আমি, শিমি আর মেখলা
আমি, শিমি আর মেখলা
আমার মাথাটা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি কাকে বেছে নেব? আমার প্রথম প্রেম না দ্বিতীয় প্রেম কে থাকবে আমার জীবনে সেই কঠিন সিদ্ধান্ত কি করে নেব আমি? হ্যাঁ, আমি আজ মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করছি মেখলাকে আমার ভালো লাগে। আমি ভীষন ভাবে ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। ওর সাথে আমার শুধু মানসিক নয় শারীরিক সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। মেখলা দুর্নিবার ভাবে আকর্ষণ করছে আমাকে। মেখলার সেই আকর্ষণের কাছে শিমি হেরে যাচ্ছে। ওর প্রতি আমি যেন বিকর্ষিত হচ্ছি। শিমিকে আমি চিরতরে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চাই। যে কোনও মূল্যে আমি মেখলাকে পেতে চাই। এতদিন আমার ডায়েরীর প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা একটা নামই লেখা ছিল, "শিমি" কিন্তু মেখলা এসে সব পাতাগুলো ওলট পালট করে দিল। মেখলা যে, সব পাতায় আঁচড় কেটে দিচ্ছে। আমার ডায়েরীটা সম্পূর্ণ করতে চাইছে ও। কি করব আমি এখন? কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভাবতাম শিমি আমার জীবনের একমাত্র প্রেম কিন্তু আজ আর জোর গলায় সেটা বলতে পারছি না। আমার আর শিমির সম্পর্কের মাঝে দমকা হওয়ার মতো এসে গেছে মেখলা। মেখলা যেন বেপরোয়া ফাগুন বাতাস যার পরশে সব কিছু অন্য রকম লাগে। আবার অন্য দিকে সেই ছোট্টবেলা থেকে শিমি আমার পাশে থেকেছে। আমার এই নিঃসঙ্গ বান্ধবহীন ধূসর মরুর মত জীবনে শিমি যেন এক টুকরো মরুদ্যান কিন্তু এটাও সত্যি আমি আর মেখলা পরস্পরকে প্রচণ্ড ভালোবেসে ফেলেছি। কি করব আমি?
" এই তোর নাম কি কিরে?"
" অ অ অরণ্য। অ অরণ্য সেন।"
" অ অ অ অ অরণ্য। হা হা হা।"
" আমি তো ভাবলাম তোর নাম তোতলারাম সেন। হি হি হি।"
" তোতলা, তোতলা।"
" এই অ অ অরণ্য, খেলবি নাকি আমাদের সঙ্গে? ফু ফু ফুটবল খেলতে জানিস? হি হি হি।"
" কোন স্কুলে পড়?"
"সে সে সেবানাথ বিব বিদ্যানিকেতন।"
" মহুয়া, ছেলের তো মুখে এখনও কথা ফোটেনি।"
" তুই এত ভালো গান করিস আর তোর ছেলে...। ব্যাড লাক।"
আমার জীবনের নানা ঘটনার ছেঁড়া ছেঁড়া কোলাজ মাঝে মাঝেই আমার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। বেশিরভাগ ছবির রংই বড্ড ধূসর নয়ত বর্ণহীন সাদা-কালো নেগেটিভ। আমি অরণ্য সেন। বেড়ে উঠেছি এই আধা মফস্বল শহরে। বাবা,মা আর আমি এই তিনজনের ছোট্ট সংসার আমাদের। বাবা সারাদিন ব্যস্ত তার ব্যবসা নিয়ে আর মা তার অফিস নিয়ে। চাকরীর সাথে সাথে মা আবার বাড়িতে গানের স্কুলও চালায়। যথেষ্ট স্বচ্ছলতার মধ্যে বড় হয়েছি আমি কিন্তু অভাব যেখানে সেটা হল আমার জন্য বাবা-মায়ের বরাদ্দ সময়ে। বাবা-মা আমাকে ভালোবাসে না একথা আমি কখনোই বলব না । আমার ঠিকঠাক কথা না বলতে পারার জন্য ওঁদের বিভিন্ন রকম মন্তব্যের সম্মুখীন হতে হলেও ওঁরা এই নিয়ে কখনও দ্বিরুক্তি করেন নি আসলে আমার সমস্যাটা ওঁদের কখনও সমস্যা বলে মনেই হয়নি। ওঁরা মা-বাবা হিসেবে সমস্ত কর্তব্য করে গেছেন কিন্তু ওই আমার জন্য বা আমার সমস্যা বোঝার জন্য তাঁদের হাতে সময় বড্ড কম। বাবা বাড়ি ফিরে একবার হলেও আমার ঘরে আসে । আমার খবরাখবর নেয় কিন্তু সারাদিনের শ্রমে ক্লান্ত বাবার চোখমুখ দেখলে আমারই মায়া হয়। আমার একমাত্র সঙ্গী ছিল ঠাকুমা কিন্তু আমার দশ বছর বয়সে সেও চলে গেল আমাকে একলা করে দিয়ে। বাবার মুখটা দেখতে পেতাম সকালে ঘুম থেকে উঠে আর রাত্রে ঘুমোতে যাবার সময়। মা বিকেলে বাড়ি ফিরলেও আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ত নিজের গানের স্কুল নিয়ে। আমার তো আবার সেখানে প্রবেশের উপায়ই নেই। খাবার টেবিলে ওই টুকটাক কথাবার্তা। স্কুল, আঁকার স্কুল, কোচিং এমনকি অনেক সময় পারিবারিক বা বাবা-মায়ের বন্ধু-বান্ধব মহলের কোনও গেট টুগেদার সব জায়গায় আমি আমার সম বয়স্কদের হাসির খোরাক। গোদা বাংলায় বলতে গেলে আমি তোতলা অর্থাৎ কথা বলতে গেলে আমার আটকে যায় বলে সবাই ধরে নিয়েছিল পড়াশোনা, খেলাধুলা, ছবি আঁকা সবই বোধহয় আমার আটকে যায় যদিও আদৌ এই ধারনাগুলো সত্যি ছিল না কিন্তু ক্রমাগত একই ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতে আমিও যেন এই মিথ্যে ধারণাটাকে সত্যি বলে মানতে শুরু করেছিলাম।
আমার ঠিকঠাক কথা বলতে না পারাটা যেন আমাকে সবদিক থেকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। আমি শুধু সবার থেকে আড়াল খুঁজতাম। মা-বাবা ছাড়া কারুর সঙ্গে কথা বলতেও ভরসা পেতাম না। মাঝে মাঝে মনে হত একটা বিশাল রুক্ষ প্রান্তরে আমি একলা দাঁড়িয়ে আছি।
" অরু বাবু, মাকে ডেকে দাও। চিঠি আছে।
" ম মা, চিঠি।"
" রমাপদকে একটু দাঁড়াতে বল। আমার একটু দেরী হবে।"
" অরু বাবু এমন করে মনমরা হয়ে একলাটি চুপ করে বসে আছো কেন? সব ছেলেরা হইহই করে মাঠে খেলতে যাচ্ছে। তুমি যাবে না বন্ধুদের সঙ্গে?"
" আ আ আমার কোনও বো বন্ধু নেই।"
" সে কি কথা! তোমার কোনও বন্ধু নেই? কেন?"
" কে কেউ আ আমাকে খেলতে নেয় না।"
" তাই তোমার মুখটা এমন শুকনো। আচ্ছা, তুমি আমার সঙ্গে যাবে? তোমার সঙ্গে একজনের আলাপ করাবো। যাবে আমার সঙ্গে?
" হুম। যাবো।"
" আচ্ছা, তোমার মাকে জিজ্ঞেস করি। তারপর নিয়ে যাবো।"
সেদিন রমাপদ কাকুর কথায় মা কোনও আপত্তি করেনি। মায়ের গানের ছাত্রছাত্রীদের আসার সময় হয়ে এসেছিল তখন আমি আরও একলা হয়ে যাবো এই ভেবেই মা বেশ খুশি মনে বলেছিল, " যাবে তো যাক না তোমার সাথে। একটু ঘুরে আসলে ভালো লাগবে। যদি সন্ধ্যে হয়ে যায় তুমি শুধু একটু পৌঁছে দিয়ে যেও।" রমাপদ কাকু আমাদের এলাকার পোস্ট অফিসের পিয়ন। বহুদিনের পরিচিত লোক তাই মা ভরসা করে ছেড়ে দিয়েছিল। রমাপদ কাকুর বাড়ি চন্দননগর। এখানে চাকরী সূত্রে এসে নদীর ধারে কম টাকায় বেশ অনেকখানি জায়গা কিনে একখানা টালির বাড়ি বানিয়েছেন। সামনে প্রচুর গাছপালা। রমাপদ কাকুর স্ত্রী অল্প বয়সেই মারা যান তারপর কাকু আর দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। সেদিন রমাপদ কাকু তাঁর বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন আমাকে আর তারপরেই সেই গোধূলির রং মাখা বিকেলে প্রথম দেখা হয়েছিল আমার আর শিমির। তখন আমি মাত্র তেরো। রমাপদ কাকু কেমন ঘোর লাগা মায়া জড়ানো কণ্ঠে বলেছিলেন, " আমার এই পাগলী মেয়েটাও বড্ড একা। তুমিও একা। যদি পারো আমার শিমির বন্ধু হয়ে যাও। আমার জীবনটা তো ওই ভরিয়ে রেখেছে। দেখবে ও তোমাকেও ভালো রাখবে, ভালোবাসবে।" সত্যিই সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত শিমি আমাকে ভালো রেখেছে, ভালোবেসেছে। আর হ্যাঁ, আমিও শিমিকে ভালোবাসি নাকি বাসতাম? আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। শিমির সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে আমি আমার একাকীত্ব ভুলে যেন একটা নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছিলাম। আমার মনের দোসর হয়ে উঠেছিল শিমি। যে আমি তোতলামির জন্য বাবা-মা ছাড়া কারুর সঙ্গে সেভাবে কথা বলতাম না সেই আমি আমার সব না বলা কথার ঝুড়ি উপুড় করে দিতাম শিমির কাছে। কুঁকড়ে থাকা আমিটা আবার পাখনা মেলছিল। শিমি যেমন রমা পদ কাকুর জীবনের একমাত্র অবলম্বন তেমনি আমারও নিশ্চিন্ত আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। আমি আবার ছবি আঁকতে আরম্ভ করেছিলাম। আমার যে ছবি আঁকতে ভালো লাগে সেটা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। প্রথম প্রথম আমার আর শিমির মাঝে রমাপদ কাকু অনুঘটকের মত কাজ করত তারপর আমাদের মাঝে আর কেউ ছিল না। রমাপদ কাকু আমার আর শিমির বন্ধুত্বে এত খুশি ছিলেন যে বলার নয়। আমি যখন তখন চলে যেতাম শিমির কাছে। বাবা-মাও আমাকে কখনও বাধা দেয়নি কারণ আমার পড়াশোনায় উন্নতি হচ্ছিল। আমি অনেক হাসি-খুশি থাকছিলাম আর মন খারাপ করে বসে থাকতাম না। আগেই বলেছি আমার বাবা-মায়ের কাছে সময় খুব কম তাই তাঁরা আমি ভালো আছি এতেই সন্তুষ্ট। শিমি আমার জীবনটাকে স্বাভাবিক করে তুলেছিল। অনেক আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল আমাকে। আসলে শিমি একটা খোলা জানালার মত ছিল আমার কাছে যার মধ্য দিয়ে আলো, হওয়া সব প্রবেশ করছিল আমার জীবনে। আমি আর কারুর টিটকিরি, বাঁকা মন্তব্য বা মেকি সহানুভূতি কোনও কিছুকে পাত্তা দিতাম না। কোনও বন্ধুরও প্রয়োজন অনুভব করতাম না। নিজেই আর কারুর সাথে প্রয়োজনের বাইরে মিশতাম না। শিমিই আমার সবকিছু হয়ে উঠেছিল। ইতিমধ্যে মায়ের এক সহকর্মীর পরামর্শে আমাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখায় বাবা-মা। আমার কথা আটকে যাওয়ার সমস্যা প্রায় অর্ধেক কমে যায় কিন্তু ততদিনে আমার আর এসবে কিছু যায় আসে না। আমি পড়াশোনা, ছবি আঁকা আর শিমির মধ্যে ডুবে যেতে লাগলাম ক্রমশ। আস্তে আস্তে আমি বড় হতে লাগলাম। যে বয়সে কৈশোর আর যৌবন মুখোমুখি দাঁড়ায় সেই সন্ধিক্ষণে আমিও একদিন এসে দাঁড়ালাম। সেখানেও আমি অন্য কাউকে প্রবেশাধিকার দিলাম না। ততদিনে আমার ভালো রেজাল্টের দৌলতে অনেকেই আমার চারপাশে ভীড় জমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আমার সমস্ত জুড়ে ছিল শুধু শিমি। একদিন
শিমির শরীরে ঠোঁট ছুঁইয়েই আমি প্রথম যৌবনের স্বাদ নিলাম। এভাবেই বেশ চলছিল কিন্তু মেখলা এসে সব সমীকরণ ওলট-পালট করে দিচ্ছে।
" অরু, এ হল মেখলা। খুব ভালো মেয়ে। বিশ্বাসদের বাড়িটা কিনে এসেছে ওরা।" মা আলাপ করিয়ে দিয়েছিল মেখলার সঙ্গে। মেখলা গান করে। গান সংক্রান্ত কোনও ব্যাপারে মায়ের কাছে এসেছিল।
" আমি মেখলা আর তুমি অরণ্য তাই তো? খুব ভালো ছবি আঁকো।" ঝর্নার মত কথা শুরু করেছিল মেখলা।
" হুম।"
" তুমি চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছ তাই না?"
" হুম।"
" আমি কি এতই খারাপ যে আমার সঙ্গে একটুও কথা বলা যায় না? শুধু হুঁ দিয়ে উত্তর দিতে হয়।" অভিমানী সুরে বলে উঠেছিল মেখলা।
" ন না তা নয়।"
" তাহলে হুম ছাড়া আর কোনও কথা বলছ না কেন?
" ন না এমনি। কি বলব?"
" কি বলব মানে! পৃথিবীতে কথার অভাব বুঝি?" চোখ পাকিয়ে বলে উঠেছিল মেখলা।
ওর মুখ ভঙ্গী দেখে হেসে ফেলেছিলাম আমি। মেখলাও হাসতে শুরু করেছিল। ওর হাসির মধ্যে অদ্ভুত এক সারল্য চোখে পড়েছিল। সেদিন আমাকে চুপ থাকতে দেয়নি মেখলা। কথা বলিয়ে নিয়েছিল আমাকে দিয়ে। ওর মা আর আমার মা গল্প করছিলেন সেই ফাঁকে আমি আর মেখলা প্রচুর গল্প করেছিলাম। শিমি ছাড়া এই প্রথম কারুর সঙ্গে এভাবে গল্প করেছিলাম আমি। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম যে আমার কথা আটকে যাওয়াটা মেখলা খুব স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করেছিল। ওর মধ্যে কোনও রকম প্রতিক্রিয়া দেখতে পাইনি আমি যেন সবারই এরকম হয়, আমার মধ্যে কোনও অস্বাবাবিকত্ব নেই। মেখলার সাবজেক্টও আমার মত বোটানি। এম এস সি লাস্ট সেমিস্টার। ও বায়না ধরল ওকে পড়া দেখিয়ে দিতে হবে। হয় ওদের বাড়ি যেতে হবে নয়ত ও আমাদের বাড়ি আসবে। আমি আপত্তি করার চেষ্টা করেছিলাম কারণ সেই মুহুর্তে মনে হয়েছিল যে আমি শিমির সঙ্গে যে সময় কাটাই তাতে ভাগ বসিয়ে দেবে মেখলা কিন্তু মেখলার মা, আমার মা আর সর্বোপরি মেখলার সামনে আমার আপত্তি টিকল না। এখন মনে হয় হয়ত আমার প্রতিরোধ তত জোরালো ছিল না। নিজের অজান্তেই হয়ত আমি মেখলার সঙ্গ চেয়েছি সেইজন্য নিজেই নিজেকে ধোঁকা দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার অভিনয় করেছি। আমি মেখলাকে পড়াতে আরম্ভ করলাম। কখনও ওদের বাড়িতে আবার কখনও আমাদের বাড়িতে। মেখলা শুধু নিজেই পড়ত না আমি যেসব চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিলাম সেইসব নিয়েও ওর প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল। আমি যেমন ওকে পড়াচ্ছিলাম তেমনি বিভিন্ন বিষয়ে মেখলাও আমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করত। শিমির জন্য বরাদ্দ সময়ের অনেকটাই মেখলা দখল করে নিচ্ছিল ক্রমশ। শিমির অবশ্য কোনও অভিযোগ ছিল না এজন্য। আসলে শিমি তো চিরদিন আমার পাশে থেকেছে। কোনও দিন আমার কোনও অসুবিধা করে নি। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার যেমন শিমির সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগতো তেমনি মেখলার সঙ্গও ভীষন ভাবে উপভোগ করছি আমি। সত্যি বলতে কি মেখলার সাথে সময় কাটাতেই যেন বেশি আগ্রহ জন্মাছিল। দুজনে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়াশোনা আর বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় মত্ত হয়ে থাকতাম। আমি মেখলার সাথেও মনের দরজা খুলে কোনও দ্বিধা দ্বন্দ্ব না রেখে প্রচুর কথা বলছিলাম। আগে সারাদিনে একবার অন্তত শিমির সঙ্গে দেখা করতেই হত আমাকে। সেই অভ্যেস বদলাতে লাগলো। মেখলাও যে আমার প্রতি দুর্বল সেটা ও আমাকে আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে লাগলো। আমার আর শিমির মধ্যে ক্রমবর্ধমান এই দূরত্বের মাঝেই আমার জীবনে একটা খুব বড় ঘটনা ঘটে গেল। আমি রেলে একটা ভালো চাকরী পেয়ে গেলাম। আমার পোস্টিং হয়েছে খড়্গপুর। সবকিছু হয়ে গেছে শুধু কয়েকদিন পর জয়েনিং। এত ভালো সবকিছুর মধ্যে আরও একটা ঘটনা ঘটল। আমার রেজাল্টটা বেরোনোর ঠিক আগের দিন রমাপদ কাকু আমাকে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখলাম কাকু বেশ অসুস্থ। ওনার ভাইপো এসেছে ওনাকে নিয়ে যাবে চিকিৎসার জন্য। রমাপদ কাকু আমার হাত ধরে বললেন, " দ্যাখ না অরু, এরা শুনছে না। আমি বলছি শিমিকে ছেড়ে, এই জায়গা, এই বাড়ি ছেড়ে আমি যাবো না কিন্তু ওরা শুনছে না। আমাকে দিয়ে অনেক দিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়েছে। আমাকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে। সুস্থ হলে তবে আসতে দেবে। আবার বলছে রিটায়ার্ড করার পর এখানে থাকতেই দেবে না। বাড়ি নিয়ে চলে যাবে। "
কাকুর ভাইপো আমাকে বলল, " আপনি একটু বোঝান কাকুকে। এত বছর ধরে যা করেছে, যেমন করে থেকেছ আমরা মেনে নিয়েছি কিন্তু এভাবে নিজের ইচ্ছেমত থেকে থেকে পাগলামী করে একগাদা রোগ বাধিয়ে বসেছে। আমরা আর শুনব না। আমাদের বাড়িতে জয়েন্ট ফ্যামিলি। সবাই কাকুর জন্য চিন্তা করে। বাড়ি নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তবে এখানে আসতে দেব।"
আমি রমাপদ কাকুকে বললাম, " ভালোই তো । যাও না সুস্থ হয়ে ফিরে এসো।"
রমাপদ কাকু আমার হাতদুটো চেপে ধরে মায়া জড়ানো চোখে অসহায় ভাবে বললেন, " কিন্তু শিমি তো যেতে পারবে না। ও একলা থাকবে কি করে? তুমিও তো আর আগের মত আসো না। তোমার কাছে বোধহয় ওর প্রয়োজন ফুরিয়েছে তাই না? কি হবে আমার শিমির?"
রমাপদ কাকুর কথাগুলো চাবুকের মত আছড়ে পড়ল আমার বুকে। সত্যিই আমি মেখলার জন্য শিমির সঙ্গে অন্যায় করেছি এই বোধটা কামড়ে ধরল আমাকে। আমি রমাপদ কাকুর হাতটা ধরে বললাম," না না, তুমি চিন্তা করো না। আসলে একটা চাকরির পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কলকাতা গিয়েছিলাম পরীক্ষা, ইন্টারভিউ সবকিছুর জন্য। ওখানে মাসিবাড়িতে কদিন রয়ে গেছলাম তাই আসা হয়নি। আমি তো আছি শিমির জন্য। তুমি যাও।"
আমার কথায় রমাপদ কাকু যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, " তাহলে তোমার ভরসায় যাচ্ছি আমি।"
একটা অপরাধ বোধ থেকে সেদিন আর আমি শিমির দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি । পরদিন থেকে আবার পুরোনো অভ্যাসে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমি মেখলাকে এড়িয়ে যাওয়া শুরু করলাম। ওর মেসেজের উত্তর দিতাম না। ফোন করলে দায়সারা ভাবে উত্তর দিতাম। এমনকি আমার চাকরী পাওয়ার খবরটাও মা মেখলার মাকে জানিয়েছিল। আমি একটা ফোনও করিনি অথচ আমরা চাকরী পাওয়ার পেছনে মেখলার অবদান কম নয়। আমার পড়াশোনায় মেখলা ওর সাধ্যমত সাহায্য করেছে। আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। আসলে আমি জানি আমি মেখলার কাছাকাছি থাকলেই আমার অন্য রকম অনুভূতি হবে। আমি মেখলার কাছাকাছি আর শিমির থেকে দূরে চলে যাব। যদিও আমি পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম আমার আর শিমির মাঝখান থেকে মেখলাকে আমি সরাতে পারছি না। শিমির কাছে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আর আগের মত কথা বলতে বা সবকিছু শেয়ার করতে ইচ্ছে করে না। বেশিরভাগ সময় চুপচাপ বসে থাকি আর মনের মধ্যে মেখলার সাথে কাটানো সময়গুলো উঁকি দিতে থাকে। রমাপদ কাকু মাঝে মাঝেই ফোন করেন। আমি শিমির কাছে যাচ্ছি কিনা খোঁজ নেন। মাঝে মাঝে মনে হত কৃতজ্ঞতার নাগপাশে আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে।
আমি মেখলাকে ভীষন ভাবে মিস করছিলাম। চাকরী পাওয়ার আনন্দটাও আমি ঠিক ভাবে উপভোগ করতে পারছিলাম না এমনি একদিন আমি কিছুটা যেন শুকনো কর্তব্য বা কৃতজ্ঞতার প্রকাশ করতেই শিমির কাছে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি এমন সময় অফিস থেকে ফিরে চেঞ্জ না করেই মা আমার ঘরে এল। আমি খুব অবাক হলাম।
" অরু, তোর আর মেখলার মধ্যে ঝগড়া হয়েছে?"
" ঝ ঝগড়া কেন হবে?"
" তাহলে তুই তোর চাকরী পাওয়ার খবরটা জানাস নি কেন ওকে?"
" তু তুমি তো জানিয়েছ তাই আর ফোন করিনি।"
" এটা কি কথা অরু! আমি করা আর তুই নিজে ওকে ফোন করায় পার্থক্য নেই? তোর তো দেখা করে জানানো উচিত ছিল। তুই যেমন ওর পড়ায় হেল্প করেছিস তেমনি ও ও তোকে কত হেল্প করেছে। কত ভালো মেয়েটা আর তুই ওর সাথে এরকম ব্যবহার করছিস! মেয়েটার শরীর খারাপ কিছুদিন ধরে সেই খবরটাও তো রাখিস না। শরীর খারাপ নিয়েই লাস্ট সেমিস্টারের পরীক্ষাগুলো দিয়েছে। কেমন হয়েছে সেটা জানার জন্যও তো একবার ফোন করতে পারতিস। আর কদিন পরেই তো চলে যাবি তুই।" মা বেশ রেগে গেছে। সাধারণত বাবা-মা আমার ওপর কখনও রাগে না। মা বেরিয়ে যাওয়ার পর আমার মাথাটা ঘুরতে লাগলো। মেখলার শরীর খারাপ! ও শরীর খারাপ নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে! ওর পরীক্ষা চলছে জানা সত্ত্বেও আমি ইচ্ছে করেই খবর নিই নি। ও বোধহয় বুঝতে পেরে গেছে যে আমি ওকে এড়িয়ে যাচ্ছি তাই ও ফোন, মেসেজ সব বন্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ করেই শিমির ওপর ভীষন রাগ হতে লাগলো আমার। সবকিছুর মূলে শিমি। ওর জন্যই আমি মেখলার প্রতি অবিচার করেছি।
" আরে, অরণ্য এসো এসো।" মেখলার মা আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।
" আপনারা কোথাও বেরোচ্ছেন?"
" একটু ডাক্তারের কাছে যাবো। মেখলা বাড়িতেই আছে। অরণ্য, বাবা তুমিই একটু দরজাটা লাগিয়ে দাও। আমরা বেরিয়ে যাই। দেরী হয়ে গেছে।" মেখলার বাবা-মা বেরিয়ে যেতে আমি পায়ে পায়ে মেখলার রুমে গেলাম। দরজাটা ভেজানো ছিল। কি মনে হতে মেখলাকে না ডেকেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে মেখলা।
" মে মেখলা।" নরম স্বরে ডাকলাম আমি।
আমার ডাকে মেখলা ধড়পড় করে উঠে বসলো। ওর চোখ দুটো লাল। ও যে কাঁদছিল সেটা বুঝতে বুদ্ধিমান হওয়ার দরকার হয় না। আমি কি বলব বুঝতে না পেরে কথা শুরু করার জন্য বললাম, " তোমার শরীর খারাপ ?"
বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো মেখলা।
" আমার মত একটা সামান্য মেয়ের শরীর খারাপ নাকি সে মরে গেছে তাতে তোমার কি?" মেখলার অভিমান মেঘ ভাঙা বৃষ্টির মত দু চোখ ছাপিয়ে নেমে আসছে। একঢাল খোলা চুল, সাদা নাইটি পরিহিতা অভিমানী চোখমুখ নিয়ে দাঁড়ানো মেখলাকে দেখে আমি পাগল হয়ে গেলাম। হ্যাঁ, সত্যিই আমি যেন পৃথিবীর সবকিছু ভুলে গেলাম।
ছুটে গিয়ে ওকে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললাম, " আ আয়াম সরি। আয়াম সো সরি। আ আমার খু খুব ভুল হয়ে গেছে সোনা।" আমি মেখলার চুলে, নাইটির ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া ওর পেলব কাঁধে ঠোঁট ঘষতে লাগলাম।
" কি করছ? বাবা-মা ...।"
আমি মেখলাকে কথা শেষ করতে দিলাম না ওর ঠোঁট দুটোর দখল নিয়ে নিলাম। বাবা-মার দেখে ফেলার ভয়ে মেখলা ছটফট করে উঠল। আমি কয়েক মুহুর্তের জন্য ঠোঁট সরিয়ে বললাম, " ও ওনারা বেরিয়ে গেছেন। এ এখন শুধু আ আমি আর আমার মে মেখলা।" এবার আর মেখলা আমাকে বাধা দিল না।
" তুমি কেন বোঝ না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? সেই প্রথম দিনই তোমাকে দেখে আমার লাভ আ্যট সাইট হয়ে গিয়েছিল।" চুমুতে চুমুতে আমাকে ভরিয়ে দিতে দিতে বলল মেখলা।
" আ আমিও তো তোমাকে ভীষন ভালোবাসি।" আমিও বললাম মেখলাকে যদিও অনেক বছর আগে একই কথা বলেছিলাম আমার জীবনের প্রথম প্রেম শিমিকে। সেদিন আমি আর মেখলা নিজেদের মধ্যেকার শারীরিক, মানসিক সব দূরত্ব মুছে দিয়ে ছিলাম। মেখলার নরম শরীরে ডুবে যেতে যেতে আমি নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছিলাম। শিমির রুক্ষ শরীরের পরিবর্তে মেখলার শরীরটা আমার কাছে যেন নরম তুলোর উত্তাপ দিচ্ছিল।
বাড়ি ফিরে আসার একটু পরেই রমাপদ কাকুর ফোন থেকে ওনার সেই ভাইপোর ফোন পেলাম।
রমাপদ কাকুকে গোপন করে ফোন করেছে। রমাপদ কাকু শিমির জন্য এখানে ফিরে আসার জিদ করছেন কিন্তু ওনার শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ। চিকিৎসা এবং দেখভাল দুটোই দরকার ওনার অথচ উনি পাগলামী করে যাচ্ছেন। আমি যেন একটু বোঝাই ওনাকে। আমি ভাইপো ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করলাম।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। আমি নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে চলেছি। কাকে রাখব আমার জীবনে। আমার প্রথম প্রেম না দ্বিতীয় প্রেম। শিমির প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আজ আমি যা কিছু সব শিমির জন্যই। আমি যখন ক্রমশ অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলাম তখন শিমিকে আঁকড়ে আমি আবার আলোর দিকে এগিয়ে গিয়েছি কিন্তু শিমিকে এত বেশি আঁকড়ে ধরেছি যে যখন পরিবেশ, পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে তখনও আমি কারুর দিকে ফিরে তাকাই নি। কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে আমার দুর্বলতা নিয়ে খুব একটা কেউ যে মাথা ঘামাত তাও নয় কিন্তু আমি কোনও মেয়ে তো দূর অস্ত কোনও ছেলের সঙ্গেও ভালো ভাবে বন্ধুত্ব করে উঠতে পারিনি। একমাত্র মেখলাই পেরেছে সব আগল ভেঙে আমার মনের দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে। এতদিন আমার আর শিমির যে সম্পর্কটা আমার কাছে সবচেয়ে দামী ছিল আজ সেটাই বোঝা মনে হচ্ছে, পায়ের বেড়ি মনে হচ্ছে। আমি অনুভব করতে পারছি শিমিকে আঁকড়ে সারা জীবন কাটানো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমি বেছে নিচ্ছি আমার দ্বিতীয় প্রেম মেখলাকে। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না মনে হচ্ছে। আমি মেখলাকে বিয়ে করতে চাই। ওর সঙ্গে একটা সুস্থ, সুন্দর জীবন কাটাতে চাই। আমি স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি সুন্দর একটা রেল কোয়ার্টার আর তার বাগানে হাত ধরাধরি করে বসে আছি আমি আর মেখলা। একটা ছোট্ট বাচ্চা মেখলার কোলে খিলখিল করে হাসছে। আমি জানি শিমি বেঁচে থাকতে আমার এই স্বপ্ন সত্যি হবে না। কৃতজ্ঞতার বোঝায় আমি ঝুঁকতে থাকব। সোজা হয়ে মেখলার হাত ধরতে পারব না। তার ওপর রমাপদ কাকু নিজেও শিমি ছাড়া কিছু জানে না আর আমাকেও জানতে দেবে না। অস্বীকার করব না যে একদিন কাকুই আমাকে শিমির নেশা ধরিয়ে আমার জীবনটাকে উত্তরণের পথ দেখিয়ে ছিল কিন্তু এখন মনে হয় সেটা তো অন্য ভাবে করলেও পারত। নিজেই তো আমার বন্ধু হতে পারত। আমার কাছে এখন মুক্তির একটাই পথ শিমিকে শেষ করে দেওয়া। শিমি বেঁচে থাকলে আমি বোধহয় মেখলাকে গ্রহণ করতে পারব না আর তাহলেই আমি সুস্থ ভাবে বাঁচব না। আমি মন শক্ত করে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রমাপদ কাকু ফিরে আসার আগেই আমাকে কাজটা করতে হবে তাছাড়া আমাকেও চাকরীতে জয়েন করতে চলে যেতে হবে তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিমিকে মরতে হবে।
রাতের আকাশ আজ যেন বড় বেশী কালো। ঠান্ডা হওয়া দিচ্ছে। যে কোনও মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে। আজকের রাতটাই উপযুক্ত। রাস্তাঘাটে লোকজন বেশি থাকবে না। মেখলাকে " গুড নাইট, সুইট ড্রিমস" লেখা মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে আমি তৈরি হয়ে নিলাম। মা-বাবা অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে গেছে। আমি রেনকোটের হুডটা তুলে দিয়ে পেছনের দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাস্তা জনপ্রাণী হীন। আমি দ্রুত পায়ে পৌঁছে গেলাম। শিমিকে শেষ করার অস্ত্রটা আমি রামপদ কাকুর বাড়িতেই পেয়ে যাব। ও বাড়ির সবকিছু আমার নখদর্পণে।
অস্ত্রটা হাতে নিয়ে আমি একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম । আমাকে পারতেই হবে। মেখলার জন্য, আমার নিজের জন্য পারতেই হবে। অস্ত্রটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম।
" এই শুনছ। মিস্টার গুপ্তার কোয়ার্টারে কি সুন্দর একটা শিমূল গাছ হয়েছে। আমাদের বাগানে একটা লাগাবে?"
" ন ন নাহ, একদম নাহ।" আমি প্রায় আঁতকে উঠলাম।
মেখলা অবাক হয়ে বলল, " আমি জাস্ট এমনি জিজ্ঞেস করলাম। এরকম করছ কেন! না তো না।"
আমি চায়ের কাপটা হাতে কোয়ার্টারের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সেই বর্ষার রাতে আমি রমাপদ কাকুর গোডাউন থেকে কুড়ালটা বের করে হাতে নিয়েছিলাম শিমিকে কাটব বলে কিন্তু হঠাৎ করেই প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ে। চারিদিক আলোয় ভরে যায়। আমি কিছুক্ষনের জন্য প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরতে দেখি নিজের প্রথম প্রেমকে নিজের হাতে খুন করার পাপ থেকে ঈশ্বর আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছেন। নাকি শিমি নিজেই বুঝতে পেরে আমাকে পাপের হাত থেকে বাঁচিয়ে বাজটাকে নিজের শরীরে আহ্বান করেছিল? বাজ পড়ে শিমি পুরো ঝলসে গিয়েছিল আর বাঁচে নি। শিমি নিজে চলে গিয়ে আমাকে আর রমাপদ কাকুকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। রমাপদ কাকুর অকাল মৃতা স্ত্রী নিজে হাতে খুব শখ করে শিমিকে পুঁতে ছিল। শিমিকে লাগানোর কয়েক দিন পরেই উনি মারা যান। সেই থেকে রমাপদ কাকু শিমিকে নিজের মেয়ে বলে ভাবতে আরম্ভ করে। শিমি ওঁর কাছে শুধু একটা শিমূল গাছ ছিল না । ছিল ওনার স্ত্রীর শেষ স্মৃতি। শিমিকে আঁকড়ে বাঁচতে আরম্ভ করে কাকু আর ওনার সেই অনুভূতি একাকী, নিঃসঙ্গ আমার সদ্য কিশোর মনের মধ্যেও ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমিও শিমিকে শুধু একটা গাছ নয় আমার বন্ধু, আমার প্রেমিকা আমার সবকিছু ভাবতাম। সেইদিন আমি চুপিচুপি বাড়ি ফিরে এসেছিলাম কেউ জানতেও পারেনি যে আমি শিমিকে খুন করতে গিয়েছিলাম। রমাপদ কাকু শিমির খবরটা শুনে প্রথমে খুব ভেঙে পড়েছিল। অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিল কিন্তু বাড়ির লোকদের সহচর্যে কাকুও শিমির শোক ভুলে বাড়ির লোকদের সাথে নতুন করে বাঁচছে। ওখানকার পাট তুলে দিয়ে বাড়ি চলে গেছে রমাপদ কাকু। আমিও মেখলাকে বিয়ে করে খড়্গপুরে চলে এসেছি। মা-বাবা আসে মাঝে মাঝে। আমরাও বাড়ি যাই। রমাপদ কাকুর সঙ্গে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয় কিন্তু কেন জানি না শিমির কথা একবার ও বলে না। মাঝে মাঝে নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে আমি কি সত্যিই খুব স্বার্থপর? শিমি তো আমার প্রথম প্রেম ছিল। রমাপদ কাকু যেমন ওকে আঁকড়ে বেঁচে ছিলেন আমি কি পারতাম না? আমি কি অপরাধী?