সুটকেস রহস্য
সুটকেস রহস্য
রাত তখন সাড়ে তিনটে হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো । নন্দিনী স্বপ্নীলকে ঠেলে তুললো, " নীল, এই নীল দ্যাখো না কেউ অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল দিচ্ছে । কিগো উফ্ কি কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম রে বাবা! নীল, এই নীল " । নীল কোনোরকমে ঢুলতে ঢুলতে উঠে গিয়ে দরজা খুললো । নন্দিনী ও আসলো পিছু পিছু । দরজা খুলতেই দুজনেই অবাক , দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । নীল বললো, " কিগো কেউ তো নেই ? তবে দরজার সামনে এই সুটকেসটা কে রেখে গেলো ? " নন্দিনী বললো, " সেটাই তো ভাবছি , এটা কার ? কেনোই বা এখানে রেখে গেছে ? হ্যাঁ গো, বোমা-টোমা নেইতো এতে ? " নীল বললো, " না খুললে কি করে বুঝবো ? " নন্দিনী হঠাৎ খেয়াল করলো লেটারবক্স - এ একটা খাম , নন্দিনী খামটি নিয়ে দেখলো এতে স্বপ্নীলের নাম লেখা ।
" কিগো নীল এতে তো তোমার নাম লেখা " । নীল বললো , " কিন্তু আমাকে কে কি পাঠাতে পারে ? তাও আবার সুটকেসে ? " নন্দিনী বললো , " দাঁড়াও চিঠিটা পড়ে দেখি । " নন্দিনী চিঠিটা খুলেই অবাক হয়ে বললো, " একি! চিঠিটা তো পুরো ফাঁকা, কিছুই লেখা নেই । আচ্ছা কেউ মজা করে.... " নন্দিনীর কথা শেষ না হতেই নীল হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিলো । নীল বললো, " কি আশ্চর্য, এতো কিছু লেখা তুমি বলছো কিছু লেখা নেই ? "নন্দিনী তো আকাশ থেকে পড়লো । ও দেখলো blank চিঠি আর নীল বলছে লেখা আছে ! নীল ততোক্ষণে চিঠিটা পড়েই রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে । নন্দিনী বললো, " কিগো কি হোলো ? তুমি এরকম কাঁপছো কেনো ? কি লেখা আছে এতে ? "
নীল বললো, " ও কিছু না, এমনি । থাক্ ঐ সুটকেসটা খুলতে হবে না । চলো চলো গিয়ে শুয়ে পড়ি , কালকে আবার অফিস আছে । " নন্দিনী বললো, " কিন্তু..... " । "উফ্ আবার কিন্তু ? চলো ঘুমাবে চলো " এই বলে নীল জোর করে নন্দিনীকে নিয়ে শুয়ে পড়লো । শোয়ার সাথে সাথেই নন্দিনী ঘুমিয়ে পড়লো , কিন্তু নীলের আর কিছুতেই ঘুম আসলো না । প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় নীল দরদর করে ঘামছে । যাইহোক সকাল হলে সব কাজ শেষ করে দুজনেই অফিস বেড়িয়ে গেলো ।
নন্দিনীকে অফিসে পৌঁছে নীল আর অফিসে না গিয়ে সোজা বাড়িতে ফিরে আসে । দরজা খুলে ঢুকেই আগেই সুটকেসটা খুললো । সুটকেসটা খুলতে স্বপ্নীলের চক্ষু চড়কগাছ । সুটকেসটার মধ্যে ছিল একটা সাত - আট বছরের মেয়ের রক্তমাখা জামা , একটা দড়ি , একটা প্যান্টি আর একটা রক্তমাখা রুমাল । এসব দেখেই পুরানো সব কথা মনে পড়ে গেলো নীলের । নীল মনে মনে ভাবলো, " এগুলো আজই কোথাও লুকিয়ে ফেলতেহবে "। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির কোণায় বাগানে মাটি খুঁড়ে সব চাপা দিয়েই আবার অফিসে চলে গেলো । সন্ধ্যা সাতটায় নন্দিনী আর স্বপ্নীল একসাথে অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে আসে । তারপর দুজনে মিলে অনেক গল্পগুজব করে রাতের ডিনার শেষ করে শুয়ে পড়ে । রাত ঠিক সাড়ে তিনটা নাগাদ নন্দিনী একটা কান্নার শব্দ শুনতে পায় । নন্দিনীর বুঝতে পারে এটা কোনো বাচ্চা মেয়ের কান্নার আওয়াজ । নন্দিনী খুব ভয় পেয়ে যায় । সাত তাড়াতাড়ি নীলকে ডেকে বলে , " নীল, নীল, এই নীল, কিগো..... " । " " কি হোলো আবার " বলে নীল ঝাঁঝিয়ে উঠলো । নন্দিনী বললো, " আমার মনে হোলো আমাদের ঘরে কোনো বাচ্চা মেয়ে কাঁদছে । " এই কথা শোনার পর নীল ঘেমে- নেয়ে মূর্ছা যাবার উপক্রম । নীল ঘরের আবছা আলোয় একটা বাচ্চা মেয়ের ছায়া দেখতে পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল । নন্দিনী চোখে-মুখে জলের ছিটা দেওয়ার পর নীলের জ্ঞান ফেরে । সেদিন রাতটা কোনোরকমে কেটে যায় । পরদিন সকালে দুজনেই অফিস যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে সেসময় আবার সেই বাচ্চা মেয়ের কান্নার শব্দ । দুজনের তো ভয়েই কাবু , বিশেষ করে নীল । যাইহোক কোনোরকমে তৈরী হয়ে দুজনেই অফিস বেরিয়ে যায় । সন্ধ্যার পর দুজনেই একসাথে অফিস থেকে ফিরে আসে । রাতের ডিনার শেষ করে নীল আর নন্দিনী শুয়ে পড়ে । রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আবার সেই কলিংবেলের শব্দ । নীল এবার এতোটাই ভয় পেয়ে যায় যে দরজা খুলতে সাহস পায় না, তাও নন্দিনীর জোরাজুরিতে দরজা খোলে । আবার দরজার সামনে সেই সুটকেসটাই রাখা । নীল মনে মনে ভাবে, " আরে আমিতো সুটকেসটা বাগানে মাটির নিচে পুঁতে দিয়েছিলাম, তাহলে এটা আবার এখানে এলো কি করে ? " নন্দিনীও ভয় পেয়ে চুপ করে থাকে । দুজনেই চুপ করে বসেছিল হঠাৎ নন্দিনী বলে ওঠে, " আমি সুটকেসটা খুলে দেখি কি আছেএতে ? " নীল বলে, " না না থাক্ খুলতে হবে না । " কিন্তু নীলের কোনো কথা না শুনে নন্দিনী জোর করে সুটকেসটা খোলে । নন্দিনী সুটকেসটা খুলতেই অবাক হয়ে যায়, একটা বাচ্চা মেয়ের রক্তমাখা জামাকাপড় দেখে । " সেকি এগুলো এলো কোথা থেকে? কে পাঠালো? নীল কী ব্যাপার বলোতো? "বলতে বলতে নন্দিনী উঠে দাঁড়ায় । হঠাৎ নীল দ্যাখে সুটকেসের সেই রক্তমাখা জামা পড়ে সেই বাচ্চামেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে । নীলকে ভয়ে কাঁপতে দেখে নন্দিনী পিছন ঘুরতেই মেয়েটিকে দেখে ভয়ে সঙ্গা হারায় । দিনের পর দিন কখনো দিনের বেলা , কখনো রাতের বেলা , কখনো বেডরুমে, কখনো রান্নাঘরে সবসময় মেয়েটিকে দেখতে পেত স্বপ্নীল ও নন্দিনী । এইসময় নন্দিনী ছিল দুমাসের অন্তস্বঃত্তা । এইসব ভয়াবহ ঘটনা চলাকালীন নন্দিনী পড়ে গিয়ে গর্ভপাত ঘটে । প্রচন্ডভাবে আতঙ্কিত হয়ে নন্দিনী নিজের মাকে সব ঘটনা খুলে বলে । একজন Paranormal Researcher এর পরামর্শে একদিন রাতে বাচ্চা মেয়েটির আত্মার সাথে সংযোগ স্থাপন করা হয়। মেয়েটির এভাবে আসা আর ভয় দেখানোর কথা জিজ্ঞেস করায় মেয়েটি তর্জনী দ্বারা নীলের দিকে ইশারা করে । নীলের উপর চাপ সৃষ্টি করায় নীল অতীতের ঘটনা সব খুলে বলতে শুরু করে ।
মেয়েটির নাম ফুলি । নীলদের বাড়িতে কাজ করতো মালতী মাসি, ফুলি ঐ মালতী মাসির বাপ - মা মরা একমাত্র নাতনি । বছর সাত - আটের মেয়ে ফুলি বাড়ির কাছে একটি অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পড়তো । সকাল দশটায় স্কুল ছুটির পর নীলদের বাড়িতে ঠাকুমার কাছে চলে আসতো । মালতী মাসি সব বাড়ির কাজ শেষ করে ফুলিকে বাড়িতে নিয়ে যেত । সেদিন ছিল শনিবার , নীলের কলেজ হাফ ডে তাই দুপুরেই বাড়িতে ফিরে আসে । নীল বাড়িতে ফিরে আসার পর নীলের বাবা-মা একটু বেরোয় কয়েক ঘন্টার জন্য । ফুলি তখন ঘরের এক কোণায় বসে পুতুল নিয়ে খেলছে । ছোট মেয়ে তাই জামাকাপড় ঠিক আছে কিনা খেয়াল নেই , খেলায় মত্ত । সেদিন কলেজে নীলের বন্ধুদের মধ্যে যৌনতা সংক্রান্ত আলোচনা হয়েছিল, কাজেই ছোট্ট ফুলির শরীরের প্রতি তার বিকৃত কাম জেগে ওঠে । চকোলেট আর পুতুল কিনে দেবার লোভ দেখিয়ে ঐ ছোট্ট শরীরটার ওপর নিজের যৌন লালসা মেটায় । তখন যেন সে এক অন্য নীল , কি করছে, কেন করছে কিছুই তার মাথায় নেই । এদিকে রক্তাক্ত ফুলি অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে কিন্তু চীৎকার করতে পারছে না কারণ, হাতদুটো খাটের সাথে বাঁধা আর মুখে পরনের প্যান্টিটা ঠেসে গোঁজা । সম্বিৎ ফিরতেই নীল বুঝতে পারে কি ভুল সে করেছে । রক্তাক্ত ফুলিকে কোথায় লুকাবে , যদি ফুলি কাউকে বলে দেয় তাহলে কি হবে এই ভেবে নীল ফুলিকে গলা টিপে মেরে বস্তায় মুড়িয়ে গাড়িতে করে নিয়ে বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটা পুকুরে ফেলে দেয় । আর ফুলির জামাকাপড় একটা সুটকেসে ভরে ঐ পুকুরেই ফেলে বাড়িতে ফিরে আসে । ফুলির ঠাকুমা নাতনির খোঁজ করলে নীল বলে, " আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম দেখিনি ফুলি কোথায় গেছে । অনেক খোঁজ করে কয়েকদিন পর ফুলির দেহ উদ্ধার হয় । পরে ধীরে ধীরে সব ঝামেলা মিটে যায় । এই ঘটনার পর আট বছর কেটে গেছে । নীল ঘুণাক্ষরেও কোনোদিন কাউকে এই ঘটনা জানায় নি । হয়তো কেউ কোনোদিন জানতেই পারতো না যদি না ফুলির অতৃপ্ত আত্মার প্রকাশ ঘটতো । নীলের স্ত্রী নন্দিনী গর্ভবতী হওয়ার পরেই ফুলির অতৃপ্ত আত্মা প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে ফিরে আসে ।
নীলের মুখে সব শুনে নন্দিনী নিজেই পুলিশ ডেকে সব জানায় এবং নীলের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় । আদালতের রায়ে শিশু ধর্ষণ , হত্যা ও মৃতদেহ লোপাটের জন্য নীলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যায় । কিন্তু ফুলির অতৃপ্ত আত্মা কারাগারেও নীলকে প্রত্যহ নানা ভাবে ভয় দেখাতে থাকে । কারাবাসের ছয় মাসের মাথায় প্রায় উন্মাদগ্রস্ত হয়ে নীল আত্মহত্যা করে । ফুলির আত্মার প্রতিশোধ স্পৃহার ও নিরসন হয় ।

