চন্দ্রমুখী
চন্দ্রমুখী
এ চন্দ্রমুখী কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্র নয়, এ চন্দ্রমুখী দেবদাসের চন্দ্রমুখীও নয়। এর কোন কোঠিবাড়ি নেই, এ কোন রকম নাচতে-গাইতে জানেনা, কোন রঙ্গ রস বা ছলাকলা ও জানেনা। তবুও এ চন্দ্রমুখী, বাপ ঠাকুর দার দেওয়া নাম চন্দ্রমুখী। এরও একজন দেবদাস আছে, তবে সে মাদকাসক্ত নয়। এই দেবদাসের বাপ ঠাকুরদার কোন জমিদারি নেই, তবে অবস্থাসম্পন্ন ঘর, বেশ স্বচ্ছল সংসার। এই দেবদাস বিবাহিত, ঘোরতর সংসারী। তবুও মনের কোথায় যেন আজও চন্দ্রমুখী রয়ে গেছে। এর কোন পার্বতী নেই, আছে শুধু চন্দ্রমুখী, যা তার প্রথম ও আদি প্রেম। যে প্রেম পরিনতি পায়নি, তাই বুঝি আজও এর আকর্ষণ দুর্নিবার।
চন্দ্রমুখীর ও সংসার আছে, স্বামী আছে, তবে সে নিঃসন্তান। তার মনেও দেবদাসের উজ্জ্বল উপস্থিতি আজও বর্তমান। প্রতি মুহূর্তে সে দেবদাস কে অনুভব করে। তার অনুভূতিতে দেবদাস আজও তাকে আদর করে, তার শরীর মন ছুঁয়ে যায়। যদিও বাস্তবে দেবদাস কখনোই চন্দ্রমুখী কে ছুঁয়ে ও দেখেনি, তারা শুধুমাত্র পরস্পর পরস্পরের মনটা কে ছুঁয়ে ছিল। এ হলো আর এক দেবদাস ও চন্দ্রমুখীর কাহিনী।
ট্রেন টা যখন ঝাঁঝাঁ স্টেশনে এসে থামল, তখন স্টেশনের পিছনের পাহাড়টার মাথায় সবে সন্ধ্যে নেমেছে। স্টেশন চত্বর টা বেশ ফাঁকা। ট্রেন থেকেও সে ছাড়া আর দু একজন দেহাতি পুরুষ নামল। স্টেশনের পূব দিকটায় একটা মাত্র চায়ের দোকান, সেও ঝাঁপ ফেলার জন্য তৈরি। সবে শীত বিদায় নিয়েছে, এখানে কিন্তু ঠান্ডা টা বেশ ভালো আছে। দেবদাস কাঁধের চাদরটা খুলে গায়ে জড়িয়ে নিল। তারপর ছোট সুটকেস টা হাতে তুলে নিয়ে টাঙ্গার খোঁজে স্টেশন থেকে নেমে এলো। গুটিকয়েক ভাঙা হাট থেকে ফেরা আদিবাসী মহিলা ও পুরুষ ছাড়া আর সেভাবে তেমন মানুষ জন চোখে পড়ল না। গত সপ্তাহে সে চিঠি লিখে চন্দ্রমুখী কে জানিয়ে ছিল যে সে আসছে। তার চাঁদ কে সে দেখতে আসছে। আজ কুড়ি বছর হয়ে গেল চন্দ্রমুখীর বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে আজও যোগাযোগ আছে শুধুমাত্র চিঠিতে। বিয়ের পর পরই চন্দ্রমুখী যে চিঠি দিত, তাতে শুধু থাকত সংসারের গল্প। তারপর কবে যেন একদিন সে গল্প শেষ হয়ে গিয়েছিল, তখন দেবদাসের কাছে পৌঁছাত শুধু প্রকৃতির বর্ননা। দেবদাসের মনে হতো যেন তার চাঁদ নিজের স্বামীর থেকেও বেশি ভালবেসে ছিল বিহারের এই প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামটি কে। তখনই সে অনুরোধ করেছিল একবার আসতে, তার চাঁদ কে দেখে যেতে। তাই গত সপ্তাহে সে চিঠিতে জানিয়ে ছিল আসবে। আর সেই মতো আজ সে এসে পৌঁছেছে তার চাঁদের দেশে।
একটা টাঙ্গা ধরে চিঠিতে জানানো ঠিকানা বলে উঠে বসলে সে। মনে পরে গেল চন্দ্রমুখীর লেখা সেই ছেলেমানুষি চিঠির কথা। চিঠিতে ছিল একরাশ বায়না, কি নিদারুণ মনের আকুতি, "তুমি একবার এসে দেখে যাও দেবদা, তোমার চাঁদ কে কি দেখতে ইচ্ছে করে না? এবার যদি না আসো তো আর চিঠি লিখব না। "
দেবদাস উত্তরে জানিয়ে ছিল, "তুমি কি করে জানবে চাঁদ আমার ইচ্ছের কথা? আমার ইচ্ছে করে দু হাতে তোমার মুখটা নিয়ে আমার চোখের সামনে ধরি। ইচ্ছে করে তোমার চোখে চোখ রেখে সারা রাত বসে থাকি। কিন্তু তাতে ও কি আমার ইচ্ছে গুলো শেষ হবে চাঁদ? তুমি জানো না আমি কেন যাই না। আসলে আমি চাই না তোমার সুখের সংসারে কলঙ্ক লাগুক। তাই তোমার চিঠি গুলো নিয়েই আমি সন্তুষ্ট থাকি। ও গুলো বুকে চেপে ধরে রেখে তোমার স্পর্শ নি। " আরও অনেক কিছু লিখে ছিল। কোন দিন যে কথা গুলো মুখে বলতে পারেনি, সে গুলো লিখে ছিল। আর আজও সে চন্দ্রমুখীর আবদার রাখতেই চন্দ্রমুখীর কাছে এসেছে।
তার বলে দেওয়া ঠিকানা মতো টাঙ্গা যখন চন্দ্রমুখীর কোয়ার্টারে এসে পৌঁছাল, তখন সন্ধ্যে উতরে গেছে। আর একদিন পরেই পূর্নিমা, চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। ঘরে ফেরা পাখির দল যে যার আস্তানায় পৌঁছে গেছে। মানুষ জন ও সেভাবে রাস্তায় চোখে পরে নি। টাঙ্গা থেকে নেমে সে দেখল কোয়ার্টারে কোথাও কোন আলো জ্বলছে না। দেবুর একটু চিন্তা হলো, তবে কি চন্দ্রমুখী তার চিঠি পায়নি?ওরাকি কেউ বাড়ি নেই? এ সব ভাবতে ভাবতে দেবদাস কোয়ার্টারে র কাছে এগিয়ে গেল। সামনে টা অনেকখানি জায়গা জুড়ে গাছ লাগানো, বাউন্ডারি টা নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, ঢোকার মুখে একটা কাঠের গেট লাগানো। দেবু এগিয়ে গিয়ে কাঠের গেটটার গায়ে লাগানো লোহার আঙটা টা খুলল, জোরে একটা আওয়াজ হলো। সেই আওয়াজেই বোধহয় কোয়ার্টারের দাওয়ায় বসে থাকা কুকুর টা মুখ তুলে একবার দেখল। কিন্তু তার আলসেমি এতো বেশি যে সে দেখে নিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। এবার যেন ভিতর থেকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ক্রমে আলোর রেখা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো। তারপর এক বয়স্ক দেহাতি মহিলা কে দেখা গেল। কাছে এসে সে বলল, " কৌন হ্যায়? " তারপর আলোটা মুখের সামনে তুলে ধরে বললে, "দেব বাবু? "
দেবদাস বলল, "মেমসাব ঘরমে হ্যায় কি নেহি? "
-"হাঁ জি! আপ অন্দর আইয়ে। "
সে আলো অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। একটু অবাক ও হলো, চন্দ্রমুখীর এ হেন ব্যবহারে, সে এলো অথচ চন্দ্রমুখী বাইরে এলোনা। মহিলাটি তাকে নিয়ে গিয়ে বাইরের ঘরের সোফায় বসালো। ক্ষীণ আলোয় সে যেটুকু দেখতে পেল ঘরটার যেন জরাজীর্ণ অবস্থা। আসবাব বলতে ঐ কতকগুলি পুরাতন সোফা, একটা ছোট রং চটা টেবিল আর খানকতক পুরানো পর্দা ও একটা ভাঙা টবে একটা অর্কিড, যা দিয়ে ঘরের দীনতা ঢাকার ব্যার্থ চেষ্টা করা হয়েছে। দেবদাস তার ভালবাসার মানুষটিকে এভাবে থাকতে দেখে যতটা না অবাক হলো, তার থেকে ও বেশি অবাক হলো এই ভেবে যে সে নিজে কখনও জানতে চায়নি যে চন্দ্রমুখী কেমন আছে। একটু পর চন্দ্রমুখী ধীর পায়ে ঘরে এসে ঢুকল। লন্ঠনের মৃদু আলোয় চন্দ্রমুখী কে দেখে দেবদাস বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এ কোন চন্দ্রমুখী কে দেখছে সে? সেই চাঁদের মতো মুখটা শুকিয়ে গেছে। টলটলে পদ্ম বিলের মতো চোখ গুলিতে ক্লান্তির ছাপ। চোখের কোনে ঘন মেঘের মতো কালিমা। আর তার সেই পরিপাটি পটরানীর অঙ্গে আজ অতি সস্তা দামের শাড়ি। দেবদাস বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল চন্দ্রমুখীর দিকে, অনেএএএএএকক্ষণ। কি যে দেখল হয়তোবা সে নিজেও জানেনা। তারপর সে উঠে এল চন্দ্রমুখীর সামনে, দু হাতে তার হাত দুটো মুঠোর মধ্যে নিয়ে গভীর আবেগে বলল, " চাঁদ, কি হয়েছে তোমার? "
আহা! কত্ত্বদিন পর শুনল চাঁদ ডাকটা। তারপর মলিন হেসে বলল, " সব শুনবে দেবদা, সব বলবো। বলার জন্য ই তো ডেকেছি। তবে এতো দূর থেকে এসেছ, আগে একটু মুখে কিছু দাও, বিশ্রাম কর, তারপর না হয় শুনবে।"
এই বলে সে দেবদাস কে নিয়ে কোয়ার্টারের পিছন দিকটায় কূয়োতলায় গেল। আজ চতুর্দশী, চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। আর সেই আলোয় কূয়োতলাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চন্দ্রমুখী একটা গামছা এনে কূয়োতলায় রেখে দিল, তারপর তার সারাদিনের সঙ্গী যার কথা চিঠিতে লেখে সেই দেহাতি মহিলা, রামাইয়ার উদ্দেশ্যে গরম জল দিয়ে যেতে বলল। তারপর দেবদাস কে বলল, " এখানে নামেই বসন্ত, ঠান্ডা এখনও সেভাবে যায় নি। একটু গরম জলে স্নান করো, নয়তো শরীর খারাপ হলে তোমার ছেলেমানুষ বৌ আমায় দোষ দেবে। " এই বলে সে ঘরে চলে গেল।
দেবদাস একটা বুনো ফুলের গন্ধ পেল। কি ফুল তার জানা নেই। অথচ গন্ধটা র মধ্যে সে এক অদ্ভুত মাদকতা খুঁ
জে পেল। একবার ভাবল নাম টা জিজ্ঞেস করে, পরক্ষণেই ভাবল থাকনা, সব কিছু নাইবা জানল। কিছু অজানা থাকলে ক্ষতি কি? না হয় মনের মতো কিছু একটা নাম সে দিয়ে দেবে।
চন্দ্রমুখী ঘর থেকে একটা সাবান এনে কূয়োতলায় রেখে বলল, " কেউ এদিকে আসবে না, নাও স্নান করে নাও। আমি ততক্ষণ তোমার খাবার তৈরি করি। " দেবদাস মুচকি হেসে বলল, " আমার কাউকে আর লাগবে না, তুমি সঙ্গে থাকলেই হলো। "
চন্দ্রমুখী উত্তর দিলনা। পিছন ফিরে চলে গেল বাড়ির ভিতর। চন্দ্রমুখীর হাঁটার ধরন টাও দেবদাসের বড় পরিচিত। তার প্রতি টি পদক্ষেপ আজও দেবদাস চোখ বুজলেই দেখতে পায়। ছোটবেলায় যখন শ্রীরামপুরের গঙ্গার ধারে দুজনে ঘুরে বেড়াতে, তখন কতো সময় দুজনে গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকত। দেবদাস শুধুমাত্র চোখের দৃষ্টি দিয়ে চন্দ্রমুখীর শাড়ির তলা থেকে উঁকি দেওয়া গোড়ালি তে আদর করত। এমনি ভাবেই কতবার সে চোখের দৃষ্টি আর অনুভূতি দিয়ে চন্দ্রমুখী কে আদর করেছিল। কারণ শরীর ছোঁয়ার মতো সাহস ও মানসিকতা তখন তার ছিল না। এসব ভাবতে ভাবতে কোন অতিতে সে পৌঁছে যায়।
শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে ছিল দেবদাসদের বড়ো দোতলা বাড়ি, আর তার অনতিদূরে ছোট মাটির ঘরে চন্দ্রমুখীরা থাকত। ছোট থেকেই চন্দ্রমুখী তাদের মাটির ঘর আলো করে থাকত। অপরূপ সুন্দরী ছিল সে। তারা দুজনে একসাথে বড়ো হয়েছিল, একসাথে লেখাপড়া ও শিখেছিল। কবে যে দুজন দুজনকে ভালবেসে ফেলেছিল জানা নেই। দুজনের মধ্যে ছিল এক পবিত্র প্রেম। কত সময় তারা একসাথে কাটিয়ে ছিল। দুজনে দেবদাসদের ছাদে এমন পূর্ণিমা র রাতে বসে কত গল্প করত, কত গান গাইত।
সে রাত গুলো ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান রাত। রূপসী রাতের শরীরে তখন তাদের মতোই যৌবন ছিল। রূপালী চাঁদের গায়ে রোমান্টিক গন্ধ ছিল। মাটির গা থেকে সোঁদা গন্ধ আসত। সেই মাতাল করা গন্ধে ওরা দুজনে দুজনের চোখে চোখ রেখে হারিয়ে যেত। এখনও এমন কোন রাতে দেবদাস একা একা ছাদে ওঠে, আবার কখনও বা স্ত্রী উর্মিকে নিয়ে ও ওঠে, কিন্তু কোন গন্ধ তো ও আর পায়না। মনে মনে ভাবে হয়তোবা চন্দ্রমুখী নিজের সাথে ঐ সুবাস গুলো নিয়ে চলে গেছে।
কূয়োতলার পিছন দিকের ঝোপ থেকে কি একটা সরে যাওয়ার শব্দ হলো। শহুরে মানুষ দেবদাস ভয়ে চমকে উঠল, তার চিন্তায় ছেদ পড়ল, হাত থেকে ধাতব মগটা সিমেন্টের রকে পরে জোর শব্দ হলো। চন্দ্রমুখী বোধহয় কাছেই ছিল, আওয়াজ শুনে কূয়োতলায় নেমে এল। দেবদাস আঙুল তুলে ঝোপটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, "ওখানে একটা কি চলে গেল। " চন্দ্রমুখী হেসে বলল, "মেরুদণ্ড হীন সরিসৃপ। " এমন ভাবে কথা গুলো বলল যেন মনে হলো কোন মজার বস্তু। এবার সত্যি দেবদাস ভয় পেল, সে তাড়াতাড়ি স্নান করে ঘরে উঠে এলো। ভিতর ঘর থেকে সোনামুগ ডাল ভাজার গন্ধ পেল, খিদে টা যেন একটু বেশিই অনুভব হলো।
চন্দ্রমুখী বলল, "ততক্ষণ একটু চা আর নিমকি খাও, রান্না শেষ হতে আর মিনিট কুড়ি দেরি। " তার পিছন পিছন রামাইয়া একটা ট্রে করে কালো জিরা দিয়ে ভাজা কুচো নিমকি ও গরম ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে ঘরে ঢুকল।
প্রায় আধা ঘন্টা পর চন্দ্রমুখী খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল। দেবদাস কপট রাগ দেখিয়ে বলল, " আমি কি খাবার জন্য এসেছি চাঁদ? এই তো রাতটুকু সময়, আমি চলে গেলে না হয় তুমি রান্না কর। এখন আমার সামনে একটু শান্ত হয়ে বসলে তো পারো। তোমায় একটু মন ভরে দেখতাম। "
চন্দ্রমুখী বলল, " তখন যে আর রান্না করে খাওয়াবার মতো কেউ থাকবে না। "
দেবদাস অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, " কেন তোমার স্বামী? কোথায় তিনি? "
"আগে খেয়ে নাও তারপর সব শুনবে। " এই বলে চন্দ্রমুখী পিতলের বাসনে পরিপাটি করে সাজিয়ে খেতে দিল।
দেবদাস অবাক হয়ে দেখল এতো কাজ তার চাঁদ শিখল কবে? খেয়ে উঠতে বেশ রাত হয়ে গেল। তারা দুজনে বাইরের বারান্দায় এসে বসল। এমন তো কত রাতের সাক্ষী ছিল তারা, কিন্তু আজকের রাত টা তাদের কাছে নির্মম মনে হলো। এই রাতে চন্দ্রমুখী কে বুকে নিয়ে আদরে আবেগে ভরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। সেখানে আজ সে অন্য কারোর সম্পত্তি। দেবদাস বলল, "এবার বলো তোমার কথা। "
"সে কথা বলার জন্যই তোমায় ডেকেছি, আর সে সব শোনার পর তুমি হয়তো আর কখনও এখানে আসবে না। হয়তোবা আমার খোঁজ ও নেবে না। " মাথা নিচু করে কথা কটা বলল চন্দ্রমুখী।
দেবদাস কৌতূহল বশতঃ তাকিয়ে দেখল তার দিকে। এবার চন্দ্রমুখী জল ভরা চোখে তাকিয়ে বলল, " আমি বিক্রি হয়ে গেছি দেবদা, তোমার চাঁদ এখন বাজারের মেয়ে। আমার বাবা যাকে উপযুক্ত মনে করে তোমায় বঞ্চিত করে ছিল, সে আমার উপযুক্ত ছিল না, আমি ছিলাম তার উপযুক্ত। আমায় নিয়ে সে ব্যবসা করে ছিল। আমি ছিলাম তার ব্যবসার লক্ষী। নিজের শরীরের বিনিময়ে তাকে মুঠো মুঠো টাকা এনে দিয়েছিলাম। আর যখন তার লক্ষী উপচে উঠল, তখন সে অনত্র সংসার পেতে চলে গেল। আর আমি পরিনত হলাম বেশ্যায়। " কান্নায় ভেঙে পড়ল চন্দ্রমুখী।
দেবদাস স্তব্ধ হয়ে বসে গেল। অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। শুধু কতগুলো রাতচরা পাখির দল উড়ে গেল দূর দিয়ে। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে শিশির পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গেটের কাছের শিউলি গাছটা থেকে একটা পেঁচা ডেকে উঠল, হিমেল হাওয়ার ঝাপটা লাগল তাদের গায়ে।
চন্দ্রমুখী বলল, " এবার ওঠো দেবদা, এখানে বেশ ঠান্ডা, সর্দি হয়ে যাবে। ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম কর। রাত শেষ হতে এখনও অনেক দেরী। ভোরবেলা একটা টাঙ্গা আসবে। তুমি স্টেশনে চলে যাবে। প্রথম ট্রেনে কলকাতা ফিরে যেও। টিকিট কেটে রেখেছি, কারণ দিনের আলোয় তোমায় কেউ দেখুক এটা চাইনা। আজকের পর আর তুমি এসো না। মনে করো তোমার চাঁদ মরে গেছে। "
দেবদাস উঠে এলো তার কাছে, তারপর চন্দ্রমুখী কে অবাক করে দিয়ে নিজের বুকে টেনে নিল। যে কোনদিন চন্দ্রমুখী কে স্পর্শ করেনি, আজ সে পরম স্নেহে, গভীর আবেগে চন্দ্রমুখী কে জরিয়ে নিল নিজের বুকে। চন্দ্রমুখীর কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারপর বলল, " তুমি নষ্ট মেয়ে নয় চাঁদ, তোমার কাছে যে বা যারা আসে তারা নষ্ট চরিত্রের। চন্দ্রমুখীরা কোনদিন চন্দ্রমুখী হয়ে জন্মায় না। তাদের চন্দ্রমুখী করে তোলে সমাজের নোংরা মানুষ গুলো। আর তোমরা কলঙ্কিত হও তাদের দ্বারা। আমি আবার আসব চন্দ্রমুখী, বারবার আসব, আরও অনেক অনেক বার আসব। তোমার শরীর নয় মন ছুঁতে আসব। আমার ভালবাসাকে দেখতে আসব, তবে এভাবে রাতের অন্ধকারে আর নয়, দিনের উজ্জ্বল আলোয় আমার চাঁদ কে দেখব। সমাজকে ভয় পেয়ে তোমায় একদিন হারিয়ে ছিলাম, আর সেই ভয়ে নিজেকে ঠকাব না। আমার ভালবাসাকে চোখ দিয়ে ছুঁতে আসব। "
কথায় কথায় রাত শেষ হয়ে এলো। এটা বসন্ত কাল, কিন্তু এদিকে এখনও ঠান্ডা টা বেশ আছে। ভোর বেলা টাঙ্গা এসে দাঁড়ালে দেবদাস বেড়িয়ে এলো। চন্দ্রমুখী তার কোয়ার্টারের বাউন্ডারির ভিতর একটা অমলতাস গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। এই সময় সারা গাছ হলুদ ফুলে ভর্তি হয়ে যায়। গাছের নিচে ও অনেক ঝরা ফুল বিছিয়ে থাকে। চন্দ্রমুখী একটা পানাফুল রঙের শাড়ি পরে ঐ গাছ তলায় হলুদের মাঝে এসে দাঁড়ায়। দেবদাস গেটের বাইরে থেকে মুগ্ধ দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইল। তারপর সে নিজেকে নিজে কথা দিল, চন্দ্রমুখী আমি আবার আসব, শুধু তোমাকে এভাবে দেখার জন্য আরও অনেক বার আসব।