Manasi Ganguli

Fantasy

4.1  

Manasi Ganguli

Fantasy

অকাল বসন্ত

অকাল বসন্ত

6 mins
410


"কইগো শুনছো,আমার চশমাটা পাচ্ছি না,একটু খুঁজে দিয়ে  যাওনা"।

"দেখো না ঘরের টেবিলেই হবে,এই তো একটু আগেই দেখলাম তোমার চোখে"। 

"না গো পাচ্ছি না,একটু দেখে দিয়ে যাও না বাবা"।

 দুপুরে খাবার পরে তপনবাবু হাঁকডাক জুড়ে দিয়েছেন। অমিতাও খেয়ে উঠেছেন কিন্তু রাজত্বের কাজ পড়ে আছে তাঁর রান্নাঘরে,বাড়তি খাবার তুলে রাখা,জানলা দরজা বন্ধ করা, ঘন্টা দুই বাদে নাতি আর্য স্কুল থেকে ফিরবে,তার খাবার গুছিয়ে একেবারে মাছটাও বেছে রাখা। যা দস্যি ছেলে,এসে পড়লে আর কিচ্ছুটি করতে পারবে না অমিতা। অবশ্য এতে তাঁর কোনও অভিযোগ নেই,হাসিমুখেই নাতির ওটুকু দৌরাত্ম সহ্য করেন তিনি,এ তাঁর পরম পাওয়া। আর তাইতো তপতী নিশ্চিন্ত মনে অফিসে কাজ করতে পারে। জানে তার শাশুড়ি প্রাণ দিয়ে তাঁর নাতিকে আগলে রাখবেন। তপতী মেয়েটিও বড় ভালো,শাশুড়িকে টেকেন ফর গ্রান্টেড করে নেয়নি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে রান্নার মাসি আসার আগেই নিজেদের দুজনের টিফিন,ছেলের স্কুলের খাবার সব রেডি করে, ছেলেকে স্কুলের জন্য তৈরি করে শাশুড়ি -শ্বশুরের চা করে দিয়ে নিজে রেডি হয়েই ছোটে আবার সারাদিনের পরিশ্রমের পর রাতে এসে সবার খাবার গরম করে খেতে দেওয়া,সব করে। অমিতাদেবী বারণ করেন কিন্তু সে বলে,"সারাদিন ওই নাতি সামলানো কি কম কাজ নাকি? যেদিন আমার কষ্ট হবে বলবো,সেদিন তুমি করো মা"। শাশুড়ি বউয়ের রসায়নটা এ বাড়িতে বেশ ভালো কিন্তু সেই নাতি বাড়ি ফেরার আগে অমিতাদেবী রোজ দুপুরে দুটি ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে নেন,নাহলে তিনি ধকলটা নিতে পারেন না, আর তাই চেষ্টা করেন দুপুরে খাবার পরে রান্নাঘরের কাজটা তাড়াতাড়ি সারতে। "এইসময় আবার হাঁকডাক!" কিন্তু উনি যা শুরু করেছেন এখন ঘরে না গেলেই নয়,অস্থির হয়ে পড়বেন নাহলে, ভাবে অমিতা।

     ঘরে ঢুকেই অমিতার চক্ষুস্থির,চশমা চোখে দিয়ে চশমা খুঁজে বেড়াচ্ছেন তপনবাবু।"কি যে কর না,শুধু শুধু এ সময় ব্যস্ত করা",অমিতার এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে তপনবাবু এগিয়ে এসে অমিতাকে জাপটে জড়িয়ে ধরেন বুকের মধ্যে। "আরে,কর কি,কর কি,হঠাৎ হল কি তোমার? ও চশমা না পাওয়াটা তার মানে অছিলা,বুঝেছি এবার"। তপনবাবু এমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছেন অমিতাকে যে তাঁর নিজেকে সে বাঁধন থেকে মুক্ত করার সাধ্য নেই। "কিগো অমি,তুমি যে দেখি কিছুই খবর রাখো না আজকাল। জানো না আজ 'হাগ ডে',তাইতো তোমায় হাগ করলাম। আজ প্রেমিক-প্রেমিকারা দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।" "মরণ বুড়ো বয়সে ছেনালি! সব জানি,তা আমরা কি প্রেমিক প্রেমিকা?" "তা নয়? আমরা চল্লিশ বছর ধরে প্রেমিক-প্রেমিকা,যতদিন বাঁচবো আমরা প্রেমিক প্রেমিকা হয়েই বাঁচবো। ও অমি,শোনো না,শোনো,এসো না আজ আমরা দুজনে দুজনকে হাগ করে শুয়ে থাকি। বড় ইচ্ছা করছে। কতদিন তোমায় এভাবে বুকে জড়িয়ে ধরি নি,কি যে ভালো লাগছে,ছাড়তেই ইচ্ছা করছে না। এবার তুমি বলো তো সত্যি করে,তোমার ভালো লাগছে না?" অমিতা নববধূর মত লজ্জা জড়ানো গলায় বলে,"খুব ভালো লাগছে গো"। যাও তাহলে খুব তাড়াতাড়ি কাজ সেরে চলে এসো,সে ব্যাটা নাতি বাড়ি এলে আর তোমায় এভাবে পাব না। তাকে নিয়ে তুমি ব্যস্ত হয়ে পড়বে তারপর খাওয়া হলে আমাদের মাঝে এসে শুয়ে সে দুষ্টুটা গল্প শোনার আবদার করবে,রাতেও আমাদের দুজনের মাঝেই তো শোয়। চলে এসো লক্ষ্মীটি তাড়াতাড়ি, এসময় বাড়িতে কেউ নেই,শুধু তুমি আর আমি।" "কিন্তু মাছটা তো এখনও বাছা হয়নি"। "না হোক,একদিন মাছ না খেলে কিছু ক্ষতি হবে না এমনিতেও খেতে চায় না,তুমিই জোর করে ওকে খাওয়াও রোজ। আজ ওর মাছ খাওয়ার ছুটি। যাও যাও,তাড়াতাড়ি সেরে এসো। 'আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব,হারিয়ে যাব আমি তোমার মাঝে'- তপনবাবু দু'কলি গেয়েই ফেললেন। অমিতা তাঁর চল্লিশ বছরের প্রেমিক, তাঁর স্বামীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে রান্নাঘরে চলে গেলেন। দীর্ঘদিন পর তপনবাবুর ভালবাসার পরশে আচ্ছন্ন তিনিও। অল্পক্ষণের মধ্যেই মধুর হাসির সুরভি ছড়িয়ে তাঁর বেডরুমে প্রবেশ। সেই সৌরভে মাতাল তপনবাবু গেয়ে উঠলেন,'এসো এসো,আমার ঘরে এসো,আমার ঘরে......'। তপনবাবুকে আজ ভালোবাসায় ভর করেছে। অমিতা বিছানায় অপেক্ষারত তপনবাবুর পাশে গিয়ে শুতেই তিনি জড়িয়ে নিলেন তাঁকে বুকের মধ্যে নিবিড় করে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন আর অমিতা পক্ষীশাবকের মত স্বামীর বুকের মধ্যে মুখটা গুঁজে আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রইলেন। দুজনে চুপ করে দুজনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য উপভোগ করতে লাগলেন। তপনবাবু অনুভব করছেন অমিতার ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। অনেকক্ষণ পর তিনি নীরবতা ভঙ্গ করলেন,"অমি,কতদিন পর আমরা এমন ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত কাটাচ্ছি বলো,আমার তো সেই বিয়ের প্রথম প্রথম যেমন অনুভুতি হতো আজও তেমনই লাগছে। তোমার কেমন লাগছে বলতো সোনা?" কতদিন পর তপনবাবু অমিতাকে 'সোনা' বলে সম্বোধন করলেন,মনটা ভীষণ খুশিতে ভরে গেল ওর। আবেশ জারিত স্বরে বললেন, "আমারও তেমনই লাগছে গো আজ।" "আজ হঠাৎ একটু মজা করতে প্রাণ চাইল বড়,আর মজা করতে গিয়েই আবার আমাদের ঝিমিয়ে পড়া স্রোতহারা ভালোবাসার নদী গতি পেল। অমি,সোনা একটা গান শোনাও না আজ।" তপনবাবুর গলায় প্রেমের আকুতি যেন ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো। অমিতারও মনটা ফুরফুরে হয়ে আছে। সে গাইল,"পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়! ও সেই চোখে দেখা,প্রাণের কথা,সে কি ভোলা যায়।" গান শেষ হলে তপন বুকের মাঝে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরলেন অমিতাকে। বিয়ের আগে চারবছর প্রেম করেছেন তাঁরা,তখন এসব 'হাগ ডে','কিস ডে' ছিল না কিন্তু ছিল ভালোবাসা,একে অপরকে পাবার আকুতি। সবদিনগুলি তখন ছিল হাগ ডে,কিস ডে। একটু সুযোগ পেলেই দুজনে দুজনের আলিঙ্গনে বদ্ধ হতেন। অমিতার ভয় হতো,বলতেন,"আমাদের ভালোবাসার সম্পর্কটা যদি আমাদের বাড়ি থেকে মেনে না নেয়?" তপনবাবু নিবিড় আলিঙ্গনে অমিতাকে নিজের বাহুপাশে শক্ত করে বেঁধে ফেলেছিলেন,যে বাঁধনে ভরসা ছিল,বলেছিলেন,"ভাবছো কেন, আমি তো আছি তোমার পাশে,দেখি তো এ বাঁধন ছিন্ন করে কে তোমাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারে।" তপনবাবুর ভালোবাসার আলিঙ্গনে ভরসা পান অমিতা,তাঁর ভাবনা,চিন্তা, ভয় নিমেষে উধাও হয়ে যায়,তপনবাবুর প্রতি ভালবাসায় ভরে ওঠে মন। মনে হয় তাঁর,এমন এক গভীর, আন্তরিক আলিঙ্গনের কাছে তুচ্ছ পৃথিবীর সকল পার্থিব ও বস্তু,এ এমনই অমূল্য সম্পদ। দুজনে দুজনের পরশে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরতেন,কথা বেশি হতো না,যা হতো তা পরশে, যত না বলা কথা হয়ে যেত বলা। ছেড়ে থাকা যখন অসম্ভব হয়ে উঠল তখন ওরা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অমিতা ব্রাহ্মণের মেয়ে আর তপনবাবু ঘোষ,শুদ্র,বাড়ি থেকে প্রবল আপত্তি শুদ্রের ঘরে মেয়ে দিতে। সামাজিক অনুশাসনে তখন ভালোবাসার উর্ধে ছিল জাতি-ধর্ম। তপনবাবুর বাড়িতে যদিও আপত্তি ছিল না কোনো,আর আপত্তি করবেই বা কে, ছিলেন তো এক বুড়ি মা,তিনি সুন্দরী বৌমাকে বুকে জড়িয়ে ঘরে তুলেছিলেন। তপনবাবু তখন বেকার,মানে মানে কেবল টিউশনি ভরসা,কোনো স্থায়ী চাকরি তাঁর হয়নি তখনও। কত কষ্ট করে থেকেছেন স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে অমিতা তাঁর বাড়িতে। সেই তিল থেকে তাল করে সংসারটাকে নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন অমিতা। বাড়িকে গৃহমন্দির করে গড়ে তুলেছেন তিনি। এই গৃহমন্দিরে সর্বদা সুখ বিরাজ করছে এযাবৎ। তপনবাবু ভোলেননি তাঁর স্ত্রী অমিতা তাঁর পাশে থেকে কষ্ট সহ্য করেছিলেন বলেই তিনি একজন সফল মানুষ হতে পেরেছিলেন। আর তাই স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল শ্রদ্ধামিশ্রিত। কোনোদিনই কিছুই তাঁর অদেয় ছিল না অমিতাকে,যদিও অমিতা কখনও মুখ ফুটে কোনো কিছুই চান নি বা ভালোবাসার অধিকার দাবি করেননি। তপনবাবু ভালোবেসে তাঁকে যা দিয়েছেন তাতেই খুশি থেকেছেন। এই সংসারটাই ছিল তাঁর প্রাণ,যেটুকু যা চেয়েছেন সংসারের প্রয়োজনে,নিজের শখপূরণের জন্য নয়। তাই বলে তপনবাবুও হাত গুটিয়ে থাকেননি যখন যেমন সাধ্য হয়েছে তেমন উপহার অমিতার হাতে তুলে দিয়ে তাঁর হাসিমুখটা দেখতে ভালোবাসতেন তিনি। উপহার পেয়ে অমিতার যত খুশি হতেন তপনবাবু বোধহয় তার থেকেও বেশি খুশি হতেন। প্রথম জীবনে যখন সংসারে আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খেতেন তিনি তখন বিশেষ দিনে একটা গোলাপ তার হাতে দিতে ভোলেননি, কখনও বা বেলফুলের মালা এনে তাঁর খোঁপায় জড়িয়ে দিয়েছেন। ফুলের মতোই মিষ্টিমধুর সম্পর্কটা তাতে দিনে দিনে সতেজ হয়েছে। আর স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে অভাবের সঙ্গে কাল কাটানোর কালেও কখনও কোনো বিরূপ মনোভাব পোষণ করেননি তপনবাবুর প্রতি। দুজনের ভালোবাসা ছিল দুজনের প্রতি শ্রদ্ধামিশ্রিত আর তাই সে ভালোবাসা দিনে দিনে গভীরতা পেয়েছে। ভালোবাসা প্রকৃতঅর্থেই পূর্ণতা পেয়েছে তাদের মাঝে। বয়স,কাজের চাপ, সংসার এই নিয়ে যে প্রেম সুপ্ত হয়েছিল দুজনের মনের গভীরে,প্রকাশ পাবার সুযোগ পায়নি তা আজ হঠাৎ এসে তপনবাবুকে অধীর করে তুলেছে। সেই ভালোবাসার সুরভী তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন তার পরমপ্রিয় প্রেমাস্পদকে,তাঁর জীবনজুড়ে আছেন যিনি,তাঁর ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে রানি হয়ে বসে আছেন যিনি,সেই অমিতাকে।

     এই অবেলায় যখন দুজনে দুজনের সান্নিধ্য উপভোগ করছেন, বাইরে কু কু করে বসন্তের প্রথম পিকোধ্বনি যেন সঙ্গত করল তাদের গভীর আলিঙ্গনকে,দুজনে দুজনের চোখে চোখ রেখে মৃদু হাসলেন,তপনবাবু আরও দৃঢ করলেন বন্ধন। এভাবে কিছুকাল কাটলো। দুজনেই মধুর আবেশে আচ্ছন্ন। মোহভঙ্গ হল ডোরবেল বাজলে। আর্য এল স্কুল থেকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy