Rima Goswami

Horror Crime Thriller

3.3  

Rima Goswami

Horror Crime Thriller

আতঙ্কের দ্রাঘিমা ভৌতিক গল্প

আতঙ্কের দ্রাঘিমা ভৌতিক গল্প

42 mins
307


আবির আর চিত্রার হানিমুনটা আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল । তাই বিয়ের পর কোনমতে আবিরের মা জয়ীতার জোরাজুরিতে অষ্টমঙ্গলাটা করেই ওরা দুজন ছুট দেয় রাজার দেশ রাজস্থানের দিকে । রাজস্থানের বিভিন্ন স্থান এলেবেলে ভাবে ঘুরবে তারপর ফিরে আসবে ওরা কলকাতা এটাই প্ল্যান ছিল । চিত্রা নামটা আপাদমস্তক বাঙালি হলেও সে জন্মসূত্রে একজন পোলিস । ওর আসল নাম মার্থা । আবির আগের বছর বেড়াতে যায় পোল্যান্ড তার দিদি অতসীর কাছে । অতসী ওর স্বামী সমীর চাকরি সূত্রে পোল্যান্ড গেছে কয়েক বছর আগে। আবিরের পোল্যান্ড যাবার পরই আলাপ হয় দিদির প্রতিবেশী মার্থার সাথে । সহজ সরল মার্থাকে ভালো লেগে যায় ব্যবসায়ী আবিরের । তারপর জাঁদরেল মা জয়ীতার সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করে , গ্যাটের অনেক টাকা বারবার পোল্যান্ড যাওয়া আসায় খরচা করে শেষে আবির সফল হয় মার্থাকে পেতে । মার্থা হতে পারে বিদেশি কিন্তু একদম চুলবুলি বাবলি টাইপের সোজা মেয়ে । কোনরোকমের কেতা নেই ওর মধ্যে । আবিরকে পেয়ে ও খুব খুশি । তাই আবিরের মায়ের ইচ্ছায় নিজের নামটা পর্যন্ত পাল্টে ফেলেছে । মার্থা পরিচিত হয়েছে চিত্রা নামে । যদিও নামটা নাকি ওর ভারী পছন্দ হয়েছে । চিত্রা পোল্যান্ডে একাই থাকত ওর কেউই নেই , জ্ঞান হয়ে থেকেই ও অনাথ । একটা অর্ফ্যানে বড় হয়ে ওঠা মার্থা ওরফে চিত্রাকে আবিরের সাথে বিয়ে ফাইনাল হওয়ার পর আবিরের দিদি অতসীর কাছে বাঙালি কালচার বা ভাষা সব কিছু শিখতে হয়েছে । যদিও বাংলা ভাষা চিত্রা এখন খুব ভালো বোঝে কিন্তু বলতে একটু ডিফিকাল্ট লাগে । আর লিখতে তো একদমই পারে না ।


বিয়ের ঠিক একমাস আগেই অতসী ওর হাসবেন্ড সমীর চলে আসে কলকাতা সঙ্গে পাত্রী চিত্রা । আবির চিত্রাকে কলকাতা আসার পর থেকেই বহু জায়গা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়েছে । তারপর বই পোকা চিত্রাকে আবির সোনার কেল্লা উপন্যাসটির ইংরেজি ভার্সন এনে দিলে সেটা পড়ার মাত্র চিত্রা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে ওরা হানিমুন করতে ওখানেই যাবে । আবির ও রাজি হয়ে যায় কারণ জয়সলমির জেলার নামটার সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হলেও ও নিজেও যায়নি কোনদিন রাজস্থান। আবিরের মা কোনদিন ভাবেননি একমাত্র ছেলের এভাবে অন্য কোন দেশের মেয়ের সাথে বিয়ে হবে । আবিরের বড় প্রমোটারীর ব্যবসা । মোটের উপর ওকে এলিজেবল ব্যাচেলর বলাই যায় । জয়ীতা মানে আবিরের মা একটা শঙ্কা নিয়েই ছেলের ধুমধাম করে বিয়ে দেন প্রবাসী চিত্রার সাথে । আত্মীয় স্বজনেরা কেউ কেউ বললো বৌমা ভালো হয়েছে , আবার কেউ কেউ মুখ টিপে হেসে সমালোচনা করেছে । মন খারাপ গুলো বুকে চেপে জয়ীতা ছেলের মন রেখেছে । আবির যদি সব ছেড়েছুড়ে চলে যেত মেয়েটার কাছে ! তাহলে জয়ীতার দুই সন্তান অতসী আর আবির দুজনেই প্রবাসী হয়ে যেত । এই এতবড় বাড়ি , সম্পত্তি কে ভোগ করত ? শান্তনু জয়ীতার স্বামী হার্টের পেশেন্ট । ওর জন্য ও চিন্তা থাকে । তাই বেশি অশান্তিতে যায়নি জয়ীতা , না হলে বিনা যুদ্ধে কোনদিন সুচাগ্র মেদিনী কাউকে ছাড়েনি জয়ীতা রক্ষিত ।


চিত্রা আর আবির প্রথমে যায় জয়পুর সেখান থেকে উদয়পুর হয়ে চিত্তোর । চিত্তর থেকে অনেক দূরে,রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে, থর মরুভূমির কোল ঘেঁষা জয়সলমিরে হলুদ বালু পাথরে তৈরি সোনার কেল্লার দেশে যখন ওরা রওনা তখনো ওরা জানত না যে কি ভয়াবহতা ওদের জন্য অপেক্ষমান । চিত্তর থেকে যোধপুর বা বিকানের না গিয়ে ওরা সোজা জয়সলমিরের রাস্তা ধরে কারণটা চিত্রার সোনার কেল্লা যাবার ব্যাকুলতা ৷ প্রায় তিনশো কিলোমিটার পথ, রাস্তা খুব ভাল। তাই গাড়িতে ছয়-সাড়ে ছয় ঘণ্টার বেশি লাগেনি৷ ওরা যাযাবরের মত ঘুরছে কোন প্ল্যান বা টুরিস্ট গাইড ছাড়াই । দুজনে যেখানেই যাচ্ছে সেখানকার সার্কিট হাউসেই থাকছে । রাজস্থানের সব সার্কিট হাউসই বেশ রাজকীয়। তার মধ্যেও সোনার পাথরে সূক্ষ্ণ কারুকার্য করা জয়সলমিরের সার্কিট হাউসটা দেখার মতো৷ চিত্রার নজর নতুন এই অভিনব রাজকীয় স্থান দেখতে কিন্তু আবিরের মন পরে আছে পোল্যান্ড গার্লের শরীরের বিভাজিকাতে ।


আবির যত চায় চিত্রাকে একটু নিভৃতে নিজের মতো করে পেতে ততই চিত্রা ব্যস্ত হয়ে পড়ে বেড়াতে । জয়সলমির পৌঁছে ওরা প্রথমে চলে যায় পশ্চিমে, পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে সম্ নামের একটি ছোট গ্রামে ৷ সেখানে প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে বহু যুগ ধরে বালি জমে জমে এখন পাহাড়ের আকার নিয়েছে, তার চূড়ায় সূর্য্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখে চিত্রা আবিরকে হাজার বার ধন্যবাদ জানায় এত সুন্দর একটা অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ৷ চিত্রা বায়না করে বালির পাহাড়ে ওঠার জন্য কিন্তু সেই বালির পাহাড়ে চড়া মানুষের সাধ্যাতীত । জিপও সাঁ করে কয়েকশো ফুট উঠে যায়, তার পর উপর থেকে সোজা নীচে ঝাঁপ মারে৷ নীচে বালি থাকায় গাড়ি ও আরোহীরা অক্ষত থাকে, কিন্তু ঝাঁকুনিতে মনে হয় জীবন বিপন্ন হয়ে গেছে । আবির রিস্ক নেয়না কিন্তু পোলিস গার্ল চিত্রা আনন্দ উপভোগ করে । সব কষ্ট ওর তুচ্ছ মনে হয় যখন চোখের সামনে আদিগন্ত হলুদ বালুর সমুদ্রের মধ্যে সারাদিনের কর্মক্লান্তির পর দিনমণি রক্তবর্ণ ধারণ করে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে শুরু করে । আবির তারা লাগায় ওদের ফিরতে হবে আশ্রয়ে । চিত্রা আর আবির রওনা দেয় সার্কিট হাউসের দিকে পথে খানিকক্ষণ আলো-ছায়া মেলানো একটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তার পর অন্ধকার যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে । স্থানীয় একটি ছেলের সঙ্গে ওরা যায় বানজারা প্রোগ্রাম দেখতে । 


রাজস্থান ট্যুরিজম অতিথিদের জন্য ওই বালির ধারে তাঁবুখাটিয়ে লোকনৃত্য ও লোকগীতি সমেত নৈশাহারের আয়োজন করে । চিত্রা ও জয়েন করে রাজস্থানের নৃত্যশিল্পীদের সাথে । সেখানে কয়েক পাত্র মদ সেবন করে আবির অপেক্ষা করে কখন তার প্রিয়তমা ফিরতে রাজি হবে । কয়েক ঘন্টা পর মাথার উপরে হাজার হাজার ঝলমলে তারা আর দু’দিকে অজস্র জোনাকির ঝিকমিক দেখতে দেখতে দুজনে সার্কিট হাউসে মেতে ওঠে মধুচন্দ্রিমার মায়াবী রাতে । ওরা কেউ নোটিস করেনা একটা কালো ছায়া সর্বদা তাদের ফলো করে যাচ্ছে । 


সার্কিট হাউসে পৌঁছে চিত্রা একটা বাথ নিতে বাথরুমে ঢুকে যায় । এদিকে উশখুশ করে যাচ্ছে আবির । এত অপেক্ষা সইছে না দুজনের । চিত্রাকে হাঁক লাগায় আবির আর কতক্ষন লাগবে । চিত্রা বলে টেন মিনিটে ও রেডি হয়ে যাবে । আবির রেগে যায় ও বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে চেঁচায় ... হোয়াট? তুমি এখনো দশ মিনিট নেবে ? এত দায়িত্বজ্ঞানহীন কি করে হতে পারে তুমি? পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমায় আমি যদি না দেখি তাহলে আজকেই হানিমুন শেষ । আই এম সরি আবির যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি স্নান সেরে আসছি বেবি । 

গো টু হেল .. বলে বারান্দার দিকে চলে যায় আবির । চিত্রার অভ্যাস রাতে স্নান সেরে ঘুমাতে যাবার । বিদেশি হওয়ায় তার অভ্যাসের সাথে আবিরের বিস্তর ফারাক । বাথরুম থেকে নাইট ড্রেসে বেরিয়ে এসেই চিত্রা আবিরকে হাঁক দেয় । আবির এসে বসে বিছানায় । চিত্রা মন দিয়ে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে প্রসাধন করে । আর সেইসব এতক্ষণ মন দিয়ে আবির দেখছিল।


আবির চিত্রাকে রাগাতে বলে , আর না ক্রিম স্নো না মাখলেও চলবে হানি । এমনিতেই তুমি সুন্দরী । তোমাকে পেতে তো কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি আমায় । আমার মা জানো তো কত রাগী । এবার এই অধমের কাছে একটু এসে করুণা করো । চিত্রা মুচকি হেসে এগিয়ে আসে আর আবিরকে জাপটে ধরে .

.. 

চিত্রা বলে , তোমার মত হ্যান্ডসাম,ড্যাশিং, ডেম সেক্সি, ইয়ং ম্যানই তো আমার স্বপ্নে আসতো । ইন্ডিয়ান ছেলেকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে । সাধারণ প্যানপেনে গায়ে পরা ছেলে যে আমার পছন্দ নয় মিস্টার হাসবেন্ড । 

আবির চিত্রার মুখটা হাত দিয়ে বন্ধ করে দেয় । ওর ঠোট দুটো ঘুরে বেড়ায় চিত্রার কাঁধ জুড়ে । আবির নেশাগ্রস্তর মত বলে ,  আই ওয়ান্ট প্লেজার ফ্রম ইউ এনি কস্ট, বাই হুক অর ক্রুক। বিয়ে না করলে পেতাম কি করে ...ঠোঁটের কোনায় একটা বাঁকা হাসি রেখা ফুটিয়ে মনে মনে বলল আবির।


রাজার দেশ রাজস্থানের সার্কিট হাউসের পেলব বিছানায় দুটি যৌবনময় শরীর । একে অপরের সঙ্গে তারা ব্যস্ত আদিম ক্রিয়ায় । রাতভর ভালোবাসা বাসি করে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে । মাঝরাতের দিকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই চিত্রার মনে হয় কেউ যেন ঠিক মাথার উপরের দিকে ওকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেই যাচ্ছে । তার প্রখর দৃষ্টি যেন ভেদ করে যাচ্ছে চিত্রার সমস্ত সত্বাকে । চিত্রা অনুভব করে কিছু অন্যরকম , কিছু অপার্থিব ওর ঘাড়ের উপরে নিঃস্বাস নিচ্ছে । কিন্তু ও চেয়েও চোখ খুলতে পারে না । ঘুমের একটা ঘোর যেন ঘিরে ফেলেছে ওকে । 


সকালে ঘুম ভেঙে একটা মানসিক খচখচানি থাকলেও ও এর আবিরকে কিছু বলে না । আবির ব্যাপারটা কেমন ভাবে নেবে সেটাও জানে না চিত্রা । ওরা ব্রেকফাস্ট করেই রওনা দেয় সোনার কেল্লার দিকে । হতাশ করল কিন্তু সোনার কেল্লার এখনকার অবস্থা৷ যেটা দেখতে এখানে আসা , যেটার প্রতি একটা অদৃশ্য মোহ চিত্রা অনুভব করছে তার প্রবেশ দ্বারের সামনেই একদল দালাল অথবা গাইড, যেভাবে ওদের আক্রমণ করল তাতে আবিরের মনে হলো তীর্থক্ষেত্রের পান্ডাদের কথা ৷ কেল্লা ঘুরতে ঘুরতে আবির অবাক হলো দেখে দুর্গের ভেতরে এখনও অনেকগুলি পরিবার বাসা বেঁধে আছে, যার ফলে এক বিচিত্র পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে৷ আবিরের কোন আন্দাজ ছিল না সোনার কেল্লার ভিতরে মানুষ রেগুলারলি বসবাস করতে পারে । চিত্রা গাইড মারফত জানতে পারে এদের পূর্বপুরুষ দুর্গাধিপতির অনুচর ছিলেন এবং সেই অধিকারে তাঁদের পরিবার দুর্গের গোড়াপত্তন থেকেই সেখানে থাকে৷ গুটিদশেক পরিবার থেকে বাড়তে বাড়তেএখন প্রায় হাজার দশেক মানুষ বাস করে৷ এরা নিজেদের উত্তরাধিকারীত্বের দাবি ছাড়তে নারাজ। কিন্তু, এত লোকের চাপে দুর্গের পরিকাঠামো ভেঙ্গে পড়ছে। ওরা কেল্লার ভিতরের রাজকীয় স্টাইলের রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ করে । ওখানকার হস্তশিল্প হাটে কেনাকাটা করে চিত্রা । কিছু পুতুল , চলি , সাইড ব্যাগ , মুখোশ কিনে নেয় চিত্রা । যদিও আবির মানা করে এসব কিছু কিনতে কারণ ওর মা জয়ীতা খুব চুজি । উনি একদম এসব চিপ জিনিসপত্র পছন্দ করবেন না । চিত্রা বলে , এখানকার এই গরীব মানুষ গুলো এই জিনিসপত্র বিক্রি করেই পেট চালায় তাই সকল টুরিস্টদের কিছু কিছু কেনা উচিত । এতে ওদের সাহায্য করা হবে । আবির আর বাধা দেয় না । এদেশের কালচার সমন্ধে চিত্রার স্বচ্ছ ধারণা নেই । তো এখন ও যেটা করছে করুক । আবিরের মা ঠিক শিখিয়ে নেবেন বউকে । 


সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে জয়ীতা রক্ষিত । বিয়ের শেষে মেয়ে অতসী চলে গেছে পোল্যান্ড । মার্থা ওরফে চিত্রা তো পোল্যান্ড এর মেয়ে । এদেশে তো সে আগে কোনদিন আসেনি । তবে কেন জোতিষী বৌভাতের রাতে নববধুকে দেখে বললেন এই মেয়েই জয়ীতার কাল হয়ে ফিরে এসেছে ! আজ সন্ধ্যের ঘটনাটা তার মধ্যে ভয়ের অনুভূতির ই সৃষ্টি করেছে। ছেলে বউ মধুচন্দ্রিমা পালনে সেই রাজস্থানেই গেল । জয়ীতা একবার মানা করে বলেছিল সিঙ্গাপুর যেতে । তারপর চিত্রার আগ্রহ দেখে জয়ীতা আর মানা করেনি । তাছাড়া জায়সেলমেরের সেই দিন গুলো এখন তো অতীত।  জয়ীতার পুনর্জন্ম মনে আছে । সেতো অনেক কাল আগের কথা । এখন কি আর বিপদ হতে পারে । সেটা ভেবেই জয়ীতা বাধা দেয়নি । আজ সন্ধ্যায় ছেলের বেডরুমে একবার গিয়েছিল জয়ীতা । বিয়ের গিফ্ট গুলো একদিকে রেখে আসতে বলেছিল কাজের লোককে । সেটা হয়েছে কিনা দেখতে গিয়ে হঠাৎ আবির আর চিত্রার বিশাল ছবিটা যেটা অতসী ওদের গিফট করেছে ... হ্যাঁ ওটার দিকে চোখ পড়তেই  মনটা কুডেকে উঠেছিল । ছবিতে চিত্রার চোখে আজ যেন কিছু একটা ছিল। চিত্রার মধ্যেই আগের জন্মের কুকর্মকে দেখতে পেয়ে গেছে আজ জয়ীতা । সেই মুখ , সেই চিন্হ .. আগে কেন লক্ষ করেনি ও ? যেচে বিপদ ডেকে আনলো তবে জয়ীতা । অতসীই চিত্রার রাজস্থানে হানিমুন যাবার আগ্রহ দেখে দেওয়ালে টাঙানো এই ছবিতে আবিরের আর চিত্রার ছবিটা এডিট করে রাজস্থানী বর বধূর রূপ দিয়ে তৈরি করিয়েছে । জয়ীতার দেখা হয়নি ব্যস্ততাতে । এখন এই ছবিতে রাজবারা বধূ রূপে চিত্রাকে দেখে জোতিষীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। এখন কি করবে জয়ীতা ?  চিত্রা বিদেশিনী বলে বোঝা যায়নি ওই মায়া .. জয়ীতার পরম শত্রু মায়া । এখন রাজস্থানে গিয়ে কি ওর মনে পড়ে যাবে আগের জন্মের কথা ? ও কি জয়ীতাকে চিনে নেবে তাহলে ? সোফায় বসে নানান রকমের চিন্তা করে ওর সারা শরীরে জ্বালা ধরছে, আর এই জ্বালা একটা জিনিস ই কিছুটা হলেও মেটাতে পারে, আর সেটা হলো একটা পুরুষ শরীর। তার নিজের স্বামীর দ্বারা যে সেটা পূর্ণতা পাবেনা সেটা সে জানে। বয়সে অনেক বড়ো একজন লোককে বিয়ে করার আসল কারণটা যে শুধু অর্থ, আর ক্ষমতা সেটা তার চেয়ে ভালো আর কেই বা জানে । আর তাই জন্যই তো এই বিশেষ জায়গায় আশা, বিশেষ কিছু পাওয়ার লোভে। লোভ জন্ম জন্মান্তর ধরেই জয়ীতার সঙ্গী । শরীর ত্যাগ করলেও আত্মা লোভ ত্যাগ করতে পারেনি । এবার কথা হলো আতঙ্ক কি ছেলের বউয়ের নাম নিয়ে ফিরে এলো জয়ীতার সাথে বদলা নিতে । 


জয়ীতার ভালো লাগে শান্তনুর অসুস্থতার সুযোগে বাড়িতে জিগালো ডেকে এনজয় করতে । আর সেটা কেবলমাত্র শারীরিক সম্পর্ক করেই নয় । জিগালোকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে তাকে রীতিমতো শুষে নেয় জয়ীতা । সেটা কখনো জ্বলন্ত সিগারেটের ছেঁকা, কখনো কামড়ে আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করা .. জয়ীতার দেওয়া যন্ত্রণা পুরুষ শরীরে যে ছটপটানি, যে আর্তনাদের সৃষ্টি করে, সেটাই তার কাম কে শান্তি দেয় । ছেলে আবির সবটা না জানলেও বেশ কিছুটা জানে মায়ের রুচিবোধ সমন্ধে । আবির প্রোমোটর তাই হাজার দিন রাত করে বাড়ি ফেরে । ব্যস্ত থাকে খুব । সাধারণ আবির কিন্তু কোন মেয়েবাজিতে নেই । ও চতুর ব্যাবসায়ী হলেও কিন্তু ঢিলা ক্যারেকটার নয় মায়ের মত । মায়ের কদর্য দিকটা জেনেও আবির কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তিনি কিছু বলে উঠতে পারে না। আর বলবেনই বা কী করে, সব কিছু তো এখন মায়ের নামে। মা যদি ওকে ব্যবসা থেকে সরিয়ে দেয় ? বাবা শান্তনু রক্ষিত মাটির মানুষ । জীবনে একটাই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর সেটা হলো নিজের হাঁটুর বয়সের জয়ীতাকে বিয়ে করে ।  গরিব ঘরের সুন্দরী মেয়েকে তার কন্যাদায় গ্রস্থ পিতা শান্তনুর হাতে তুলে দিতে চাইলে শান্তনু আর না করতে পারেনি । সে তখন ভাবেনি নিজের থেকে এত ছোট মেয়েটাকে বিয়ে করলে আগামীকাল কি ফল ভোগ করতে হতে পারে।  যদিও জয়ী কোনরকম অযত্ন করেনা স্বামীর । শান্তনুকে ভালোবাসে জয়ী তবে কোথাও একটা অন্ধকার অতীত, কিছু ধোঁয়াটে মুহুর্ত, আর অনেক আঁকে হাহুতাশ লুকিয়ে আছে স্ত্রীর মধ্যে সেটাও অনুভব করতে পারে শান্তনু । জয়ীতার জন্ম বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় । তারপর ওর বাবা মা চলে আসে এদেশে । এখানে এসে হাওড়ার দিকে একটা ঝুপরিতে মাথা গুঁজে কোনমতে ছিল ওরা । জয়ীতার রূপ ছিল আগুনের মত আবার তার সাথে ব্যক্তিত্ব ও ছিল ভীষণ । বাপ মায়ে আলোচনা করত , এই গরীবের ঘরে এমন রানীর মত মেয়ে কি করে জন্ম নিল ? 

উত্তর পেয়েছিল জয়ীতা তখন ওর বয়স মাত্র ষোল । একরাতে ঘুমের মধ্যেই দেখেছিল নিজের জন্মান্তরের দৃশ্য । মরুভূমির দেশ .. বেলে পাথরের হাবেলি .. জৈন মন্দির .. আর সেই নির্মম হত্যা দৃশ্য । যে হত্যা কান্ডর মূল হোতা ছিল জয়ীতা নিজে । প্রথম দিকে ভয় লাগত তারপর ধীরে ধীরে ধোঁয়াশা সরে গিয়েছিল । মনে পড়ে গিয়েছিল ওর অতীত জীবনের কথা । তখন থেকেই একটা উদগ্র কামনা সৃষ্টি হয়েছিল ওকে আবার বড়লোক হতে হবে । আবার রানী হয়েই বাঁচতে হবে । মাথায় ঘুরপাক খেত ওই প্রেমিক জোড়ার শেষ কথা গুলো ... রানীসা জন্মান্তর ঘটবে .. ফিরবে সকল চরিত্র গুলো । ইতিহাস আবার নিজেকে ঘুরিয়ে দেখাবে । শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে সেটা এজন্মে না হলেও হয়ত আর জন্মে । 

জয়ীতার মধ্যে একটা ভয় কাজ করতে শুরু করে । আতঙ্কর যে দ্রাঘিমা সে এককালে রচনা করেছিল তা হয়ত এজন্মে তার দিকেই ধেয়ে আসছে । 

কালীঘাট মন্দিরে জয়ীতাকে দেখে শান্তনু । জয়ীতার বাবা হাতে পায়ে পরে যায় শান্তনুর । মেয়েকে এই পাত্রের হাতে তুলে দিলে যে মরেও শান্তি । এমন রানীর মত মেয়েকে বস্তিতে মানায় না ।শান্তনুকে বিয়ে করতে একবারের জন্য আপত্তি করেনি জয়ী । সে জানত চল্লিশের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো শান্তনু রক্ষিত বড়লোক । অর্থ প্রতিপত্তি কোনটার অভাব নেই । একা মানুষ শান্তনু । তাই বিয়েটা করেছিল জয়ী।  একে একে কোলে এসেছিল অতসী , আবির । ঝুপরি থেকে মা বাবাকে এনে রেখেছিল জয়ী । সব সুখে একটাই কাঁটা ছিল নিজের জন্মান্তরের সেই প্রতিশোধের ভয় । তখন থেকেই বড্ড তাবিজ , কবজ আর জোতিষীতে আস্থা জয়ীতার । তাবলে ও সত্যি ভাবেনি সারাটা জীবন ভালো করে কাটিয়ে শেষে এই একচল্লিস বছর বয়সে এসে তার সামনে হাজির হলো তার জন্মান্তরের শত্রু .. মায়া । 

মায়ার হয়ত কিছুই মনে নেই গত জন্মের কথা । এদেশে জন্ম ও নেয়নি সে । সে জন্ম নিয়েছে পোল্যান্ড এ মার্থা নাম নিয়ে । জয়ীতার এখন রাগ হচ্ছে আবিরের উপরে । এদেশে মেয়ে ছিল না ? যে বিদেশ থেকে মায়ের মৃত্যুকে ডেকে নিয়ে এলো সে । আর ঠিক এদেশে এসেই তার জয়সেলমের যাবার ইচ্ছা ও জাগল । এবার ওখানে গিয়ে যদি সব মনে পড়ে যায় মার্থা ওরফে চিত্রার । ও যদি বুঝে যায় ওই মায়া আর জয়ীতা রানীসা ? 

জয়ীতা ভেবেই নেয় আবির আর চিত্রা মধুচন্দ্রিমা থেকে ফিরলেই চিত্রাকে শেষ করে দিতে হবে । না না আগাছাকে বাড়তে দিলেই সে মহিরুহ হয়ে শেষ করে দেবে জয়ীতাকে । 

জয়ীতা আগের জন্মেও হারেনি আর এজন্মেও হারবে না । 

সমস্ত রাগ আজ জয়ীতা জিগালোটার উপরে ঝেড়ে দেয় । কুড়ি হাজার টাকার বিনিময়ে জিগালোটা সারারাত ধরে পায় অজস্র সিগারেটের ছেকা , কালসিটের দাগ ।।

রাজার দেশে এসে থেকে একটা আবছা অনুভূতি সবসময়ই অনুভব করতে পারে চিত্রা । জয়সেলমেরের সার্কিট হাউসের নরম শয্যায় ঘুমাতে ঘুমাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেলো চিত্রার। চোখ মেলে তাকাতেই আলো আঁধারি পরিবেশে সামনে চাদর ঢেকে ঘুমিয়ে থাকা আবিরের খোলা  পিঠটা নজরে এলো। উপুড় হয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে আবির । চিত্রা নিজেকে এগিয়ে নিয়ে এলো আবিরের কাছে । একমনে দেখতে লাগল ওকে চিত্রা ওরফে মার্থা । পোল্যান্ড এ এত পুরুষের মধ্যে কই কাউকে তো এতটা কাছের মনে হয়নি কোনদিন । আবিরকে দেখেই কেন প্রেমে পড়তে ইচ্ছা হলো ? আদিম ইচ্ছেটা চাগাড় দিয়ে উঠলো ? আবিরের উন্মুক্ত পিঠে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে চিত্রা । সোনার কেল্লা দেখে থেকে আর কোথাও যাওয়া হয়নি সারাটা দিন এই সার্কিট হাউসে ঢুকে আছে ওরা । সারাটা দিন ওকে জ্বালিয়েছে আজ আবির । চিত্রা সারাটা দিনের কথা ভেবে মনে মনে হাসলো। আবিরকে জৈন মন্দির দেখার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করলেও আবির রাজি হয়নি আজ কোথাও বেরোতে । ও নাকি মধুচন্দ্রিমাতে এসে সারাটাক্ষণ নিজের শরীরে চিত্রাকে অনুভব করতে চায়। আবির ব্যবসায়ী মানুষ , তার কলকাতা ফিরে কি অত সময় থাকবে যে চিত্রার সাথে কয়েকটা ঘনিষ্ট মুহূর্তে বিলীন হয়ে থাকবে ? এই তো সুযোগ সব ভুলে কাছাকাছি আসার । নতুন বিয়ের পর দুজনের দেহমনেই এখন অগণিত রঙের হাতছানি। নিজেকে বড্ড সুখী মনে হয় চিত্রার । পোল্যান্ড এ একা একা আজীবন থেকে এসেছে ও । কাছের কেউ নেই এটা ভেবেই ভীষণ কষ্ট পেয়েছে ও তখন। অনাথ হওয়ার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে তাকে। সেই প্রথম যখন প্রতিবেশী অতসীর বাড়িতে দেখা হয় আবিরের সঙ্গে .. কেন জানে না চিত্রা তখনই আবিরের প্রতি গভীর আকর্ষণ টের পেয়েছিল। ওদের দেশে প্রেমটাই যথেষ্ট একসাথে থাকার জন্য কিন্তু ভারতে বৈবাহিক সম্পর্ক দামী । অধিকারহীন , নামহীন একটা সম্পর্ক এখানে সমাজের চোখে অনৈতিক , অবৈধ। চিত্রা তাই আর দ্বিতীয় দফা ভেবে দেখেনি । ছেড়ে এসেছে নিজের দেশ । ভুলেছে নিজের নাম পর্যন্ত । সে মার্থা থেকে হয়েছে চিত্রা আবির রক্ষিত । সামাজিক নিয়ম মেনে এবং মনের বাঁধন দিয়ে বাঁধা দুটো প্রাণ ওরা । আবিরের ঘুম ভেঙ্গে যায় ও চিত্রাকে আবিস্কার করে নিজের পিঠের উপর । 

অদম্য ইচ্ছাটা চাগার দিয়ে ওঠে সাথেসাথে । চিত্রাকে এক ঝটকায় বিছানায় টিপে ধরে আবির । ওর হাত ঘুরে বেড়ায় চিত্রার শরীরময় । আবিরের ঠোঁটে খেলে যায় দুস্টু মৃদু হাসি । আবিরকে নিজের দিকে টেনে নেয় চিত্রা   একটা প্রচ্ছন্ন অনুমতি থাকে চিত্রার আচরণে। তারা দুজনেই এখন আদরের অনন্ত সাগরে ডূব দিতে চাইছে। হারিয়ে যেতে চাইছে একে অপরের মধ্যে। ওরা কেউ লক্ষ করেনা একটা কালো ছায়া দাঁড়িয়ে আছে ওদের মাথার উপরে । ছায়াটা দিন দিন নিজের পরিধি বাড়িয়ে যেন চিত্রার কাছে আসতে উন্মুখ হয়ে যাচ্ছে । ছায়াটা একটা আকার ধারণ করছে ধীরে ধীরে । কিন্তু সেসব অনুভব করার সময় আবির বা চিত্রা কারো নেই । ওরা নিজেদের মধ্যে এতটাই ব্যস্ত যেন প্রথম বার এভাবে একে অপরকে কাছে পেয়েছে। চিত্রা চোখ বন্ধ করে নিজের সারা শরীরে আবিরের উন্মত্ত সোহাগ অনুভব করতে থাকে ।যেন নেশা লেগে গেছে দুজনেরই কাছাকাছি আসার । চিত্রা আবিরকে দেখে , স্বেদ বিন্দু ফুটে উঠেছে ওর মুখময় । আবিরকে দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে যায় চিত্রার । আবিরের মুখটা নিমেষে পরিবর্তিত হয়ে যায় অচেনা কোন পুরুষের মত । দীর্ঘ দুটো দ্বীপ্ত চোখ , লম্বা কেশরাসি , কালো তাও দেওয়া গোঁফ .. যেন কোন রাজকুমার । চিত্রার খুব চেনা লাগে মুখটা .. বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁদে ওঠে ওর । এক ধাক্কায় আবিরকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দেয় ও । নেশাগ্রস্তর মত চিৎকার করে বলে , আসবে না আমার কাছে কুওর সা । আমি মায়া ... আমি একজন দাসী মাত্র । 

বিছানা থেকে এক ঝটকায় মাটিতে পড়ে কঁকিয়ে ওঠে আবির । মার্বেলের মেঝেতে চোট লাগে ওর । টেনে হিঁচরে কোনমতে শরীরটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে লাইটটা জ্বালে আবির । চিত্রা কেমন যেন ভূতে পাওয়ার মত বসে আছে বিছানায় । সামনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে , আমি মায়া কুওর সা .. আমি মায়া । 


চিত্রা কেন নিজেকে মায়া মায়া বলছে ? সারাটা রাত শেষে না পেরে আবির চিত্রাকে একটা শাড়ি দিয়ে হাত পা বেঁধে রেখে দেয় । আবির আর পেরে উঠেনি । ভয় আর ক্লান্তি ঘিরে ধরে ওকে সারারাত যুদ্ধ করে । চিত্রার শরীরে যেন হাজার হাতির বল ! আবির চিত্রাকে বলে , তুমি মায়া নয় .. তুমি পোল্যান্ড থেকে এসেছ .. তুমি মার্থা । 

কিন্তু পজেসড হয়ে যাওয়ার মতো চিত্রা একনাগাড়ে বলে যায় .. আমি মায়া কুওরসা .. আমি মায়া । 

আবির সকালে উঠে ভাবে এখন কি করণীয় ? এখানে ডাক্টরের আশা করা বৃথা । চিত্রা যতই ওর বিবাহিতা হোক তবুও ও বিদেশিনী । এখন যেভাবে ও রিয়াকট করছে তাতে এখানকার মানুষ তো অবিরকেই ভুল বুঝবে । ও শেষে নিজের মা জয়ীতাকে কল করে । জয়ীতার মনটাও ঠিক নেই । সারাদিন ধরে ও ভেবেই যাচ্ছে কি করে গত জন্মের কর্মফল থেকে বাঁচা যায় ? 

যদিও এই মার্থা বা চিত্রা যদি গতজন্মের মায়াও হয় তবুও থোড়াই না জয়ীতাকে শাস্তি দিতে পারবে ? কোন সংবিধান , কোন আইনে লেখা নেই যে গতজন্মের অপরাধের জন্য কেউ কাউকে শাস্তি দিতে পারে । বিজ্ঞান বা আইন কেউই পুনর্জন্মে বিশ্বাসী নয় ।

জয়ীতা যদিও মনকে একটু বুঝিয়ে এনেছিল কিন্তু সবটা আবার ঘেঁটে ঘ হয়েই গেল সাতসকালে ছেলের ফোন পেয়ে । আবির তার মাকে বলে , মম প্লিজ তুমি জয়সালামের চলে এসো কুইক । চিত্রা কেমন করছে গত রাত থেকে । সমানে বলে যাচ্ছে ও নাকি মায়া । আর কোন কুওরসার কথা বলছে সমানে । যেন চোখের সামনে ও কুওরসাকে দেখতে পাচ্ছে । আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না । তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে এসো । 

জয়ীতার ভিতরে একটা কাঁপুনি শুরু হয়ে যায় ছেলের কথা শুনে । মায়া ! কুওরসা ! ... 

হাতের পাশে দামী সোপিসটা ছুড়ে মারে জয়ীতা । ঝনঝন করে ভেঙে যায় মূর্তিটা । জয়ীতা নিজের সিধান্তর উপরে আফসোস করে । কেন সব জেনেও ওদের যেতে দিল ওখানে ? 

ছেলেকে জয়ীতা অবশ্য বুঝতে দিলো না । শুধু শক্ত গলায় বলল , বাবু আমি আজ রাতের মধ্য পৌঁছে যাবো ডোন্ট ওয়ারি । একটা কথা মাথায় রাখবে মেয়েটার কাছাকাছি যাবে না , একটু দূরে দূরে থাকবে তুমি । আর ও বাঁধা অবস্থায়ই থাকুক । নিজে খেয়ে নেবে তবে ভুলেও দয়া মায়া করে ওকে খাবার খাওয়াতে কাছে যেও না । এন্ড লাস্ট ওয়ান .. কাউকে কিছুই বলার দরকার নেই । না দিদিকে বলবে না তোমার বাবাকে । 

চিত্রার মাথার কাছে ঘুরছে অদৃশ্য এক শক্তি । যাকে শুধুমাত্র চিত্রাই দেখতে পাচ্ছে কিন্তু আবির দেখতে পাচ্ছে না । আবির ভাবে এতদিন ভূতেধরা শুনেছে গল্প কথায় ... এখন চোখে দেখে সত্যি ভেবে পাচ্ছে না ও যে কি করবে ? 

জয়ীতা চিন্তায় ছিল এটা জেনে যে তার পুত্রবধূই গত জন্মের মায়া । এখন কুওরসা নামটা শুনে ও বুঝেই গেল অতৃপ্ত কামনা সহজে চরিতার্থ হওয়ার নয়! কুওরসা ও মুক্তি পায়নি । সে এতদিন ওখানেই অপেক্ষা করছিল মায়ার । মায়াকে জয়ীতা শুধুই দিয়েছে লাঞ্ছনা আর বঞ্চনা। এখন কুওরসা জয়ীতার অপরাধের সব পাওনা সুদে আসলে পূরণ করতে চায়!

জয়ীতা গতজন্মের আনন্দি । কুওর মান সিংয়ের বিন্দনী ... কুওরানীসা ছিল আনন্দি । স্বামীর সম্পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করাই হোক বা নিষিদ্ধ ভোগ সবটাই সে করেছে প্রাণ ভরে। কুওরসা স্ত্রীর কাছ থেকে কোন সুখই কোনদিন পায়নি । তখনই কুওরসার জীবনে আসে মায়া । মায়া অনন্দির সাজ শৃঙ্গারের কাজ করত । কার্তিকের মত কুওরসার মন লেগে যায় এই মায়ার উপরে । মায়া ও ফেরাতে পারেনি তার মনিবের প্রেম প্রস্তাব । মায়ার প্রস্ফুটিত যৌবন কুওরসাকে  দিয়েছে এক সুখের সাগরের সন্ধান। রানীসা আনন্দি যদি মরু তো মায়া সাগর । কামনার সমুদ্রে সাঁতার কেটে কুওরসা আর মায়া একে অপরকে তৃপ্ত করেছিল। এমন তৃপ্তি কোনদিনই কুওরসা মান সিং স্ত্রী অনন্দির কাছে পায় নি! আনন্দির কাছে সোনার অলংকার গুনে গুনে রাখা , ঠাটবাট , পরকীয়া এসবই ছিল কাঙ্খিত।  নিজের স্বামী কুওরসার প্রতি প্রেম ভাব ছিল না তার কোনদিনই । মায়া কিন্তু বুঝেছিল মান সিং মানুষটা একা । মায়া ভেসে গিয়েছিল কুওরসা মান সিংয়ের বলিষ্ঠ বাহুর উষ্ণ আলিঙ্গনে ... কিন্তু বেশিদিন লুকিয়ে এই অভিসার চলেনি । প্রেমের নেশা যে বড় অস্থির। 

ধরা পড়ে যায় মায়া অনন্দির কাছে । নিজের একই অপরাধের জন্য কোনরকম কোন অপরাধ বোধ ছিলনা তার কিন্ত কুওরসা আর মায়ার প্রেম আনন্দি মেনে নিতে পারে নি । যদিও কুওরসাকে কিন্তু আনন্দি সেদিন মেরে ফেলতে চায় নি! মায়াকে মেরে ফেলে আনন্দি আবিষ্কার করে কুওরসার হৃদ স্পন্দন ও মায়ার মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গেছে! কিন্তু তখনও যে অনন্দির রাগ মোচন সম্পূর্ন হয় নি! তাই তীব্র আক্রোশে মায়ার শরীরটা খন্ড খন্ড করে দিয়েছিল সে । 

আজকে আনন্দি জয়ীতা হয়ে জন্ম নিয়েছে । আর মায়া সুদূর পোল্যান্ড এ মার্থা নাম নিয়ে জন্ম নিয়েছে । জয়ীতার নিজের ছেলেই খাল কেটে কুমির এনেছে । না হলে কখনোই মার্থা এদেশে আসত না । আর সে নিজের পুনর্জন্মের কথা মনেও করতে পেত না । ছেলের উপরে এখন অসম্ভব রাগ হচ্ছে জয়ীতার । মায়াকে সে এমন কষ্ট দিয়ে মেরে ছিল যে তাকে তো ফিরে আসতেই হতো বদলা নিতে । মরার আগে মায়াকে আতঙ্কের যে দ্রাঘিমা পার করতে হয়েছিল সেটা কি এখন ঘুরে আসতে চলেছে জয়ীতার দিকে ? 

জানো জয়ীতা কর্ম ফিরে ফিরে আসে । বারবার সে ফিরে আসে অসত্যর উপরে সত্যর বিজয় স্থাপনা করতে । যুগে যুগে এটাই হয়ে এসেছে । সে সত্য যুগ হোক , দ্রাপর যুগ হোক বা কলি যুগই হোক । অসত্যর বিজয় সর্বদা সাময়িক । সত্য রক্তাক্ত হোক , সত্য বারবার হোঁচট খাক তবুও দিনের শেষে সূর্যাস্তের সময় এসে পৃথিবী দেখে ধর্মের বিজয় হয়েছে অর্ধর্মের উপরে । 

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥ পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥


জয়ীতা হাতের মুঠোয় থাকা রুপোর পুষ্পপত্রটি ছুঁড়ে মারে স্বামী শান্তনুর দিকে । জয়ীতা হিসহিস করে বলে , ব্যাস অনেক বলে ফেলেছ শান্তনু । আর একটা কথাও সহ্য করবো না । 

শান্তনুর মাথায় পুষ্পপত্রটি লেগে কপালে আঘাত।লাগে। শান্তনুর মাথা থেকে বেরিয়ে আসে বিন্দু।বিন্দু রক্ত । মাথাটা কি একটু টাল খেয়ে গেল ? শান্তনু মাটিতেই বসে যায় সামলাতে না পেরে । রূপের আগুনে নিজের বিবেক হারিয়ে হাঁটুর বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করে শান্তনু খুব ভালো করেই বুঝে গিয়েছিলেন যে সুখ নামক যে অদৃশ্য সোনার পাখি তিনি কিনতে চেয়েছিলেন সেটা আসলে মরীচিকা। জয়ীতা আজীবন শান্তনুর সাথে ঘর তো করেছে কিন্তু সে অন্যান্য মেয়েদের থেকে বরাবরই আলাদা । তার পঙ্কিলতা ঢাকা পড়ে যায় শান্তনুর প্রতিপত্তি ও নিজস্ব সৌন্দর্যতে । আপাত দৃষ্টিতে সমাজের , পরিবারের চোখে জয়ীতা একটি সুষম নারী মূর্তি । কিন্তু তার উদগ্র কামনার জন্য পুরুষদের করা নারকীয় অত্যাচার , ব্যবসা বারবার জন্য দুষ্কর্ম সবটাই আর কেউ না জানলেও শান্তনু জানে । আজ সে বৃদ্ধ , জয়ীতার তুলনায় অনেকটাই অকেজো হয়ে গেছে । তবে যে দূরদৃষ্টি সেদিন ছিল না এখন খুব হয়েছে । জয়ীতার সাথে বিয়ের সময় ওর বয়স তখন খুব কম । তো সেই সময়ের তো তেমন কিছু মারাত্মক অতীত ওর ছিল না । পুরো ব্যাপারটা গোলমেলে ও ভাবনার ঊর্ধ্বে এটা শান্তনু বুঝেছিল জয়ীতার অতিরিক্ত জোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাস , তন্ত্র মন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকা দেখে । শান্তনু সবটা না জানলেও জয়ীতার সাথে দীর্ঘ সংসার করে এটুকু জেনেছে যে জয়ীতার জন্মান্তর হয়েছে । সেই জন্মান্তর ওকে অতীতের কোন পাপকে বারবার মনে করিয়ে দেয় । 

শান্তনু তাও কোনদিন জয়ীতাকে কিছু বলেনি । জয়ীতাও অসুস্থ হয়ে যাওয়া শান্তনুর যত্নর কোন অভাব রাখেনি । স্ত্রীর কর্তব্য পালন করে গেছে । কিন্তু আজ যখন জয়ীতার সান দেওয়া তরোয়াল শান্তনুর একমাত্র পুত্রবধূর উপরে ঝুলছে তখন আর শান্তনু চুপ থাকতে পারেনি । 

জয়ীতা আবিরের ফোনটা পেয়েই সোজা যোগাযোগ করে জোতিষী রামানুজমের সাথে । ফোনে কথাবার্তা সেরে জয়ীতা বেরোতেই যাবে এমন সময় মাঝখানে শান্তনু ঢুকে সবটা বরবাদ করে দিতে চাইছিল । এককালে টাকার জোরে নিজের থেকে কুড়ি বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করতে লজ্জা পায়নি । এখন দুদিন আগে ছেলের বউ হয়ে আসা বিদেশিনীর উপরে দরদ উথলে উঠছে । জয়ীতা এখন ধৈর্য রাখতে অক্ষম । নাহলে এভাবে সে কোনদিন আচরণ করত না শান্তনুর সাথে । গত জন্মেও তো কুওরসা মান সিংকে সে সন্মান দিয়েই এসেছিল । মাঝে মায়া না এলে কোনদিনই স্বামীর সাথে বনিবনার অভাব তো হতো না । 

এজন্মেও আবার মায়া চিত্রা হয়ে এসেছে জয়ীতা আর শান্তনুর মাঝে । অতীত বারবার নিজেকে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় । আগের বারেও জিত হয়েছিল আনন্দি মানে জয়ীতার । এবার ও তাই হবে । 

আবিরকে ফোন করল জয়ীতা । আজ তার পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে । তিনবার ফোন বেজে বেজে কেটেই গেল । কিন্তু ছেলেটা ফোন ধরছে না কেন ? চিন্তা হলো একমাত্র ছেলের জন্য একটু । এবার ঘুরিয়ে ফোন করেছে আবির । ফোন ধরেই ঝরে পড়ে জয়ীতার রাগ ... 

কতবার ফোন করেছি? চেক কর একবার। কি করিস কি হ্যাঁ ? রাজামহারাজা ও এত ব্যস্ত থাকেনা সবসময় । আবির পেটের ক্ষুধা নিবৃতি করতে একটু বাইরে বেরিয়েছিল । ফোনটা রুমেই ফেলে গিয়েছিল সে । এরই মধ্যে হাত পা খুলে কিভাবে যেন পালিয়ে গেছে চিত্রা ! এদিকে ফোনটা ধরেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে যাচ্ছে মা । মায়ের এটাই সমস্যা কেউ মায়ের মনের মতোকিছু না করলেই মাথা গরম হয়ে যায় । আবির মায়ের ফোনের ওদিক থেকে চিৎকার শুনেও চিত্রার পালিয়ে যাবার বিষয়ে কিছু বলল না, কারণ এখন একথা বলা মানেই আরো ঝামেলা বেড়ে যাবে। 

ওদিক থেকে জয়ীতা আবিরের রিপ্লাই না পেয়ে খেঁকিয়ে উঠলো অধৈয্য হয়ে ..

কী হল, কথার উত্তর দেওয়া যাচ্ছে না? এর বেলা বোবা হয়ে গেলি ? চিত্রা কোথায় আবির ? ভালো করে বেঁধে রেখেছিস তো ? 

আবিরের পেট থেকে কথা বেরিয়েই যায় , মা মার্থা সরি চিত্রা পালিয়ে গেছে । 

জয়ীতা : -'তোর মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? কী বলছিস ভেবে বল, প্লিজ । তুই জানিস না ও আসলে কে । ও আসলে কি । কি করে পালালো ? ধর ওকে বাবু , আমি আসছি । 



আনন্দি যেদিন মায়াকে খুন করেছিল সেইদিনটা ছিল অমাবস্যা । পাথুরে বেলে পাথরের হাবেলির চোরা কুঠুরিতে মায়াকে নিয়ে গিয়ে ওকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করে আনন্দি । প্রথমে ধারালো ধাতুর তৈরি চাবুকে র আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে মায়াকে আনন্দি । তারপর মিটটি কা তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় মায়ার শরীরে । আগুনের বহ্নি শিখা গোটা চোরা কুঠুরি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে । কুওর সা আগের রাতেই আনন্দিকে জানিয়েছে তার আর মায়ার সম্পর্কের কথা । কুওরসা মান সিং চান মায়াকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে । আনন্দির লোভ , গরিব মানুষদের ঠকানো বন্দকি ব্যবসাতে , বাড়ির জল আনার ভিস্তিদের সাথে পরকীয়া সবই জানেন কুওর সা । তিনি আনন্দিকে জানান ওনার সম্পত্তির অর্ধেক দেবেন আনন্দিকে । ওনার শুধু মুক্তি চাই অনন্দির থেকে । মায়াকে নিয়ে স্বস্তিতে কাটাতে চান কুওর মান সিং । আনন্দি প্রথমে কিছুই বলেনি কুওর সাকে।  তার মাথায় তখন চলছিল অন্য ষড়যন্ত্র । আনন্দি সহ্য করতে পারছিল না , একজন সামান্য দাসীর জন্য কুওর সা তাকে ত্যাগ করতে চান । মায়ার রূপ বিষ লাগছিল সেদিন অনন্দির । মায়ার রূপ , মিষ্টি মিষ্টি কথা এগুলোই কুওর মান সিংকে এতটা সাহসী করে তুলেছে । তাই মায়াকে পুড়িয়ে কালো কয়লা করে দেওয়াটা খুব দরকার ছিল । মান সিং আনন্দির চুপ থাকাটা সম্মতি ধরে নিয়েছিলেন । কারণ আনন্দি স্বভাবত লোভী । তার কুওর সাকে দরকার কি ? না হলে এত সুপুরুষ বিন্দ থাকতে কে বাড়ির কাজের লোকেদের সাথে পরকীয়াতে মেতে ওঠে ? তারপর যখন আনন্দির আসল উদেশ্য কুওরসা বুঝতে পারেন । ততক্ষন অনেক দেরি হয়ে গেছে । মায়া ততক্ষনে পুড়ে গেছে । কুওরসা আনন্দির ওই নৃশংসতা সহ্য করতে পারেননি । সহ্য করতে পারেননি ভালোবাসার মানুষটার ওই প্রচন্ড কষ্টে মৃত্যু । ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হার্ট এট্যাক হয়ে যায় কুওর সার । তারপর অনেকদিন বেঁচে ছিল অনন্দি । রাজা নেই তো কি হয়েছে ? রাজত্ব তো আছে । সারাটা বাড়ি তান্ত্রিক দিয়ে বেঁধে ফেলে বেশ কাটিয়ে দেয় আনন্দি জীবনটা । তারপর একদিন ঘুমের মধ্যেই হার্ট এট্যাক হলে জয়সেলমেরের কুওরানী সা আনন্দি বাইয়ের মৃত্যু হয় । কোন ওয়ারিস না থাকায় হাবেলি পরেই থাকে খন্ডর হয়ে । কুওর সার আত্মা শান্তি পায়নি । কুওর সা জানতেন পাপের হিসাব দিতে ফিরতেই হবে সব চরিত্র গুলোকে । যদিও কালচক্র থেকে মুক্তি না পেয়ে কুওর সার পুনর্জন্ম হয়নি । কুওর সা সুক্ষ শরীরেই অপেক্ষা করে গেছে মায়ার । আর এখন মায়া ফিরে এসেছে । নতুন জন্ম নিয়ে , নতুন পরিচয় নিয়ে । মায়া এই মরুর দেশে পা রাখতেই কুওর সা সঙ্গ নিয়েছিল চিত্রা রূপী মায়ার । যদিও মায়ার গত জন্মের কিছুই মনে নেই । তাই কুওর সার সুক্ষ শরীর কালো ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল মায়ার চারপাশে । আর অমাবস্যার রাতে চিত্রা স্পষ্ট অনুভব করে কুওর সাকে । সে এখন এজন্ম ও গতজন্মের সরলরেখার মাঝে ঝুলছে । চিত্রার সামনে ভাসছে কুওর মান সিংয়ের চেহারা । আর একটা অস্পষ্ট মহিলার মুখমন্ডল । ওই মহিলার জন্যই তো সেইদিন যেদিন ওর জীবনটা পাল্টে গেছিল। 

অস্বাভাবিক আচরণের কারণে ভয় পেয়ে আবির চিত্রাকে বেঁধে খেতে গিয়েছিল । সেসময় কুওর মান সিং খুলে দেয় চিত্রার বাঁধন । পজেসড চিত্রা পিছু নেয় কুওর সার । এদিকে আবির ফিরে চিত্রাকে না পেয়ে মাকে ফোন করে । জয়ীতার সাথে কথা বলেই ফোন রেখে আবির ভাবতেই শুরু করে চিত্রার আচরণ স্বাভাবিক নয় । ওর মা জয়ীতা যেটা বুঝতে পারছে সেটা অবিরের সেটা কিন্তু ঠাওর করতে পারছে না । আবির এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে বেড়িয়ে পড়ল চিত্রাকে খুঁজতে । হ্যাঁ সে কিছুটা স্বার্থপর তার মায়ের মত কিন্তু চিত্রা তার দায়িত্ব । মার্থা নামের মেয়েটি এককথায় তার দেশ , তার পরিচয় ছেড়ে চলে এসেছে এদেশে শুধুমাত্র আবিরকে ভালোবেসে। সারাটা দিন এদিক ওদিক খুঁজে আবির চিত্রার একটা কানের দুল খুঁজে পায় একটু শুনশান এলাকায়।  ও বেরোবার সময় ফোন আর হাতে একটা পুরনো দিনের চার ব্যাটারির টর্চ সার্কিট হাউস থেকে নিয়েই বেরিয়েছিল । আঁধার হয়ে আসছে আবির কানের দুলটা যেখানে পরে ছিল সেদিক দিয়ে হাঁটতে শুরু করে । ও টর্চ জ্বেলে এগিয়ে চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে। একটু যেতেই একটা খন্ডর নজরে আসে । বোঝাই যাচ্ছে যে এদিকে বহু বছর কেউ আসে না। ঝোপ ঝাড় আগাছায় ঘন হয়ে গেছে সেই অংশ। 

সন্তর্পনে আবির চলে আসে সে পুরোন হাবেলির পিছনে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে চোখ সইয়ে হাঁটতে শুরু করে। পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে শুকনো আগাছা । কানে আসছে রাত পাখির কর্কশ শব্দ , শুনশান অন্ধকার ভৌতিক পরিবেশ । আবিরের শরীরে কাঁটা ফুটে উঠেছে যেন । এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত যাবার সময় আবিরের পা বেয়ে পেরিয়ে যায় একটা বিষধর সাপ তার ঠান্ডা শরীর ছুঁইয়ে আবার মিশে গেল ঝোপে। আবিরের গলা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ , ও থমকালো। চিত্রার গলার স্বর পাওয়া যাচ্ছে .... তাহলে এটাই তার গন্তব্যস্থল । বজরংবলির নাম নিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে ভেতরে ঢুকল আবির ।


জোতিষীকে সঙ্গে নিয়ে জয়ীতা পৌঁছে গেছে ফ্লাইটে জয়পুর । ওখান থেকে ওরা আসছে জয়সেলমের । 

পথে জোতিষী জয়ীতাকে বলে , জন্মছকে শনি তুঙ্গে থাকার অর্থ প্রারব্ধ কর্ম ভালো। আমরা বেশিরভাগ মানুষই তুঙ্গ থাকার অর্থকে বৈভব দিয়ে বিচার করি।আসলে কিন্তু তা নয়। প্রতিটি গ্রহ নক্ষত্রই আমাদের কিন্তু ঈশ্বরমুখী করার চেষ্টায় রত।তাই তুঙ্গী গ্রহের ফলে মানুষ যখন ভোগ বিলাসে ডুবে থাকে,তখনই শনি মহারাজ সাড়ে সাতি বা মহাদশায় মানুষকে শাস্তি দেন ।

জয়ীতা এমনিতেই টেনশনে আছে । ওই মায়াকে বধ করতে হবে । আবিরকে বোঝাতে হবে যে চিত্রা ভালো মেয়ে নয় । আবিরের ওকে ত্যাগ না করলে মৃত্যু যোগ আছে । এদিকে জোতিষী কি উল্টো পাল্টা বকেই যাচ্ছে । জয়ীতা গম্ভীর হয়ে বলে , ভালো কিছু বলুন । শুভ কিছু বলুন । এখন গ্রহরাজ কি করবে না বলে বলুন ওই আগের জন্মের পাপকে কি করে সরানো যায় । 

জোতিষী বলেন , তিন রকম কর্মের ফল আমাদের ভোগ করতে হয় । সঞ্চিত, ক্রিয়মাণ আর প্রারব্ধ। জন্ম জন্মান্তরের আমাদের ভালো বা খারাপ যেকোনো কর্মের কারণে আমাদের এ জন্মে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান নির্দিষ্ট হয়। তাই একই মায়ের গর্ভের দুই সন্তানের ভাগ্যও আলাদা হয়। আপনার কর্ম ফল আগের জন্মে আপনি আটকে দিলেও এজন্মে সেটা আর বিকড়াল রূপ ধারণ করে ফিরে এসেছে । এখন আপনাকে কিছুর বিনিময়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করতে হবে । 

জয়ীতা : ভনিতা করার সময় আছে বলে আপনার মনে হয় ? যা বলার স্পষ্ট করে বলুন । অর্থ ব্যয় করে যদি ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যায় তো তাই সই । আর ভালো লাগছে না । 

জোতিষী : আমি ছক এঁকে দেখেছি । আপনি নিঃসন্তান ছিলেন গত জন্মে । আর সন্তান কামনায় আপনি পরপুরুষে গমন করে ছিলেন । ভেবে ছিলেন সমস্যা আপনার পূর্ব স্বামী মান সিংয়ের মধ্যেই ছিল । কিন্তু যখন মায়া গর্ভবতী হয় তখন আপনি বুঝে যান সমস্যা আপনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে । মায়া নিজেও জানত না সে সন্তানসম্ভবা । কুওর সা ও জানতেন না । এবার আপনি ভাবলেন মায়ার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখলে আপনার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না । তাই আপনি তাড়াহুড়ো করে এক সন্তানসম্ভবা নারীকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করলেন । মৃত্যুর পর আর জানা অজানার কোন দেওয়াল থাকে না কারণ আত্মা শক্তিশালী , সে অবিনশ্বর । 

মায়া জন্ম নিয়েছে মৃত্যুর বহু বছর পরে । তার পূর্ব জন্ম মনেও ছিল না । কুওর সা জন্ম নেননি । তিনি মৃত্যুর পরে সব জেনেই গেছেন প্রকৃতির নিয়মে । তিনি অপেক্ষায় ছিলেন তার মায়ার ফিরে আসার । আর আপনি আনন্দি থেকে জয়ীতা হয়ে আগের জন্মকে মনে রেখে এই গোটা জীবনটা ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে গেছেন । আর ভাগ্য তো দেখুন আপনার নিজের সন্তানই আপনার যমকে আপনার সামনাসামনি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে । 

জয়ীতা : এটা দেখুন আমি জাতিস্মর হওয়াতে এজন্মে আমি প্রায় পঞ্চাশটা বছর ধরে ভয়ে ভয়ে বেঁচে আছি । গত জন্মের পাপের ভয় । এতে কি আমার পাপক্ষয় হয়নি ? 

কত টাকা দিলে আপনি আমাকে বাঁচার উপায় করে দেবেন বলুন ? 

জোতিষী : টাকা নয় ... তার রক্তের বিনিময়ে রক্ত চাই । সন্তানের বিনিময়ে সন্তান । জীবনের বিনিময়ে জীবন । 

জয়ীতা : মানে !

কুওর সা মায়াকে জাগিয়ে তুলবে চিত্রার মধ্যে । তারপর আপনার সন্তানকে ওরা দুজনে মিলে ... 

জয়ীতা জোতিষীকে আর কথা বলতে সুযোগ দেয়না । কোমরে গোঁজা ছুরিটা সোজাসুজি গেঁথে দেয় লোকটার বুকে । শুনশান পথে তারপর গাড়ি থেকে ফেলে দেয় জোতিষীর প্রাণহীন দেহটা । 

গাড়ির চালক ভয় পেয়ে প্রথমে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল । তাকে জয়ীতা গান পয়েন্টে রেখে বলে , চুপচাপ নিয়ে চল।  মোটা অংকের টাকা পাবি । আর না শুনতে জয়ীতা রক্ষিত পছন্দ করেনা । এই বন্দুকের নল মাথার খুলি উড়িয়ে দেবে নিমেষে । 

ছেলেটা প্রানের ভয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটে যায় জাইসেলমেরের দিকে । 


আবির চিত্রার কন্ঠস্বর ফলো করে পুরোনো ভাঙা হাবেলির ভিতরে সন্তর্পনে এগিয়ে গেল । ঝরকার দেওয়াল ঘেঁষে একটু এগোতেই চোখে পড়ল একটা ঘর। আবির দেখল পাশাপাশি অনেকগুলো ঘর আছে। বোঝা যায় একসময় এই ঘরেই মানুষ বাস করতো, হাসত, খেলত। ঘরটার দিকে যেতেই একটা সিঁড়ি লক্ষ করলো আবির । চিত্রার গলা পাওয়া যাচ্ছে , আমাকে ছেড়ে দাও ... আই বেগ ইউ ... আবির কোথায় তুমি আমাকে বাঁচাও .. 

আবির ক্ষয় প্রাপ্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওপরে। এটাই সেই ঘর। এখানেই আছে চিত্রা ... ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে আবির । চিত্রা ভয়ে গুটিয়ে আছে আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘকায় এক পুরুষ । তার মুখটা দেখতে পাচ্ছে না আবির কিন্তু পিছন থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুরুষটি ক্ষমতাবান ।আবিরের পায়ে দরজাটি লেগে হঠাৎ একটা খুট করে শব্দ হলো। শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সেই পুরুষটি .... আবির দেখলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিমান এক আতঙ্ক ...


আবির ব্যবসায়ী মানুষ , রূপের জাদুতে ভুলে এবং লাভ ক্ষতির হিসাব বুঝেই সে বিয়ে করেছিল মার্থা নামক পোলিষ নারীকে । সেই নারী ও আবিরের প্রেমে মজে নিজের নাম , ধর্ম সব ভুলে চিত্রা নাম নিয়ে এদেশে চলে আসে । আবিরের প্রেমে আবেগের থেকে বেশি ছিল প্রফিট এন্ড লসের কারিকুরি । কিন্তু হঠাৎ মধুচন্দ্রিমায় এসে চিত্রার অস্বাভাবিক আচরণ তারপরে ওর গায়েব হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হয় আবিরের । আবির ভাবে মেয়েটা তো নিজের চেনা পরিবেশ ফেলে ওর হাত ধরে , ওকে বিশ্বাস করেই এখানে এসেছে । মেয়েটা অনাথ আর আবির ছাড়া এ পৃথিবীতে কেউই নেই ওর । এখন আবির না ওকে খুঁজে বের করলে , ওকে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবে । আবির নিজের মা জয়ীতাকে দেখে দেখে একটু স্বার্থপর হয়ে গেছে কিন্তু তার শরীরেও ওর বাবা শান্তনু রক্ষিতের রক্ত বইছে । বাবা আবিরকে শিখিয়েছে যখনই বিপদে পড়বে ভয় পেয়ে পালিও না । বজরংবলির নাম নিয়ে সেই ভয়ের মোকাবিলা করবে তুমি । 

আজ আবিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক মূর্তিমান বিভীষিকা । একটা রাজ পোশাকে থাকা প্রেত .. যার চোখ বলতে কিছুই নেই , মুখটা প্রায় কঙ্কালের মত । মুখের ভিতরে দাঁত পর্যন্ত দৃশ্যমান । গাটা কেমন গুলিয়ে উঠলো আবিরের।  ভূতের উপরে মোটেই বিস্বাস ছিল না ওর । মায়ের আজীবন মন্ত্র তন্ত্র , যোতিষী চর্চা দেখে আবিরের সবটাই হাস্যকর লাগত । এখন সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক ... 

আবির ততলিয়ে জিজ্ঞাসা করলো , কে তুমি ? আমার স্ত্রীকে কেন তুলে এনেছ ?

কুওর মান সিং আবিরের প্রশ্নের উত্তর দিল না । এক ঝটকায় ওকে মায়াবলে আটকে দিল একটা থামের সাথে । কুওর মান সিং ইতিহাসকে এবার আবার চিত্রার সামনে তুলে ধরতে এগিয়ে এলো । সে যে মান সিংয়ের মায়া সেটা বোঝাতে পারলেই ব্যাস মান সিং এক ধাপ জিতে যাবে । চিত্রা আবিরকে দেখে যদিও মনে একটু বল পেয়েছিল এখন ওই প্রেত আবিরকে তুরি মেরে বন্দি করে দেবার পর চিত্রা কেঁদে ফেলে । ও আবিরকে বলে , আমাকে মরতে দাও , তুমি পালাও আবির । 

আবির : না সেটা হয়না চিত্রা । আমি এতদিন গর্ব করে বলতাম আমি মায়ের ছেলে । মেয়ের মত চালাক ও বুদ্ধিমান । তবে আজ এই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারছি স্বার্থপর হয়ে কোন লাভ নেই । বাঁচলে তোমাকে নিয়েই বাঁচব । আর মরে গেলে তোমাকে নিয়েই মরবো । 

দুজনের চোখেই জল । ওরা ভাবতে পারেনি সোনার কেল্লা দেখতে এসে এভাবে ভৌতিক ফ্যাসাদে পরে যাবে ওরা । 

আবির দেখে ওই প্রেত একটা কেরোসিনের টিন এনে চিত্রার শরীরে ঢেলে দিচ্ছে আর কিসব বিড়বিড় করছে । আবির ভয়ে চিৎকার করে , ও সমানে বলে যায় .. আমার স্ত্রীকে কেন মারতে চাও তুমি ? আমরা কি ক্ষতি করেছি তোমার ? 

চিত্রা তুমি ভয় পেও না । মা আসছে বলে । 

কুওর ঘুরে তাকায় আবিরের দিকে । আবিরকে কুওর বলে , তোমার মাকেই তো দরকার । আসুক সে ,আমি বহুকাল ধরে তারই অপেক্ষা করে যাচ্ছি । 

চিত্রার শরীরে কেরোসিন ছিটিয়ে দিতেই ওই গন্ধে ওর মনটা কেমন যেন হালকা হয়ে আসছিল । চোখের সামনে ভাসছিল কিছু ধোঁয়া ধোঁয়া ঘটনা । ওর শাশুড়ি জয়ীতার মত একজন মহিলা ওর শরীরে ঠিক এমনি ভাবে তেল ছিটিয়ে দিচ্ছে ... 

ও গুঙিয়ে ওঠে আর চোখ দুটো উল্টে যায় ওর । মুখ তুলে তাকায় চিত্রা ... আবির দেখে চিত্রার চোখ সাদা । চোখের ওই নীল মনি দেখা যাচ্ছে না । চিত্রা ঘরঘরে গলায় বলল ... কুওর সা .. মায়া আমি মায়া । 

কুওর সা তো এটাই চাইছিল এতক্ষন ধরে । মায়াকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কুওর মান সিং । ওরা রাজবাড়ি ভাষায় কথা বলেই যায় যার মর্মার্থ একটুও বুঝতে পারে না আবির । তবে এটা বোঝে যে চিত্রা এখন ওই প্রেতের কবলে । 

কুওর ঝরকার কাছে গিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে । একটা ধুলোর ঝড় ওঠে মরুভূমি বেয়ে । জয়ীতার গাড়িটা এলোমেলো হয়ে যায় ঝড়ের মুখে পড়ে । ড্রাইভার বলে , মাইজি রিস্ক হয়ে যাচ্ছে । মারা পড়ব দুজনেই । জয়ীতা ড্রাইভারকে গাড়িটা দূরে একটা আলো দেখা যাচ্ছে ওই দিকে নিয়ে যেতে বলে । ওখানে আশ্রয় পাওয়া যাবে হয়ত । 

ধুলোর ঝড়ের কবলে পড়ে জয়ীতা যেখানে জাইলো গাড়িটা দাঁড় করায় সেখানেই দাঁড়িয়ে তার গত জন্মের পাপের সাক্ষী , ওই ভগ্ন হাবেলিটা । জয়ীতা ভালো করে লক্ষ করে না এটাই তার আর কুওর সার এককালের সংসার । ঝড়ের থেকে বাঁচতে ভিতরে ঢুকে যায় জয়ীতা কিন্তু ড্রাইভার ছেলেটি গাড়িতেই অপেক্ষা করে । তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দেয় ভিতরে ঢুকে বিপদ বাড়বে বই কমবে না । এমনিতেই বালু পাথরের এই পুরোনো হাবেলি গুলো বিষাক্ত সাপ খোপের আড্ডা তারপরে ধসে পড়তে পারে যখন তখন । জয়ীতা হাবেলির ভিতরে ঢুকতেই বিশাল দরজাটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায় । প্রদীপের হালকা আলোয় জয়ীতা দেখে জায়গাটা খুব চেনা যেন ! ও আবিরকে ফোন করতে যায় এটা জানাতে যে ধুলোর ঝড়ে সে আটকে পড়েছে এবং খুব তাড়াতাড়ি সার্কিট হাউসে পৌঁছে যাবে । ফোনটা বেজে ওঠে কিন্তু আবিরের রিংটোন শোনা যায় ! জয়ীতা দেখে চারপাশে । আবির কি এখানে ? জয়ীতা ফোনের রিংয়ের শব্দ ফলো করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে । একটু একটু করে যেন চোখের উপর থেকে ধোঁয়াশা সরে যায় । দোতলায় উঠে হাত পা যেন অসার হয়ে যায় জয়ীতার । একি ! এটা তো সেই মৃত্যুপুরী ! ভয়ে লোম খাড়া হয়ে যায় ওর।  ধুলোর ঝড় থেকে বাঁচতে কোন অতল খাদে এসে পড়লো সে ? আবিরের ফোনের শব্দ এখানে কেন আসছে ? জয়ীতার মন ওকে সঙ্কেত দেয় পালা এখান থেকে । জয়ীতা সিঁড়িতে পা রেখে নীচে নেমে যাবার জন্য । তখনই কোন মন্ত্রবলে ভগ্ন , জরাজীর্ণ হাবেলিটা সেই আগের মতো ঝকঝকে তকতকে হয়ে যায় । জ্বলে ওঠে ঝাড়বাতি , চারদিকে সাজানো গোছানো সব কিছু যেমনটা আনন্দি আর মান সিংয়ের সময় ছিল । জয়ীতা ভয়ে সিঁটিয়ে যায় । চিত্রা যাই হোক এই ভেল্কিবাজি করতে পারবে না কারণ সে এখন সাধারণ মানুষ । চিত্রার মনে পড়তেই পারে যে সে গতজন্মের মায়া কিন্তু এই ভোজবাজি তার দ্বারা সম্ভব নয় কিছুতেই । তবে কি সে আছে এখানে ? কুওর মান সিং ? 

জয়ীতা হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস অনুভব করে পিছন দিকে । ঘুরে তাকিয়ে জয়ীতা দেখে দাঁড়িয়ে আছে কুওর সা...  মান সিং । পরনে সেই মৃত্যুর দিনের পোশাক , সেই সুন্দর রাজপুতানি চেহারা , তাও দেওয়া মোছ ... 

জয়ীতা বলে , কুওর সা ! 

কুওর সা হাসে আর নিমেষে সুন্দর সৌম কুওর সা পরিবর্তিত হয়ে যায় ভয়ানক প্রেতে । জয়ীতা সহ্য করতে পারে না কুওর সার এই ভয়াল রূপ । সে সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায় । কুওর মান সিং জয়ীতার একটা হাত ধরে টানতে টানতে ওকে সেই ঘরে নিয়ে আসে যেখানে একদিন মায়াকে হত্যা করেছিল জয়ীতা ওরফে আনন্দি । আবির চেষ্টা করছিল নিজেকে ছাড়াবার কিন্তু কিছুতেই সে বাঁধন খুলতে সক্ষম হচ্ছিল না । এদিকে আবির দেখছিল চিত্রা কেমন পাগলের মতো প্রলাপ করে যাচ্ছে আজব ভাষায় । ও যেন চেনেই না আবিরকে । আবির সমানে বলে যায় , চিত্রা ... তুমি আমার স্ত্রী । ওই ভূতের পাল্লায় পড়লে দুজনেই বেঘোরে মারা পড়ব । প্লিজ তুমি আমাকে খুলে দাও । আমরা চলো পালাই এখান থেকে । মা আসছে আমাদের বাঁচাতে । চিত্রা এগিয়ে আসে আবিরের দিকে , ওর পরনের পোশাক অর্ধেক ছিঁড়ে গেছে । চুল গুলো এলোমেলো ... হাওয়ায় উড়ছে । চোখ দুটো মনিহীন সাদা ... আবিরকে চিত্রা বলে ... 

আমি মায়া ... কুওর মান সিংয়ের উপপত্নী । তোর মা আমার খুনি । আমার সন্তানের খুনি সে । 

এরই মধ্যে মান সিংয়ের প্রেত নিয়ে আসে চেতনাহীন জয়ীতাকে । 

আবির দেখে ওর মা অজ্ঞান অবস্থায় । ও ভয়ে মাকে ডাকে .. মা মা ওঠো মা ... 

চিত্রা এসে বসে অজ্ঞান জয়ীতার কাছে । ঠাস ঠাস করে চড় মেরে জয়ীতার চেতনা ফিরিয়ে আনে চিত্রা । আবির দেখে যে মেয়েটা ওর মাকে যমের মত ভয় পাচ্ছিল এখানে আসার আগে । সেই মেয়েটা কেমন চড় মেরে যাচ্ছে নিজেরই শাশুড়িকে । আবির চিৎকার করে ... এই প্রেত আমার মা তোমার কি ক্ষতি করেছে ? কেন আমার পরিবারের পিছনে পড়েছ তুমি ? 

মান সিং হেসে ওঠে । সে হাসি কি ভয়ানক ! যেন চারদিক কেঁপে উঠল । মান সিং বলে , কর্ম ফিরে ফিরে আসে ছোকরে .. তোর এজন্মের মাই আমার আগের জন্মের রানী আনন্দি বাই ছিল । এই মহিলা ছিল চারিত্রিক ভাবে নিকৃষ্ট ও বন্ধ্যা । আর তোর স্ত্রী ছিল আমার প্রেম , আমার মায়া । মায়াকে আমি ভালোবাসলেও , আনন্দিকেই নিজের পত্নির স্থান দিয়েছিলাম । আর এই আনন্দি এতই নিকৃষ্ট মনের যে মায়ার সন্তানসম্ভবা হবার খবর পেয়ে তার মনে হিংসা জন্ম নেয় । আমার আজন্ম শিশু সহ মায়াকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করে আনন্দি । আমি সহ্য করতে পারিনি আমার প্রেমের এই ভয়াবহ মৃত্যু । আমার হৃদয় খান খান হয়ে যায় । আমিও মরে যাই । মায়া জন্ম নেয় আর আনন্দি ও জন্ম নেয় তবে আনন্দি পরে মরলেও সে আগে জন্মায় আর সে ছিল জতিস্মর । তোর মায়ের সব মনে ছিল আর আমার মায়াকে সে প্রথমে চিনতে না পারলেও এখন এই মেয়েই মায়া সেটা বুঝে ওকে আবার মারতে এই মরুভূমি পর্যন্ত ছুটে এসেছে । ও জানে না আমি ওর মৃত্যু হয়ে বহুবছর ধরে এখানে অপেক্ষা করছি । আজ আমার বদলা পূরণ হবে ।

আতঙ্ক কি সেটা জানতে হবে তোমাকে ... 

তরপে তরপে মরণের যন্ত্রনা কি জানতে হবে .. 

আপন সন্তানের মৃত্যুর হাহাকার তোমার কান শুনবে তবেই তো প্রতিশোধ পূর্ন হবে । যে আতঙ্ক তুমি বহুকাল আগে ছড়িয়ে ছিলে আজ তার দ্রাঘিমা পার করবো আমি কুওর মান সিং ... 

আমি নিজের প্রেমের সেদিন করুন মৃত্যু সহ্য করতে পারিনি , আমার হৃদয় স্তব্ধ হয়ে যায় সেদিন , আমার মৃত্যু হয় । আমি মরেও পঞ্চভূতে বিলীন হয়েও রয়ে গেছি এই পৃথিবীতে কেন জানো ? আমি হাজার বার ধিক দিয়েছি নিজেকে , একজন রাজপুত হয়েও কি করে আমি আমার মায়ার হত্যাকারীকে শাস্তি না দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লাম ? তাই আমি প্রহর গুনেছি । আমি জানতাম সেই সৃষ্টির নিয়ম , যখন যখন অধর্ম হয় তখন তখন ধর্মের জন্য এই সৃষ্টি নিজে কিছু অলৌকিক ঘটনার সৃষ্টি করে যা অধর্মকে নাস করে । আনন্দি বাই তুমি ভাবলে মায়াকে মেরে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেবে । কিন্তু আমি শেষ মুহূর্তে সবটা দেখে ফেলি আর আমিও মারা যাই । নিজের বিন্দকে মরতে দেখেও তুমি ক্লান্ত হওনি । তোমার মনে গ্লানি আসেনি । তুমি তোমার বাকি জীবন বিলাসিতাতে কাটিয়ে দিয়েছ চূড়ান্ত নোংরামি করে । বাড়ির নকর চাকরদের পর্যন্ত রেয়াত করোনি তুমি । শরীরের খেদ মেটাতে তুমি বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের ব্যবহার করেছ আবার কখনো কখনো তাদের গুপ্ত হত্যা পর্যন্ত করিয়েছ ।কর্ম ঠিক তার ফল দেয় । কখনো ভালো ফল কখনো মন্দ ফল । তুমি আনন্দি হয়ে একটা গোটা জীবন ভালো ভাবে কাটিয়ে মরেছ কিন্তু ওই যে কর্ম ! সে তোমার এজন্মে ভয় হয়ে পিছু করে গেছে । মানুষের জন্মান্তর মনে থাকে না সেটা তার জন্য আশির্বাদ । তোমার আগের জন্মের পাপের বোঝা মনে রাখা তোমার অভিশাপ । আর কর্ম ফিরে এসেছে তোমার পুত্রবধূ হয়ে । এই যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে সে আমার মায়া ... অন্য ভূমিতে জন্মে সে কর্মের জন্যই ফিরে এসেছে আর দেখ কার হাত ধরে ফিরছে তোমার নিজের সন্তানের হাত ধরে । এখন তুমি মরবে সেইভাবে যেভাবে একদিন মায়াকে মেরেছিলে , আর মরবে তোমার সন্তান ও কেননা মায়ার গর্ভের সন্তানকে ও তুমি হত্যা করেছিলে । যা দিয়েছ সেটাই ফিরে পাবে আজ । 

জয়ীতা চিৎকার করে , না মান সিং তুমি আমাকে মারতে পারো না । তুমি রাজপুত , তুমি ক্ষত্রিয় । গতজন্মের পাপের ফল আমাকে তুমি এজন্মে দিতে পারো না এভাবে । আমি নারী তুমি পুরুষ হয়ে কোন নারীকে হত্যা করতে পারো না । 

এই চিত্রা নিজের হুঁসে ফিরে এসো । তুমি পোল্যান্ড থেকে এসেছ , তোমার নাম মার্থা।  তুমি মায়া না , তুমি আবিরের স্ত্রী । এই চিত্রা শুনতে পাচ্ছ তুমি ? 

পজেস চিত্রা হাড় হিম করা হাসি হেসে ওঠে , ঘরঘরে গলায় বলে , রানীসা আমি মায়া ... মায়া ।

আবির হতবাক হয়ে যায় কুওর সার কথা শুনে । তাহলে এই কারণে মা আজীবন মন্ত্রতন্ত্র , যোতিষী নিয়ে পড়েছিল । 

মান সিং আবার বলে , আসার আগেও তুমি তোমার ল্যাজ মানে ওই যোতিষী যাকে কতদিন ধরে তুমি ব্যবহার করে এসেছ তাকেও মেরে ফেলেছ । তুমি কিছুক্ষণ আগেই নরহত্যা করে এসেছ । আমি এখন প্রেত , আর প্রেতের কোন ধর্ম হয়না । সে শুধুমাত্র তার প্রতিশোধ নিতে অপেক্ষা করছে এত যুগ ধরে । 

আবির : মা তুমি ওই যোতিষীকে মেরেছ ? আইন হাতে তুলে নিয়েছ তুমি ? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে মা ? 

কুওর সা ততক্ষনে মশাল নিয়ে এসেছে । এই হাবেলি আজ জতুগৃহতে পরিণত হবে । আজ আবির আর জয়ীতাকে পুড়িয়ে মারবে কুওর সা । মায়া ও তার সন্তানের মৃত্যুর বদলা পূরণ হবে আজ  । চিত্রার হাত ধরে মান সিং ওকে বলে , এদের মৃত্যুর পর আমি বিলীন হয়ে যাব । আমার অস্তিত থাকবে না আর । তুমিও আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে । তুমি ফিরে যেও তোমার দেশে । এখানে ফিরে আসার প্রয়োজন শেষ হয়ে যাবে তোমার । 

আবির ঘেমে উঠেছে কুওর সার কথা শুনে । এই প্রেত ওদের জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করবে । আর চিত্রা ও পরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে কিন্তু ততক্ষন তো অনেক দেরি হয়ে যাবে ! আবির আর ওর মা তো আগুনে দগ্ধে মরবে ! আবির বুঝে পায়না কি করবে  । হঠাৎ ওর গলায় থাকা বাবার দেওয়া বজরংবলির লকেটটা বেরিয়ে আসে গেঞ্জির বাইরে । আবিরের মনে পড়ে যায় ওর বাবা কোনদিন বুজরুগিতে বিশ্বাস না করলেও ঈশ্বরে ভীষণ বিশ্বাসী । বাবা ওকে সবসময় বলত গলায় যেন সঙ্কটমোচনের এই লকেটটা পড়ে থাকে আবির । কোন ভূত পিশাচের সাধ্য নেই এই বর্ম ভেদ করে আবিরের ক্ষতি করে । 

মায়ের পাপ কর্মের ফল যদি সন্তানকে পেতে হয় তো বাবার পূর্ন কর্মের ফলও তো আবিরের সাথে আছে । আবিরের বাবা বরাবরই সঙ্কটমোচন হনুমানের পুজো করেন । উনি বলেন এই দেবতাকে মন থেকে ডাকলে, জীবন থেকে সমস্ত বিপদ-আপদ দূর হয়ে যায় ৷ তাই আমাদের প্রত্যেক শনি-মঙ্গলবার তাই মন-প্রাণ দিয়ে বজরংবলীর পুজোয় ব্রতী হওয়া উচিত ৷ আর বজরংবলী বা সঙ্কটমোচন হনুমানের পুজোতে অবশ্যই পাঠ করতে হবে হনুমান চালিশা ৷ যা পাঠ করা প্রচণ্ডই উপকারী ৷ আবিরের বাবার কাছে হনুমান চালিশা শুনে শুনে সবটাই মুখস্থ হয়ে গেছে । 

জীবন ও মৃত্যুর সরলরেখায় দাঁড়িয়ে আজ প্রথম বার চতুর মায়ের বদলে বাবার দেখানো পথ বেছে নেয় আবির । ও বজরংবলির লকেটটা নিজের গলা থেকে খুলে পজেজ চিত্রার দিকে ছুঁড়ে দেয় । আবিরের কাছে হনুমান চালিশা মন্ত্রর জ্ঞান আছে কিন্তু চিত্রা বিদেশিনী সে তো জানেনা এই মন্ত্রজাপ করতে । ওকে লকেটটা দিলে হনুমানের কৃপায় ও যদি সজ্ঞানে ফিরে আসে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে পারবে আবির । আবিরের ছুঁড়ে দেওয়া লকেটটা সোজা গিয়ে চিত্রার জমায় গিয়ে আটকে যায় । পবিত্র বজরংবলির সুক্ষ স্বর্ণ লকেটের স্পর্স পেতেই আবার সজ্ঞানে ফিরে আসে চিত্রা । 

কুওর সা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গমগমে গলায় আবির পাঠ করতে শুরু করে হনুমান চালিশা ...

রামদূত অতলিত বলধামা ৷ অঞ্জনিপুত্র পবনসুত নামা ৷’মহাবীর বিক্রম বজরঙ্গী ৷ কুমতি নিবার সুমতি কে সঙ্গী ৷’বিধবান গুণী অতি চাতুর ৷ রামকাজ করিবে কো আতুর ৷’লায়ে সঞ্জীবন লক্ষ্মণ জিয়ায়ে ৷ শ্রী রঘুবীর হরষি ওর লায়ে ৷’ভীম রূপ ধরি অসুর সংহারে ৷ রামচন্দ্র কে কাজ সংবারে৷’


কুওর সার কর্ন কুহরে সেই পবিত্র জাপ গিয়ে পড়তেই ছটপট করতে শুরু করে । তার আর্তচিৎকাররে কেঁপে ওঠে গোটা হাবেলি । জয়ীতা আবিরকে বলে , শয়তান ছেলে ওই মেয়েটাকে কেন দিলি বজরংবলির ওই লকেট ? আমি তোর মা আবির ... 

আবির কোন কথা বলেনা , সে ক্রমাগত জাপ করতেই থাকে । কুওর সা কানে হাত দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । এই সুযোগে হাত বাঁধা অবস্থাতেই আবির উঠে যায় তার মায়ের কাছে । ইশারায় ভয়ার্ত চিত্রাকে বলে জয়ীতার বাঁধন খুলে দিতে । চিত্রা এসে জয়ীতা আর আবির দুজনের বাঁধনই খুলে দেয় । আবির একবারের জন্য থামেনা । সে পাঠ চালিয়ে যায় । আবির ইশারা করে ওদের এই হাবেলি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে । জয়ীতা , চিত্রা আর আবির বেরিয়ে যাবে এমন সময় গোটা হাবেলি আগুনে জ্বলে ওঠে । ওরা দেখে কুওর সা কানে হাত দিয়েই এগিয়ে আসছে ওদের দিকে । কোনরকমে ওরা হাবেলির বাইরে পা রাখে , আবিরের মুখে তখনো হনুমান চালিশার মন্ত্র ... কুওর বিকট পাশবিক চিৎকার করে ... চিত্রা হাবেলির দরজার এপার থেকে বলে , মান সিং মুক্ত হয়ে যাও তুমি । প্রতিশোধ কোনদিন সুখের হয়না । তুমি ক্ষমা করে দাও তোমার অপরাধীকে । তুমি মুক্তি পেল আমিও সুখী হব মান সিং । কোন না কোন জন্মে আবার আমাদের মিলন হবে । এভাবে নিজের আত্মাকে কষ্ট দিও না ... জয়ীতা দেখে চিত্রা ব্যস্ত কুওর সার সাথে কথা বলতে আর আবির মন্ত্র বলে যাচ্ছে । দরজার ওপারেই লেলিহান আগুনের শিখা । ইতিহাস নিজেকে বারবার ঘুরিয়ে আনে । জয়ীতা ধাক্কা দিতে চায় তার চির শত্রু মায়া বা এজন্মে চিত্রাকে । কিন্তু একি ! কুওর সার হাত লম্বা হয়ে এগিয়ে এসে সামনে থেকে সরিয়ে দেয় চিত্রাকে । সে গিয়ে ঘাড় গুঁজে পরে আবিরের বুকে আর হোঁচট খেয়ে জয়ীতা গিয়ে পড়ে হাবেলির ভিতরে , লেলিহান অগ্নিশিখার মাঝে । জান্তব চিৎকার করে ওঠে জয়ীতা .... 

আবির দেখে মা দাউদাউ করে জ্বলছে । কিন্তু কিছুই করার নেই । সে তার মাকে বিপদের মুখ থেকে বের করে আনার পরেও মা নিজের মনবৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি । তাই নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে এনেছে ওর  মা জয়ীতা রক্ষিত । কুওর সার প্রতিশোধ মনে হয় ঈশ্বর ও পূর্ন করতে চাইতেন । নাহলে এভাবে জয়ীতা আবার চিত্রাকে মারার চেষ্টা কখনোই করত না । 

কুওর সার প্রতিষধস্পৃহা পূর্ন হওয়ায় সে আগুনের মাঝেই বিলীন হয়ে যায় । জয়ীতার রূপসী শরীরটা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় । আবির চিত্রাকে নিয়ে ফিরে আসে তার বাবা শান্তনুর কাছে কলকাতা । পাপ বাপকেও ছাড়ে না , জয়ীতাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেও তাই আবির বাঁচাতে পারেনা । আতঙ্কের যে দ্রাঘিমা সে নিজের হাতে আগের জন্মে রচনা করেছিল সেটার উপসংহার ও তাকেই লিখতে হলো , নিজের জীবন দিয়ে ।।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror