টিকটিকির খেয়াল
টিকটিকির খেয়াল
অমলেশ ব্যাগটা খুলেই চমকে উঠল। ব্যাগ খোলামাত্রই একটা একটা বাচ্চা টিকটিকি ভিতর থেকে বেরিয়ে আসলো। কিছুটা ভয় পেয়ে যেই অমলেশ সরে গেলো, তখনই টিকটিকিটা ব্যাগ থেকে সোজা লাফ দিল বিছানায় এবং সেখানে ২-৩ সেকেন্ড স্থির থেকে বিছানা থেকে মাটিতে নেমে টেবিলের পিছনে চলে গেল।
অমলেশ কিছুক্ষণ আগেই ভোপাল থেকে কোলকাতায় বাড়িতে ফিরেছে ১৫ দিন বাদে। অফিসের কাজে গিয়েছিল দিল্লি, সেখান থেকে ভোপাল। ষ্টেশন থেকে নেমে ট্যাক্সিতে উঠেই ঠিক করে নিয়েছিল বাড়িতে গিয়ে খেয়ে-দেয়ে ব্যাগ থেকে শুধুমাত্র অফিসের ফাইল গুলো বার করে ঘুমোতে যাবে। কারন কাল অফিসে গিয়ে আবার রিপোর্ট জমা দিতে হবে। তাই ফাইল গুলো হাতের কাছে রাখা দরকার।
কিন্তু ব্যাগ থেকে টিকটিকি বেরোতে, অমলেশ ঠিক করলো ব্যাগের ভিতর যা যা জিনিসপত্র আছে সব বাইরে বের করবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কিন্তু ব্যাগ থেকে শুধুই জিনিসপত্র বেরোল এবার। টিকটিকি বা অন্য কোনও প্রানি বেরলনা। অমলেশ কোনোরকমে জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘুমোতে চলে গেল। ভোর রাতের দিকে বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন পড়ায় অমলেশের ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাথরুম থেকে ঘরে আসার মুহূর্তে অমলেশের চোখ পড়ল টেবিলের দিকে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ফুলদানির পাশে শুয়ে থাকা ছোট্ট টিকটিকিটার দিকে। অমলেশ ভাবল, এটা কি সেই ব্যাগ থেকে বেরনো টিকটিকটা? কিন্তু চোখে ঘুম থাকায় এবং পরেরদিন সকালে অফিসের চিন্তায় সে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন অফিসে গিয়ে কাজের চাপে অমলেশ টিকটিকির কথা একেবারেই ভুলে গেল।
কিন্তু বাড়িতে ফিরেই আবার টিকটিকিটাকে দেখতে পেলো। এবার ফুলদানিটার গায়ে সেঁটে আছে। অমলেশ একবার ভাবল, এটা কি সেই টিকটিকিটা? অন্য টিকটিকিও হতে পারে তো? কিন্তু টিকটিকি নিয়ে এত কি ভাবার আছে সেই প্রশ্নও ওর মনে আসলো। তাই সে আর টিকটিকিটিকে নিয়ে বেশি না ভেবে নিজের কাজে মন দিল।
প্রতিরাতের মত আজও অমলেশের ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিন্তু লাইট জ্বেলে যা দেখল তাতে অমলেশের যেটুকু ঘুম-ঘুম ভাব ছিল তা একেবারেই চলে গেল। অমলেশ দেখল, টিকটিকিটা ফুলদানির গায়ে সেঁটে আছে আগের মতন এবং ফুলদানি থেকে ঝুলে থাকা রজনীগন্ধা ফুল একটু একটু করে খাচ্ছে। টিকটিকি কীটপতঙ্গ খায় অমলেশের এটাই জানা ছিল। কিন্তু এখন যা দেখছে তা তো আগে কখনো দেখেই নি এমন কি কোথাও পড়েও নি। এরকমও যে হতে পারে তা জানা ছিল না।
সকালে প্রথমেই মাকে ঘটনাটা জানালো। এবং দেখাল রজনীগন্ধা ফুলহীন স্টিকটা। যদিও টিকটিকিটিটাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। মাও অমলেশের সাথে একমত। এমন যে হতে পারে তা তারও জানা ছিল না। অফিসে গিয়ে এক কলিগকে জানাতে সে বলল এমন হতেই পারেনা। তার ধারনা অমলেশ ঘুমের চোখে ভুল দেখেছে। অমলেশ ভাবল, সে ভুল দেখেছে? কিন্তু সে নিজের চোখে দেখল টিকটিকিটা ফুল খাচ্ছে।
অফিস থেকে বেরিয়েই কিছু রজনীগন্ধা ফুল কিনে ফেলল। যদি কাল রাতে টিকটিকিটা ফুলগুলি খেয়েই থাকে তাহলে আজও নিশ্চয় খাবে।ঘরে ঢুকেই রজনীগন্ধা ফুলগুলিকে ফুলদানির মধ্যে রেখে দিল। সেই রাতে অমলেশের আর ঘুম এলনা। মাঝে মাঝেই লাইট অন করে দেখে নিচ্ছিল টিকটিকিটা এসেছে কিনা। শেষে ভোর রাতের দিকে টিকটিকিটা হাজির হল। এবং মনের সুখে আগের রাতের মতন রজনীগন্ধা ফুল খেতে লাগলো। অমলেশের আর কোনও দ্বিধা থাকল না যে এই টিকটিকটি ফুল-পাতা খায়। আর দেরি করল না অমলেশ, পাশেই রাখা ফোনটা নিয়ে ভিডিও করতে শুরু করে দিল।
পরেরদিন অফিসে গিয়েই যে কলিগ টিকটিকির পাতা খাওয়া বিশ্বাস করেনি তাকে প্রথম ভিডিওটা দেখাল। সে তো দেখে থ। একে একে বাকিরাও দেখল এবং সবাই অবাক হল। কেউ বলল এটা টিকটিকিই না অন্য কোনও জীব, কেউ আবার মজা করে বলল, টিকটিকি নিরামিষাশী হয়ে গেছে।
বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে শুনল সকালবেলা যখন রান্নাঘরে তরকারি কাটছিলেন তখন নাকি একটা টিকটিকিটা এসে কিছু বাঁধাকপির পাতা খেয়েছে। অমলেশের বুজতে ভুল হলনা যে এটা সেই টিকটিকিটাই। এবার ঘরে ডুকেই দেখতে পেলো টিকটিকিটাকে। টিউবলাইটের ঠিক পাশেই। কিন্তু কি আজব ব্যাপার। গত রাতের তুলনায় টিকটিকিটার সাইজ যেন একটু হলেও বেড়েছে।
এইভাবে প্রায় একমাস কেটে গেল। টিকটিকির ভিডিও এখন ইউটিউবে ভাইরাল হয়ে গেছে। অমলেশের বাড়িতে লোকে টিকটিকির পাতা খাওয়া দেখতে আসে। টিকটিকিকে পোকা ধরে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু টিকটিকিটা টা নাকছ করে দিয়েছে। এরই মধ্যে অমলেশ এবং অমলেশের মায়ের সাথে প্রাণীটার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
তবে যেটা বলার বিষয় তা হল টিকটিকিটার সাইজ। টিকটিকিটার সাইজ এখন প্রায় একটা গোসাপের সমান। এক মাসে এতটা বড় হয়ে যাবে তা অমলেশ স্বপ্নেও ভাবেনি। টিকটিকিটার জন্য এখন আলাদা করে বাজারও করতে হয় অমলেশকে। সারাদিন দেয়ালে ঘুরে বেড়ায় এবং খাবার সময় নিচে নেমে আসে। টিকটিকির খবর এখন গোটা কলকাতা জেনে গিয়েছে। প্রতি রবিবার লোক আসে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে টিকটিকিটাকে দেখতে।
এরকমই একটি রবিবার এক সাহেব এসে হাজির। নাম জন। আমেরিকা থেকে আসছেন উনি। তিনি টিকটিকিটির ভিডিওটি ইউটিউবে দেখেছেন এবং তিনি ওটিকে কিনতে চান। সিনসিনাটিতে ওনার একটা প্রাইভেট জু আছে সেখানে তিনি টিকটিকিটাকে রাখবেন। অমলেশকে টাকা অফার করলেন ১ লাখ। টিকটিকিটার প্রতি এই কয় মাসে একটা মায়া পরে গেলেও টিকটিকিটা যে কোনও কাজে আসছেনা সেটা অমলেশ ভালই বুঝতে পারছিলো। তার ওপর একটা টিকটিকির জন্য একেবারে ১ লাখ টাকা কেউ দিতে পারে সেটা কল্পনাই করতে পারেনি। কিন্তু প্রস্তাবে এক্তাই শর্ত জন রেখেছিলো তা হল, সে টিকটিকটাকে একমাস পর্যবেক্ষণ করবে। যদি এটি সত্যিই হয় যে টিকটিকিটি তৃণভোজী এবং আকারে বাড়ছে তবেই সে টিকটিকিটি কিনবে। অমলেশও এই শর্তে রাজি হয়ে গেলো। জনের প্রথম দর্শনেই টিকটিকিটাকে ভাল লেগে গেলো। সে এটা স্বীকার করলো এত বড় টিকটিকি সে কখন দেখেনি।
জন প্রতিদিন অমলেশের বাড়িতে আসে এবং টিকটিকির সব্জি খাওয়া দেখে যায়। জন ভীষণ খুশি। রোজই বলে ‘ওয়াট আ এমেজিং ক্রিচার’। এই ভাবে কিছুদিন চলল। কিন্তু একদিন টিকটিকি বেঁকে বসলো। কিছুতেই সে ওপর থেকে নিচে নামবে না। কিছুই খেতে চাইছে না। সাহেব যত পালং শাক খাওয়াতে যায় তত মুখ সরিয়ে নেয়। সাহেব ভাবল বোধহয় শাক পছন্দ নয়। তাই সে ফুলকপির পাতা খাওয়ানোর চেষ্টা করে। তাতেও না। এই ভাবে জন অনেক কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করলো। কিছুই খেল না।
পরেরদিন সাহেব ২০ রকমের বিভিন্ন সব্জি নিয়ে এসে হাজির। কিন্তু আজও একই অবস্থা। যেন সে নো টু ফুড। সাহেবের দেওয়া খাবার খাচ্ছে না দেখে অমলেশ নিজেও চেষ্টা করে খাওয়ানোর। কিন্তু তারও সাহেবের মতনই হাল। অমলেশের মাও চেষ্টা করলো কিন্তু সেখানেও একই ফল। কিছুই খেতে চাইছে না টিকটিকিটা। এই ভাবে বেশ কএকদিন চলল। টিকটিকিটি কিছুই মুখে নিচ্ছেনা। সাহেবের ধৈর্য আর থাকছেনা। সে যেন প্রতিবাদ করছে কোনও একটা কিছুর বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে সাহেব আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করলেন তা হল টিকটিকিটার আকারে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আগের তুলনায় কিছুটা ছোট হয়ে গিয়েছে। টিকটিকিটা কিছু খাচ্ছেও না আর দেয়াল থেকেও নিচে নামছে না।
সাহেব একমাস পূর্ণ হবার আগেই কলকাতা থেকে বিদায় নিয়েছেন। টিকটিকি ছাড়াই। অমলেশও ১ লাখ পায়নি। আর টিকটিকিটা এখন আগের মতন শাক-সব্জি খায় না এবং আকারেও এখন বাকি পাঁচটা টিকটিকির মতনই হয়ে গেছে। এখন সে সারাদিন ঘরের দেয়ালে ঘুরে বেড়ায় আর পোকামাকড় ধরে খায়।