Apurba Kr Chakrabarty

Horror Tragedy

4.0  

Apurba Kr Chakrabarty

Horror Tragedy

তন্ত্র শক্তি ( তৃতীয় পর্ব )

তন্ত্র শক্তি ( তৃতীয় পর্ব )

17 mins
178



                      

                         ( অভিশাপ)

নবীনের এবার নজরে এল।দক্ষিণমুখী বড় কক্ষটি চাবি তালা লাগানো। ভোড় রাতে ঘর তো খোলা ছিল, আর এক ভদ্রলোক বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিলেন! ভাবল হয়ত সকালে কোথাও বের হয়েছেন ।আজ তো তার ঘুম থেকে উঠতেই বেশ দেরী হল।কী আর করবে, নিচে নেমে এসে পড়ে থাকা লুঙ্গি গেঞ্জি আবার কেচে পরিস্কার করেনিল, এবার আর বাহিরের বারান্দার রেলিং এ নয়,  ঘরের পশ্চিম জানালার কপাট খুলে ,লোহার গরাদের মিলে দিল, ক্ল্যাম্প দিয়ে এঁটে দিল যাতে আর নিচে না পড়ে যায়।

হালকা টিফিন করল, চা আর কে দেবে ! পরে বাইরের দোকানে খেয়ে নেবে। মুড়ি কলা আর সন্দেশ অল্প জল ঢেলে মেখে চটকে খেয়ে নিল। প্রায় দশটা আর সে দেরি করবে না।অফিস যেতে পনের মিনিট তো হাঁটতে হবে। অফিসের গাড়ী সে সরকারী কাজ ছাড়া নিজের জন্য কোন  দিনও ব্যবহার করে না, অফিস হেড কে বলেও না। 

আজ নবীন অফিসে বেশ মুডে ছিল,জুনিয়র রবিন কে ধন্যবাদ জানাল এই ঘরের জন্য পলাশের সাথে যোগাযোগ সেই করিয়ে দিয়েছিল।বৃহস্পতিবার থাকায়  দোতলার দুটি ঘরে আজ পলাশদের কর্মচারীরা ছিল না, আজ তাদের ছুটি ,তবে এক তলায় দুজন নাইট গার্ড ও এক কেয়ার টেকার ছিল। দোতলার ঘর দুটো পলাশদের চার কর্মী না থাকায় নবীন একা, তাই দোতলাটা আজ বেশ নির্জন । রাত প্রায় দশটা হোটেল থেকে খেয়ে সবে নবীন তার ঘরে ঢুকেছে। দরজার খিল দেয়নি, একবার বাথরুম রুম যাব ভাবছিল। হঠাৎই দরজা ঠক ঠক  আওয়াজ। এত রাতে আবার কে এল !কেয়ার টেকার হয়ত। 

এবার দরজা খুলতেই নবীন দেখল সেই ভদ্রলোক, যাকে ভোড়ের সময় বাথরুম থেকে ফেরার পথে বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সে  ধূমপান করতে দেখেছিল। আলাপ করব ভেবেছিল ,তবে সকালে তার ঘুম থেকে ওঠার অনেক আগে ঘরে চাবিতালা লাগিয়ে ভদ্রলোক চলে গেছিলেন।

নবীন দেখল ভদ্রলোক বয়স্ক কিন্তু সুদর্শন স্মার্ট  এক সম্ভ্রান্ত আভিজাত্যের অহংকার মুখে চোখে ফুটে পড়ছে। গৌরবর্ন  দীর্ঘদেহী, উন্নত  কপাল, টিকল নাক, চোখে এক বুদ্ধিদীপ্ত ভাব। গোঁফ দাড়ি কামানো। পোষাক পরিচ্ছেদে নাইট গাউন সিল্কের হালকা কালো,পায়ে ঘন কালো ডিনার শু।

নবীন বলল "বসুন স্যার, আপনার সাথে আলাপ করার খুব সখ ছিল। গতকাল ভোড়ে আপনাকে দেখে কেমন যেন---"

ভদ্রলোক একটু রুষ্ট হয়ে নবীনের কথা মাঝ পথে থামিয়ে বলল,"আমি আপনার ঘরে যেচে আলাপ জমাতে আসি নেই, অভিযোগ আর সর্তক করতে এসেছি।"

থতথম খেয়ে নবীন বলে "কেন স্যার কী কারন জানতে পারি! আর আপনার পরিচয়!"

"আমার পরিচয় পেলে বিপদ হবে।আপনাকে এখন সতর্ক করছি।এ ঘর থেকে রাতেই বের হতে বলছি না, রাত তো অনেক হয়েছে !তবে সংযত আচরণ করবেন।আপনার নজরে আসেনি ! এক তান্ত্রিক বাবার এ ঘরে তৈলচিত্র রয়েছে,এ ঘর তার।এখানে কোন অনাচার উনি সহ্য করবেন না।আগামীকাল খুব সকালেই এ ঘর ছেড়ে চলে যাবেন। দোতলার বাথরুম টয়লেট আমি ব্যবহার করি, ওখানে যাবার চেষ্টা করবেন না। নিচের বাথরুম টয়লেট ব্যবহার করুন, যদি আজ রাতে দরকার হয়। নচেৎ চরম কিছুর জন্য প্রস্তুত হোন।"

আর কোন কথা না বলে ভদ্রলোক ঘর ছেড়ে চলে গেলেন ,মনে হল খুব রুষ্ট ।

নবীনের একটু ভয় সংকোচ লাগল, তার গতকাল রাতে তার অসংযত আচরণ কী ভাবে জানল!তবে তান্ত্রিক সাধুর ছবি থাকায় তার মনে হল, হয়ত এ ঘর এক সময়ে কোন তান্ত্রিক সাধু থাকতেন,কিন্তু এ লোকটি কে !

এরপর সে একটু অন্য পরিকল্পনা নিয়ে একতলার বাথরুম গেল। একই আকারে বড় বাথরুম ,তবে সুসজ্জিত নয়,আয়না নেই। দীর্ঘদিনের বহু মানুষের ব্যবহারে একটা অপরিছন্নতা।

এবার রামুর কাছে গেল, কেয়ার টেকার একাই থাকে, রান্না নিজে করে, সংসার দুর কোন গ্রামের বাড়ীতে। রামুকে এ সব কথা বলাতে গুরুত্ব দিল না। গম্ভীর ভাবে বলল, "রাতে চুপ চাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন ,সকালে ঠিক হয়ে যাবে।"

"তার মানে কী বলতে চাইছ! আমি ভুল বকছি! নেশাগ্রস্ত!"

"আপনি কী যেটা আমার চেয়েও আপনি নিজেকে বেশী চেনেন, আমার অনেক এখন কাজ আছে , কাল সকালে যা বলার বলবেন, সব শুনব।"

নবীন বুঝল যে, রামু তাকে বিশ্বাস করছে না।এবার পাকা সবুদ রাখতে, মোবাইলটা ফুল চার্জ ছিল, বারান্দার দিকে জানালায় এমন ভাবে মোবাইল সেট টি লুকিয়ে রাখল, যাতে সহজে দেখা না যায়, আর বুড়ো লোক এত সব মোবাইল বোঝে না। সাইলেন্স মোডে রেখে,ভিডিও রেকর্ড অপশন চালু করে রাখল, রাতে ও সকালের ঐ ভদ্রলোকের সব গতিবিধি যাতে নজরে রাখা যায়। আর কখনই বা যায়।

দক্ষিণমুখী কক্ষের দরজা রাতে তখন আধ খোলা, আবছা লাল আলো ঘরের মধ্যে, নবীন বেশস্পষ্ট দেখছিল। দরজার বরাবর লক্ষ্য করে মোবাইলের মুখটা করেছিল ,তার উদ্দেশ্যেই ছিল ঘর থেকে মেজাজী ঐ বুড়োর হালচাল রাত থেকে সকাল অবধি নজরে রাখা।

রাতে ভালো ঘুম হল না, নবীন সারারাত কান খাঁড়া করে রাখল। বাইরের কোন শব্দ বা চলা ফেরার কিছু আওয়াজ হয় কিনা।শরীর বেশ ক্লান্ত রাতে ঘুম  না হলে আজও সে স্বভাব দোষে শেষ রাতে নিজের অসংযত আচরণে অবসন্ন লাগছিল।

ভোড়ের সময় একটু ঘুম ধরেছিল, কিন্ত কেউ যেন তাকে নাড়িয়ে দিল, নবীন চমকে ওঠে পড়ল।কেউ নেই, কে নাড়িয়ে দিল ? সকালের আলো ফুটেছে, পশ্চিম জানালার দিকে তাকালে অনুমান হল।মোবাইল টা বাইরের আছে,জানালায় রাখা ভিডিও ফুটেজ কী এল চরম কৌতুহলে সর্বাগ্রে দেখার জন্য দরজা খুলে বের হল।মোবাইলটা নিয়ে দেখল, কোন ফুটেজ নেই, তবে ভিডিও সেটিং করতে কী তাড়াহুড়োর মধ্যে ভুল হয়েছিল! তার আফসোস হচ্ছিল।

 মোবাইলে দেখল পাঁচটা পঞ্চাশ। হঠাৎই নজরে এল দক্ষিণমুখী কক্ষের ঘরে তালাচাবি দেওয়া! এত সকালেই বুড়ো পালিয়েছে তবে ? রাতে এত হুমকী সকালে গেল কোথায় !

এবার নবীন নিচে নামল,  রামু খুব সকালেই ওঠে, বোধহয় হিন্দি ভাষী, নিচের রারেন্দায় মধ্য বয়সের রামু চটের বস্তায় বসে আপন মনের সুরে হিন্দিতে রামচরিত ভজন করছিল। নবীনকে দেখে সে চুপ করল, "এত সকালে সাহেব!"

নবীন বলল "আমি তোমার কাছেই জানতে এলাম ঐ বুড়ো ভদ্রলোক কী খুব সকালেই উপর থেকে নেমে বেরিয়ে গেছে?"

এবার রামু কেমন উদভ্রান্ত," ভয়ে মুখ বিবর্ন, বলে সাহেব সত্য কী কোন বৃদ্ধ ভদ্রলোককে আপনি দেখেছেন?"

"আরে দেখা মানে ! রীতিমত কথা বলেছি, তুমি তো রাতে ভাবলে আমি নেশাখোর ভুল বকছি বা মিথ্যা বলছি!"

"সাহেব যদি তাই হত ,ভালো হত। রাতে আমি আর খুলে বলি নেই, উপরে দোতলায় ঘরে একা শোবেন তাই ভয়  পারেন।আবার আপনি যে ঠিক বলেছেন, বিশ্বাসও সম্পূর্ণ হয়নি।যাক আপনি এখনই এ বাড়ী ছেড়ে পালান।"

"এ তো ঐ বুড়ো রীতিমত মেজাজে হুমকির সুরে গত রাতেই বলেছিলেন।"

"তবু আপনি এখনও আছেন " ভয়ার্ত্ত উদ্বিগ্ন রামু কেমন উদভ্রান্ত।

"আরে সকালে তো ঐ কেটে পড়ল, তা আবার তোমার নজরে এল না! " মনে মনে ভাবল তাকে যড়যন্ত্র করে এরা আবার তাড়াতে চায় না তো ! কোন কিছু গোপন করতে চাইছে ! আমি থাকলে ওদের সমস্যা।

রামু এবার বলল , "সাহেব, দক্ষিণ মুখী দোতলার ঘর সব সময়ই তালাচাবি থাকে, আমি ত্রিশ বছর দেখছি।কে ঐ বৃদ্ধ ভদ্রলোক মাথায় আসছে না, যাই হোক আমার কেমন রহস্য লাগছে । দরকারে ছোট বাবুকে ফোন করে বিষয়টা বলুন,বা বড়বাবু মানে পলাশ সাহেবের বাবাকে ফোন করুন, উনি  নিশ্চয়ই বিষয়টার রহস্য জানবেন।ছোট বাবু এই কদিনের ছেলে,সব হয়ত জানেন না,তাই আপনাকে এরকম দীর্ঘদিনের ব্যবহার না হওয়া ঘরে থাকতে দিলেন।"

আজ ভোড়ে নবীন বাথরুম যায়নি রাতে জল খুব কম খেয়েছিল, যাতে ভোড়ে বের হতে না হয়, ঐ বুড়োর হালচাল দেখার জন্য মোবাইলের যাতে ভিডিও ফুটেজ রেকর্ডিংএর কোন ব্যাঘাত না হয়।

এবার সে নিচের বাথরুমে যাব ভাবল, পরক্ষণেই ভাবল উপরে যাই, এখন ও কি করে আমায় বাধা দেয় দেখি !

নবীন এক সময়ে যুক্তিবাদী বিজ্ঞান মঞ্চের সক্রিয় সদস্য ছিলো । অনেক অলৌকিক কাহিনীর কথা জানে ,কিন্ত কোন প্রমাণ ছাড়াই মানুষ তা বিশ্বাস করে। রামুর কথা যদি সত্যিই হয়, দেখি না কে আমাকে বাধা দেয় !

 নিচের তুলনায় উপর বাথরুম অনেক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, স্নানটা তা হলে ওখানেই করব।

উপরের বাথরুম থেকে ঘুরে এবার নবীন ঘরে ঢুকল, ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে দাঁত মাজতে যাবে, এমন সময় মোবাইলে ফোন বাজল। নবীন দেখল এক অজ্ঞাত নম্বরের ফোন,এমন ফোন তার মাঝে মধ্যেই আসে,

 সরকারী গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন , অনেকেই এর ওর কাছে তার ফোন নাম্বার জেনে কল করে,কোন সময়ের জ্ঞান থাকে না। এই সাত সকালে! ধরব না ভেবে শেষে ফোন ধরল, আবার এখন কেউ বিরক্ত করবে হয়ত!  

ফোন ধরতে অপর প্রান্ত থেকে বেশ রুষ্ট স্বরে এক কন্ঠ যেন গতরাতের বৃদ্ধের গলা , বলল,"তুমি এত নির্বোধ আর অহংকারী দেখে বুঝিনি,মানুষের বুদ্ধি প্রযুক্তি, আর ঈশ্বরের সৃষ্টি তুমি, তোমার দৃষ্টি মেধা ব্রেন এক কী করে ভাবলে  ! তোমার মোবাইলে আমার ক্রিয়াকর্ম নজরে আসে না দৃষ্ট নয়।কারন তুমি যা কিছু আমার বিষয়ে দেখেছ জেনেছ সব অলৌকিক। আমি তোমার মোবাইল সেটিং করে ভিডিও তোলার পরিকল্পনা সব দেখেছি জানি,কিন্ত কিছু করি নি। 

এ রাতটা তোমার সব কিছুই অজ্ঞতা আমি হজম করব ভেবেছিলাম, কিন্ত আমার কথা অমান্য করে তুমি আমার গুরুর বিছানা আজও অপবিত্র করেছ। আমার বাথরুম আবার নোংরা করলে । সকালে ঘরটাও ছাড়লে না ! তারমানে আমাকে তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা চ্যালেঞ্জ ! আমার গুরুকে আঘাত অপমান ,আজ তুমি জেনে বুঝেই করেছ ! আমার বাথরুম টয়লেট গেলে আমাকে চ্যালেঞ্জ করে ! শোন আমি বীভৎস রূপে এভাবে ভয় দেখাই না।যাকে আমার সহ্য হয় না, বিরক্ত লাগে তাকে এই জগতেই রাখি না,আর ত্রিশ দিনের মধ্যে তোমার মৃত্যু কেউ, রুখতে পারবে না।"

নবীনের কেমন হেঁয়ালী মনে হয়,বলে "আপনার পরিচয় টা জানতে পারি!"

"আমার বিষয়ে জানার দেখছি তোমার খুব আগ্রহ!পুরোন কোট রোডে পোষ্ট অফিসের কাছে একটা পুরোন দশকর্মার দোকান ," তন্ত্র মন্ত্র" , ঐ দোকানে জিজ্ঞেস করো গোকুল বিশ্বাসের বাড়ী, নিকটেই দেখিয়ে দেবে ।ওর বাড়ি যাও ,আমার কথা ওকে জিজ্ঞেস করবে,তোমার সব প্রশ্ন পেয়ে যাবে। জেনে আর কি করবে !আর কটা দিন ।"

ফোন কেটে গেল। নবীন দেখতে গেল ফোন নাম্বার টা নিয়ে নিদিষ্ট অ্যাপসে নাম জানবে।

কিন্ত বিস্মিত বিচলিত হয়ে দেখল, কোন ফোন নাম্বার ভিউ হচ্ছিল না।কল রেকর্ড নেই।

নবীন এবার রীতিমত মত ভয় পেলো! সব কেমন রহস্য আর মিলে যাচ্ছে।আমি কী সত্যিই ত্রিশ দিনের মধ্যেই মরে যাব!

দাঁত মাজা স্নান অফিস মাথা থেকেই চলে গেছে, চুলোয় যাক সব।

এবার সে গায়ে পোষাক গলিয়ে এক রিকশায় চেপে "তন্ত্র মন্ত্র " দশকর্মার দোকান পোষ্ট অফিসের রাস্তার পথে চলল ,অনেকটা পথ। তখন আটটা দোকানটি সবে খুলছে, হন্তদন্ত নবীন ঐ দোকানের মালিককে গোকুল বিশ্বাসের বাড়ী জানতে চাইলে।  দোকানদার বললেন, তার দোকানের বাম দিকের গলি বরাবর হেঁটে যেতে,ডান দিকের পাঁচ নম্বর বাড়ি। 

বাড়িটি বেশ পুরোন নবীন দেখল,কারুকার্য ভরা ছোট বাড়িটি ভগ্ন দশা,এককালে সচ্ছলতা ছিল মনে হয় এখন দারিদ্র্যতার ছাপ বেশ স্পষ্ট।

কড়া নাড়লে এক মধ্য ত্রিশের কোঠায় যুবক বের হলে,নবীন বলল, " আমি গোকুল বাবুর সাথে দেখা করব।"

যুবক বলল,  "কিন্ত উনি তো অসুস্থ ঘর থেকেই বের হোন না।"


                         (চতুর্থ পর্ব )

                          দুষ্ট তান্ত্রিক

নবীন বলে "খুব দরকার, রায় সিংহ জমিদার বাড়ি থেকে আসছি। "

যেন ম্যাজিকের মত কাজ হল , " অপেক্ষা করুন দাদুকে জিজ্ঞেস করি।"

একটু পর ফিরে এসে বলল,"আসুন উনি আপনাকে ডেকেছেন।"

 নবীন গৃহে ঢুকল,  ভয়ে টেনশনে কেমন থমথমে মুখ।বৃদ্ধের শরীর জড়াজীর্ন  নব্বই না একশ বছর কে জানে ! পুরোন দিনের একটা খাটে বসে,তাকে দেখে উঠে বসল, ঘরে ছোট একটা চেয়ারে পাতা নবীনকে বসতে বলে  বলল, "আপনি কি রায় সিংহ বাড়ির বংশধর  !  "

নবীন বলল "না তবে ঐ বাড়িতে দুদিন আছি তার পর সব ঘটনা সবিস্তারে বলল।"

বৃদ্ধ কেমন ভয়ার্ত্ত উদ্বিগ্ন খানিক ক্ষন চুপ থাকে।    " আপনাকে উনি কিন্ত সতর্ক করেছিলাম, আপনি যদি তা শুনতেন আজ খুব সকালে বাড়ি ছেড়ে দিতেন,আপনাকে নাড়া দিয়ে খুব  সকালেই কিন্তু তুলে  দিয়েছিলেন ----"

নবীন কথা থামিয়ে বলে,"দয়া করে উনি কে আগে বলবেন?"

বৃদ্ধ বললেন, "উনি জমিদার বিক্রম বাহাদুর সিংহ রায়, সিংহ রায় তাঁদের রাজ উপাধি।বংশ পরমপর উনার  পরিবার বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী।কিন্ত বিক্রম বাহাদুর পরিনত বয়স তখন ষাট বা তার বেশী।

উত্তর ভারতে প্রায়ই তীর্থে যেতেন। একা একা  বিভিন্ন ধর্মস্থানে ঘুরে বেড়ানোর তার তখন স্বভাব। জমিদারীর সব দায়িত্ব ছেলেদের হাতে ছেড়ে দিলেন। হঠাৎই একদিন এক হরিদ্বার হিন্দিভাষী তন্ত্র সাধককে সঙ্গে নিয়ে গৃহে ফিরলেন। দেখলেই কেমন ভয় ভয় করে সমীহ হয় ।দীর্ঘাকায় কৃষ্ণ বর্ন বলিষ্ঠ শরীর, গেরুয়া বসন, মুখমন্ডল গোঁফ দাড়ি পরিপূর্ণ, মাথায় জটা, তীব্র জ্বল জ্বল করছে তার লালাভো ক্ষুদে চোখ ,তেমনই তার কর্কশ গলা।

 জমিদার বিক্রম বাহাদুর,তার বৈষ্ণব ধর্ম ও কৃষ্ণ প্রেম ছেড়ে পুরোপুরিই তান্ত্রিক গুরুর দীক্ষিত শিষ্য হলেন। তান্ত্রিক দিব্যজ্যোতি মহারাজ, আক্ষরিক অর্থেই তিনি, নারী নরকের দ্বার মনে করতেন। তিনি বলতেন, নারী না থাকলে মানবকুল ধ্বংস হত, এত জ্ঞান মেধা নিয়েও নারী দেহের মোহ, কাম সম্ভোগ মায়ার ছলনায় আমরা নির্বোধ, সুখ শান্তির,  সহস্র গুন দুঃখ উদ্বেগ নিয়ে আমরা সারা জীবন বর্বরের মত অতিবাহিত করি। আনন্দ দেহজ আরাম সুখ অনুভূতির, সহস্র গুন রোগ যন্ত্রণা ,আর প্রাকৃতিক নিয়মে আমরা সদা পীড়িত। এ জীবন নরকসম অভিশপ্ত ,নারীর দেহ ছাড়া এ জীবন সৃষ্টি হত না। তাই নারীকে পরিহার করো, দুরে রাখো। যারা এই নীতিতে বিশ্বাস করত তাদের শিষ্যত্ব মেনে নিতেন দীক্ষা দিতেন। তন্ত্র বিদ্যা শিখাতেন।  

বিক্রম বাহাদুর তাই তার স্ত্রীর সঙ্গ ত্যাগ করলেন, তিনি কোন স্ত্রী মানুষের হাতে খাবেন না, দর্শনও করবেন না।আমি তার দেহরক্ষী ছিলাম, আমাকে তিনি তার সর্বক্ষণের অনুচর করলেন, রান্না বান্না পোষাক পরিস্কার থেকে সব করতাম। আমাকে মোটা বেতন দিতেন।

 আমি আমার স্ত্রীর সাথে সহবাস করি কিনা জিজ্ঞেস করতেন না, কিন্ত প্রত্যেক দিন আমাকে সকালে উনার সাক্ষাৎ এর আগে গঙ্গা জলে স্নান করে নিজেকে শুদ্ধ হতে হত,সে জন্য বাথরুমে গঙ্গার জল বড় চৌবাচ্ছায় নিয়মিত রাখা থাকত।

তীব্র মেধাবী জেদী বিক্রম বাহাদুর অক্লান্ত পরিশ্রমে এ জামিদারী স্থাপন করেন। তিন ছেলে তাকে শ্রদ্ধা সমীহ করত, তিন ছেলে ছাড়া এ বাড়ীর আর কোন সদস্য বা বাইরে মানুষ তার সাক্ষাৎ করার অনুমতি ছিল না। এক কথার মানুষ ছিলেন। তখন বৃটিশ যুগ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে ,দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের তিনি আর্থিক সাহায্য করতেন, পুলিশের কাছে খবর ছিল, তিনি তার ঘরে অস্ত্র মজুত রাখেন,বিপ্লবীদের আশ্রয় দেন। তন্ত্র সাধনা তার বাহানা।

আপনি যে ঘরে থাকছেন ,ওটা ছিল তাঁর তন্ত্রগুরু দিব্যজ্যোতি তান্ত্রিক মহারাজের জন্য নিদিষ্ট, যদিও তিনি বছরে শুধু কালী পুজোর সময়টা সাতদিন থাকতেন। জমিদার বিক্রম বাহাদুরের  ঘরে তার  তন্ত্রশক্তি সাধনার বহর দেখলে ভয়ে বুক কাঁপতো, কঙ্কাল নর মুন্ড, সিঁদুরে আঁকা ভয়ঙ্কর ছবি,শত প্রদীপের আলো সাতদিন একটানা জ্বলত দাউ দাউ করে,নিষ্ঠা ভরে জমিদার বাবু তন্ত্র বিদ্যা পাঠ নিতেন, খাওয়া ঘুম  যেন ভুলে যেতেন।বাকী সময় ঐ তান্ত্রিক সারা ভারত নেপাল সহ অনেক দেশ পরিভ্রবন করতেন। 

একমাত্র নারী সম্পর্ক হীন, নিষ্কাম পুরুষ তার শিষ্য, ও তাদের দীক্ষিত করা আর তন্ত্র শিক্ষা দেওয়া যেন তার লক্ষ্য। বড় বড় প্রভাব শালী অনেক মানুষ তার অনুগত ছিলেন, কিন্ত শিষ্য ছিলেন সেই তুলনায় অনেক কম। দক্ষিণ মুখী দোতলার ঘরে বিক্রম বাহাদুর থাকতেন, দোতলার বাথরুম উনি ব্যবহার করতেন,তবে গুরু এলে তিনিও এ বাথরুম ব্যবহার করতেন। এছাড়া আমাকে ব্যবহারে অনুমতি দেন, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আমি করতাম। 

দোতলার পঞ্চম পুবমুখী ঘর,তান্তিক বাবার আর দক্ষিণ মুখী ঘর বিক্রম বাহাদুরের ঘর, এই অংশে আমি আর তার তিন ছেলে ভিন্ন সবার প্রবেশ নিষেধ ছিল, তবু ছেলেদের নির্দেশ ছিল ,শুদ্ধ হয়ে গঙ্গা জলে স্নান করে তার সাক্ষাৎ করতে। আর বিপ্লবীদের তিনি ,জমিদারীর খাজনা আদায়ের একটা অংশ নিয়মিত দিতেন, নায়েব শশীকান্ত মাধ্যম বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। অর্থের যোগান ছাড়া আর কিছু সম্পর্ক ছিল না আমি যতটুকু জানি।

একদিন পুলিশ এল,তাকে গ্রেফতার করতে আর তার ঘর সার্চ করতে। অস্ত্র মজুত আছে এমন খবর ছিল, তাই উদ্ধার করতে। গিন্নি মা বাড়ির সবাই শঙ্কিত , এই বয়সে গ্রেফতার আবার কত অনাচার অত্যাচার হবে। আমাকে দিয়ে বলে পাঠালেন ,উনি যেন ঐ ঘরে চাবি দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান।

গিন্নি মায়ের এই পরামর্শ শুনে উচ্চস্বরে হাসলেন  বললেন,"জমিদার বিক্রম বাহাদুর কারও ভয় করে না, আমি তান্ত্রিক গুরুর কৃপায় সর্বশক্তিমান আমাকে  ধরবে কে !"

পুলিশ আসে আমি ঐ দক্ষিণ মুখী দোতলার ঘরে বাইরে চাবি দিয়েছিলাম, পুলিশ কোন কথা শোনে না।চাবি চাইল ,গিন্নি মায়ের কথামত বললাম ,উনি চাবি দিয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছেন, চাবি তার কাছে।

দুজন বন্ধুকধারী হাবিলদার , একজন দারোগা  সাথে রিভালবার, আমার কোন কথা শুনল না, দরজা আটকে ছিলাম, লাথ মেরে আমাকে ফেলে দিল, চাবি ভেঙ্গে দরজার কপাট খুলে ভিতরে ঢুকেই তিন জনেই ভয়ার্ত্ত চিৎকারে বেরিয়ে এল, কেমন যেন উদভ্রান্ত ঠক ঠক করে কাঁপছিল।

 বাইরে থেকে দেখিলাম, বিক্রম বাহাদুর তার বিছানায় সমাধিস্থ হয়ে বসে, ঘর থেকে গরম উত্তাপ বের হচ্ছে এক মিনিট টেকা দায়, কিন্ত উনি বেশ নির্বিকার, ওদের রণহুঙ্করে বললেন, এক মাসের মধ্যেই তোরা চরম শান্তি পাবি।আমাকে বলল, চাবি যেমন দিয়েছিলে তেমনি লাগিয়ে রাখো, আর কোন দিন খুলবে না, যে খুলবে, আমার ঘরের পবিত্রতা নষ্ট করবে , এক মাসের মধ্যেই তারও মৃত্যু হবে ।

পুলিশ তিন জন ভয়ে পালিয়েছিল আর কেউ আসে নি।আর ঐ তিন জনের এক মাসের আগেই মৃত্যু হয়।কি রোগ কোন ডাক্তার হাজার পরীক্ষা করে অনুমান করতে পারে নি। সে সময়ের অনেক দেশী বিদেশী সাহেব বড় বড় ডাক্তারের কথায়, বাহ্যিক খুব বেশী পরিবর্তন না হলেও তাদের শরীরের অভ্যন্তরে অঙ্গ ফুসফুস হার্ট লিভার বৃক্ক থেকে সবকিছু নষ্ট, অশীতপর চরম বার্ধক্য জনিত কারনে দেহ বিকল হয়ে যেন তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে কী একটা রোগের মত,কিন্ত তা এত দ্রুত মানুষকে আক্রান্ত করে না,আবার তিন জনের একসাথে ! এটাই বড় বিষ্ময়, সে সময়ে পেপারে এনিয়ে অনেক লেখালেখিও হয়। তবে নেতাজীর নেতৃত্বে এর কিছুদিন পর আই এন এর ভারত আক্রমণ বৃটিশদের দিশেহারা করে।মানুষের মধ্যে চরম আশা উন্মাদনা, এই সব খবর সহজে তাই চাপা পড়ে যায়। "

এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল," আমার মনে হয় এটা কোন তন্ত্র শক্তি,যা গুরুর কাছে বিক্রম বাহাদুর মহাশয় অর্জন করেছিলেন।"

নবীন বলল "আমি কী সত্যিই এক মাসের মধ্যেই মরে যাব!"

 বেশ দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে গোকুল বলল "আমার অনুমান সেটাই, আপনি যদি মিথ্যা প্রমাণ করেন তবে, আগ্রওয়াল বাবুর নিশ্চিতে ঐ অভিশপ্ত ঘরে আর চাবি লাগাবে না।"

নবীনের সারা শরীর কেমন করছে,তবে কি তার ও এই অভিশাপ লেগেছে! সত্যিই সে এক মাসে মরে যাবে!

বিভ্রান্ত নবীন এমন অবস্থা, কোন সৌজন্যতাবশত বৃদ্ধ কে ধন্যবাদ বা নমস্কার না জানিয়ে তার বাড়ী থেকে এবার বেরিয়ে আসে।এবার পলাশ কে ফোন করলে, বিজি টোন ।এবার সে রবিন তার অফিসের জুনিয়র সহকর্মীকে ফোন করল,পলাশদের বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইল। খুব জরুরী দরকার নবীন জানালে,স্থানীয় বাসিন্দা,দীর্ঘদিনের আগ্রওয়ালদের সাথে রবিনের সম্পর্ক। রবিন একটা পথ নির্দেশ ও লোকেশন দিল। মেনরোডে ময়ুরাক্ষী বাঁধ ,তারপর বরাবর পশ্চিম দিকে একটু গেলে, যে কেউ পলাশ আগ্রওয়াল নাম বললে ওদের বাড়ি দেখিয়ে দেবে। 

এক অটো চালককে বলে নবীন এবার পলাশ আগ্রওয়াল দের বাড়ী জিজ্ঞেস করে চিনে চিনে গেল। মস্ত বাড়ি ,শহর থেকে একটু দুরে নির্জন পরিবেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে বাড়ী।কলিং বেল বাজিয়ে বাড়ির বাইরে ছিল, একজন ভৃত্য শ্রেনী কেউ মনে হয় দরজা খুলে জিজ্ঞেস করল কাকে চাই।

নবীন নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, "পলাশ বাবুর সাথে জরুরী দরকার।" পলাশ বাবু নেই শুনে,নবীন বলল "উনার বাবা বাড়িতে আছেন!"

ভৃত্য এবার বলল" হ্যাঁ আছেন খবর দেবো !"

"নিশ্চয় খুব জরুরী বলবে!"

ঘাড় নেড়ে ভৃত্য গৃহের ভিতর গেল।

সমানে একটা মস্ত বড় কুকুর বাড়ির ভিতর থেকেই ভেক ভেক করে যাচ্ছে।অধৈর্য নবীনের মনে হচ্ছিল বাড়ীর ভিতর চলে যাই, কিন্তু কুকুর টা বাধা।

সরকারী অফিস থেকে এত সকালেই অফিসার হঠাৎই কেন ! তাই তিনি,ভৃত্যকে বললেন " বাবুকে বৈঠকখানায় বসতে বলো আমি আসছি।"

বাড়ির সংলগ্ন বৈঠক খানা ,ভৃত্য নবীন কে ডেকে দরজার চাবি খুলে বৈঠকখানায় বসাল।একটু পর ভিতরের দরজা দিয়ে এক ভদ্রলোক ঢুকতে দেখে নবীন নমস্কার করল,ভদ্রলোকও প্রতি নমস্কার করল । তার আর ধৈর্য ধরছে না।

ভদ্রলোক বললেন আপনাদের অফিস পলাশ যাতায়াত করে আমি যাই না,তাই চেনা পরিচিতি নেই ।বলুন এত সকালেই খুব জরুরী কাজ বুঝি !

"ঠিক তাই তবে ব্যক্তিগত, " বলে সব ঘটনা নবীন বলল।

ভদ্রলোক খানিক থমকে কী সব যেন স্মরণ করে বললেন "  আমি হলে আপনাকে ঐ ঘরে থাকতে বলতাম না।পলাশ ঠিক জানে না। কোন দিন  আবার দক্ষিণ মুখী দোতলার বড় ঘরটা খুলে না দেয় ! " 

পলাশকে ফোন করলেন কিন্ত সেই একই বিজি। ভদ্রলোক বললেন "আজ ও খুব ব্যস্ত রাইস মিলের মেশিন এসেছে, কোম্পানির লোক এসেছে তাই হয়ত ফোন ধরছে না, তবে  গোকুল বাবু যা সব  বলেছেন, এতটা আমিও জানি না। শুধুমাত্র বাড়ি রেজিস্ট্রেশনের দলিল আর লেনদেন পর ,ঐ বিক্রম বাহাদুরের বড় ছেলে বলেছিল, দোতলার দক্ষিণ মুখী ঘর খুলবেন না । ওটা আমার বাবার সমাধি আছে,এজন্য আমরা,বাড়ির মুল্য একলাখ টাকা আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি।বাবার আত্মা যেন কষ্ট না পায়।যা আপনাদেরও অমঙ্গল হতে পারে।

 আর পূর্ব মুখী পাঁচ নম্বর ঘরটা ব্যবহার করবেন কোন ধর্মীয় পবিত্র কাজে। অসুচী কোন কাজ বিষেশত কোন দম্পতির যেন ঐ খাটে কোনদিন রাত্রিবাস না করে। মহিলা প্রবেশও কঠোর ভাবে নিষেধ করেছিলেন। "

কৌতুহলে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিক্রম বাহাদুরের ছেলে বলেছিলেন, এক তান্ত্রিক সাধুর তৈলচিত্র আছে, আমরা বৈষ্ণব, কিন্ত উনি তান্ত্রিক বাবার গুরু, তাই বাবার সমাধি ঘরের পাশে বাবার গুরুর তৈলচিত্র থাক, বাবা অনেক খরচ করে আর নিষ্ঠার সাথে এক নামী শিল্পীকে দিয়ে এই তৈলচিত্র আঁকিয়ে ছিলেন । নিয়মিত ছবিতেই তার গুরুর বন্দনা আর স্মরন করতেন ।

বলেছিল ব্যবহার করবেন, তবে খুব সুচিতা আর পবিত্রতা মেনে। কারণ ঘরে ঐ তান্ত্রিক তৈলচিত্রে আছেন ,উনি সংসার বিরাগী , নারী সঙ্গ তীব্র অপছন্দ করেন, কাম বসনা আর যৌনাচার চরম ঘৃনা করেন, আর বার বার বলেন তৈলচিত্র যেন ঐ ঘরেরই থাকে, নচেৎ বাবার আত্মা রুষ্ট হবেন।"

এত বড় বাড়ী, দুটো ঘর সামন্য ,একটা ঘর ব্যবহার করা যাবে না, চাবিতালা থাকবে,সে জন্য একলাখ সে যুগে মানে, এখন বিশ লাখের কম নয়। আর একটা ঘরে ব্যবহার হবে, তবে পবিত্রতা মেনে,আর একটা তৈলচিত্র থাকবে তাই মেনে নিয়েছিলাম।

 আমি আপত্তি করি নেই।এত সব জানতাম না যাক আরও সতর্ক হতে হবে। তবে আপনাকে যদি কোন ভাবে সাহায্য করতে পারি করব ,কথা দিচ্ছি  তবে তন্ত্র বিদ্যা বড় ভয়ানক শুনেছি ,এর ক্ষমতা বলে ভিখারীকে রাজা বানায়, রাজা হয় ভিখারী।"


অসহায়ের মত নবীন নির্বাক মাথা নামিয়ে বলে "সব আমার ভাগ্য, দোষ কারও নয়, আর তো মাত্র একমাস বা তার কম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নবীন উঠে দাঁড়াল।"

গজপতি আগ্রওয়াল বললেন, " সাহেব আপনি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত, আজ অফিস করা দরকার নেই, বাড়ী যান,আর আমার সামান্য পরামর্শ, কোন তান্ত্রিকের সাথে যোগাযোগ করুন, কথায় আছে বিষে বিষে বিষক্ষয় , তবে তেমন তান্ত্রিক চাই।"


নবীন বৈঠকখানা ঘর থেকে বের হল, এবার, অটোয় ভাড়াঘরে ফিরল,তবে এখন তার পলাশ আগ্রওয়ালদের গোডাউনের দোতলায় যেতেও কেমন ভয় হচ্ছিল। রামুকে সঙ্গে করে উপরে উঠল, তার ব্যাগ পোষাক মালপত্র যা ছিল নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করে সোজা কামারকুন্ড। 

মনটা এমন উথলপাথার করছে যেন সে মরে যাবে,বাস ট্রেনের যাবার ধৈর্য ক্ষমতা পাচ্ছে না। টাকার মোহ, হিসাব,  কৃপনতা ,কোনদিকে হাওয়া। গাড়ি নটার কিছু পর ছেড়েছিল, তখনও অফিস খোলে নেই।

আজ শুক্রবার বিকেলে তার অফিস থেকে বাড়ী ফেরার কথা। বাড়ি যেতে রাত আটটা হয়।আজ দুপুর দুটো একটু পর নবীনকে গাড়ীতে বাড়ি ফিরতে দেখে ,স্ত্রী মালতী কেমন বিষ্ময়ে জিজ্ঞেস করল , " কী গো হঠাৎ এত দুপুরে গাড়ীতে ফিরলে যে !শরীর খারাপ না কী!"

নবীন প্রথম ভাবল সব চেপে যাবে মালতীর চিন্তা বাড়াবে না,কিন্ত মালতীর মুখ দেখে স্থির থাকতে পারল না, " বিষন্ন মুখে বলল,শরীর খারাপ নয়, সাক্ষাৎ মৃত্যু দেখছি, তাও একমাসের মধ্যেই।"

মালতী উদ্বিগ্ন বলে "কী হেঁয়ালী করছ ! কী হয়েছে খুলে বলো!"

ড্রাইভারকে ভাড়ার টাকা মিটিয়ে অবসন্ন ক্লান্ত নবীন এবার ঘরে এক চেয়ারে বসল।

মালতী ব্যাকুল হয়ে ওঠে "কী গো কী হয়েছে তোমার ! " 

এবার নবীন সত্যিই ভেঙ্গে পড়ে কান্নায় তার গলা রুদ্ধ, নীরব মাথা ঝুঁকিয়ে কাঁদছে।

মালতী তার মাথায় ঘাড়ে, হাত দিয়ে মালিশ করার মত ঘসে শ্বান্তনা দিতে থাকে, কিন্ত কোন এক অজানা আশঙ্কা সে নিজেও এবার কাঁদতে শুরু করল।

ছেলে বাইরে পড়াশোনা করে,আর মেয়ে স্কুল থেকে তখনও ফেরেনি।

মালতীর কান্নায় নবীন এবার বিব্রত বলে "তুমি কাঁদছ কেন! তোমাকে অনেক শক্ত হতে হবে,ছেলে মেয়েদের এবার তুমি গার্জেন তোমাকেই ওদের দেখতে হবে, আমি তন্ত্র সিদ্ধ কোন এক অলৌকিক দুষ্ট আত্মার অভিশপ্ত " বলে সব ঘটনা খুলে বলল।

মালতী সাহস জোগায়, "আমি যদি সতী নারী হই, কেউ তোমার কোন অনিষ্ট করতে পারবে না। আগ্রওয়াল বাবুর ঠিক বলেছেন, আমি কালই তোমাকে নিয়ে বাপের বাড়ির যিনি আমাদের গুরুদেব ,আমিও দীক্ষিত, ওর কাছে যাব, কী পরামর্শ দেয় দেখি।তুমি স্নান করে কিছু খাও।এত চিন্তা ভয় করে লাভ কি বলো!"

নবীনের দাঁত মাজা হয়নি, এবার দাঁত মেজে স্নান করে ভাত খেল, মালতী দ্রুত ভাত আলু সিদ্ধ, আর ডিমের ওমলেট করল,আচার আর ঘি ছিল । খিদের জ্বালায় সে তত দুর্বল ক্লান্ত অবসন্ন বোধ করছিল। খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে এতটা নার্ভাস ছিল না।নবীন স্ত্রীকে পরামর্শ দিল ,"ছেলে মেয়েকে এসব বলো না।"

মালতী তাকে মৃদু ভৎসনা করল "এত কৃপনতার কী দরকার ছিল, ভালো ঘর পাঁচ ছ হাজার ভাড়া নিলে তিন চার হাজার মাসে বেশী পড়ত , দীর্ঘদিনের ফাঁকা ঘর ব্যবহার হয় না, ভয়ঙ্কর তান্ত্রিকের ছবি সেই ঘরে কেন থাকতে গেলে ! তাও ঐ দুষ্ট আত্মা যখন সতর্ক করল, ঐ রাতেই তোমার অফিসের নাইট গার্ডের ঘরে এসে শুতে পারতে । আমি হলে তো তাই করতাম। আর এত তোমার কীসের সাহস দুষ্ট আত্মা সাথে চ্যালেঞ্জ! কেনই বা এই বয়সে এত তোমার রস ! দুদিন সহ্য হয় না ! আমি তো তোমায় কোন দিন না করি না। কী সর্বনাশ করলে বলো!"

মালতীর কথায় যুক্তি পায় নবীন।কিন্তু কি করবে।

গাড়িতে আসার সময় অফিস থেকে বার কতক ফোন আসে রিসিভ করে নি ।এবার রবিন কে ফোনে সব বলল,"আমার মনের যা পরিস্থিতি,একা থাকা আর অফিসের কাজ অসম্ভব,যদি একমাস পরে বেঁচে থাকি ,তখন অফিসের কথা ভাবব। একমাস আমি, ই এল নিচ্ছি কাল ডাকযোগে দরখাস্ত পাঠাবো।"

রবিন আশ্বাস দিল, "ভাববেন না দাদা ,আগে নিজে সুস্থ হয়ে বাঁচুন, অফিসের চিন্তা পরে।"

নবীন বলল, "বসকেও বলেছি এত ডিটেইল নয় ভীষণ অসুস্থ তাই বাড়ী যাচ্ছি। দশটাতে ওবেলা ফোনে বলেছি,তার পর আর কোন ফোন ধরি নেই ,মনটা ভেঙ্গে গেছে।"

রবিন ভরসা দেয়, "কিচ্ছু হবে না দেখবেন!"

নবীন কিন্ত বিশ্বাস হয় না।

পরদিন তারা মালতীর গুরুদেব নবদ্বীপের কাছে তার আশ্রম, গঙ্গার পাশে। তিনি সব শুনে বললেন, আগামী অমবশ্যার রাতে একটা যজ্ঞ করব ,কোন অশুভ শক্তি যেন নবীন বাবার কোন অনিষ্ট সাধন না করতে পারে।

সে তো প্রায় একমাস ধাক্কা ,তাই এ প্রস্তাব মালতী ও নবীনের ভরসা দিল না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে হঠাৎই মালতীর মনে হল, গতবছর হরিদ্বারে তারা এক ধর্মশালায় উঠেছিল, এক কর্মকর্তা হরিশ শর্মার সাথে ভালো আলাপ হয়েছিল । একটা নাম ঠিকানা মোবাইল ফোন নাম্বার সমেত কার্ডও সে দিয়েছিল, ব্যাগ হাতড়ে খুঁজে খুঁজে, পেয়ে গেল, ভদ্রলোক বাংলা ভালো জানেন। গাড়িতে আসতে আসতে মালতী ফোন করল,তখন সন্ধ্যা নামছে।


              ক্রমশ 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror