ঘনাদা রহস্য উন্মোচন পর্ব আট
ঘনাদা রহস্য উন্মোচন পর্ব আট
বাবলু যেটা ভাবছি সেটা যদি হয় তবে বুঝতে হবে রহস্য অনেক বেশি জটিল । আমি আজ রাতের বেলা টুক করে চলে যাবো মন্দিরে । টর্চটা ভালো করে চার্জ দিয়ে রাখ । সাথে ফোন নিয়েই শুতে হবে বুঝলি । দরকারে আমি ফোন করবো । আর যদি ভোর পর্যন্ত না করি তবে পুলিশে ফোন করবি । আর হ্যাঁ মলি আজ এই ঘরেই থাকবে । ওকে বলবো বিছানার ওদিকে রাখা ডিভানে শুতে । ওকে লাজোর কাছে রাখা মোটেও সেফ না । আমি যতদূর সম্ভব ঠিক দিকেই যাচ্ছি ।
ঘনাদা একটানা কথা গুলো বলে গেল । ওর চোখে মুখে উদ্বেগ দেখতে পাচ্ছি ।
আমি মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। কেমন যেন ধোঁয়াশা লাগছে । মন্দিরে নিজের চোখে দেখে এসে এখন কি এমন দেখল ও ছবিতে ! যে রাতের বেলা যেতে হবে মন্দিরে !
কিছু জিজ্ঞাসা করবো তার আগেই কলম দিয়ে খাতায় কিসব ম্যাপ করতে লাগলো ঘনাদা । আর বিড়বিড় করতে শুরু করলো ।
এমন সময় খোকন এসে বলল , শ্যামাপদ বাবুর এক বোন এসেছেন ওনার বেবিকে নিয়ে । বেবিটা কি কিউট! চল বাবলু দেখবি।
ঘনাদা বিশেষ পাত্তা দিলো না । কানে পেন গুঁজে বারবার ফোন আর খাতা দুটোকে দেখতে লাগলো ।
আমি খোকনের সাথে বেরিয়ে এলাম । শ্যামাপদ বাবুর বাড়িতে লোক মারা গেছে আর ওনার বোন এখানে এখন ! যাই বিষয়টা দেখতে হবে ।
নিচে নেমে দেখলাম এক চকচকে স্মার্ট মহিলা জমে উঠেছে মলি , লাজো, বাপির সাথে । ভৈরব সিং একটা ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মহিলার বয়স বোঝা যায়না তবে খুব বেশি হবে না । পরনে জিন্স আর একটা চেক শার্ট । লম্বা চুল পনিটেল করা ।
সঙ্গে একটা নার্সারি ব্যাগ সম্ভবত বাচ্চার জন্য ।
আমাকে দেখে মলি উচ্ছসিত হয়ে বলল , এই বাবলু কোথায় থাকিস ? দেখ কি কিউট বেবি ।
আমি এসে দাঁড়াতে মহিলা আমাকে জরিপ করতে লাগলো । তারপর বলল , তুমি দেবাশীষের কাজিন তাই তো ? আমি লীনা ব্যানার্জী।
মহিলা হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দনের জন্য । আমি আবার এই মুহূর্ত গুলোতে কেমন যেন ভেবলে যাই ! আমি ক্যাবলার মত করমর্দন করার জন্য হাত না বাড়িয়ে নমস্কার করলাম ।
তারপর বললাম , আমাকে আপনি কেমন করে চিনলেন?
লীনা বললেন , আমি আর ঘনা জার্মানে ছিলাম একসাথে অনেক বছর । তারপর ও চলে এলো । যোগাযোগ রাখেনি এই আর কি । তারপর আমি এসেছিলাম দেশে তো ভাবলাম নিজেদের মাটির কাছে ঘুরে আসি। এখানে এসে শুনি দেবাশীষ ও এসেছে । আমাকে দাদা বলল ফোন করে । তবে আমার জেঠু মারা গেছেন সেটাও শুনলাম ফোনে ।
মলি বলল , তুমি একা এসেছ ! তোমার বর কই গো ?
দেখলাম নিমেষে মুখটা ছোট হয়ে গেল লীনার।
তারপর হেসে বললেন , আমি একাই ট্রাভেল করছি । নালন্দা এসেছিলাম ওখান থেকে রাজগীর হয়ে এদিকে এলাম।
ও ভৈরব দা শুনছি যে আবার দেবী মূর্তি চুরি হয়েছে ?
ভৈরব বলল , মেম সাহেব আর বলবেন না । কি যে হচ্ছে ! আসলে মন্দিরে তো বারোমাস পুজো হয়না । সাপের আড্ডা ওই মন্দিরে কে যাবে ? বছরে একবার পুজো হয় । তো আমি মাঝে মাঝে দেখে আসি মন্দির । আগেকার দিনের লোকে মন্দিরে কপাট তো করতেন না । এই মন্দিরে ও নেই কোন দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা। বারোমাস খোলাই পড়ে থাকে । আর এই এলাকায় মানুষ হাতে গুনে বাস করে । কোন সমস্যা হয়নি । তারপর একদিন দেখি মূর্তি নেই । আর জানেন তো মূর্তি ফিরে আসার আগেই এই বাড়িতে খুন জখম হয়েছে অতীতে । ভাবছি তাই কি যে হয় । তারপর কর্তা মারা গেলেন ।
এই খোকারা এসেছে মাস্টারের সাথে বেড়াতে । ওদের মাস্টার একাই ঘুরছে । ওরা বাড়িতেই আছে এসে থেকে । আমি পতঙ্গ দিয়েছি খেলছে বড়িয়া। আর এই খুকি এসে আমার বিটিয়ার মন হালকা করে দিয়েছে । লাজো আমার একাই থাকে । ওর মন বহেল গেল এই খুকি এসে ।
লাজো: জানো আমাকে লালি , নেল পালিশ দিয়েছে মলি । মলি অনেক ভালো মেয়ে ।
লীনা হাসলো লাজোর খুশি দেখে ।
তারপর বলল , ঘনাকে দেখছি না ?
আমি বললাম , ঘনাদা উপরের ঘরে বসে আছে ।
লীনা দেখলাম ভৈরব সিংয়ের কোল থেকে বাচ্চাটা নিয়ে উপরে উঠে গেল তরতর করে। বিষয়টা আমার মোটেও ভালো লাগলো না । যতই চেনা হোক আমার অবিবাহিত দাদার কাছে অমন করে যাবার কি আছে ?
মলি বলল , ভৈরব কাকা ওই বাচ্চাটা ছেলে না মেয়ে ?
ভৈরব বলল , মুন্না না মুন্নী তা তো জানি না !
সবাই খুব হাসতে লাগলো ভৈরব সিং এর কথায়। আমি ততটা খুশি হতে পারছি না । এই মহিলা আবার কেন এসে হাজির হলো ? যাই একটু উকি মেরে আসি । জ্যাঠা মশাইকে গিয়ে সব লাগিয়ে দেবো টুকটুক করে ।
লীনা বাচ্চা কোলে দাদার ঘরে ঢুকে গেল হুড়মুড় করে । আমি পা টিপেটিপে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। জানি মলি খারাপ ভাববে কিন্তু আমার জানা দরকার কি বলবে এই মহিলা ।
আমি দেখলাম , ঘনাদা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এমন সময় ওই মহিলা ঢুকে সরাসরি দাদাকে ডাকলো .. দেবাশীষ ভাবতে পারিনি তুমি এখানে ...
দাদা ঘুরে তাকালো । দাদার মুখ দেখে ঠিক বুঝতে পারলাম না দাদার অভিব্যক্তি । সে আসলে খুশি না বিরক্ত ।
দাদা বলল , লীনা তুমি এখানে !
লীনা : হুম হয়ত জানো না আমি এই পরিবারের মেয়ে । আমি নালন্দা আর রাজগীর হয়ে এখানে ভাবলাম দুদিন থেকে যাবো । দুম করেই আসা। জার্মান থেকে কয়েক সপ্তাহ আগেই দিল্লিতে এসেছি ।
ঘনাদা দেখলাম কোলের বাচ্চাটি দেখে একবার লীনাকে দেখল । তারপর আঙ্গুল দিয়ে বাচ্চার দিকে দেখিয়ে বলল , তোমার বাচ্চা ?
লীনা : আমার ছেলে সৌম্যশিস সমাদ্দার।
ঘনাদা একটা বিরক্তি সূচক মাথা নাড়ল তারপর বলল , কি ! কি বলতে চাও ক্লিয়ার করবে ?
লীনা : জনক পিতৃত্বের দার ঝেড়ে চলে আসতেই পারে । এর আগেও এমন ঘটনা ভুরি ভুরি ঘটেছে । কুন্তী সেও তো সূর্যের দায় অস্বীকার করার ফলে একাই কলঙ্ক মেখেছে । আসলে জরায়ু যে একমাত্র নারীদেহের অঙ্গ । তুমি পুরুষ কি বুঝবে বলো ? চলে এলে যে আমার সাথে অশান্তি করে । একবার খবর নিয়েছিলে আমি কেমন আছি ? নাওনি তুমি ।
আমি তোমার সন্তানকে জন্ম দিয়েছি। একাই ওই ইনফ্যান্ট বাচ্চাকে পেলেছি । আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম । কিন্তু সেটা করতে বিবেকে বেধে ছিল । শুধু একটা রাত পাবে কাটিয়ে ফিরেছি বলে আমি তোমার এতটা অভক্তির কারণ হয়ে গেলাম ! আমি ভাবতেও পারিনি ।
ঘনাদা : তাহলে আজ কেন এলে এসব বলতে ?
লীনা : এটা তো ঈশ্বরের সঙ্কেত । নাহলে কেন দেখা হলো আমাদের ? না না তোমার ভাইকে আমি কিছু বলিনি । কাউকে কিছু বলব না। যাকে রক্ত দিয়ে শিঞ্চন করেছি তাকে আমি কারো ঘাড়ে গছিয়ে দেব না ।
ঘনাদা : আমি তোমাকে বিশ্বাস করিনা । আমি তো আমাদের কালচারের বাইরে গিয়ে তোমার সাথে লিভ ইনে ছিলাম । কাউকে বাড়িতে বলতে পারিনি কারণ তাতে তাদের ইমোশন হার্ট হতো। ভেবেছিলাম তোমায় নিয়ে দেশে ফিরে বিয়ে করবো । তুমি দিনদিন যেভাবে উৎশৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্থ হয়ে উঠলে আমি আর পারিনি সেদিনের ওই রাতভর পাবে কাটানো । চলে এসেছিলাম সব কিছু ছেড়ে । আমার জীবন পাল্টে গেছে এই কয়েক বছরে । আমি তোমাকে কোন রকমের সুখ সুবিধা দিতে অপরাগ । তাই তোমার মত মেয়ের আমার সাথে পোষাবে না । আমি অকৃতদার ছিলাম আর আজীবন থাকবো । তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো আমার কোন সমস্যা নেই ।
আমি আর বাকি কথা শুনতে পারলাম না ।আমার চোখের কোনে চিকচিক করছে জল । আমি ছুটে অন্য একটি ঘরে ঢুকে পড়লাম । দাদা আমার ঘনাদার বাচ্চা ! তার প্রেমিকা ! কেন এমন কিছু হলো যে ওরা আলাদা হলো ? আমি নিজের দাদাকে চিনি । সে বিশাল জেদী । এখন আমি কি করবো ? সব কিছু জেনেও দাদাকে আজীবন কষ্ট পেতে একা ছেড়ে দেবো ? না জ্যাঠা মশাইকে সবটা বলে দেবো ?
এদিকে রহস্য সমাধান করা একান্ত প্রয়োজন । তবে কি ফিরে সব জানাবো ? আর লীনা না মানে লীনা বৌদির বাড়ি তো কোথায় জেনে গেছি । থাক বাবা আর জ্যাঠা মশাই যা করার করবে। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব সেটাই করবো । আমি চেষ্টা করবো ওদের কাছে টেনে আনার ।
আমি নিজেকে একটু সামলে মলি , খোকন আর বাপির কাছে চলে গেলাম । দেখলাম বাচ্চাটা ওদের কাছে খেলছে । ওর মা নাকি লাজোর সাথে কিচেনে গেছে । আমি বাচ্চাটা দেখে ইমোশনাল হয়ে গেলাম। আমি ওর কাকা আর ও আমার একমাত্র ভাইপো।
মলিকে বললাম , এই বাড়ির মালিক পক্ষ হয়ে লীনা কেন কিচেনে গেল ?
মলি বলল , ব্যাসনের ফুলুরি বোমা তৈরির জন্য ।
বুঝলাম লীনা জানে দাদা ফুলুরি খেতে ভালবাসে কিনা তাই মনের রাস্তা খুঁজতে পেট দিয়ে যেতে চাইছে । আমি মনে মনে হাসলাম কিন্তু কিছুই বললাম না ।