তৃতীয় লিঙ্গ
তৃতীয় লিঙ্গ
রাত থাকতে থাকতে উঠে পরে নিতাই অধিকারী, রোজ তার এক রুটিন। দুটো ট্রেন পাল্টে অনেক টা দূরে যেতে হয় তাকে। বাড়ি ফিরতেও বেশ রাত হয়ে যায়। বিছানা ছেড়ে উঠে কূয়োতলায় যায় সে। রাতে ফিরে এসেও এই কূয়োতলায় বসেই সারা শরীরের অবাঞ্ছিত রোম তোলে। তারপর স্নান করে তবে ঘরে ঢোকে। গতকাল রাতে ও এর অন্যথা হয়নি। সূর্য ওঠার আগেই সে তৈরী হয়ে বেড়িয়ে গেল।
ভোরের মিষ্টি হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে স্টেশনে পৌঁছায় সে। রোজ ভাবে ঘরে ফিরে শিউলি কে সব বলবে, কিন্তু শিউলি যদি সব শোনার পর তাকে ঘেন্না করে, ভীষণ ভয় হয়। আজও যখন সে বাড়ি থেকে বের হলো, শিউলি তখন বছর ছয়েকের ছেলে ফটিককে নিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নিতাইয়ের কুড়ি বছরের জীবন সঙ্গী শিউলি, অনেক টানাপোড়েন, অনেক অভাব - অভিযোগ, অনেক সুখ দুঃখের সাথী। ফটিকের ওপরে আরও দুটি মেয়ে আছে নিতাইয়ের, অনেক গুলো পেটের দ্বায়িত্ব তার। আগে আগে শিউলি ঘরে বসে সেলাই করত, তার অভাবের সংসারে তাপ্পি দিত। তখন অবশ্য নিতাইয়ের উপার্জন ছিল আরও কম। বৃদ্ধা মাও তখন সুস্থ ছিলেন, তাই সংসারের অনেক কাজ করতেন। তারপর মা অসুস্থ হলে, সব দ্বায়িত্ব বর্তায় শিউলির ওপর, তার ওপর তিন টে সন্তান, সেলাইয়ের কাজ শিউলির আর ক্ষমতায় এলোনা।
তাও সে অনেক দিন আগের কথা, নিতাই তখন হরিনাম দলে ঢোল বাজাতে দূরের গ্রামে যেত। খুব ছোট থেকেই সে এই বিদ্যা বাবার থেকে অর্জন করেছিল। বাবা ছিলেন হরিনাম দলে র বাদক, নিতাই আর তার ছোট ভাই বাবার সাথে সাথে যেত। খুব ছোট থেকে ই তারা বাবাকে দেখে এই কৌশল রপ্ত করেছিল। এরপর বাবা হঠাৎই সাপের কামড়ে মারা যান। নিতাইয়ের কাঁধে চাপে সংসার চালানো র দ্বায়িত্ব। সেও বাবার ঢোল নিয়েই বেড়িয়ে পরে। তখন স্বচ্ছলতা ছিলনা ঠিকই, পরিবর্তে সুখ আর শান্তি ছিল ভীষণ। এরও কিছু দিন পর ছোট ভাই বাদল যাত্রা দলের সাথে মিশে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে, তার মা উতলা হয়ে ওঠেন বড়ো ছেলে নিতাইয়ের জন্য। ফলস্বরূপ তাকে গৃহবন্দী করার উদ্দেশ্যে বিয়ে দিয়েছিলেন শিউলির সঙ্গে। শুরু হয়েছিল নিতাইয়ের জীবনের আর একটি নতুন অধ্যায়।
এইসব অতীত ভাবতে ভাবতে নিতাই পৌঁছে গেল তার গন্তব্যে, কোলকাতা র এক প্রত্যন্ত গলি, যেখানে কিছু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের বাস। হ্যাঁ নিতাই আজ পুরুষ হয়েও নারী রূপ ধরে তৃতীয় লিঙ্গের গোষ্ঠী ভূক্ত হয়ে উপার্জন করে।
যখন সে খেতে পেত না, যখন প্রচন্ড রকম অভাবে তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা বন্ধ হতে বসেছিল, যখন শিউলি গর্ভবতী অবস্থায় একবেলা খেয়ে থাকত, তখন কেউ নিতাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ায় নি। আর ঠিক তখনই নিতাইয়ের সাথে আলাপ হয়েছিল, বিশ্ব সংসারে বঞ্চিত, অবহেলিত, এই মানুষ গুলোর। আর এরাই সরল, লাজুক, নিতাইকে নিয়ে এসেছিল তাদের এই জগতে। বুঝিয়ে ছিল অধিকার কেউ হাতে তুলে দেবে না, ছিনিয়ে নিতে হবে, না খেয়ে বোকারা মরে। নিতাই অভাব মেটাতে সঙ্গী হয়েছিল এদের। এরাই হাতে ধরে সব ছলাকলা শিখিয়ে ছিল।
সে গ্রামে সবার কাছে নিতাই বৈষ্ণব বলে পরিচিত ছিল। গ্রামের সবাই জানে সে হরির নাম সংকীর্তন করে শহরে ভিক্ষে করে। শহরে সে পরিচিত ছিল নিতু হিজড়া নামে। আর এ ভাবেই চলে তার সংসার টা।
কিন্তু এই অভিনয় করতে করতে নিতাই ও কি আজ ক্লান্ত? নাকি সে নিজেকে ঐ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ মনে করে? তবে কেন আজকাল তার সবেতেই এতো সংকোচ? সে আজকাল আর শিউলি র দিকেও চোখ তুলে তাকাতে পারে না। আজ অনেক বছর হয়ে গেল ছেলের জন্মের পর থেকেই তাদের আর কোন শারীরিক সম্পর্ক ও নেই। নিতাই কোন এক অজ্ঞাত কারণে শারীরিক টান আর অনুভব করে না। আর সব থেকে আশ্চর্য হলো শিউলি ও এই নিয়ে কখনও কোন অভিযোগ করে না। তবে কি নিতাই এই সুদীর্ঘ বছর অভিনয় করতে করতে ওদের মতোই..........
নাহ্! আর কিছু সে ভাবতে পারছে না। কতো বার তো সে ভেবেছে এই কাজ আর সে করবে না, কিন্তু বাড়ি ফিরে কতকগুলো অভুক্ত পেট দেখলেই সব কেমন তার ওলটপালট হয়ে যায়। তখনই সে পরের দিনের জন্য নিজেকে তৈরী করে। শুধু আত্মগ্লানি তে ভোগে বোধহয় শিউলি কে সে ঠকাচ্ছে।
নিতাই ধীর পায়ে গিয়ে ঢোকে নিজেকে সাজানো র জন্য নির্দিষ্ট ঘরে। সাথে করে ঘর থেকে বয়ে আনা ছোট সুটকেস টা খোলে। আর তারপর ই সে অপার বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ভিতরে শিউলির সেই লাল শাড়ি টা যেটা সে তিন বছর আগে শিউলিকে শখ করে কিনে দিয়েছিল, সাথে একটা চিরকুট। তাতে অপটু হাতে লেখা আছে - " তোমার শাড়ি টা বড্ড নোংরা হয়ে গেছে, তাই আমার সব থেকে দামি শাড়ি টা আজ সবচেয়ে দামি মানুষ টা কে দিলাম। চিন্তা করোনা আমি তোমার পাশে আছি। যখন আমরা খেতে পেতাম না তখন কেউ সাহায্য করেনি। তুমি কিছু অন্যায় করছো না। টাকা জমলে আমায় আর একটা ওই রকম শাড়ি কিনে দিও।
---তোমার শিউলি। "
নিতাইয়ের চোখে জল এসে গেল, তবে কি শিউলি সব জানে? সে তৈরী হয়ে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে এলো। তাদের বস্তিতে আজ যেন কিসের অনুষ্ঠান হচ্ছে। স্টেজের ওপর কোন এক নেতা বক্তৃতা দিচ্ছেন, "তৃতীয় লিঙ্গের ব্যাপারটা আমরা প্রাচীন ভারতের তিনটি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থে ও পাই- হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম। আর এ থেকেই আমরা ধারণা করতে পারি যে বৈদিক সংস্কৃতি তিনটি লিঙ্গকে ই স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও ভারতে আমরা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়া দের বুঝি। "
নিতাই কথা গুলো দাঁড়িয়ে শুনল। তারপর সে নিজেকে প্রশ্ন করল, সে তবে কে? সে কি তবে পুরুষ? নাকি নারী? নাকি অর্ধনারীশ্বর? যার একদিক পুরুষ এবং আর একদিক নারী। না সেতো তাও নয়। সেতো পুরুষ, শরীরে এবং মননে সে সত্যি পুরুষ। অভাবের তাড়নায় সে শুধু অভিনয় করছে। তার তো তিনটি ঔরসজাত সন্তান আছে, যারা তার পৌরষত্বের পরিচয় বহন করছে। তবে তার এতো সংকোচ কিসের?
পথে নামল নিতাই, ওরফে নিতু হিজড়া। আজ সে টাকা পেলে শিউলির জন্য একটা ভালো শাড়ি কিনে নিয়ে যাবে। তারপর সে মনে মনে ভাবলো, আজ সে অনেকদিন পর শিউলি কে আদর করবে, সত্যিকারের পুরুষদের মতো আদর, যা তাদের জীবন থেকে অনেক দিন আগে হারিয়ে গিয়েছে। সেটা কে আবার আজ সে ফিরিয়ে আনবে।