অগ্নিস্নাতা ৫
অগ্নিস্নাতা ৫
আজ কাশীনগরে সয়ম্বর সভার আয়োজন করা হয়েছে।চারিদিকে তাই সাজো সাজো রব,রাজ অন্তপুরে যেমন ব্যাস্ততা তুঙ্গে তেমনি নগরের রাজ পথেও আজ দলে দলে নগরবাসী রাজপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে চলেছে । রাজপ্রাসাদের মূল দরজা আজ সাধারণের জন্যে উন্মুক্ত । কাশীরাজ যেমন অতিথি রাজা রাজকুমারগণের আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখেন নি সকল সুযোগ সুবিধার ব্যাবস্হা করেছেন।তেমনি নগরের সাধারণ মানুষের ভোজনের ব্যাবস্হাও আজ রাজভবনে করা হয়েছে।আজ নগরবাসীও নিমন্ত্রিত।
রাজকুমারীদের সয়ম্বর দেখার উদ্দেশ্য তাই উৎসাহিত জনগণ একে একে এসে উপস্থিত হচ্ছে রাজপ্রাসাদে।তবে প্রায় বেশীর ভাগ মহিলা,যুবতীরা জ্যেষ্ঠা রাজকুমারীকে আজ নববধূর সাজে দেখার জন্যে বেশী উৎসুক।কারন নগরবাসী রাজকুমারী অম্বাকে বেশীর ভাগ সময়ই স্বল্প অলঙ্কারে সজ্জিত দেখেছে। অম্বা যখন বের হতেন তখন তাকে তীরধনুক নিয়ে অশ্বে উপবিষ্টা অবস্থায় দেখা যেতো এবং তখন তার সঙ্গী ছিল সেনাপতি পুত্রী চিত্রলেখা।মহাদেবের মন্দিরে গমন কালেও রাজকুমারী রাজ বস্ত্র পরিধান করলেও স্বল্প অলঙ্কারে সজ্জিত হতেন।যখন রাজকুমারীর সহোদরারা সৌন্দর্য বর্ধনক নানা উপাদান সামগ্রী মুখমন্ডল সহ গাত্রে লেপন করে অঙ্গশোভা বর্ধনে নিজেদের ব্যাস্ত রাখতেন তখন রাজকুমারী অম্বা নির্ধারিত লক্ষ্য তীর বিদ্ধ করার অভ্যাস করতেন।অস্ত্রশিক্ষায় পারদর্শী হয়ে ওঠা ছিল রাজকুমারী অম্বার অন্যতম উদ্দেশ্য,তাই চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না।
সকাল থেকে রূপবতী রাজকুমারীদের সৌন্দর্য আরো বর্ধিত করার জন্যে সবাই রত।আজ রাজকুমারীরা রত্ন খচিত বস্ত্র পরিধান করেছে।রাজকুমারী অম্বা, অম্বিকা,অম্বালিকা আজ নতুন রূপে নিজেদের সাজাতে ব্যাস্ত। সুগন্ধি পুষ্প দ্বারা গাঁথা মালা ধারন করে তাদের কেশরাশির শোভা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।রাজকুমারীরা নানা অলঙ্কারে সজ্জিত হয়েছে ।বাদ যায়নি রাজকুমারী অম্বাও,আজ সে নিজেকে সাজিয়েছে ______
সাজ শেষে অম্বা এসে দাঁড়ায় সুবিশাল দর্পণের সামনে।নিজের হাতে যবনিকার পর্দা উন্মোচন করতেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় ।দর্পনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে__
এভাবে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে খেয়াল নেই।তারপর কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে রাজকুমারী অম্বা চিন্তার জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসেন।
রাজকুমারী অম্বা দেখে তার প্রিয় সখি চিত্রলেখা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
চিত্রলেখা নিজের চোখের থেকে একটু কাজল নিয়ে লাগিয়ে দেয় অম্বাকে।তারপর ধীর কন্ঠে বলে সখি তোমার ভগিনীদের থেকে আজকে তুমি অনেক বেশি সুন্দর। শাল্বরাজের দৃষ্টি আজ তোমার থেকে সরবে না।এইভাবে বার্তালাপে সময় অতিবাহিত হতে থাকলো।অবশেষে সেই সময় এসে উপস্থিত হলো। রাজকুমারীরা সয়ম্বর সভায় দিকে প্রস্থান করলেন।
রাজকুমারীরা যখনই সভায় এসে যখন উপস্থিত হলেন তখন দেখলেন সেখানে রত্নখচিত সিংহাসন কাশীরাজ উপবিষ্ট।তার পাশেই তিনটি রৌপ্যনির্মিত আসন সেখানে রাজকুমারীরা উপবিষ্টা হবে ।অন্যান্য আসনগুলো অলঙ্কৃত করছ মহারাজা, রাজকুমারেরা উপবিষ্ট রয়েছেন।রাজকুমারীরা পিতা মহারাজকে প্রনাম করে নিজ নিজ স্থানে উপবিষ্ট হলেন।তাদের পাশেই স্বর্ণ থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন দাসী।এরপর পরিচয় পর্বের সূচনা হয়।সকল রাজা রাজকুমাররা আত্মপরিচয় দিতে ব্যাস্ত, রাজকুমারীদের হৃদয় জয় করার প্রচেষ্টায় রত।এসবের মাঝেই অম্বার দৃষ্টি বারংবার চলে যাচ্ছিল শাল্বরাজের দিকে। ওদের দৃষ্টি বিনিময় হতে থাকলো।এখন বরমালা পড়ানো শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।কিন্তু আজও
অম্বার হৃদয় এতো চঞ্চল কেন?প্রিয় মিলনের আশায় তিনি কি উদগ্রীব!তবে কেন তার বামেতর নয়ন বারংবার কম্পিত হচ্ছে?এমন কিছু কি ঘটতে চলেছে যা কালের নিয়মে ঘটবে।এক অজানা আশংকায় অম্বার চিত্ত বিহ্বল হয়ে উঠেছে!
কেন মনে হচ্ছে বিশাল ঝড় আসতে চলেছে যা সব কিছুকে ওলোট পালোট করে দেবে।
হঠাৎ রাজসভাগৃহের বাইরে হ্রেসা ধ্বনি শোনা গেল
তারপর সহসা সেই অনাপ্রেক্ষিত ঘটনা ঘটে।ঘোষিত হয় শান্তনু পুত্র মহাপরাক্রমশালী অপরাজেয় শ্রেষ্ঠ ধনু্র্ধর গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম সভাগৃহে উপস্থিত হচ্ছেন।রক্ষীরা সরে দাঁড়াল ।শ্বেতশুভ্র বস্ত্র পরিহিত বর্ম সহ যুদ্ধের জন্যে প্রয়োজনীয় সজ্জায় সজ্জিত ধনু্র্বান নিয়ে গঙ্গাপুত্র যখন সভায় এলেন তখন সভাগৃহে সকল রাজার মুখে অমাবস্যার কালো মেঘ সদৃশ হলো।তবে ইনি বরাবেসে কেন? এই প্রশ্ন তখন সকলের মনে মুখে। তিনি উপস্থিত হওয়া মাত্রই আমন্ত্রিত নৃপতিগনের নিকট থেকে নানা অপমান মূলক মন্তব্যের শরঘাত তাকে বিদ্ধ করতে থাকে।
কেউ কেউ বলেন ভীষ্ম ব্রহ্মচারী হওয়ার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছেন।কাশী রাজকুমারীদের রূপে মোহিত হয়ে তিনি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।নিজের আয়ুর বিষয়ে চিন্তা করে নি।এই প্রায় বৃদ্ধ হতে চলেছেন, যুবকাবস্হা তো অনেক আগেই পার করে এসেছেন।তবে ওনার ব্রহ্মচারী প্রতিজ্ঞার কি হবে? কেউ আবার বলে এই রাজকুমারীরা এটাই সুন্দরী যে ঋষিদের পক্ষেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য ।সেখানে এই ভীষ্ম একজন রাজকুমার তারপক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা ____এই কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে এক রাজা বলেন উনি বোধহয় পিতার মৃত্যুর অপেক্ষায় ছিলেন।
প্রথমে তিনি নীরবে সেইসব কুকথা শুনলেও ওনার ধৈর্য্য বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না।তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন।কিন্তু অপমান যখন করুবংশকে নিয়ে করা হয় গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম সবাইকে সাবধান করেন।
কিন্তু রাজকুমারী অম্বার কর্ণে এসব কথা ঢুকছে না।অম্বা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে শান্তনু পুত্র মহাপরাক্রমশালী অপরাজেয় শ্রেষ্ঠ ধনু্র্ধর গঙ্গাপুত্র ভীষ্মের দিকে।গুরুর কাছে অস্ত্র শিক্ষা কালে সামনে দন্ডায়মান এই সর্বশ্রেষ্ঠ বীর ভীষ্মর কথা কতবার শুনেছে,হিসাব নেই।অম্বাঅনেক বার কল্পনায় তাকে দেখেছে।কিন্তু তাকেই চাক্ষুস করছে এই প্রথম। আজ সভাগৃহে যে এতো রাজা লোকজনের সমাগম রয়েছে তা অম্বা ভুলে গেছে।পুরানো একটা স্বপ্ন না কল্পনার অম্বার চোখের সামনে আবার ভেসে ওঠে।এই পোশাক পরিহিত রাজাকেই তো অম্বা প্রায়ই স্বপ্নে দেখত।কিন্তু মুখটা দেখতে পেত না ।শাল্ব রাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ার পর এটা যে কেবল স্বপ্ন ছিল তা মনে হতো।এদিকে সভাগৃহে কি ঘটছে তার খেয়াল অম্বার নেই,রাজকুমারী কল্পনার জাল বুনে চলেছে।
কাশীরাজ বলেন শান্তনুপুত্র আপনি এখানে আমন্ত্রিত নন।তবে এখানে কেন এসেছেন?
ভীষ্ম তখন দৃঢ় অথচ সংযোত কন্ঠে বলেন আমি এখানে আমন্ত্রিত নই তাই এখানে আপনার অতিথি দ্বারা আমাকে করা অপমানের উত্তর আমি দেয় নি,কারন সেখানে আপনার অপমান।তবে রাজন রাজকুমারীদের সয়ম্বর করে আপনি ঠিক করেন নি।এই রাজকুমারীরা হস্তিনাপুরের রাজরানী হবে তা নির্ধারিত।আমি বিবাহের এক নিয়ম হরণ সেই পদ্ধতিতে আমার ভাই বিচিত্রবির্যের জন্য রাজকুমিরদের নিয়ে যাচ্ছি।আমি বর প্রার্থী না করেমি কেবল প্রতিনিধিত্ব করছি।
শাল্ব রাজ বলেন বর নির্বাচন করার অধীকার রাজকুমারীদের রয়েছে।এভাবে আপনি বাধা দিতে পারেন না।আপনার জিহ্বায় লাগাম দিন।
ভীষ্ম বলেন শাল্ব রাজ আমি যদি আপনার জীবন না দান করতাম আজ আপনি জীবিত থাকতে পারতেন না।আর আমার লাগম জিহ্বায় নয় আমি অশ্বে কেবল লাগাম টানি।আমি রাজকুমারীদের নিয়ে যাবো।কারো আপত্তি থাকলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন।
সভায় উপস্থিত সকল রাজারা আক্রমণে উদ্যত হলে ভীষ্ম তৎক্ষণাৎ প্রথম বানে তাদের অস্ত্র ও দ্বিতীয় বানে মস্তকমুকুট মাটিতে পতিত করে এবং ঘোষিত করে এখানে আমি ব্যাতীত কারো নেই।
এরপর কাশীরাজ আর আপত্তি করতে পারলেন না।কন্যাদের আদেশ দিলেন।আবিষ্ট অম্বার এতক্ষণে চেতনা ভঙ্গ হলো।বান,মুকুট পতন সকল রাজাদের মুখমন্ডল প্রত্যক্ষ করে ঘটনা অনুমান করলেন।অম্বার নেত্র অশ্রুতে পরিপূর্ণ হলো।নিজের ভালোবাসাকে এভাবে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না।কিন্তু যুদ্ধে ভীষ্মের সঙ্গে অম্বা পারবে না।তেমনি ভীষ্মের মতের বিপক্ষে গেলে কাশীরাজ্য অসুরক্ষিত হয়ে পড়বে ।তাই পিতামহারাজ ওনার সঙ্গে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।পিতামহারাজের অসহায় দৃষ্টি অম্বার চোখে ধরা পড়লো।কাশীকে জড়াসন্ধের মতো অত্যাচারীর হাত থেকে হস্তিনাপুরের রক্ষক গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম রক্ষা করেন।ভীষ্ম বিমুখ হয়ে গেল কাশীরাজ্যের বিপদ। অম্বা প্রথমে একজন রাজকুমারী তাই আগে রাজ কর্তব্য পরে তার ভালোবাসা। কিন্তু কাকে ভালোবাসে অম্বা?সেই শ্বেতবস্ত্র পরিহিত সুপুরুষ তো দেবব্রত শাল্বরাজ তো নয়।তবে সৌভাধিপতি শল্যকে অম্বা যে ভালোবাসে ! ওদের এতোদিনে প্রণয়ের সম্পর্ক।এরমধ্যেই ওরা তিন ভগ্নি রথের কাছে চলে এসেছে ।ওরা রথে চড়ল।এবার রথ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে,কিন্তু একটা তীর এসে অশ্বের পদতলে সমুখে পতিত হলো।ভীত অশ্ব তার গতি শ্লথ করল।