Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sayantani Palmal

Horror Tragedy Classics

2.8  

Sayantani Palmal

Horror Tragedy Classics

গভীর রাতের অতিথি

গভীর রাতের অতিথি

13 mins
472



9 জুন, 2018


পাহাড়ী অঞ্চলে বর্ষাকাল বড় ভয়ংকর। প্রায়শ সে ধ্বংসের বার্তা নিয়ে আসে। এইসময় রাত্রিবেলা পেট্রোলিং করা যে কি কষ্টদায়ক কাজ সে যাকে করতে হয় শুধু সেই বোঝে। 

“ টিটু গাড়ি সাইড মে লাগাও। বারিষ বহত হ রাহি হ্যায়। আগে তো রাস্তা ভি খারাব হ্যায়।”

“ জি স্যারজি।”

তরুণ পুলিশ ইন্সপেক্টর মোহিত রাও আর কনস্টেবল টিটু থাপা এই দুজনের আজ পেট্রোলিং এর ডিউটি। অন্যসময় হলে এমন দুর্যোগের রাতে কেউ বেরোয় না কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনুকূল নয়। শহরে চাপা অশান্তির আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। একটু হাওয়া পেলেই সেই সুপ্ত অঙ্গার তার লেলিহান বাহু বিস্তার করে সারা শহরকে দগ্ধ করবে তাই ওপর থেকে নির্দেশ আছে কোনও রকম শিথিলতা বরদাস্ত করা হবে না। বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বাড়ছে আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। পুরনো গির্জার মাঠের পাশে বোলেরোর কাঁচ তুলে দিয়ে বসে রইল দুজনে। একটু তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল। গাড়ির কাঁচে উপর্যুপরি আঘাতের শব্দে নিদ্রাচ্ছন্ন ভাব দূর হয়ে সচকিত হয়ে উঠল দুজনে। গাড়ির ভেতরের আলোয় অনুমান করল কেউ হাত দিয়ে ক্রমাগত চাপড়ে চলেছে। বিস্মিত মোহিত টিটুর দিকে তাকালো।

“ স্যারজি, লাগতা হ্যায় কোই মুসিবত মে হ্যায়। মাদত মাঙ্গ রাহা হ্যায়।”

“ ইউ আর রাইট।”  

গাড়ির কাঁচ নামিয়ে মোহিত বলল, “ কৌন হ্যায়?”

প্রতুত্তরে ঝোড়ো বাতাসের শনশন আওয়াজ ছাড়া কিছুই ফেরত পেল না সে। বাইরে রাতের গহন অন্ধকার ভেদ করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টির ঝাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার চোখমুখ। হঠাৎ করে মোহিতের দমবন্ধ হয়ে এল। একটা বজ্র মুষ্টি তার গলায় চেপে বসেছে। 

“ স্যারজি ক্যায়া হুয়া? ক্যায়া হুয়া?” টিটু চিৎকার করে উঠে মোহিতকে বাঁচবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল কিন্তু পরমুহূর্তেই সেও বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আঁধার রাতের আগন্তুক তার অন্য হাতটা দিয়ে চেপে ধরেছে টিটুর গলা। তার লম্বা তীক্ষ্ণ নখ বিদীর্ণ করে দিচ্ছে টিটুর গলার চামড়া। অমানুষিক শক্তি তার শরীরে। দুই শক্ত সামর্থ্য যুবক ছটফট করতে করতে এগিয়ে যেতে লাগলো মৃত্যুর দিকে।


14 জুন, 2018

রাত প্রায় বারোটা। মুখ তুলে একবার ওপরের দিকে তাকিয়ে অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করল কদম। আকাশের অবস্থা ভালো নয় যেকোনো মুহূর্তে আবার বৃষ্টি নামবে। কয় দিন ধরে ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে চলেছে। এই দুর্যোগ কবে থামবে কে জানে। রাস্তাঘাট স্বাভাবিক ভাবেই শুনশান। এই দুর্যোগের মধ্যে বেরিয়ে দুজন পুলিশের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটায় এই কদিন আর পুলিশ পেট্রোলিং ও নেই । যদিও ঘটনাটা গোটা শহরে আড়লন ফেলে দিয়েছে। তবে কদমের পক্ষে ভালোই হয়েছে। নিশ্চিন্তে কাজ সেরে ফিরতে পারবে। রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হয়ে আছে তাই বাইকের গতি বাড়াতে পারছে না নাহলে অনেক আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যেত। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ এর আলো তরোয়ালের ফলার মত কালো আকাশের বুকে চিরে দিচ্ছে। আচমকা ব্রেক কষতে বাধ্য হলো সে। পিচ্ছিল রাস্তায় প্রায় উল্টে পড়ে যাচ্ছিল। যা হোক করে সামলাল।

“ কৌন হ্যায় রে? ইস তারহা বিচ সড়ক পে খাড়ে কিউ হ?” রেগে উঠে বলল কদম কিন্তু রাস্তার মাঝে দাঁড়ানো দীর্ঘদেহী লোকটির কোনও ভাবান্তর ঘটল বলে মনে হয় না। হুড লাগানো কালো লং কোট পরা ব্যক্তিটির মুখটা অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না। হুডটাও অনেকটাই নামানো। গাড়িটা স্ট্যান্ড করে কদম তার মুখমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। ও জানে না রাতদুপুরে কার সাথে লাগতে এসেছে। কদম কাছে আসতেই আগন্তুক তার মাথার হুডটা খুলে ফেলল। বাইকের হেড লাইটের আলোয় তার মুখের দিকে তাকিয়েই কদমের সারা শরীর দিয়ে আতঙ্কের শীতল স্রোত প্রবাহিত হলো। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখ আর জ্বলন্ত দুটি অঙ্গারের মত চোখ দেখে কয়েক মুহূর্ত কদম বাকশক্তি রোহিত হয়ে গেল। তারপর অস্ফুটে তার মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দই নির্গত হলো, “ পিটার!” তার মন বলে উঠল পালাতে হবে কিন্তু পালাবার উপক্রম করতেই দুটো হাত তার কানের দুপাশ চেপে ধরলো। মুহূর্তের মধ্যে কদমের মুন্ডুটা উড়ে গিয়ে পড়ল তার বাইকের সিটে আর মুন্ডহীন ধড়টা ধপ করে একটা আওয়াজ করে পড়ে গেল রাস্তার ওপর। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির জলের সাথে কদমের রক্তস্রোত মিলেমিশে হারিয়ে যেতে লাগলো পাহাড়ি পথের বাঁকে। মধ্যরাতের আগন্তুক তার কাজ শেষ করে চলল পরবর্তী শিকারের উদ্যেশ্যে। 


  পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কিছুটা উঠে গেল জাগিয়া। বড় একটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় খুঁজে নিল সে। রেইনকোট চুঁইয়ে জল ঢুকে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার জামাকাপড়। এ কদিন সে লুকিয়ে ছিল নিচের একটা পাহাড়ি গ্রামে। শহরে থাকাটা নিরাপদ মনে হয় নি তার। আজ রাতের অন্ধকারে শহরে ফিরে যাবে ঠিক করেছিল কিন্তু এই বৃষ্টিটা বড় জ্বালাচ্ছে। কাঁধের ওপর একটা স্পর্শ অনুভব করে পেছন ফিরল জাগিয়া। 

“ কৌন?” আগন্তুক নিরুত্তর। হাতের পাঁচ সেলের টর্চটা জ্বালাতেই আলো আর বৃষ্টির খেলার মধ্যে পৈশাচিক চেহারাটা দেখে জাগিয়ার হৃদস্পন্দন বন্ধ হবার উপক্রম করল। গলা শুকিয়ে আসছে, নিশ্বাস ঘন হচ্ছে তার। বেশিক্ষণ কষ্ট অনুভব করতে হলো না তাকে। তীক্ষ্ণ দাঁতের কামড়ে গলার নলিটা দুফাঁক হয়ে সে সব যন্ত্রণার উর্দ্ধে চলে গেল। জাগিয়ার মৃতদেহটা গড়িয়ে পড়ল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। 


19 জুন, 2018


 ঘুমিয়ে ছিলেন সিরিল ডিসুজা। স্বামী মারা যাবার পর থেকে একাই থাকেন এই ছোট্ট একতলা বাড়িটায়। আগামী বছর হসপিটালের নার্সের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর দিল্লিতে ছেলের কাছে চলে যাবেন ঠিক করে রেখেছেন। “ ভো উ উ উ” নিজের পোষ্য আলসেশিয়ান রকির চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেল সিরিলের। রকি সারারাত বাগানে ঘুরে বাড়ি পাহারা দেয়। রকি ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছে। সিরিলের মনটা কু ডাকলো। নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। হয়ত কোনও চোর বাগানে ঢুকেছে নাহলে রকি এরকম করবে না। এমনিতে সিরিল বেশ সাহসী মহিলা। হাতে একটা লাঠি আর ছাতা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। বাগানের আলোটা সারা রাতই জ্বলে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। হিসেব মত রকি ওর জন্য বাগানে যে শেডটা করা আছে সেখানে থাকার কথা। রকির চিৎকারটা আচমকা বন্ধ হয়ে গেছে। ওকে আশেপাশে দেখতে পাচ্ছেন না সিরিল। বাগানের ভেজা মাটিতে পূর্ণবয়স্ক মানুষের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে গোলঞ্চ গাছটার কাছে পৌঁছে শিউরে উঠলেন সিরিল।

“ রকি মাই চাইল্ড!” কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। তাঁর নিঃসঙ্গ একাকী জীবনের একমাত্র সাথীর রক্তাক্ত মৃতদেহটা কাদার মধ্যে পড়ে আছে। রকি ছিল তাঁর পুত্রসম। অবলা জীবটাকে কে এমন করে মারল? ধড়-মুন্ডু আলাদা হয়ে গেছে রকির। হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন সিরিল। শোকে কাতর সিরিল কয়েক মুহূর্ত বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে ছিলেন। সম্বিৎ ফিরল তাঁর ঠিক পেছনেই কারুর অস্তিত্ব অনুভব করে। বাগানেই স্বল্প আলোয় অনুপ্রবেশকারীর চেহারা দেখেই চিৎকার করে উঠলেন সিরিল। কালো লং কোট পরিহিত আগন্তুক যে ইহজগতের বাসিন্দা নয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তার বুকে ছোট্ট একটা বুলেটের সাইজের গোল ফুটো। সিরিল কাঁপতে কাঁপতে বাগানের মাটিতে থেবরে বসে পড়লেন। তাঁর অন্তিম প্রহরের দিকে যে ঘড়ির কাঁটা ছুটে চলেছে সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে সে। সিরিল ঈশ্বরের নাম নিয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ করলেন মৃত্যুদূতের কাছে। রকি আর তার আশ্রয়দাত্রীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ দুটোর দিকে তাকিয়ে একটা পৈশাচিক হাসি খেলে গেল মধ্য রাতের আগন্তুকের মুখে।



 1লা জুলাই,2018

রাত এগারোটা

পাশে শুয়ে থাকা অরিনের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হলো বৃতি। অরিন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এক ঘুমে রাত কাবার করে ও। খুব সতর্কতার সঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল বৃতি। প্রয়জনীয় কিছু জিনিস পত্র ব্যাগে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। সদর দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিল। সমস্ত কাজ সারল সে নিঃশব্দে। অরিন উঠে পড়লে মুশকিল হয়ে যাবে। তার সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই দ্রুত পা চালাল সে। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে। সুদীপ অপেক্ষা করছে তার জন্য। 


  পেছনের দরজাটা টেনে দিয়ে প্রায় দৌড়ে রাস্তায় উঠলো অরিন। ওই তো সামনেই একটু দূরে বৃতির লাল রঙের রেন কোটটা দেখা যাচ্ছে। দূরে কোথাও বাজ পড়ল একটা। জলীয় বাষ্পকে সঙ্গী করে পাহাড়ের দিক থেকে ছুটে আসছে হিমেল হওয়া। এমন দিনে বিছানার নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে কোথায় চলেছে বৃতি? ছুটি নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিল ওরা জুন মাসের মাঝামাঝি। সেখানেই প্রথম অরিনের মনে সন্দেহের বীজটা প্রোথিত হয়। বৃতির সাথে বিয়ের সময় থেকেই অরিন জানতো সুদীপ আর বৃতি খুব ছোটবেলার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধুত্ব ওদের মধ্যে। অরিন খোলা মনেই নিয়েছিল ওদের সম্পর্কটা। প্রায় দেড় বছর হতে চলল ওদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পনের দিনের মধ্যেই অরিন বৃতিকে নিয়ে এখানে ওর কর্মস্থলে চলে এসেছিল। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। আর পাঁচটা সদ্য বিবাহিত দম্পতির মত ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল তাদের সম্পর্ক। অরিন তো এবার দুজন থেকে তিনজন হবার কথাও ভাবছিল কিন্তু এবার কলকাতায় যাবার পর থেকেই অরিন বুঝতে পারছিল কোথাও একটা তাদের এই ছন্দময় জীবনের সুর কাটছে।


বৃতি কিছু গোপন করছে তার কাছ থেকে। ফিসফিস করে ফোনে কথা। তার অজান্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া। জিগ্যেস করলে অদ্ভুত সব বাহানা দিচ্ছিল। আর এবারের কলকাতা যাওয়া তো বৃতির জিদেই। একুশ তারিখ হসপিটালে নতুন ডাক্তার যোগ দিতেই বৃতি কলকাতা যাওয়ার জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে উঠলো। অরিন অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে ডাক্তার ঝা একদম সদ্য পাশ করা ছেলে। তাকে নিয়ে ডাক্তার রায় হসপিটাল চালাতে খুব অসুবিধার সম্মুখীন হবেন। এখানকার হসপিটালটা তো খুবই ছোট। বেশি স্টাফও নেই। তাছাড়া হসপিটালের বড় ভরসা বর্ষীয়ান সিস্টার সিরিলের আকস্মিক মৃত্যু ঘটল। তারওপর বৃতি ওর জিদ থেকে একচুল নড়ল না। শেষে কান্নাকাটি শুরু করে অরিনকে ছুটি নিতে বাধ্য করল। আজ সকালেই ফিরেছে ওরা। অরিন নিশ্চিত সুদীপও এখনে এসেছে কারণ বৃতির এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অরিন আবিষ্কার করে বৃতি গোপনে সুদীপের সাথে দেখা করছে অথচ এর আগেও কলকাতায় গেলে ওরা দুজনে মিলে সুদীপের সাথে দেখা করেছে। সুদীপ ওদের বাড়িতে এসেছে কিংবা বৃতির বাপের বাড়িতে সকলে মিলে আড্ডা দিয়েছে। তাহলে এখন এই লুকোচুরি কেন? ওদের ফিরে আসার দুদিন আগে অরিন খবর পায় সুদীপ কলকাতার বাইরে কোথাও গেছে। অরিন আজ নিশ্চিত হয়ে গেল যে সুদীপ এখানেই এসেছে কারণ শহরে পরপর অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটছে এই পরিস্থিতিতে বৃতি এত রাতে গোপনে বাড়ির বাইরে বেরল কিসের টানে? অরিনের চোখ দুটো আজকের আবহাওয়ার মতোই ঝাপসা হয়ে এল। দেখেশুনে বিয়ে হলেও সে বৃতিকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে কিন্তু বৃতি তার ভালোবাসার এই মূল্য দেবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। বৃতি চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। যেন ভীষন তাড়া ওর। অরিন ওর গতি দ্রুত করল।



  কয়েকদিনের ক্রমাগত বৃষ্টিতে কবরখানার মাঠে গোড়ালি ডোবা জল। জল ছাপিয়ে বৃতি এগিয়ে চলল। বুকটা এত জোরে ঢিপঢিপ করছে যে নিজের হৃদস্পন্দন নিজেই শুনতে পাচ্ছে। সারি সারি কবরের নিচে ঘুমিয়ে আছে পরপারের যাত্রীরা। বৃতির মনে হলো ওরা যেন এক্ষুনি উঠে আসবে। আকাশে মেঘ গুড়গুড় করছে । নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। বৃতির হঠাৎ করে খুব কান্না পেয়ে গেল।

“ আমি এখানে।” সুদীপের কন্ঠস্বর।

হাতের টর্চটা তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতেই কাছেই সুদীপকে দেখতে পেল। বুকটা একটু হালকা লাগছে বৃতির। সুদীপ ওর কাছে এগিয়ে এল।

“ চল।”

এগোতে গিয়ে জলের মধ্যে বৃতি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেই সুদীপ ওকে ধরে ফেলল।

“ বাহ, বাহ, বাহ বৃতি। তুমি পারলে আমার সঙ্গে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে! কেন বৃতি? কেন করলে? আমার ভালোবাসায় তো কোনও ফাঁক ছিল না। তুমি যদি ওকে ভালোবাসতে তো ওকেই বিয়ে করতে পারতে।” অরিন খুব সাবধানে, খুব সন্তপর্নে বৃতিকে অনুসরণ করে এখানে পৌঁছে গেছে বৃতি একটুও বুঝতে পারে নি।

“ তুমি এখানে!” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল বৃতি।অরিনকে দেখে তার মুখটা সাদা বিবর্ণ হয়ে গেছে। তার দু চোখে বিস্ময়ের আড়ালের ভয় উঁকি দিচ্ছে।

“ ,অরিনদা তুমি ভুল বুঝছ আমাদের।” সুদীপ বলে ওঠে।

“ আমি তোমার সাথে কথা বলছি না। আয়াম টকিং উইথ মাই ওয়াইফ।” ফুঁসে ওঠে অরিন।


বৃতির কানে যেন কিছুই ঢুকছে না। সে একদৃষ্টিতে অরিনকে দেখছে। দূরে রাস্তার আলোটা ক্রমশঃ আবছা হয়ে এখানে পড়েছে। সেই প্রায় অন্ধকারের মধ্যেও অরিনের মুখটা যেন সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বৃতি হঠাৎ করে অরিনের কাছে ছুটে এসে দুহাতে ওর মুখটা ধরে কেঁদে ফেলল, “ তুমি এখানে এলে কেন? ও তোমাকে মেরে ফেলবে। সোনা, প্লিজ তুমি বাড়ি যাও। আমি কাজ শেষ করেই আসছি।” হতভম্ব অরিন বৃতির কথা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।


নিজের রেডিয়াম লাগানো ঘড়িতে সময় দেখে উদ্বিগ্ন সুদীপ বলে উঠলো,“ বারোটা বাজতে চলল। বৃতি তাড়াতাড়ি চল। অরিন দা তুমি বাড়ি গিয়ে দরজা- জানালা সব বন্ধ করে থাকবে যাও। আমরা ফিরে গিয়ে সব বলব। প্লিজ অরিন দা কথা শোন।”


“ সোনা, প্লিজ তুমি বাড়ি যাও। আমি তোমার কিচ্ছু হতে দেব না।” শক্ত করে অরিনকে জড়িয়ে ধরে বলল বৃতি। 

“ তাড়াতাড়ি চল বৃতি। সময় নেই আর।”

ওরা চলে যাবার উদ্যোগ করতেই অরিন বৃতির হাতটা টেনে ধরল।

“ আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।কি বলছ তোমরা। আমাকে খুলে বল সব নাহলে তোমায় আমি কোথাও যেতে দেব না।।”

“ বললে তো তুমি বিশ্বাস করবে না।” অসহায় কণ্ঠে বলে বৃতি।

“ না আমি শুনতে চাই। কে আমাকে মারবে?”

“ গ্যাংস্টার পিটার ডিসুজার পিশাচ।”

“ আর ইউ ম্যাড?”


“ জানতাম তুমি এটাই বলবে। ভেবে দেখ তো কারা কারা খুন হয়েছে? ইন্সপেক্টর রাও যে পিটারকে গুলি করে ছিল, টিটু তার সঙ্গেই ছিল। পিটারের দলের বিশ্বাসঘাতক কদম যে পিটারকে ধরিয়ে দিয়েছিল, পুলিশের সোর্স জাগিয়া যে পিটারের বিরুদ্ধে ইনফরমেশন জোগাড় করে ছিল, সব শেষে সিরিল আন্টি। তুমিই বলেছিলে সেই বৃষ্টির রাতে হসপিটালে শুধু তুমি আর সিরিল আন্টি ছিলে যখন গুলিবিদ্ধ পিটারকে আনা হয়। তোমার কাছেই শোনা পিটারের বউ রেবেকার অভিযোগ ছিল পুলিশের নির্দেশে তোমরা পিটারকে না বাঁচিয়ে মেরে ফেলেছো। রেবেকা যে ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে রীতিমতো চর্চা করে সেটা এ শহরের সবাই কম বেশি জানে। প্রতিটা খুন কিভাবে হয়েছে ভেবে দেখ। দে আর ব্রুটারলি মার্ডারড। সিরিল আন্টির মৃত্যুর খবরটা পাওয়ার পরই আমি প্রমাদ গুনি। পাঁচ দিন অন্তর খুন গুলো হচ্ছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম এরপর তোমার পালা তাই জোর করে কলকাতা পালিয়ে গেলাম তোমাকে নিয়ে। তুমি বা তোমার বাবা-মা কেউ এসবে বিশ্বাস কর না ভালো ভাবেই জানতাম তাই আমার একমাত্র ভরসা ছিল সুদীপ।”


ওদের কথাবার্তার মাঝে কখন যে ঘড়ির কাঁটা তিনটে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বারোটার ঘরে শুয়েছে ওরা খেয়াল করেনি। কবরস্থানের মাটিতে মৃদু কম্পন অনুভব করে ওরা সচকিত হলো। 

“ বৃতি দেখ।” সুদীপের আতঙ্কিত গলা। সুদীপের অঙ্গুলি নির্দেশ অনুসরণ করে ওরা দেখল একটা সমাধির ভেতর থেকে একটা অপার্থিব আওয়াজ ভেসে আসছে। তার পাশে স্কার্ট-ব্লাউজ পরিহিতা এক মহিলা দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্রচ্চারণ শুরু করেছেন। সমাধি ফলকের লেখাগুলো অন্ধকারে পড়া যাচ্ছে না নাহলে ওরা দেখতে পেত লেখা আছে, “ পিটার ডিসুজা, জন্ম 3জানুয়ারি 1972, মৃত্যু 4 জুন,2018।” সমাধিটা দু ফাঁক হয়ে গেল। ভেতর থেকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর ওপার থেকে মাথা তুলে দাঁড়ালো পিটার ডিসুজার কবরস্থ দেহটা। সারা শরীর থেকে কালো কালো পোকা ঝরে পড়ছে। 


“ ডক্টর ইউ আর ফিনিশ। তুমি নিজেই ধরা দিতে চলে এলে! কলকাতা পালিয়ে বাঁচবে ভেবেছিলে।” রেবেকার মুখে ক্রূর হাসি, চোখে প্রতিশোধের আগুন।

“ অরিন পালাও।” বৃতি চিৎকার করে উঠলো।


মুহূর্তের মধ্যে রেবেকার হাতের পিস্তল গর্জে উঠলো। অরিন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল কাদা জলের মধ্যে। পায়ে গুলি লেগেছে।


“ ডক্টর আমি তোমার বুকে গুলিটা করতে পারতাম অনায়াসে আমি গ্যাংস্টারের বউ আমার নিশানা অব্যর্থ, বহু লোককে শুইয়েছি আমি কিন্তু আমি চাই পিটার নিজে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিক। তুমি অনেক দিন বেশি বেঁচে গেলে। পিটারকে প্রতি রাতে জাগিয়ে তোলার মত শক্তি আমার নেই বলে তুমি এখনও বেঁচে আছো।” হিসহিসিসিয়ে বলল রেবেকা।

“ বৃতি তোমরা পালাও।” 

“ না তোমাকে ছেড়ে আমি যাব না।” জলের মধ্যে বসেই অরিনকে আঁকড়ে ধরল বৃতি। পিশাচ রূপী পিটার ওদের একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। একটা বীভৎস পচা গন্ধ ছড়িয়ে গেছে বাতাসে। সুদীপ অরিনকে টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করাল কিন্তু পালাবার পথ বন্ধ। ওদিকে রেবেকা দাঁড়িয়ে আছে উদ্যত পিস্তল হাতে। অরিন আশা ছেড়েই দিয়েছে। আজ এই শয়তানের হাতে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। পিটারের সূঁচাল নখগুলো আস্তে আস্তে বসছে অরিনের গলায়। বৃতির চিৎকার আর রেবেকার অট্টহাসি হিমেল হওয়ার সাথে মিশে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসছে। উপায়ান্তর না দেখে সুদীপ একটা ঘুঁষি চালাল পিটারের চোয়াল লক্ষ্য করে কিন্তু বিধাতা বোধহয় আজ অন্য পথ ধরেছেন। পিটার রক্তচক্ষু মেলে সুদীপকে দেখল। এক অদৃশ্য শক্তি সুদীপকে প্রায় দশ হাত দূরে ছিটকে ফেলল। অরিনের নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের সামনে অন্ধকার নামছে।

“ উও ও উ ও।” পিটারের অপার্থিব চিৎকারে কেঁপে উঠল আকাশ বাতাস। অরিনের গলা ছেড়ে দিয়ে সে টলতে টলতে সরে গেল।


সুদীপ ওর পকেট থেকে একটা শিশি বের করে কি একটা তরল ছুঁড়ে দিয়েছে পিটারের গায়ে। এই মন্ত্রপুত জলটা বারোটা বাজার আগেই পিটারের কবরে ছড়ানোর কথা ছিল কিন্তু ঘটনার ঘন ঘটায় বিস্মৃত হয়ে পড়েছিল। 

“ শয়তান এভাবে ডক্টর কে বাঁচাবি ভেবেছিস?” রেবেকা আবার মন্ত্রচ্চারন আরম্ভ করল। আস্তে আস্তে পিটার আবার পূর্ববৎ অবস্থায় ফিরে এসে পুনরায় অরিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অরিনের গলা থেকে রক্তের সরু ধারা গড়িয়ে পড়ছে। ক্রমশ তার অন্তিম ক্ষণ ঘনিয়ে আসছে। 

“ উ ও ওও আ।” হাড়হিম করা এক চিৎকার করে অরিনের গলা ছেড়ে দিয়ে পিটার পিছিয়ে গেল। বাতাস কেটে একটা রুপোর ছুরি এসে আমূল বিদ্ধ হয়েছে তার পিঠে। পরমুহূর্তেই একটা রুপোর বুলেট এসে আঘাত করল তার বুকের বাম দিকে ঠিক যেখানে জীবিত মানুষের হৃদপিণ্ড থাকে। 

ফাদার জোসেফ আর ফাদার এন্ড্রু ছুটে এসে অরিন, বৃতি আর সুদীপের হাতে তিনটে মন্ত্রপুত ক্রুশ ধরিয়ে দিলেন।


“ নো ও ও। ফাদার ইউ কান্ট ডু ইট।” চিৎকার করে উঠলো রেবেকা। সে আবার বিড়বিড় করে কিছু বলার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই পিশাচ রূপী পিটারের শরীরে আগুন ধরে গেল। পিটারের শরীরে আগুন ধরার সাথে সাথে রেবেকার চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে লাগলো আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সে মাটিতে শুয়ে ছটফট করতে লাগলো। পিটারের শরীরটা ভস্মীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেবেকার জীবন দীপ ও নিভে গেল।


5 জুলাই,2018

ফাদার জোসেফ ভেজা ছাতাটা বারান্দায় মিলে দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। সোফায় বসা অরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ ওয়েল মাই বয়, কেমন আছো এখন?”

“ ভালো আছি। কাল হসপিটাল থেকে বাড়ি এলাম।”

“ জানি।”

“ আপনাকে আর ফাদার এন্দ্রুকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব।” কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ে অরিনের গলায়।

“ নো মাই বয়। ধন্যবাদ প্রাপ্য তোমার ওয়াইফ আর তোমার এই বন্ধুটির। বৃতির মনেই প্রথম সন্দেহ জাগে যে যারা খুন হচ্ছে তারা সকলেই পিটারের পুলিশের হাতে ধরা পড়া ও তার মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত আর রেবেকা যে ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা করে এটা ও তোমাদের কাজের লোকের কাছ থেকে শুনেছিল। দুইয়ে দুয়ে চার করে ও আমার কাছে ছুটে যায়। আমারও একটু খোঁজ খবর করে মনে হয় বৃতির আশঙ্কাই সত্যি কিন্তু এসব বিষয়ে আমার সেরকম জ্ঞান নেই। আমিই ওকে ফাদার এন্দ্রুর কথা বলি। এদিকে হিসেব মত সিরিলের খুন হওয়ার পাঁচ দিন পরেই তোমার পালা। বৃতি বুদ্ধি করে তোমাকে নিয়ে কলকাতা চলে গেল। তুমি তো এসবে বিশ্বাস করতে না তাই এখানে ফিরতেই সেকারনে বৃতি সুদীপের সাহায্যে ফাদার এন্দ্রুর সাথে যোগাযোগ করে। সেদিন তুমি বৃতির পেছন পেছন কবরস্থানে পৌঁছে না গেলে এত সমস্যা হত না। ফাদার এন্ড্রুর দেওয়া মন্ত্রপুত জল পিটারের কবরের ওপর যথা সময়ে ছড়িয়ে দিলে ওর শক্তি কমে যেত। উঠে আসার পর ও কাউকে আক্রমণ করার অবস্থায় থাকত না আর সহজেই ওকে শেষ করা যেত।” এতটা বলে ফাদার থামলেন।

অরিন চুপ করে রইল এসবের কিছুটা সে বৃতির মুখে শুনেছে আর ততোই মরমে মরে গেছে। বৃতি আর সুদীপকে সে কি না বলেছে সেদিন । যদিও ওরা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে তাও একটা অপরাধ বোধ কাজ করছে অরিনের মধ্যে।

“ কিন্তু ফাদার রেবেকার কি হলো?” খাবারের ট্রে নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল বৃতি।

“ আমারও একই প্রশ্ন?” সুদীপ বলে।

“ মাই চাইল্ড এখানেই শুভ আর অশুভর পার্থক্য। শুভ শক্তির চর্চায় তোমার ক্ষতি কোনও দিন হবে না কিন্তু অশুভ শক্তির চর্চায় তোমার নিজেরই ক্ষতি হতে পারে যেমন হলো রেবেকার। ওর ক্ষমতা যেই ব্যর্থ হলো অমনি সেই ক্ষমতার ভারেই ও নিঃশেষ হয়ে গেল।”

 জানালা দিয়ে রোদ এসে ঘরের মেঝেতে আল্পনা আঁকছে। দুর্যোগ থেমে পাহাড়ের কোলে আজ নতুন সূর্য । গভীর রাতের আগন্তুকের আতংক কাটিয়ে শহর আবার প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরে উঠেছে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror