Rima Goswami

Classics Children

4  

Rima Goswami

Classics Children

ঘনাদা রহস্য উন্মোচন পর্ব পাঁচ

ঘনাদা রহস্য উন্মোচন পর্ব পাঁচ

7 mins
415


ঘুমটা বেশ জড়িয়ে এসেছে তখন দাদা ফিসফিসিয়ে ডাকলো , এই বাবলু ওঠ ... 

ঘুম জড়ানো চোখে তাকালাম দাদার দিকে । আজব লোক তো ! গোটা ট্রেন অন্ধকার , সবাই ঘুমাচ্ছে । একা যেন দৈত্যটা আনমনে ছুটে চলেছে নিজের তালে । উনি এসেছেন ভূতের মত আমাকে ডাকতে ...

এই বাবলু শুনছিস .. ওই সাইড বার্থের লোকটাকে দেখছি না তো ? তুই একবার যা বাথরুমের দিকে । যদি ওখানে আছে ।

আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল ঘনাদার উপর । একেই আমি ভূতে একটু একটু ভয় পাই । তারপর নিজে না গিয়ে আমাকে বলে যা বাবলু দেখে আয় বাথরুমের দিকে ... 

কি রে ! যা ...

ঘনাদাকে এখন না করলে পড়ের বার আমাকে নির্ঘাৎ বাদ দেবে গোয়েন্দা অভিযানে ।

তাই ভয়কে বগলে চেপে বার্থ থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম বাথরুমের দিকে। যেতে যেতে ভাবলাম ঘনাদার কিসের দরকার ওই কম্বল জড়ানো লোকটার সাথে ? 

আর এই মাঝ রাতে তাকে খুঁজতে আমি বাথরুমের দিকে যাচ্ছি বা কেন ?

বাথরুমের দিকে গিয়ে কাউকে তো পেলাম না । সব কিছু শুনশান। কিন্তু দুরন্ত ছুটে চলা ট্রেনের খোলা দরজার কাছে টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে গেলাম । পড়েই যাচ্ছি প্রায় তখনি কে যেন হাতটা টেনে ধরলো আমার ।

আমার অর্ধেক শরীর বাইরে দিকে ঝুলছে । ওই হাতটা একটু আলগা হলেই আমি শেষ । চোখ বুজে ফেললাম ভয়ে ।

হ্যাঁচকা টানে ওই হাতের মালিক আমাকে টেনে তুলল উপরের দিকে ।

কানে এলো একটা গলা ... বাবলু ..

চোখ খুললাম দেখলাম ঘনাদা এসে দাঁড়িয়েছে।

আমি আমার ত্রাতার দিকে এবার তাকালাম ।

একি ! আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামাপদ ব্যানার্জি !

ঘনাদা বলল , আপনাকে আমি আগেই চিনতে পেরেছিলাম । তাই নিজে না এসে ভাইকে পাঠালাম দেখতে আপনি ঠিক আছেন কিনা। আমার ভাই আবার আপনাকে দেখতে এসে একটু হলেই প্রাণ হারিয়ে ফেলছিল ।

থতমত খেয়ে বললাম , ঘনাদা একটু হলেই প্রাণ বায়ু বেরিয়ে যাচ্ছিল । তুমি তো আমাকে বলতেই পারতে শ্যামাপদ বাবু আছেন আমাদের সাথে ।

শ্যামাপদ বাবু বললেন , দেবাশীষ বাবু আমাকে লুকিয়ে থাকতে হবে। চিত্রকূট পৌঁছে ওখানে আমি শ্যামাপদ ব্যানার্জির পরিচয়ে থাকতে পারবো না । তাহলে সন্দেহ করবে আমাকে অপরাধী । যে হয়ত আমার কোন কাছের মানুষ ।

ঘনাদা বলল , আহা আপনার আসার দরকার ছিল কি ? কেন এলেন ঝামেলা বাড়াতে ? এই তো বললেন যে আপনার জীবন সংশয় দেখা যাচ্ছে ।

আর এমন করে লুকিয়ে থেকে যাবার মানে কি ? আপনি গাড়িতে উঠে আমাকে জানাতে পারতেন । না আমাকে ভরসা করতে পারছেন না ? 

শ্যামাপদ বাবু জিভ কেটে বললেন , ছি ছি কি বলছেন আপনি ? আমি লুকিয়ে যাচ্ছিলাম কারণ আগে জানতে পারলে আপনি আমাকে বাধা দিতেন । আর শত্রু আমার চেনা কেউ হলে আমাকে নিশ্চই ফলো করবে । তো আপনার সাথে জনসমক্ষে কথা বলতে চাইছিলাম না । টয়লেট এসেছিলাম আর এই ছেলেটি নেহাত পড়ে যাচ্ছিল তো আমাকে সামনে আসতেই হলো ।

ঘনাদা : ঠিক আছে যেমন চলছিল , তেমন চলুক । ওখানে গিয়ে আমরা আলাদা আলাদা থাকবো । তারপর দেখা যাক । আমাদের নামার সময় হয়ে আসছে । 

আবার নিজেকে চাপা দিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন নিজের সিটে। আমি ঘনাদাকে ধিমে গলায় বললাম , আমার কেন জানিনা এই লোকটাকে রহস্যময় মনে হয় । আর যদি কেউ একে ফলো করে তো এই ঘটনার পর কি তার কিছু বুঝতে বাকি থাকবে ?

ঘনাদা : ক্যারি অন ভাই , তোর দ্বারা হবে । তবে এভাবে তুই পড়ে যাবি ভাবতে পারিনি । ওই লোকটা তোকে ঠিক সময় রক্ষা না করলে আজ কি যে হতো ভেবেই ভয় লাগছে ।

আমরা শুতে এলাম বার্থে । আধ ঘন্টা পরে নামতে হবে । এদিকে খোকন , বাপি আর মলি মোষ পড়ার মত ঘুমাচ্ছে । ওরা জানতেই পারলো না কি কান্ড হলো এদিকে ।

ঘনাদা বলল , ওদের কিছু জানাবার দরকার নেই আপাতত । আর এখন শুয়ে থাক একটু পরে সবকটাকে ডেকে দিবি।

মিনিট কুড়ি পর সবাইকে ডেকে দিলো দাদা । আমরা গুছিয়ে বসলাম । মলি মাঝ ঘুমে উঠে ঢুলছে বসে বসে । খুব ইচ্ছা করছে ওর মাথাটা নিজের কাঁধে রাখতে । কিন্তু ঘনাদা আছে তাই সেটা সম্ভব নয় ।

খোকন আর বাপি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নামার অপেক্ষায়।

গাড়ি স্টেশনে পৌঁছতে আমরা সবাই নেমে পড়লাম স্টেশনে । 

মলি স্টেশনে নেমে ঘনাদাকে বলল , এটা তো একটা ছোট্ট স্টেশন ! এখানে থাকার জন্য হোটেল পাওয়া যাবে !

স্টেশনে নেমে শ্যামাপদ ব্যানার্জির দেখা পেলাম না ঘনাদা বা আমরা কেউই । চিত্রকূট একটা পাহাড়ী দেহাতি এলাকা । স্টেশন থেকে আমরা পাঁচজন যখন বেরিয়ে এলাম বুঝতে পারলাম কলকাতা থেকে এখানকার পরিবেশ কতটা আলাদা । ভোর রাত এখন , স্টেশনের বাইরে হলুদ বিবর্ণ স্ট্রিট লাইট গুলো যেন আরো আঁধারে নিমজ্জিত গোটা এলাকাকে । এখন সময়টা না গরম আর না শীত । তবে এই পাহাড়ী এলাকা জুড়ে যেন একটা হিম ভাব আছে । পাহাড় গুলো যেন ঝুপসি বুড়ির মত লাগছে এই অন্ধকারে। স্টেশনের রাস্তা শেষ হতেই দেখলাম ছোট মেঠো পথট শুরু হলো যা দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে ।

ঘনাদা আমাদের বলল কোনদিকে যেতে হবে ব্যানার্জি বাড়ি পৌঁছাতে হলে !

পাশ কাটিয়ে একজন দেখলাম ডাইনে রাত ধরলো । আর যাবার আগে একটা হাতের ইশারা করলো ।

ঘনাদা বুঝল এ শ্যামাপদ বাবু ।

খোকন ঘুম জড়ানো চোখ কচলে বলল , বেমক্কা ট্রেন একটা । কি হতো এক দু ঘন্টা লেট করলে ?

আমরা ভোর বেলা নামতাম । তাহলে একটা রিক্সা তো পেতাম । 

বাপি ওর মাথায় চাটিয়ে দিয়ে বলল , চুপ পাজি ছেলে ... ঘনাদা আছে তো ভয় কি ?

মলি চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মত ঘনাদার পিছনে হাঁটছে । আমাকে ঘনাদা বলল , শ্যামাপদ ব্যানার্জি যদি ওনার বাড়িতেই উঠবেন তো এত ঝক্কি কেন করলেন ?

আমিও বুঝতে পারলাম না আসলে লোকটা কি চায়।  

দাদাকে বললাম , মনে হয় আমাদের পথ দেখিয়ে পৌঁছে অন্য কোনো জায়গায় আশ্রয় নেবেন ।

মলি বলল , আমরা কারো বাড়িতে উঠবো ? হোটেলে না ?

ঘনাদা : এখানে হোটেল পাবে না মলি । তাছাড়া তুমি একা একা হোটেল রুমে থাকতে পারবে ?

মলি একটু ঢোক গিলে বলল , না তা পারবো না ...

আমরা ঘনাদার পিছু পিছু সজাগ দৃষ্টি রেখে এগিয়ে চলেছিল সম্মুখ পানে। 

দিনের বেলা জায়গাটা কেমন জানিনা তবে এই রাতে জনমানবশূন্য মেঠো পথটি দিয়ে চলতে চলতে বেশ থ্রিল অনুভব করতে লাগলাম ।


খানিকটা হেঁটে একটা সাঁকো পেরিয়ে আমরা দাঁড়ালাম একটা বিশাল বড় পুরোনো বাড়ির সামনে ।

একটা বয়স্ক লোক লন্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল । আমাদের দেখে এগিয়ে এসে বলল , দেবাশীষ বাবু তো ?

ঘনাদা বলল , হ্যাঁ আমি দেবাশীষ ... আর এই আমার ভাইপো বাবলু আর ওরা আমার ছাত্র ছাত্রী।

লোকটি বলল , আমি এই ফেলে যাওয়া ব্যানার্জিদের বাড়ির কেয়াটেকার । আমাকে শ্যামা ফোন করে আপনাদের আসার কথা বলেছিল । তখন থেকে ঘর বার করছি । আসলে ট্রেন রাতে এসে দাঁড়ায় তো । এখানে বসতি কম তাই স্টেশন পেরিয়ে ডাইনে এলে প্রথম বাড়ি এটাই । 

আমরা ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে দেখলাম বিশাল বড় একটা অট্টালিকা । ভিতরে বিদ্যুৎ সংযোগ রইলেও রাস্তায় কোনো জায়গায় কিন্তু স্ট্রিট লাইট নেই । 

বাড়ির বাইরেটা দেখে যতটা অদ্ভুত লাগছিল আসলে ভিতর থেকে ততটাই সুন্দর ।

ঘনাদা বলল , আপনি একা থাকেন ? আর আপনার নাম জানা হলো না ?

কেয়ারটেকার বলল , আমার নাম ভৈরব সিং । আমার বিটিয়া লাজো থাকে এখানে আমার সাথে । বিবি বিহা করে কোন কালে চলে গেছে ।

মলি ফুট কেটে উঠলো , মানে !

একটা বছর কুড়ির মেয়ে বেরিয়ে এলো । সে মলিকে বলল , আমাদের এই এলাকায় মেয়েরা স্বাধীন। মাই অন্য মরদকে পসন্দ করেছিল । তাই চলে গেছে তার হাত ধরে ।

ভৈরব সিং মেয়েটিকে দেখিয়ে দাদাকে বলল , আমার বিটিয়া লাজো ।

ঘনাদা বলল , মলি আর চিন্তা নেই । তাহলে এখানেই পেয়ে গেলে সঙ্গী । এর সাথেই থাকবে তুমি ।

মলি টুক করে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলো ।

ভৈরব সিং বলল , আপনারা ঘুমিয়ে পড়বেন চলুন । সকালে উঠে আমি আপনাদের নাস্তা দেবো । স্নান সেরে তারপর এলাকা বেড়াতে যাবেন ।

ঘুমতে এসেছেন যখন তো এই ভৈরব সব দেখিয়ে দেবে আপনাদের ।

লাজো নিয়ে গেল মলিকে তার ঘরে । আর আমি , ঘনাদা , বাবলু আর খোকন একটা বিশাল ঘরে এলাম । দোতলার বারান্দা সহ রুমটা যেন ফুটবল খেলার মাঠ । রাজকীয় একটা খাট আর এন্টিক সব ফার্নিচার । আমরা চারটে মানুষে বেশ শুয়ে পড়লাম । ঘনাদা আমাদের বলল , ছাত্র আর স্যার এমনটাই থাকবি । কোন কথা না এখানে ।

খোকন বলল , দুর আমরা কিছু না বললেও ওই মলি সব বলে দেবে দেখবে ওই লাজো বলে মেয়েটাকে । একেই মেয়েদের পেটে কথা থাকে না । কি দরকার ছিল ওকে নিয়ে আসার ?

ঘনাদা একটু গলা খাকারি দিলো , কিছু বলল না ।

আমরা শুয়ে পড়লাম । শুতেই খোকন আর বাপি ঘুমিয়ে গেল । ঘনাদা এপাশ ওপাশ করছে , চোখে ঘুম নেই । 

আমি বললাম , দাদা শ্যামাপদ ব্যানার্জি কোথায় গেল ?

ঘনাদা বলল , সেটাই আমিও ভাবছি । কেমন যেন গোলমেলে লাগছে সবটা । একটা হাবেলি তাও এই পাহাড়ী এলাকাতে । যেখানে এককালে থাকত ব্যানার্জী পরিবারের লোকজন । তারা কেনই না চলে গেল এখান থেকে আর কেনই বা তাদের কুলদেবী এখানে রয়ে গেলেন ? কেনই বা চুরি হচ্ছে দেবী মূর্তি , আবার একটা সময় পর স্বস্থানে ফিরে আসছেই বা কেন ? শ্যামাপদ ব্যানার্জি এখানে চুপিচুপি কেনই বা আসলেন এমন করে , যেখানে ওনার প্রাণ হারিয়ে ফেলার ভয় আছে ।

আর এদিকে এই হাবেলীতে কেউ না থাকলেও কেমন যেন সাজানো এই বাড়িটা । একটু বেশি যেন সাজানো গোছানো । যেন একটু আগেই কেউ ছিল এই বাড়িতে ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics