উপেক্ষা ২য় পর্ব
উপেক্ষা ২য় পর্ব
সন্ধ্যার কোন চাহিদা ছিল না, ইচ্ছা ছিল না,স্বপ্ন ছিল না।তবে এই অরক্ষিত মায়ের হত্যাপুরী,ভায়ের মৃত্যুপুরী এই অভিশপ্ত বাড়ি থেকে পালানোর পথ পেয়ে হাঁফ ছেড়েছিল । মৃত সতীনের সদ্যোজাত শিশু পুত্রের মা হতে হবে, দুই মা হারা শিশুর মা হবার চেষ্টা করতে হবে।আপাতত তাদের দেখভাল যত্ন দায়িত্ব নিতে হবে। তাই সে নিজের নিরাপত্তা পাবার একটা ভরসা দেখেছিল।আর তার শিক্ষিত শিক্ষক স্বামী,একটু বয়স হোক দেখতে বেশ ভালো! তার মত অশিক্ষিত, কালো দরিদ্র,অপরের বাড়ির এক পরিচালিকা বা দাসীকে তিনি কীভাবে গ্রহন করেন,এক তীব্র ভয় সংশয় উদ্বেগ আর উৎকষ্ঠা যেন তাকে গ্রাস করেছিল। তাই ঘন ঘন সে শ্বাস ফেলছিল ,ঘাম হচ্ছিল, থমথমে মুখে কোন আনন্দ বা স্বপ্ন ছিল না,বরং মাঝে মধ্যেই মায়ের কথা মনে হলে দুচোখ জলে ভরে যাচ্ছিল।
কোন ভোজ বা ঐ জাতীয় অনুষ্ঠান বিয়ের দিন নির্মল করতে দেয়নি। তিন মাস আগেই তার আদরের প্রানের প্রিয়া স্ত্রী নমিতার মৃত্যু হয়েছিল ,তাই তার চোখেও ছিল দুঃখ হতাশায় ছায়া।নীরব শান্ত যেন কোন দায় উদ্ধার হচ্ছে।
সেদিন ফুলশস্যা নির্মলের এক রকম আপত্তি উপেক্ষা করে ভারতী ঘরোয়া ভাবে ছোট খাটো ভোজের আয়োজন করে।পাড়ার চল্লিশ জনার মত প্রতিবেশীদের খাওয়ানোর ব্যাবস্থা, আর নতুন বৌমার পরিচিতি ও সামাজিক স্বীকৃতি, যে এটা নির্মলের বৌ। বিয়ের তো চুপচাপ রেজিস্টারী অফিসে শহরে হয়েছিল ।নির্মল যদিও বলেছিল, আয়া নয় বৌমা পেয়েছ, তোমার ঐ মা ঘাতক নাতী মা পেয়েছ, ওকে ওর নতুন মায়ের হাতে তুলে দাও, আমাকে ক্ষান্ত দাও।আমি ক্লান্ত। আমার স্মৃতি জুড়ে শুধুই নমিতা, আর কারোর স্থান নেই।
সুন্দরী তেত্রিশ চৌত্রিশ বছরের নমিতার গঠন এত সুন্দর আর তেমন তার মুখমন্ভল, দেখে পঁচিশ বছরের মেয়ে মনে হত। ভীষণ আবেগ ঘন স্মৃতি আর প্রেম, সেটা ভারতী না মানুক, যতই সংসারের প্রয়োজনে নির্মলকে বিয়ে করতে বাধ্য করুক, নির্মল ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু মায়ের সাথে সংসার আর সন্তানদের প্রয়োজনে একরকম আপোষ করতে বাধ্য হয়।আর তার ফল নতুন বৌকে ভুগতে হচ্ছিল।
চরম উদাসীনতা।একটু নিভৃতে দুরে থাকে, সবার সামনে নির্মল নতুন বৌয়ের সাথে কথা বলেনি।
বাড়ির পুকুরের মাছ, ভাত,সব্জি ছেঁচরা চচ্চোরি ডাল,চাটনী,গ্রামের মিষ্টির দোকান থেকে,রসগোল্লা আর দৈ।সামান্য আয়োজন বড়জোর জনা চল্লিশ পাড়া প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করে।পাড়ার কটা বৌ,গিন্নি মিলে নিজেরাই রান্না করেছিল।তাদের আলোচনা, সন্ধ্যার কানে কম বেশী আসছিল।তিন মাস বয়সের মৃত সতীনে বাচ্চাটাকে তার কোলে দিয়ে ভারতী বলেছিল, "নিজের ছেলেকে সামলাও। ওকে তোমার গর্ভেরই ভাবো।"
এসব কথা শুনে প্রতিবেশীদের কেউ বলেছিল
"যতসব আদিখ্যেতা !কেউ ব্যাঙ্গে মুখ টিপে হাসে, তবে ভারতীর মত স্পষ্ট বাদী জাদরেল মহিলার সামনে টু শব্দ করেনি।গোপনে কেউ বলছিল,
"আহা নির্মলের ভাগ্য বলিহারী ! কত রূপসী বৌটা মরল, এখন এমন কালো ভুঁতুরি বৌ নিয়ে ঘর কর! আবার যদি ঝগড়াটে ছোট ঘরের বেটি হয়, তবে তো বেচারীর জীবনটাই বরবাদ। পাঁচুর জীবনে যা ঘটেছে!"
আবার কেউ বলেছিল, "যাই হোক মেয়েটার কত কম বয়স, আধবুড়ো বর আর তিনটে সৎ ছেলে মেয়ে,ওর ভাগ্য বলিহারি! নিশ্চয় কোন ভিখারীর বেটি, পেট ভাতে দাসীবৃত্তি করতেই ওকে বৌ করে এনেছে। ভারতী দি যা ভীষণ ধুরিবাজ মহিলা! ওর চাল বোঝা দায়।"
সন্ধ্যা কেমন চুপচাপ উদাস ছিল, শাশুড়ির কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। উনি দেখে পছন্দ করে এ বিয়ে ঠিক করেছেন,আর তার সাথে আপনজনের মত দরদ নিয়ে কথা বলছেন। স্বামীর সাথে কথা দুরে থাক দেখাই পাচ্ছে না।আবার এগার বছরের বড় সৎ ছেলে সম্রাট তাকে যেন সহ্য করতে পারছে না।কেমন ভাবে মাঝে মাঝে সে ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছিল, যেন সন্ধ্যাকে তার খুব বিরক্ত লাগছে, অসন্তুষ্ট, অসহ্য লাগছে, বরং আট বছরের সৎ মেয়েটা তার দিকে কেমন লাজুক মুখে বার বার তাকাচ্ছিল।
একবার সন্ধ্যা তাকে কাছে ইসারায় ডাকল।মহুয়া ডাকা মাত্র কাছে এসে বসল।সন্ধ্যা তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল
"আমি তো তোমাদের নতুন মা। লজ্জা করো না। আমার মাও অনেক কম বয়সে মরেছিল,তোমাদের কষ্ট বুঝি, আমি তো নতুন মা পাইনি, তোমাদের যতটা পারি ভালোবাসব যত্ন আদর করব।"
আট বছরে মহুয়া ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলেছিল "আমি তোমাকে মা ভাবলেও দাদা তোমাকে সহ্য করতে পারছে না।বলছে, সৎ মা ভালো হয় না,আর তুমি কেমন কালো মায়ের সাথে তোমার কোন তুলনাই হয় না,মা বলবে না।"
সন্ধ্যা হেসে বলে,"তোমার দাদা ছোট ছেলে ,মাকে খুব ভালোবাসত এখনও বাসে। আর আমি তো সত্যিই কালো, তোমার আগের মায়ের মত ফর্সা সন্দরী নয়। কি করবে সব ভাগ্য ! তবে তোমার দাদাও আমার ছেলে,ওকে বলবে আমি ওকে খুব ভালোবাসব যত্ন করব।তোমার ঠাকুমা আমাকে বিয়ের আগেই এসব বলেছেন।তোমাদের যত্ন ভালোবাসা করতেই আমাকে বৌ করছেন।"
মহুয়া যেন খানিক আশ্বস্ত হয়ে চলে গেছিল।
বড় বাড়ির মস্ত এলাকা জুড়ে প্রাচীর ঘেরা প্রাঙ্গন বাগানের মত, কতগাছ ! আর দোতলা পাকা বিন্ডিং, অনেক গুলো ঘর।সন্ধ্যা কেমন হীনমনত্যায় ভুগছিল, এসবে তার অধিকার আছে সে ভাবতেই পারছিল না।দীর্ঘদিন তার মা ও সে, দুর সম্পর্কের কুটুম্ব বাড়িতে দাসীবৃত্তি বা পরিচালকার কাজ করেছে।কোন দাবী অধিকার ছিল না।সেই দুর্বল অনিশ্চিত মানসিকতা থেকে বের হতে পারছিল না।নিজেকে এ বাড়ীর বৌ না ভেবে দাসী পরিচালকা ভাবছিল। কেমন তাই নিজেকে গুটিয়ে অবদমিত মনে চুপচাপ ছিল ।
শাশুড়ির সব নির্দেশ সন্ধ্যা ভয় ভয় আর এক অনিশ্চয়তা নিরাপত্তাহীন সংশয়ভরা মুখে শুনছিল, যথা সাধ্য তা পালন করছিল। যদিও ভারতী ছিল তার প্রতি দরদী, আর তাকে বিশ্বাস ভরসাও করছিল।
ফুল শয্যার জন্য শাশুড়ি তাকে বেনারসী শাড়ি আর ম্যচিং ব্লাউজ,কিছু সোনার গহনা ও নানা প্রসাধন ফুলের মালার সহকারে পাড়ার এক কম বয়সের মেয়েকে দিয়ে সাজানোর ব্যবস্থা করে।নির্মলের ঘরে কোন ফুল দিয়ে সাজানোর অনুমতি দেয় নি। পুরোন খাটে,সেটা নমিতার সাথে নির্মল ফুল শয্যার সময় ফুলের মালায় যেন ভরিয়ে দিয়েছিল, আর সুগন্ধি, রঙিন আলো ঘরের ভিতরটা যেন স্বর্গপুরি ছিল।
আজ পুরোন বিছানা পুরোন চাদর মশারীর ভিতর সন্ধ্যা কেমন ভয়ে লজ্জায় এক তীব্র অস্বস্তিতে মাথা নামিয়ে সেজেগুজে বসেছিল। কেমন এক অস্থিরতা তাকে তাড়া করছিল। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিল, ফাল্গুনে হালকা ফ্যান চলছে তবু শরীরের ভিতরটা তীব্র ভয়ে টেনশনে ঘামে ভিজে যাচ্ছিল।শোবার ঘরের দেওয়ালে স্বামী সতীনে বড় বাঁধানো ছবি।আর তা ঠিক পাশে মৃত সতীন নমিতার হাসি মুখে বড় বাঁধানো ছবি, টাটকা ফুলের মালা তার ছবিতে ঝোলানো।
নির্মল একটু রাতে এল,কপাট লাগিয়ে বলল, "আমার বিয়ের কোন ইচ্ছা ছিল না।চেয়েছিলাম ছোট ছেলেটার জন্য সর্বক্ষণের আয়া রাখব। মা রাজী নয়।আয়ার দায়িত্ববোধ কম।সৎ মা ভালো। জানি না,সৎমা ভালো না মন্দ।সেটাই তোমার পরীক্ষা, মা তাতে উত্তীর্ণ হলে ভালো, না হলে সংসারটাই ছারখার হবে।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্মল অনেকক্ষণ বসেছিল যদি সন্ধ্যা কোন উত্তর করে। এসবের সন্ধ্যা কী উত্তর দেবে ! তাও ফুল শয্যার রাতে স্বামীকে!
নির্মল আবার বলল,"আমার আগের স্ত্রী এঘরে ছবি আছে,আর থাকবে ,ওর সামনে আমি অন্য কারোর সাথে এমন কিছু করব না যাতে তার আত্মা কষ্ট পায়।আজও ও আমার মনজুড়ে, ওর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি,চোখ বুঝলেই দেখতে পাই।বারো বছরের স্মৃতি এত সহজে ভুলতে পারব না।"
আবার খানিক চুপ থাকে শেষে অধৈর্য হয়ে বলে "তুমি কিছু বলবে!"
সন্ধ্যা হতাশায় দুঃখে অন্তরটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল, নীরবে মাথা নেড়ে না জানাল।
"তাহলে অনেক রাত হল,শুয়ে পড়ো।" তারপর আলো নিভিয়ে নির্মল শুয়ে পড়ল। সন্ধ্যার হাত পা যেন হতাশায় অবশ হয়ে আসছিল। ধীরে ধীরে একপাশে সংকীর্ণ স্থান নিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে শুয়েছিল।
দুচোখ জলে ভরে যাচ্ছিল। মায়ের মুখটা মনে পড়ছিল তার কিছুই মনে আসছিল না।
পরদিন খুব সকালেই সন্ধ্যা উঠে পড়েছিল, নির্মল তখনও ঘুমুচ্ছে। শাশুড়ি এসব বিষয়ে বরাবর একটু উদাসীন ,আজ তবু সন্ধ্যাকে জিজ্ঞেস করে "নির্মলের সাথে তোমার কিছু কথা হল!"
সন্ধ্যা বলল,"হ্যাঁ মা!"
ভারতী ভাবল নির্মল আবার তার জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যপারে কিছু বলেছে কিনা তাই বলল,
"কি কথা আমার জানা উচিত নয়,তবু তোমার কী মনে হল! তোমার মায়ের মত ভেবেই জিজ্ঞেস করছি। ওর তো বিয়ে মনছিল না,তাই ওর কথা হয়ত তোমার ভালো না লাগতে পারে।"
সন্ধ্যার অন্তর দুঃখে ফেটে গেলেও মলিন হেসে বলল,
"উনি এখনও আগের স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসেন, আর দোষ কী! এই কমাস মাত্র, এমন ভাবে হঠাৎ চলে গেলেন!"
"সে তো জানি, জীবন শুধু সুখের নয়, আমার জীবনের কথা তোমাকে শোনাব একদিন। দুঃখ আর আবেগ নিয়ে থাকলে,সংসার চলে না,লাভও হয় না।"
সন্ধ্যার হঠাৎই বলে বসে,"ছোট ছেলেটাকে নিয়ে আমি যদি রাতে শুই,আপনার কোন আপত্তি আছে মা!"
ভারতী খানিকক্ষন চুপ থাকে।তারপর হেসে বলে, "তোমার ছেলেকে রাতে তোমার কাছে রাখবে এর চেয়েও সুখের কী আছে মা! ওর এখনও নামকরন হয়নি,ওর নাম তুমিই রাখবে।"
সন্ধ্যা ভেবেছিল, তার মা মরা সন্তানকে আপন করলে যদি নির্মলের মনে একটু ঠাঁই পায়।কিন্তু এতো হিতে বিপরীত! শিশু পুত্র কোলে সন্ধ্যাকে রাতে তার ঘরে ঢুকে শোবার জন্য আসা মাত্র রেগে ওঠে,বলে,
"ও কে আনলে কেন!
"ও তো আপনার সন্তান !"
"ওর এঘরে ঠাঁই নেই।"
"কেন কী অপরাধ ওর!"
"ও মাতৃঘাতক ,ওর জন্য আমার জীবন মরুভূমি ।"
"কী বলছেন আপনি! মা মরা সন্তানের দুঃখ কী জানেন!"
"আমি জানতে চাই না,তোমার জ্ঞান আমি শুনব না।"
"ওর মা ওকে দেখলে খুশী হবে।"
"শোনা বাজে অজুহাত দেবে না।নমিতার জীবন টা ওর জন্যই গেল, তুমি ওর সাথে রাতে শুতে হলে এ ঘরে নয় ,বাড়িতে অনেক ঘর আছে, অন্য ঘরে শুতে পারো।তাতে বরং তোমার আমার অস্বস্তি কমবে ।"
সন্ধ্যা করুন ভাবে বলে "আজকের দিনটা অন্তত ওকে নিয়ে এ ঘরে আমাকে শুতে দিন।"
নির্মল আর কিছু বলেনি।
পরদিন সকালে সন্ধ্যা ,শাশুড়িকে প্রায় কেঁদে ফেলে বলে,"আপনার ছেলে এই দুধের শিশুকে ওর ঘরে শুতে দিতে আপত্তি, এ নাকি মাতৃঘাতক এ কী সব কথা !"
শাশুড়ি একরাশ ক্ষোভ নিয়ে বলে, "ওটা অমানুষ, আগের বৌ ছাড়া জীবনে কিছুই জানে না।ছোট বেলা থেকেই দেখছি বড় স্বার্থপর আর অন্যদের কথাই ভাবে না,নিজের সিদ্ধান্ত ঠিক।আর সব ভুল। তুমি বৌমা তা হলে একাই নির্মলের ঘরে রাতে শোবে।"
"না মা আমি আমার রাজা সোনাকে নিয়ে অন্য ঘরে শোব, যদি আপনি অনুমতি দেন।"
শাশুড়ির খানিকক্ষন কিছু ভাবছিল পরে বলল, "তোমার ছেলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আমি কে! তুমি যেমন চাও তাই হবে।"
ভারতীর চোখ জলে ধরে ওঠে।বলে "ও পাষন্ড যদি তোমার মত মেয়েকে দুঃখ দেয়, আঘাত করে ঠিক একদিন ওকে তোমার জন্যে কাঁদতে হবে। জীবনে রূপ রং সব নয়।মন অনেক বড়।"
সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে শাাশুড়ি বলে "আমি তোমার সঙ্গেই সব সময় আছি। তোমার যা সমস্যা আমাকে বলবে।"
এদিনের পর, সন্ধ্যার সাথে নির্মলের শুধু বিছানা পৃথক হল না,একটা মানসিক দুরত্ব যেন গড়ে ওঠে। একগুঁয়ে নির্বোধ নিজের দোষ স্বীকার করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টাও ভবিষ্যতে করেনি।মৃত সে যত আপনজন প্রিয়জন হোক,তার জন্য জীবিত, কাছের মানুষকে দুরে ঠেলে দেওয়া আর হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা একই মৃর্খতা, নির্মল উপলব্ধি করেনি। এরপর সন্ধ্যার প্রতি শাশুড়ির ভালোবাসা মায়া টান বহুজন বেড়ে যায়।
বড় নাতি সম্রাটের আচরন ছিল, সৎ মায়ের প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অসহ্য আর অবজ্ঞার। সন্ধ্যা গায়ে মাখতো না। অবিবাহিত জীবনে অনেক অপমান লঞ্ছনা ভোগ করেছে, অহরহ গায়ে হাত তোলা অবধি নীরবে সহ্য করেছে।কান্না ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না।এ তো সামান্য একটা দশ বারো বছরের বালক, মায়ের স্থানে না মানতেই পারে। ভাবুক না দাসী!তার কোন দুঃখ ছিল না, কিন্তু ভারতীর তা সহ্য হবে কেন! তার চোখে বাড়ির কিছুই এড়াবে না,একদিন সম্রাটকে নিজের ঘরে ডেকে বলে,
"সম্রাট ভাই তুই কেন এই মেয়েটাকে সহ্য করতে পারিস না!"
"ওকে আমি মা মানতেই পারব না! সৎমা আপন হয় না ,ওর নিজের বাচ্চা হলেই , ওর অন্য মূর্তি হবে।আমাদের ক্লাসের গোপাল বলছিল। ওর সৎ মা ভালো নয়।"
"হতভাগা গোপাল, যেমন তার বাপ তেমনি সৎমা! তোর সে ভয় নেই, তোর এই সৎমার নিজের সন্তান কোনদিন হবে না। খুশী তো!"
"কেন! তুমি কি গনৎকার!"
"পাগল ছেলে, তুই ছোট ছেলে সব বুঝবি না,আমার উপর বিশ্বাস আছে তো!"
"সে তো আছে, কিন্ত কেমন কালো দেখতে, মূর্খ গরীব, পরের ঘরের দাসী ছিল,ওকে মা বলব না।"
"বেশ তো কী বলবি মাসী! কাজের মানুষদের তো আজকাল মাসী বলে! আর তোর, ওর উপর এত রাগ কেন! গরীব বলেই তো, ও তোর আধ বুড়ো বাপকে বিয়ে করেছে,তিনটে সৎ ছেলে মেয়েদের মানুষ করব জেনে এই বিয়ে রাজী।তোদের জন্যই তো এই বিয়ের আমি ব্যবস্থা করি।আমি যদি কাল মরে যাই কে তোদের তোর বাপের ভাত রাঁধবে!ও মুঠো খাবার ছাড়া কী পাচ্ছে!
তোর মা তো সখ আনন্দে থাকত।এ কত আমার কাজ করে দেয় জানিস!তোর কচি ভাইটার যত পেচ্ছাব পায়খানা সব নিজের হাতে ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে।তোর মা এত তোদের সময় করত না। তোদের কত ভালোবাসে ! এই সব তোর যে তাচ্ছিল্য বেয়াদবী দেখলেও রাগ করে না,আমি যদি বলি,তুমি উত্তর দাও না কেন ! ও হাসে বলে, বাচ্ছা ছেলে, ওর যদি এতে আনন্দ হয় হোক না! আমার তো কিছু ক্ষতি হচ্ছে না!"
সম্রাট খানিকক্ষন চুপ থেকে বলে।"বেশ আমি আর অমন করব না।"
"এক বার আয় না ,তোর এই কালো গরীব, দাসী মেয়েটার সাথে আলাপ কর না! আমার সঙ্গে আয়।"
সম্রাট মাথা নিচু করে সন্ধ্যার ঘরে গেল ,সন্ধ্যা তখন রাজাকে খাটে আলত পিঠ চাপড়ে ঘুম পাড়াচ্ছিল। ভারতী বলে, "দেখো বৌমা এ এসেছে!"
সন্ধ্যা সম্রাটকে তার ঘরে ঢুকতে দেখে একমুখে হেসে বলে "আজ কি সূর্য পশ্চিমে উঠেছে মা! এসো খাটে বসো বাবা।"
সম্রাট লজ্জায় মুখ নামিয়ে খাটে বসেছিল।
সন্ধ্যা বলে," মায়ের কাছে কী লজ্জা করে! কী বলবে বলো! কোন অভিযোগ, আবদার তোমার যা খুশী বলো।"
"আমি যদি তোমায় কোন দুঃখ দি, ক্ষমা চাইছি।" বলেই সম্রাট চোখ জলে ভরে ওঠে,কেমন কেঁদে ফেলল।
"সন্ধ্যা বিচলিত হয়ে তাকে কাছে টেনে নেয়,হাত দিয়ে তার চোখের জল স্বস্নেহে মুছিয়ে দেয়।তারপর বলে "তুমি অনেকটা আমার ভায়ের মত ,ও আমার চেয়ে ছ বছরের ছোট ছিল। "
সম্রাট বিষ্ময়ে জিজ্ঞেস করে "এখন কোথায় তোমার ভাই !"
সন্ধ্যা নিজেকে সামলাতে পারে না,হঠাৎই কেমন হাউ করে কাঁদতে লাগল।
এসব দৃশ্য ভারতী বেশ উপভোগ করলেও হঠাৎ সন্ধ্যার কান্না তার চোখে জল এনেছিল।
দুখী গলায় ভারতী সম্রাটকে বলে "দিলি তো মেয়েটাকে কাঁদিয়ে !"
অপরাধীর মত সম্রাট বলে" আমি কি করলাম!"
সন্ধ্যা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে," মা ওকে বকছেন কেন!ওর কী দোষ হঠাৎ আমার ভাই মায়ের কথা সব মনে পড়ে গেল।জানো সম্রাট, আমার ভাই পুকুরের জলে ডুবে মারা যায় তখন আমি বারো,ওর বয়স ছয়, মা মারা গেল তখন আমি পনের বছরের, তোমার চেয়ে একটু বড়।মা মরার কষ্ট দুঃখ আমি খুব ভালো জানি।"
দুখী গলায় সম্রাট জিজ্ঞেস করে "মা কি করে মরল!"
সন্ধ্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,"শুনেছি গলায় দড়ি দিয়ে। ওসব থাক, তুমি আজ থেকে আমার বন্ধু ঠিক তো!"
সম্রাট কৌতুহলে জিজ্ঞেস করে "তোমার বাবা নেই!"
সন্ধ্যা বলে,"কোন ছোট বেলায় বাবা মারা গেছে ঠিক মনে পড়ে না,ভাই তখন মায়ের পেটে।"
কেমন হতাশায় সম্রাট এবার বলে"তোমার জীবন তা হলে আমার চেয়েও অনেক দুঃখ কষ্টের!"
সন্ধ্যা আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু ভাবছিল কেমন আনমনা হয়ে।
ভারতী বলে ,"পুরোন কথা ভেবে কেন দুঃখ পাচ্ছ!
আমার জীবন কম কষ্ট দুঃখের নয়,আমি ভাবি না।ভবিষ্যত ভাবো, কাজে ডুবে থাকো, কোন কষ্ট থাকবে না।"
সন্ধ্যা নিজেকে সামলে নেয় হেসে বলে,"তা হলে সম্রাট বাবু আমি তোমার মা না বন্ধু!"
ভারতী বলে "একী কথা,বন্ধু হবে কেন তুমি মা!"
সম্রাট বলল, "তুমি আমার মা আর বন্ধু দুই বলে হাত বাড়িয়ে দেয়।"
সন্ধ্যা তার হাতে চেপে ধরে হেসে বলে, "মা কখনো বন্ধুও হয়।কিন্তু বন্ধু কোনদিন মা হতে পারে না!"
ভারতী বলে "ঠিক বলেছ, সম্রাট বুঝলি কিছু!"
"বুঝলাম, তবে তোমাকে মায়ের চেয়েও বন্ধু ভাবলে বেশী কাছে পাব।ভায়ের মা হয়ে থাকবে।"
সন্ধ্যা বলে "তোমার যা খুসী।"
ভারতী, সম্রাট চলে যাবার পর বলল,"এই তো ভুল করলে,বন্ধু কেন! তাহলে কুকথা গালাগাল সব দেবে, মায়ের শ্রদ্ধা পাবে না!"
"মা আপনি কেন ভাবছেন !আমার সম্মান শ্রদ্ধার কী মুল্য! সম্রাট অনেক হালকা হল,এটা খুব দরকার ছিল, আমার চেয়েও ওর এই খোলাখুলি মেলামেশা বেশী দরকার । ওর এজন্য পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছিল।ওর মুখচোখে কেমন একটা অস্থিরতা ছিল। ছোট ছেলে অন্যদের কথায় বিভ্রান্ত ছিল। আপনি ওকে এ ঘরে ডেকে এনে খুব ভালো কাজ করলেন।"
"তোমার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না বৌমা!"
এরপর সন্ধ্যার প্রতি ভারতীর ভালোবাসা আদর যেন বহুগুন বেড়ে গেলো। নিজের আর আগের বৌমার সব গহনা তাকে দিল, যদিও সন্ধ্যা তা কোন দিন পরেনি ।
শাশুড়িকে বলেছিল, "এসব আমাকে মানাবে না মা , আপনার নাতি নাতিদের বিয়েতে কাজে লাগবে।"
ভারতী আর জোর করেনি,যার আসল অলংকার স্বামীর সোহাগ আদর পায় না,তাকে জড় বস্তুর সোনার অলংকার কী সুখ দেবে!
তবে খাবার ব্যাপারে ভারতী,সন্ধ্যার কোন কথা শুনত না।সবচেয়ে বড় মাছের পিস,আর রাতে গ্লাস ভর্তি দুধ নিজের হাতে সন্ধ্যাকে খেতে দিত।বাকী খাবার দাবার ঠিক মত খাচ্ছে কীনা ভারতী নজর দিত।আগের বৌ সন্দরী হলেও সংসারে কাজে তেমন সাহায্য করত না।এখন এই বৌমা তার সব কাজ যেন নিজেই করে নেয়।দীর্ঘ দিন পরিচালিকার কাজে পটু সন্ধ্যার যেন হাত পা ছুটত।
এত কাজ করেও শাশুড়ির যত্ন করতে যেতো। শাশুড়ি নিতো না । বরং বলত "নিজের যত্ন নাও, শরীর ঠিক রাখবে,বেশী পরিশ্রম ভালো নয়।তুমি এবাড়ীর বৌ, সন্তানদের মা।তোমার উপর গোটা সংসার টা চলছে।"
ভারতী বলত "তুমি সংসারের মেরুদন্ড, তোমার কিছু হলে সংসারটাই বেঁকে যাবে,ভেঙ্গে পড়বে।"
সন্ধ্যা রসীকতা করে বলত "মা তাহলে আপনি ব্রেন, আর আপনার ছেলে হৃদপিন্ড। আর ছেলে মেয়েরা ফুসফুস লিভার কিডনি, আরও অনেক দামী। "
ভারতী হাসত, বলত "সবাইকে ধরে রাখে কিন্তু ঐ মেরুদন্ড। তোমার কোন বিকল্প নেই।"
সন্ধ্যার কোন উপায় ছিল না। এ বাড়ীর শাশুড়ির ভালবাসা আর শিশু সতীন পুত্রের মোহে সে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল। নির্মল আর সন্ধ্যার কথোপকথন ছিল ভাববাচ্যে। সন্ধ্যার মনে স্বামী নির্মলের প্রতি মনে তীব্র ক্ষোভ থাকলেও সেবাযত্নে ছিল আদর্শ স্ত্রী। তার নিরাপত্তা ইজ্জত সম্মান সব কিছুই নির্মল নির্ভর তাই স্বামীর দীর্ঘ জীবন ও সুস্থ কামনায় বার ব্রত পালন করত।
বিধবা জীবনের দুঃখ তার মা,শাশুড়ির কাছে অনেক অভিজ্ঞতা সে জানে। তাই যৌবনে কামনা বাসনা যৌন জীবনে স্বামীর ভালোবাসা আর তৃপ্তি তার অধরা ছিল। মাতৃত্ব ধারন তার সম্ভব হয়নি। তবু স্বামীর দীর্ঘ নীরোগ জীবন কামনা করত।
গৃহ বন্দী জীবনে শাশুড়ি সন্ধ্যাকে গ্রামের একটু দুরে বাবা শিবানন্দ আশ্রমে মাঝে মাঝেই নিয়ে যেত। রাজা যখন স্কুলে ভর্তি হল, প্রাথমিক শিক্ষাটা সন্ধ্যা দিয়েছিল। ক্রমে তার শিক্ষামান বৃদ্ধির সাথে সন্ধ্যাও নিজের জ্ঞান পরিধি বাড়াচ্ছিল । তার দুই বড় সৎ ছেলে মেয়ে তাকে এবিষয়ে খুব সাহায্য করত।
সম্রাট তাকে মায়ের চোখের নয়, বরং বড়দিদি বা বন্ধুদের মত আচরণ করত। তর্কিতর্কি হাসাহাসি খুব হতো ।সন্ধ্যা সেটা খুশী মনে মেনে নিতো। সন্ধ্যা কিন্তু এমন কিছু করত না যাতে সম্রাট বা মহুয়া মনে আঘাত পায়।
সন্ধ্যার যত দাবী ছিল রাজার প্রতি,যেন চোখে হারাত, পড়াশোনাতে ওর জন্য অনেক সময় দিতো, শাসন করত, তবে গায়ে হাত তুলত না। খুব অবাধ্য হলে সন্ধ্যা কাঁদত ,তখনই রাজা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে,নিজের কান, নিজে মলে, মায়ের দুঃখ দুর করত।
রাজা বড় হওয়ার সাথে সাথে বাবার স্নেহ সে পাচ্ছিল আর স্কুলে রাজার রেজাল্ট ভালোর জন্য ,নির্মল সন্ধ্যার প্রশংসাও করত। দু বড় ছেলে মেয়ে রেজাল্ট ভালো হত ,নির্মল ওদের গাইড করত।আর রাজা মা ছাড়া ক্লাস টেন অবধি অন্য কোন সাহায্য নিত না। বড় জোর স্কুল শিক্ষকদের গাইড নিতো। বাবা মায়ের একটা সম্পর্কের ছেদ আছে বড় ছেলে আর মেয়ে জানলেও রাজা তেমন জানত না।
ক্লাস টেন পাস করার পর, ঠাকমা তখন মৃত্যু শয্যার একদিন গোপনে ডেকে রাজাকে বলল,"তোর মায়ের মনে জীবনে দুঃখ দিবি না,সে যে কত বড় পাপ,আমার জানা নেই,তবে শত নরক ভোগে দুর হবে না।নিজের সন্তানে মোহ ত্যাগ করে, আর জীবনে সব কামনা বাসনা ছেড়ে তোকে বড় করেছে। এত বড় মহান মা অনেক গর্ভধারীনি মা হয় না। তোর বাবা ওর প্রতি সুবিচার করেনি।"আর ও কি বলত কে জানে সন্ধ্যা এসে পড়েছিল কিছু শুনেছিল।
তাই প্রায় কেঁদে ফেলে সন্ধ্যা বলে"এসব কি বলছেন মা !আপনি অসুস্থ, কেন এসব মনে এনে কষ্ট পাচ্ছেন। আর রাজা আমাকে দেখবে কি দেখবে না, সে জন্য আমি ভাবিত নয়, ও জীবনে অনেক বড় হোক,যদি দরকারে ও আমাদের ছেড়ে বিদেশে যায় যাবে।আমি কিছু আশা করি না।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যা বলে,"আপনি যে ভাবে একা বিধবা মা , তিন সন্তানকে মানুষ করেছেন আমি সে তুলনায় নগন্য।আমার আর্থিক সমস্যা ছিল না, আর আপনার মত প্রকৃত মায়ের সাহস ভরসা সাহায্য সব সময় পেয়েছি।আমি তো সব আপনাকে দেখেই শিখেছি। ত্যাগ কাকে বলে, আপনি আমার আর্দশ।"
ভারতীর চোখে জল বলে ,"তুমিই আমার সত্যিকারের সন্তান, যাদের পেটে ধরেছি একটা আমার মত নয়,সব স্বার্থপর অবিবেচক আত্মাকেন্দ্রিক। তুমি ছাড়া এখন আমায় কেউ ভালোবাসে না, আমি সব বুঝি!"বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। এর দিনকতক পড়ে ভারতীর মৃত্যু হয়।তীব্র ব্লাড সুগার আর কিডনি দুটোই নষ্ট হয়ে গেছিল।
রাজা সেদিন অনেক কিছুই শুনেছিল শিখেছিল,মা ঠাকমার প্রতি শ্রদ্ধার অনেকটাই বেড়ে যায়।বাবার প্রতি একটা খারাপ ধারনা তৈরী হয়।মাকে এ বিষয়ে সে বার বার জানতে চাইলে সন্ধ্যা মজার ছলে বলে,
"তোর এত সুন্দর রং এত সুন্দর মুখ চোখ আর মেধা সব তোর বাপ তার আগে মায়ের জন্য। আমি কে! আমার জন্য কেন বাবাকে খারাপ ভাবছিস!ঐ মানষটা আছে তাই তোর সম্মান ইজ্জত নিরাপত্তা, আমি কে ! তোর বাবা ভাগ্যিস আমাকে বিয়ে করেছিলেন, তাই তোর মত সোনার চাঁদ ছেলে পেয়েছি।"
রাজা মানতেই চায় না,বলে "তুমি ছাড়া আমি শুন্য। তোমার স্বভাব, সবাই বড় আর তুমি তুচ্ছ! এটা আমি মানি না। তুমি বড় বলে সবাইকে বড় করো।আর যারা ছোট অন্যদের ছোট ভাবে।নিজেকে বড় ভাবে।"
মা বেটার এমন তর্ক তাদের মানসিক বিকাশ হত।
