আমার দূর্গা
আমার দূর্গা
"ওমা মা এবারে পুজোয় একটাও নতুন জামা হবে না?"-ছোটো পাঁচ বছরের অপু তার মায়ের কোলের কাছে গিয়ে আবদার জুড়ে দিলে। অসহায় রত্না ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললেন, "হবে সোনা, বাবা নতুন কাজের সন্ধান করছে। কাজ পেলেই হবে। " ছেলে হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে বায়না ভুলল, কিন্তু রত্না জানে আবার শুরু হবে তার বায়না। আজ সাত মাস হয়ে গেল তার স্বামী বেকার। লোকাল ট্রেনে হকারি করতেন। দেশে মহামারী দেখা দিলে ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে টুকটাক করে চলছে। পেট চালানো যেখানে বড়ো সমস্যা সেখানে নতুন জামা তো স্বপ্ন।
নয় বছরের উমা তফাতে বসে কচুর লতি কাটছিল। উমা এই বয়েসেই অনেক বুদ্ধি ধরে। সে জানে তাদের সংসারের পরিস্থিতি। উমা তার ভাইকে বলে "দাঁড়া ভাই হাতের কাজটা শেষ করি তারপর তোকে নিয়ে লাইন ধারে যাব। কাশফুল তুলতে। আমরা দুজনে মিলে একটা দুগ্গা ঠাকুর বানালে কেমন হয়? মা পূজো করবে ঘরে। এবছর তো আবার পুলিশ থেকে ঘোষণা করে গেছে ঠাকুর দেখতে যাওয়া যাবে না। তাই আমরা ঘরে আনন্দ করব।"
কিছুক্ষণ পর দু ভাইবোনে লাইন ধারে কাশফুল তুলতে গেল। সেই সময় ওদের বাবা ঘরে এল। রত্নাকে বলল, "একটা ভালো খবর আছে। বামুন পাড়ার গাঙ্গুলী মাসিমা উমার জন্য একটা কাজ দেখেছেন, শহরে। ওনার বোনের বাড়িতে দিনরাত থাকা আর টুকটাক কাজ করে দেওয়া। ওরা খুব ভালো লোক অনেক গুলো টাকা মাইনে দেবে।
তাছাড়া সংসারের একটা পেট কমবে। শুধু কাউকে বলতে মানা করেছে। ছোটো বাচ্চাদের কাজ করানো নাকি অপরাধ। "
শুনে রত্না একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দুপুরের দিকে দু ভাইবোনে ফিরে আসে হাতে কিছুটা এঁটেল মাটি আর কাশফুল নিয়ে। অপু বলল,"মা দেখে যাও আমরা ঠাকুর গড়ার মাটি এনেছি, দিদি কাল তৈরি করে দেবে, তুমি একটুকরো নতুন কাপড় দিও।"
রত্না বলল, "ঠাকুর বানানো সোজা নয়, ও দিদি পারবে না। "
-"হ্যাঁ মা পারবে, দিদি তো মাটির পুতুল বানাতে পারে। "
-"উফফ! অপু তক্কো করিস না। তাছাড়া দিদি কাল শহরে যাবে, দিদি শহরে গেলে অনেক টাকা আসবে, আর ও ওখানে খেতে পাবে। আমরাও সবাই ভালো থাকব।"
অপু কি বুঝলো, গম্ভীর হয়ে বাইরে উঠোনে চলে গেল।
আজ ষষ্ঠী, উমা আজ দশদিন হয়ে গেল বাড়ি নেই। নাহ্ অপুর ঠাকুর তৈরি হয়নি। এখন আর কেউ তাকে নিয়ে লাইন ধারে কাশফুল তুলতে যায়না। সকাল থেকেই বাড়ির পরিবেশ থমথমে। ষষ্ঠীর ঢাকের আওয়াজ ওদের কানে প্রবেশ করলেও মনে প্রবেশ করেনি। আজও অপুরা একলা হয়ে যায়। তাদের দূর্গা দিদিরা আজও হারিয়ে যায়। আজও ওরা মনে মনে বলে "তুই কবে আসবি দিদি। " হয়তো বলে আবার কবে ট্রেন দেখব? হয়তো বলে আমার ঠাকুরটা তৈরি করবি তো? না পথের পাঁচালী শেষ হয়না। অপু দূর্গারা আজও সমাজে রয়ে যায়।