Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

arijit bhattacharya

Horror Classics

1.5  

arijit bhattacharya

Horror Classics

নিশিডাক

নিশিডাক

10 mins
1.4K



গ্রামটাকে একনজরে দেখলে খুব সুন্দর বলে মনে হয় বাবু, কিন্তু রাতের বেলা ঘুমোবার সময় কেউ আপনার নাম ধরে ডাকলে কোনোমতেই ঘর থেকে বেরোবেন না। গলাটা চেনা কোনো মানুষের হতেই পারে,কিন্তু ঈশ্বরের দোহাই আপনি ঘর থেকে কোনোমতেই বের হবেন না।" চায়ের দোকানের মালিক রতনদার কথায় হো হো করে হেসে উঠল বিদিত। "কেন রাতের বেলা কি চোর ডাকাতের ভয় আছে নাকি, যে আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। কেসটা কি!" 

রতনদার সারা মুখমণ্ডলে খেলে গেল এক অবর্ণনীয় আতঙ্ক। "আরে চোর ডাকাত নয় কো মশাই,চোর ডাকাত নয়। রাতের বেলা এই গ্রামে যে ঘোরে সে হল ভয়াল নিশি। এক ভয়ঙ্কর প্রেতাত্মা। যার কবলে পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। রাতের বেলা সে আপনার বাড়ির দরজা কি জানালার সামনে এসে পরপর তিনবার ডাকবে। তিনবারের বেশি সে ডাকবে না,কিন্তু ভুলক্রমেও যদি আপনি তার ডাকে সাড়া দেন,তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য। এই ডাক যে সে ডাক নয়। এই ডাক যে সাক্ষাৎ মৃত্যুডাক। নিশি মানেই যে মৃত্যু।" 


এবার থাকতে পারলাম না আমি। খেঁকিয়ে উঠলাম রতনদার উপর," কি সব যে বল না তোমরা,বাইরের লোক দেখলেই ভয় পাইয়ে দাও ,আর কি!নিশি যে রাত্রে বেরোয় আর নিজের শিকারের উদ্দেশ্যে মৃত্যুডাক দেয়,তার কি কোনো প্রমাণ আছে!" রতনদা আঁতকে উঠল,"প্রমাণ কি বাবু। গত তিন মাসে সাতজন মারা গেছে এই নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে। এই সাতজনেরই একজন রমাপদ। শহরে গিয়ে ব্যবসা করে। তিনমাস পরে দেশের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল।রাতের বেলা রমাপদ আর শান্তনু একইসাথে একইঘরে ঘুমোচ্ছিল। একসময় রমাপদ শুনতে পায় ঠিক তার জ্যেঠু শ্যামাপদ চক্রবর্তী যে পাশের গ্রামে থাকে,বাড়ির সামনে রমাপদর নাম ধরে ডাকছে। রমাপদরা বাইরের রাস্তার দিকের ঘরে শুয়েছিল। এতো রাতে জ্যেঠু ডাকছে কি ব্যাপার! দরজা খুলে সামনে কাউকে দেখতে পায় নি রমাপদ।শুধু একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল তার শরীরে। আর ওখানেই মৃত্যুতে লুটিয়ে পড়েছিল সে। যেন কোনো অদৃশ্য মায়াবী শক্তি এক অজানা মন্ত্রবলে বের করে নিয়েছিল তার শরীরের প্রাণবায়ু। শান্তনু সব ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছে।" থামলেন রতনদা।


"কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে,শান্তনু মিথ্যা কথা বলছে। এমনোও তো হতে পারে,রমাপদর মৃত্যু হার্টফেল বা অন্য কারণে হয়েছে। " নিজের যুক্তিতে অটল বিদিত।

"আরে তোমরা শহরের ছেলেরা বিশ্বাস করতেই চাইবে না। কিন্তু সারা গ্রামে ছড়িয়ে গেছে এই নিশির কথা।" 


গ্রামের নাম কৃষ্ণপুর চক,নদীয়ার কালিনারায়ণপুরের খুব কাছে। মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরত্বে। গ্রামের মূল আকর্ষণ বলতে দিগন্তবিস্তৃত চোখ জুড়ানো সবুজ ধানক্ষেত, পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চূর্ণী নদী,পূর্বপ্রান্তের বাওড়,পঞ্চাননতলা আর গ্রামবাসীদের বুক ভরা ভালোবাসা আর আন্তরিকতা। এটা আমাদের দেশের গ্রাম,আমার সাথেই বিদিত এই গ্রামে বেড়াতে এসেছে। 


নিশিডাকের ব্যাপারটা দেখলাম গ্রামের অনেকেই জানে। পঞ্চাননতলার শিবমন্দিরের পুরোহিত জানালেন অদ্ভুত এক ইতিহাসের কথা।


গ্রামের পুরোহিত বলেছিল অদ্ভূত এক কথা। সাত বছর আগে এই গ্রামে আগমন ঘটে এক কাপালিকের। তিনি গ্রামের পশ্চিম প্রান্ত যেখানে শ্মশান, হেমন্তের সাঁঝে উড়ে যায় শবপোড়ানোর ধোঁয়া, জ্বলে কাঠের চিতা,অমাবস্যা ও ভূতচতুর্দশীর রাতে শুরু হয় অপদেবতাদের আনাগোনা , সেই বলতে গেলে প্রায় জনমানবহীন শ্মশানের একপ্রান্তে একটি কুটির তৈরি করে সেখানে নিজের সাধনা সম্পন্ন করতে। কাপালিকের সারা অঙ্গ ভস্মে মাখা ,চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। সারা গ্রামে রটে যায় যে কাপালিক পিশাচসিদ্ধ। এমনিতে কাপালিক যা বলেছিলেন তার অর্থ হল যে,তন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করা তার এখনো বাকি আছে। এবং যে তিনি এইবার সিদ্ধিলাভ করতেই এই গ্রামে এসেছেন। এই গ্রামেই স্থাপনা করতে চান তিনি তাঁর সাধনপীঠ। যাই হোক,গ্রামের ধর্মপ্রাণ মোড়লেরা কাপালিকের প্রস্তাবে সায় দেয়। কাপালিকও পরিবর্তে কথা দেন যে, এর পরিবর্তে গ্রামকে নানা দুর্ভিক্ষ,রোগব্যাধি ও মহামারীর হাত থেকে রক্ষা করবেন। 

যাই হোক,কাটতে লাগল দিন। এদিকে প্রতি অমাবস্যার রাতে গ্রাম থেকে নিখোঁজ হতে লাগল এক এক পূর্ণযৌবনা সুন্দরী যুবতী। গ্রামের মানুষের মনে মননে দানা বাঁধতে লাগল সন্দেহ। 


একদিন গ্রামের মানুষ হাতেনাতে ধরে ফেলে কাপালিকের কুকীর্তি। কাপালিক নিজের তান্ত্রিক শক্তির মাধ্যমে কুমারী যুবতীদের রাতে সম্মোহিত করে নিজের আশ্রমে ডেকে নিতেন। তারপরে তাদের সাথে যৌনসংসর্গে লিপ্ত হয়ে সেই কাপালিক সিদ্ধিলাভের দিকে এগোতেন। হয়ে উঠত তারা কাপালিকের সাধন সঙ্গিনী। তারপর তাদের নির্মম ভাবে হত্যা করে গভীর অরণ্যে তাদের লাশ ফেলে দিতেন। শেয়াল কুকুরে তা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত।

পুলিশের হাতে সেই কাপালিককে তুলে দেয় সাধারণ মানুষ। কাপালিক ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যে,এই গ্রামের মানুষদের জন্য তিনি তন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করতে পারেন নি। প্রতিশোধ তিনি নেবেনই। এইবার থেকে এই গ্রামে স্বয়ং মৃত্যু গভীর রাতে ঘুরে বেড়াবে তার শিকারের খোঁজে। মৃত্যু ততক্ষণ গভীর রাতে শিকারের জন্য গ্রামের উপর ঘুরবে যতক্ষণ না পুরো গ্রাম জনশূন্য পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। 

এই মৃত্যুদূত প্রেতকে কাপালিক নিজের তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে সৃষ্টি করবেন। বলা বাহুল্য,এই প্রেতই নিশি ,এই নিশি যাকে শিকার করবে তার বাড়ির সামনে গিয়ে পরপর তিনবার ডাক দেবে তার খুব পরিচিত গলায়। সেই মানুষ যদি নিশির এই মৃত্যুডাকে ভুলক্রমে সাড়া দিয়েও থাকে,তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য। এই নিশির হাতছানি এড়ানো খুবই কঠিন। 


এরপর থেকেই অভিশপ্ত হয় গ্রামটি। ঘটতে থাকে গভীর রাতে নিশির ডাকে একের পর এক মৃত্যু। কাউকে নিশি ডাকে হুবহু তার মায়ের গলায়,আবার কাউকে ডাকে কোনো দূরের আত্মীয়র গলা হুবহু অনুসরণ করে,আবার কাউকে ডাকে তার পরম বন্ধু অথবা কাউকে ডাকে তার প্রেমিকার গলা নকল করে। পরপর তিনবার ডাকবে,তার বেশি নয়।আর সেই ডাকে সাড়া দিয়েছ কি তোমার আয়ু চলে যাবে কাপালিকের কাছে বন্দি হয়ে। আর তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে তুমি।


এতক্ষণ বলে থামলেন শিবমন্দিরের পুরোহিত। আমরা বলে উঠলাম,"তাহলে কি এই নিশির ডাকের কোনো অন্ত নেই। এইভাবেই চলতে থাকবে নিশির ডাকে একের পর এক মৃত্যু!"


অনেকক্ষণ ধরে ভাবলেন পুরোহিত। তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠল।বহুক্ষণ ভেবে বললেন ,"উপায় আছে ,উপায় আছে। যদি নিশির কবলের থেকে কেউ কোনো দৈববলে তার শিকারের জীবন রক্ষা করতে পারে,তাহলে নিশির অন্ত অনিবার্য। "


বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম,"মানে!" আমার পিঠে হাত রেখে পুরোহিত বললেন,"মানে খুব স্পষ্ট! গভীর রাতে যখন গ্রামের লোক গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন,তাদের এই নিদ্রা অন্যদিনের থেকে একদম অন্যরকম কারণ নিশি সবাইকে তার সম্মোহনী যাদুমন্ত্রে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে ,তখন নিশি এসে পরপর তিনবার ডাক দেবে তার শিকারকে। এই ডাক মৃত্যুডাক। অর্থাৎ,সে যদি এই ডাকে সাড়া দেয় ,তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু ধরুন, সাড়া দিল কিন্তু কোনো দৈব কারণের জন্য নিশি তার আয়ুকে করায়ত্ত করতে পারল না,সেক্ষেত্রে নিশির অন্ত অনিবার্য।"


এই বলে চুপ করলেন পুরোহিতমশাই। কেটে গেল কিছু নীরব মুহূর্ত।


আমার বন্ধু বিদিতের দিকে অনেকক্ষণ ধরে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকলেন পুরোহিতমশাই। তারপর বললেন,"বাবা ,তোমার যা লক্ষণ দেখছি সাবধানে থেকো। আজ রাতে তোমার মৃত্যুর ফাঁড়া রয়েছে। জান তো ,আজ শনিবার। আর এই গ্রামে প্রতি শনিবার রাতেই নিশি বেরোয়।" অদ্ভূত এক গর্বের হাসি ফুটে উঠল বিদিতের মুখমণ্ডলে। "যাক গে,আজ রাতে তাহলে নিশির সাথে মোলাকাত হচ্ছেই। কতো ইচ্ছা ছিল আমার। এই নিশি কি জিনিস সেটা দেখার! আর আমার মনের ইচ্ছা যে এতো তাড়াতাড়ি ,এতো সহজে পূরণ হবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। পুরোহিত মনঃক্ষুণ্ণ হলেন হয়তো। "না বাবা,নিশি সত্যিই আছে। ঐ যে দেখ। " এরপর সামনের শিবমূর্তিতে আমরা যা দেখলাম ,তাতে চমকে ওঠার অনেক কিছু ছিল। শ্বেতপাথরের বেদীতে বসানো শ্বেতপাথরের মূর্তি,এক অদ্ভূত দৈব জ্যোতি বিকিরণ করছে। কিন্তু,মূর্তির একজায়গা ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ। রঙ কালো নয়,কিন্তু মনে হয়েছে কেউ যেন একরাশ অন্ধকার ঐ জ্যোতির্ময় মূর্তির গায়ে লেপে দিয়েছে। অবাক হয়ে আমি বলে উঠলাম ,"এটা কি!"

"এর মানে এটাই যে,কোনো ভয়ঙ্কর অশুভ কিছু এই গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেটাই এই গ্রামের পবিত্রতা নষ্ট করছে। আর এই অশুভ জিনিসের উপস্থিতির চিহ্ন হল ঈশ্বরের জ্যোতির্ময় শরীরে এই কালিমা। ঈশ্বর সবাইকে সাবধান করে দিয়েছেন। আর আমার মতে এই অশুভ আর কেউ নয়,গভীর রাতে ঘুরে বেড়ানো নিশি।"


এবার আমি সত্যিই ভয় পেলাম। নিজের চোখে যা দেখলাম,তাকে অবিশ্বাস করি কিভাবে! তাহলে কি বিদিতের বাঁচার কোনো চান্স নেই । তাহলে কি আজ রাতে সত্যিই বিদিতের পালা। ভয়ে ভয়ে আমি গ্রাম্য পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করলাম," আপনি যদি সত্যিই বিদিতের মধ্যে মৃত্যুলক্ষণ দেখে থাকেন,তাহলে কি ওকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই!"

পুরোহিতমশাই বললেন,"দেখ বাবা,তোমার বন্ধুর বাঁচার ক্ষীণ লক্ষণ রয়েছে। কিন্তু সে লক্ষণ এতো দুর্বোধ্য যে, এর মাথামুণ্ডু আমি কিছু উদ্ধার করতে পারছি না। " আমি জোর করে বললাম,"দেখুন ,ও গোঁয়ার হতে পারে,আপনার সাথে তর্ক করতে পারে, আপনাকে অপমান করতে পারে। ওর হয়ে আমিই না হলে ক্ষমা চাইলাম আপনার কাছে। আপনাকে বলতেই হবে,ওর বাঁচার উপায়।" 


"দেখ বাবা,উপায় তো আছে। নিশির ডাকে পাওয়া অবস্থাতে ও যদি এমন কোনো পবিত্র বাড়িতে পা রাখে,যেখানে গিন্নি তাঁর স্বামীর বুকে পা রাখে আর এভাবেই ঐ বাড়ির পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ থাকে,তাহলে ও বেঁচে যাবে। নিশি ওর বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু,যে বাড়িতে গিন্নি তাঁর স্বামীর বুকে পা রাখেন,সেই বাড়িকে কি পবিত্র বলা যায়! এই কথার মাথামুণ্ডু আমি মর্মোদ্ধার করতে পারছি না। " এই বলে থামলেন পুরুতমশাই।

"আমিও তো কিছু বুঝতে পারলাম না।" হতবাক হয়ে বললাম আমি।

"বুঝলে তো বাবা,সংকেতটা এমনই দুর্বোধ্য আর জটিল।আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না,তোমায় কি বলব বল।" পুরোহিতমশাইয়ের গলায় একরাশ হতাশা।


------------------------------------------------------------------------


মন্দির থেকে ভগ্নচিত্তে আমরা মামার বাড়ি ফিরে এলাম। এইখানেই আমরা ঘুরতে এসেছি। পড়ে আসছিল সূর্যের আলো। সন্ধ্যা থেকেই দেখা যেতে লাগল পরিবর্তন। বোঝাই যাচ্ছিল,আজকের রাতটা আর পাঁচটা রাতের থেকে আলাদা হবে। সন্ধে হতে না হতেই দোকানীরা দোকানের ঝাঁপ ফেলে দোকান বন্ধ করতে লাগল। গৃহস্থরাও তাড়াতাড়ি নিজের বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করতে ব্যস্ত। বোঝাই যাচ্ছে,সারা গ্রামকে এখন একটা আতঙ্ক ঘিরে রেখেছে। রাস্তাঘাটে লোকজন কমে আসতে লাগল। রাত আটটার মধ্যে সবকিছু সুনসান।

রাতের খাওয়া দাওয়া ভালোই হল। বেনারসী চালের ভাত আর সেই সঙ্গে দেশী মুরগীর মাংস। আমরা সাড়ে দশটার সময় শুতে এলাম। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল আমাদের শোবার ঘরটা একতলায় বাইরের রাস্তার দিকে। নিশির শিকার করার পক্ষে এক আদর্শ স্থান। ঠিক করেছি আজ রাতে আমি ঘুমাব না। আমার বন্ধু বিদিতের মাথার ওপর ঘুরছে মৃত্যুর ফাঁড়া। না,সারাদিন ভেবেও পুরুতমশাইয়ের দেওয়া সংকেতটির মর্মোদ্ধার করতে পারি নি। নিশি হয়তো সবাইকে তার মায়াবী শক্তিতে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে,কিন্তু আমায় পারবে না। তাই আমি পুরোহিতের কাছে চেয়ে এনেছি,মহাদেবের মন্ত্রপূত রুদ্রাক্ষ। এই রুদ্রাক্ষ গলায় ধারণ করলে নিশির সম্মোহনী শক্তি আর আমার ওপর খাটবে না। আজ এই শনিবারের নিশীথে বিদিতকে বাঁচানোর চান্স আমি নেবই।


একই খাটে বিদিত আর আমি পাশাপাশি শুয়েছি। নিশি বিদিতের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না,আজ রাতে চোখের পাতা পড়বে না আমার।


দূরে কোথাও ডেকে উঠল অজানা এক রাতজাগা পাখি। শোনা গেল বাঁশবাগানের দিকে শেয়ালের হুক্কাহুয়া। একপাল শেয়াল একসঙ্গে ডেকে এক প্রহরের সমাপ্তি ও অন্য প্রহরের সূচনা ঘোষণা করে। তাই শেয়ালকে বলা হয় যামঘোষক। সে যাই হোক,রাত মোটামুটি বারোটা হবে। একের পর এক প্রহর অতিবাহিত হয়ে চলেছে। ওদিকে নিশির দেখাই নেই। তাহলে কি নিশিকে নিয়ে গাঁয়ে যা রটেছে সবটাই কি মিথ্যা,সবটাই কি অর্থহীন,অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামবাসীদের কল্পনা! আর আমি বৃথাই ডুমুরের ফুলের জন্য রাত জেগে বসে পণ্ডশ্রম করছি। এতক্ষণ ধরে যে থ্রিলটা ফিল হচ্ছিল ,সেটাই নষ্ট হতে বসল।


বিদিতের দিকে তাকালাম,অঘোরে ঘুমোচ্ছে ছেলেটা।আহা, কি নিষ্পাপ লাগছে ছেলেটাকে!ছোটবেলা থেকেই বিদিত আমার খেলার বন্ধু,সুখ দুঃখের পরম সাথী। তাও কৈশোরে আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল যখন আমরা দুজনেই একইসাথে সুস্মিতার প্রেমে পাগল হয়ে গেছিলাম ক্লাস নাইনে পড়ার সময়। 


ক্লাস নাইনের ঘটনা। কোঁকড়ানো চুলের বার্বি ডল সুস্মিতার জন্য আমরা দুজনেই পাগল। আমার স্বপ্ন,ধ্যান জ্ঞান সবই ছিল সুস্মিতাকে ঘিরে। আর বিদিতেরও তাই। এর ফলে শুরু হল রেষারেষি,আর তা ফাটল সৃষ্টি করল আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে। সুস্মিতা হয়তো কোনোদিনও মুখ ফুটে বলে নি,কিন্তু আমার মনে হয় ও বিদিতকেই ভালোবেসে ফেলেছিল। সুস্মিতার পাবার আশায় আমাদের মধ্যে শুরু হয়েছিল তীব্র এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলাম এককালের প্রিয় বন্ধুর প্রতি। কিন্তু বিধাতার প্ল্যান হয়তো অন্য রকম ছিল!


ক্লাস ইলেভেনের ঘটনা। নন্দাদেবী পাহাড়ে ট্রেকিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় সুস্মিতার। শোকে বুক ভেঙে যায় আমাদের দুজনেরই। আর হয়তো এই শোক আবার মিলিয়ে দেয় আমাদের দুজনাকে। 


কেটে যাচ্ছিল সময়। ডুবে গিয়েছিলাম অতীতের স্মৃতিচারণে। আমার চিন্তাকে ছিন্ন করে দিয়ে জানালা দিয়ে নারীকন্ঠে আওয়াজ ভেসে এল,'বিদিত'। আশ্চর্য,হুবহু সুস্মিতার গলা!


এককালের ভালোবাসার মুখে নিজের নাম শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বিদিত। আমিও উঠে বসলাম। ভালোই বুঝতে পেরেছি,বিদিতকে এখন নিশিতে পেয়েছে,ওকে আটকানো অসাধ্য।

আবার আওয়াজ এল,"বিদিত,আমি সুস্মিতা। এসেছি তোর কাছে । প্লিজ দরজা খোল।" জানতাম লাভ হবে না,তাও বিদিতকে বারবার নিষেধ করলাম আমি। বললাম,এসব সবই ওর শোনার ভুল। এই ঠাণ্ডা রাতে দরজা খোলা ঠিক হবে না। ঠাণ্ডা হাওয়া আসবে।

আমার নিষেধ করা সত্ত্বেও দরজা খুলে দিল বিদিত। ওকে আটকায় কার সাধ্য।ওর শরীরে এখন অতিলৌকিক আসুরিক শক্তি!

দরজা খুলতেই একরাশ ঠাণ্ডা হাওয়া প্রবেশ করল ঘরে। সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিল। ভালোই অনুভব করলাম যে,এই হাওয়া ইহজগতের নয়। কোনো এক অলৌকিক অতীন্দ্রিয় জগৎ থেকে উঠে আসছে। 

দরজার বাইরে একরাশ শূন্যতা। বাইরে কেউ নেই। বিদিত বেরোতে যেতেই ওকে আটকাতে গেলাম আমি। আমাকে ও ছিটকে ফেলে দিল ,তারপর বেরিয়ে গেল দরজা খুলে।


না,বন্ধুকে বাঁচাতেই হবে এই ভয়ঙ্করী নিশির হাত থেকে। বিদিত অনেক দূরে চলে গেছে। পেছনে ছুটলাম আমি।


শুনশান রাস্তা। চারিদিক অস্পষ্ট কুয়াশায় আচ্ছন্ন। আর এই ধোঁয়াটে কুয়াশার ওপর স্নিগ্ধ চন্দ্রালোক এক রূপালী মায়াবী প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করেছে। সেই কুয়াশার অস্পষ্টতার মধ্যেও দেখতে পাচ্ছি এক সাদা ছায়ামূর্তি বাতাসে বলতে গেলে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তাকে অনুসরণ করেছে বিদিত। বিদিতের দেহে এখন আসুরিক শক্তি। মৃত্যু এখন বিদিতকে আকর্ষণ করছে ওর ভবিতব্যের দিকে। ওকে এখন থামানো অসাধ্য।


আধঘন্টা হেটেছি,বলতে গেলে গ্রামের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে এসেছি। এই সময় ঘন্টার শব্দে চমক ভাঙল আমার। আরে,এটাই সেই ভগ্নপ্রায় মহাকালীর মন্দির না,আগে যেটার কথা শুনেছিলাম। মন্দিরটি পরিত্যক্ত,কিন্তু এখন যেন কোনো অদৃশ্য দৈববলে ঘন্টাগুলি বাজতে শুরু করেছে। মন থেকে কেটে গেল অজ্ঞানতার অন্ধকার। সকালবেলা শিবমন্দিরের পুরোহিতমশাই বিদিতকে নিশির হাত থেকে বাঁচানোর যে রহস্যময়  সঙ্কেতের কথা বলেছিলেন,এক নিমেষে তার প্রকৃত অর্থ প্রতীত হল আমার চোখের সামনে।

মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা যিনি পার্বতীরই অপর প্রতিরূপ, তিনি শক্তি,সৃষ্টি ও সময়ের প্রতীক। তিনি লোলজিহ্বা বার করে তাঁর স্বামী মহাকালের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পবিত্র গৃহ বলতে পবিত্র মন্দির। এখানে মহাকাল পুরুষ আর মহাকালী প্রকৃতি। যার অর্থ প্রকৃতির স্পর্শেই পুরুষের মধ্যে চৈতন্যশক্তি আসে। অর্থাৎ,দৈবশক্তি আবির্ভূত হয়।


না,বিদিতকে বাঁচাতেই হবে। বিদিতের দেহে নিশির দরুণ তখন প্রবল আসুরিক শক্তি। একমাত্র কোনো দৈব শক্তিই পারে ওর এই শক্তিকে দমিত করতে। আর দেরি নয়,বিদিতকে জাপটে ধরলাম পিছন থেকে আর ওকে পরিয়ে দিলাম মহাদেবের মন্ত্রপূত রুদ্রাক্ষ,যেটা এতক্ষণ আমার গলায় ছিল। আর সেটা ওর গলায় পরিয়ে দিতেই স্তিমিত হয়ে এল ওর শক্তি। আর ওকে পাঁজাকোলা করে আমি ঢুকলাম মন্দিরের মধ্যে।


আর,তারপরে যা ঘটল তা অকল্পনীয়। কোথা থেকে এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে বাজতে শুরু করল ঘন্টাগুলি,এক অদ্ভূত দৈব আভায় ভরে উঠল চারিদিক আর আগুন লেগে গেল বাতাসে ভেসে চলা নিশির গায়ে। মুহূর্তে নিশি শূন্যে মিলিয়ে গেল।


হ্যাঁ,সেই ভয়ঙ্কর অশুভ রাতে মা কালীর আশীর্বাদে আমার প্রাণের বন্ধু বিদিতকে বাঁচাতে পেরেছিলাম নিশির কবল থেকে। আর সেই রাতেই দেবীর মহিমায় ধ্বংস হয়েছিল অশুভ নিশি। পুরো গ্রাম অভিশাপমুক্ত হয়েছিল। পরের দিন আমরা যখন পঞ্চাননতলার শিবমন্দিরে গেলাম পুরোহিতমশাইয়ের সাথে,তখন লক্ষ্য করলাম শিবমূর্তির মধ্যে অন্ধকার দাগ সম্পূর্ণ অদৃশ্য। আর বিদিতও প্রণাম করেছিল পুরোহিতমশাইকে। এর পর আর ঐ গ্রামে নিশির ডাকের ঘটনা ঘটে নি। গ্রামবাসীদের মনে ফিরে এসেছিল আনন্দ আর শান্তি। 

আর সেই রাতেই বুঝেছিলাম যে,অবিচল ভক্তি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। ভক্তির এতটাই শক্তি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror