লকডাউন
লকডাউন
সকাল সাতটার লোকাল টা ঝমঝম করে শব্দ তুলে চলে গেল। এবার তার আসার সময় হয়ে গেল। জবা এঁটো গ্লাস কটা ধুয়ে রেখেই বাইরে ছুটলো। আজ দুবছর ধরে এই এক দৃশ্য দেখে আসছি।
আমি শশধর গোস্বামী, স্টেশনের পাশে চায়ের গুমটি টা আজ বাইশ বছর চালাচ্ছি। অল্প বয়সে অসৎ সঙ্গে পরে বোমা লেগে আমার বাম হাতটা অকেজো হয়ে গিয়েছিল। তখন থেকেই বাপের জমানো টাকা খরচ করে এই দোকান টা করি। একটা বিয়েও করেছি, আমার বউ সন্ধ্যা বড়ো ভালো মেয়ে। একমাত্র পুত্র জয়দীপ, বৃদ্ধা মা আর সন্ধ্যা কে নিয়ে আমার সংসার।
আমার বাম হাতটা অকেজো বলেই সন্ধ্যা তার বাপের বাড়ি থেকে ঐ আদিবাসী মেয়ে জবাকে আমার কাছে এনে দিয়েছিল। শুনেছিলাম ওর সাতকূলে কেউ নেই, অনাথ। দেখতে সুন্দরী নয় তাই হয়তো বিয়েও হয়নি। তবে খুব কাজের মেয়ে এই জবা। দোকানের খদ্দেরদের হাতে হাতে চা, খবরের কাগজ দেওয়া, আবার এঁটো গ্লাস ধুয়ে রাখা, ভোরবেলা উঠে উনুন ধরানো, কয়লা ভাঙা, বেঞ্চ গুলো পরিষ্কার করা এমনকি দিন শেষে চায়ের বাসন গুলোও মেজে রাখত সে। আমি শুধু তাকে চার বেলা খেতে দিতাম, সন্ধ্যার পুরোনো শাড়ি কাপড় গুলোই সে ব্যাবহার করত। কোনদিন একটা টাকাও সে চায়নি, তাই হয়তো আমারও দেওয়ার আগ্রহ ছিল না। তবে কখনো সখনো দোকানের দু এক জন রোজকার খদ্দের হয়তো জবার কাজে খুশি হয়ে তাকে দুএক টাকা করে দিত। তখন জবার নিষ্পাপ মুখে শিশুসুলভ হাসি দেখা দিতে।
মূলত নিত্য অফিস যাত্রীদের ভীড় থাকত দোকানে, তবে ট্রেনের হকার ও রেল পুলিশরাও আসতেন চা খেতে। এছাড়া এই ছোট্ট স্টেশনে আর তেমন কাউকেই দেখা যেতনা। জবার বয়েস ছিল চল্লিশের কাছাকাছি তবে শরীরের বাঁধন ছিল খুব সুন্দর। যাইহোক সে সারাদিন দোকানেই থাকত আর রাতে ও দোকানেই ঘুমত। এমনি করেই দিন কাটছিল।
এমনই এক বসন্তের বিকালে সেই লোকটা (যার নামটা জানা হয়নি) এসেছিল দোকানে চা খেতে কথায় কথায় বলেছিল সে লোকাল ট্রেনে হকারি করে, মশলা মুড়ি বিক্রি করে । বাড়ি তার অনেক দূর, বাড়িতে বৌ বাচ্চা সব আছে। এতদূর সে কখনো আসে না। আজ এসেছে আর সব তার বিক্রি ও হয়ে গেছে। জবা তার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আগে এক গ্লাস খাবার জল দেয়, তারপর আমার তৈরি চা। সে খুশি হয়ে জবাকে তার ঝোলা থেকে একটা বিক্রি না হওয়া মশলা মুড়ির প্যাকেট বের করে দেয়। সেদিন এভাবেই শুরু হয়েছিল তাদের সখ্যতা। যেটা কবে যেন আমার অগোচরে বট গাছের শিকরের মতো অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল। আমি টের পেলাম যখন প্রতি দিন সকাল সাতটার লোকাল টা চলে যাবার পর জবাকে দোকানে পাওয়া যেত না। ঠিক কোন না কোন অজুহাতে জবা দোকান থেকে বেরিয়ে যেত। কোনদিন খাবার জল, তো কোনদিন খবরের কাগজ, আবার কোনদিন দোকানের ধূপ কি বাতি নেই এইসব বলত। যখন টের পেলাম তখন জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। আমি ভয় পেয়ে ছিলাম, জবা সহজ সরল মেয়ে। একদিন তাকে ডাকলাম, বললাম তোমার তো সংসার আছে কেন জবার জীবন নষ্ট করছ? উত্তরে জবা মাথা নিচু করে বলল, আমার জীবনে ভালোটাই বা কি আছে, যে নষ্ট হবে? আমি অবাক হয়ে গেলাম যে জবা কখনো আমার মুখের ওপর কিছু বলেনি, আমি চুপ করে রইলাম। লোকটি বলল, আমি জবাকে ঠকাতে চাই না। আমি জবার কাছে আসি কারণ শান্তি পাই, এ এক অদ্ভুত শান্তি। আমি বলেছিলাম তোমার তো সংসার রয়েছে।
- আমি তো সেখানে ফাঁকি দিই না। সেখানে সব দ্বায়িত্ব, কর্তব্য, স্নেহ, ভালবাসা দিয়ে তারপর আসি। আর আমি জবার থেকে একটু শান্তি পাই যা সংসারে পাই না। কথা গুলো বলে লোকটা চলে গেল।
আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম এই রকম একটা সম্পর্ক দেখে। মনে মনে ভাবলাম এই সম্পর্কের পরিনতি কি? এ কি শুধুই মনের শান্তি? তারপর থেকে আর কোনও দিন জবাকে বাঁধা দিতে পারিনি, আমার মন চায়নি।
একদিন সন্ধ্যের পর দোকান বন্ধ করার সময়, জবা এসে সামনে দাঁড়াল, বললাম কিরে কিছু বলবি? জবা বেশ সংকোচের সঙ্গে বলল, দাবাবু, আপনার দোকানের পিছনের ঐ কয়লার ঘরটা ভাড়া দেবেন?
- কে নেবে ঐ ভাঙা ঘর? আমি অবাক হয়ে গেলাম।
-তিনি নেবেন বলেছেন। আমরা বিয়ে করব।
এবার আমি একটু রাগ করে বললাম, দেখ জবা ও বিবাহিত, সংসার আছে, তুই সেটা কেন ভাঙবি?
- না না তেনার সংসার সংসারের জাইগাই থাকবে। এটা হবে আমাদের লুকোনো সংসার। উনি যখন ক্লান্ত হয়ে যাবেন তখন এখানে আমার কাছে আসবেন। আমার কাছে এটা হবে সগ্গো। তুমি আর না করুনি দাবাবু। আমি তেনাকে হাঁ কই দেছি।
সেই থেকে এই রকম চলছে, সকাল বেলা আসে দোকানে চা খায় আর জবার সাথে দেখা করে চলে যায়। আর দুপুরে ফেরার সময় আসে জবার কাছে, জবা স্নান কর
ে পরিপাটি করে ভাত রান্না করে দুজনে খায়, কোনদিন শুধুমাত্র কলমি শাক ভাজা আর ভাত, আবার কোনদিন আলুভাতে ভাত। তারা কিছুক্ষণ তাদের সংসারে সময় কাটায়, আবার আমি যখন বিকালে দোকান খুলতে আসি তখন সে তার সত্যিকারের সংসারে ফিরে যায়।
আমি বিকালের দিকে জবাকে দেখি কি উৎসাহ নিয়ে তাদের পুতুলের সংসারটা সাজায়। কোনদিন কোথাও থেকে একটু পলিথিন এনে চালে আটকায়। কোনোদিন বা একটু তক্তা ভাঙা এনে পিছনের দরমাতে তাপ্পি দেয়।
এভাবে বেশ কেটে যাচ্ছিল,এরইমধ্যে কোথা থেকে যেন কি একটা মরন রোগ এসে হাজির হলে লোক মরতে শুরু করে। ছোটবেলায় ঠাকুমার মুখে শুনেছিলাম মহামারীর কথা। সরকার থেকে ঘোষণা করে সব বন্ধ করে দিলেন। ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল, আমার দোকানটাও বন্ধ হয়ে গেল। বাড়িতে সবাই বন্দী, লকডাউন।
এমনি ভাবে দিন যায়, মাস ও যায়, কেউ কারোর বাড়ি যায় না, কেউ কারোর খবর ও নেয়না। শুধু জবা একদিন দুদিন ছাড়া আসত, আর একটাই কথা বলত, দাবাবু আবার কবে সব খুলবে?
-বলতাম জানিনা রে। সন্ধ্যা কে বলতাম ওকে খেতে দাও।
শেষ দিকে জবা যখন আসত ওকে কেমন উদভ্রান্ত লাগত, কি কাতর স্বরে ও বলত, আবার কবে সব খুলবে দাবাবু?
শেষ দিকে আমাদেরই আর খাবার মিলতো না, তবুও সন্ধ্যা ওকে একটু ফেন ভাত নুন দিয়ে খেতে দিত। এর মধ্যে ঐ মরন রোগ সন্ধ্যা কে ধরেছিল হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় সে মারা গেল। আমিও কেমন বেসামাল হয়ে পরেছিলাম, জবার খোঁজ ও আর নেওয়া হয়নি। মার মুখে শুনেছিলাম জবা আসত কিন্তু কিছু বলতনা , চুপচাপ বসে থেকে চলে যেত। এরপর শেষ যেদিন ও কথা বলে ছিল সেদিন ওকে দেখেছিলাম, মনে হচ্ছিল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ফ্যাল ফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, একবার শুধু অস্পষ্টভাবে বলেছিল তিনি কি আর কোনো দিন আসবেন না?
এরপর একদিন রেল পুলিশ এসে খবর দিয়েছিল আমার দোকানের পিছনে একটা মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আমি আর বাড়ি ছেড়ে যাইনি, জবাকে আর দেখা হয়নি।
এরপর অনেক গুলো দিন কেটে গেছে।এই বসন্তে আবার সব স্বাভাবিক হতে চলেছে। ছেলে একটা প্রাইভেট চাকরি পেয়েছে। আমি আর দোকানে যাই না। ওটা ছিল রেলের জায়গা তাই আমার কিছু জিনিস ঐ দোকান থেকে নিয়ে আসার জন্য পুলিশ খবর দিয়ে গেলে আমি গেলাম। দোকানের সামনে গিয়ে খুব অবাক হয়ে দেখলাম ঐ হকার লোকটা বসে আছে। মনে মনে খুব রাগ হতে লাগল। কাছে গিয়ে বেশ ধমকের সাথে বললাম কি চাই এখানে?
-জবাকে। নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিলে সে।
তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমি একসপ্তাহ আগে এসেছি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তখন তো লকডাউন ওঠেনি? লকডাউন তো আজ তিন দিন হল উঠেছে, তুমি এলে কি করে?
লোকটা বলল আমি হেঁটেছি, পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে হেঁটেছি।
আমি বললাম জবা আর নেই, জবাও অনেক দিন তোমার অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে।
লোকটা মাথা নিচু করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর আমায় বলল একবার আমি ঢুকতে পারি, আমাদের ওই না হওয়া সংসারটা তে?
দোকান টা খুলে দিলাম বললাম যাও। ভাঙা ঘরটা আরও ভেঙে গেছে দেখলাম। লোকটা ঘরে ঢুকে একটা পুরানো টিনের ডিপে বের করে সেটা খুলল, দেখলাম তার ভিতর কটা কঁচের চুড়ি, একটা রঙিন ফিতে, দুটো চুলের কাঁটা আছে, লোকটা ডিপের ভিতর একটা মশলা মুড়ির প্যাকেট রেখে দিলে, বলল পাগলী টা খেতে খুব ভালবাসত, ওর জন্যই শত অভাবেও এটা বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। আমার কিনে দেওয়া একটা জিনিস ও ব্যবহার করত না। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আর হয়তো কখনও আসব না, বা হয়তো আসব এই ঘরটার মায়ায়।
লোকটা চলে যাবার পর অনেকক্ষণ আমি ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম, দুটো ঘুঘু পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে সম্বিত ফিরে পেলাম। দেখলাম পাখি দুটো ওই ভাঙা ঘরটাতে সংসার করছে। কারোর না হয়ে ওঠা সংসারে ওরা পরম নিশ্চিন্তে সংসার করছে।
দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম, পুলিশ কে বললাম ওখানে আমার কিছু নেই। পুলিশটা পাশের একটা কুলি মজুর টাইপ লোককে বললেন, আজই ওগুলো সব ভেঙে পরিস্কার করে ফেল। আমি বাড়ির দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন দূর থেকে শুধু ঐ লোকটাকে দেখতে পেলাম সেই হাসনুহানার ঝোপের পাশের বেঞ্চ টা তে বসে আছে, তফাৎ শুধু আজ সে একা।