরকারি সংখ্যাগুলো? আমার তো তাই মনে হয়।
তবে একটা ব্যাপারে আমারও মন খুব খারাপ হয়ে গেল। সরকারি ভাবে যখন লকডাউনের ঘোষণা হলো, তখন গরীবগুর্বো মানুষজনের কথা কেউই ভাবেনি। যতোই 'অচ্ছে দিন আয়েগা' বলুক, আসলে কিন্তু এদেশের কোটি কোটি মানুষের দিন আনি - দিন খাই অবস্থা। তাদের কথা কেন যে সরকার আগে থেকে ভাবেনি সেটা ভাবলেই মন খারাপ হয়। ঘরবন্দী হয়ে থাকার দিনগুলোয় তারা যে কি খেয়ে বাঁচবে সেটাই ভেবে দেখেনি কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারগুলো! ঘরে চাল-ডাল, আটা-ময়দা, তেল-নুন এইসব রসদ আছে কিনা সেসব ভাবলোই না। রাত আটটার বক্তৃতায় বলে দেওয়া হলো ঐদিনই রাত বারোটা থেকে লকডাউন। ঘরেই দিন কাটাতে হবে, বাঁচতে হলে বাইরে বেরনো চলবে না। বোঝো ঠ্যালা।
শহুরে লোকেদের হালত তাই খুব খারাপ। গ্রামে তো চাষবাস হয়, শাকসব্জি পাওয়া যায়। তাই গ্রামের মানুষগুলো তবু প্রতিবেশীদের দয়ায় কোনোরকমে দিন গুজরান করছে। কিন্তু যারা ভিনরাজ্যে বা শহরে কাজ করতে গিয়ে আটকে পড়েছিল তাদের অবস্থা তো আরো শোচনীয়। এই দুঃসময়ে সকলেই তো চায় নিজের বাড়ির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে থাকতে। ভাবুন তো দিল্লির ঐ ছেলেটার কথা, যে মধ্যপ্রদেশে তার নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে বলে রাস্তায় নেমেছিল। ট্রেন-বাস সব বন্ধ, রাস্তায় অন্য কোনো যানবাহনও নেই। দেখলেই পুলিশ লাঠি হাতে তাড়া করছে, পাকড়াও করে ফেরত পাঠাচ্ছে। তা সেই অবস্থাতেই লুকিয়ে-চুরিয়ে দুশো কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পথে ঠিকমতো খেতে না পেয়ে রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়ল, মারাও গেল। মধ্যপ্রদেশে তার বাড়ি তখনও একশো চব্বিশ কিলোমিটার দূর। মনে কষ্ট তো হবেই কিন্তু তার দায় কেন আমি নেব!
নিত্যদিন রাজনীতি করে দিব্বি ঠাটেবাটে বহালতবিয়তে আছে এমন সব নেতাদের মধ্যে এই ক'দিন আগেও যা মতের মিল দেখেছিলাম, এই ঘটনার পর সব হাওয়া। এ ওকে দূষতে শুরু করে দিয়েছে। অন্যদিকে আমার মোকাবিলা করতে গিয়ে অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই ডাক্তার, নার্সদের ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দারের অবস্থা। গায়ে রেনকোট, মাস্ক বাড়ন্ত, কাপড় বা রুমাল দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। হ্যাণ্ড স্যানিটাইজারের হালও তথৈবচ। অথচ এদেরই আক্রান্ত হবার ও আমাকে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সেসবে কারোর মাথাব্যথা নেই। সব নেতাই ওদিকে ত্রাণ কার্যে ব্যস্ত, ঠিকঠাক প্রস্তুতি না নিয়েই। সঙ্গে যাচ্ছে গাদাগুচ্ছের রিপোর্টার আর গণ্ডা গণ্ডা ক্যামেরা, টিভি ক্যামেরা। আরে এটাই তো সুযোগ, প্রচারও তো চাই। আরে বাপু, তোমার ত্রাণের ভারেই তো সংক্রমণ ছড়াবে আর তার জেরে কতজনের যে বেঘোরে প্রাণ যাবে তার তো কোনো ইয়ত্তা থাকবে না। আমারই ফায়দা। একবার যদি কমিউনিটি লেভেলে পৌঁছতে পারি, তাহলে আমায় পায় কে। টেস্টের শেষ দিনে ঘূর্ণি উইকেটে স্পিনারের ভেল্কির মতো। সামলানো দায়, পটাপট উইকেট পড়বে।
আজ বস্তির মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারছিলাম। একটা টিনের চালা বাড়িতে দেখলাম মা সকালে ছেলেকে মুড়ি দিয়েছে জলখাবারে। আজ আর মা কোনো বাড়িতেই কাজে যাবে না। বাবুরাই ওকে এই ক'দিন ছুটি দিয়েছে। ছেলেটা ছোট, কতই বা বয়স, মনে হয় বছর দশেকের। ক্লাস ফোরে পড়ে। মায়ের গলা জড়িয়ে আদুরে আবদার - মা, টমেটো সস আছে? ওর মা একটু হেসে বলল - দাঁড়া, দুটো টাকা দিচ্চি, দ্যাখ্ রতনের দোকানে আচে কিনা। ওই পুচকে প্যাকেটটা আনবি। তারপর বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলে উঠল - আ মোলো! কিসের মধ্যে কি, পান্তাভাতে ঘি!
কৃতজ্ঞতা স্বীকার - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়