Sayandipa সায়নদীপা

Abstract

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Abstract

সত্তা

সত্তা

6 mins
620


#দৃশ্য - ১


 টেবিলল্যাম্পের সুইচটাকে ক্রমাগত অন অফ করে চলেছে শোভন। আলোটা জ্বলে উঠলেই এই মরচে পড়ে যাওয়া টেবিলল্যাম্পটা কোমর বাঁকিয়ে শোভনেরর রোগা শরীরের সাথে সম্পর্ক বেঁধে এক অদ্ভুত প্রতিকৃতি তৈরি করছে দেওয়াল জুড়ে, ঠিক যেন একটা হায়েনা হাঁ করে গিলতে যাচ্ছে কাউকে। 

আচমকা নিরূপা দেবী ঘরে ঢুকে দ্রুত হাতে টিউব লাইটটা জ্বালাতেই উধাও হলো হায়েনাটা।

“অন্ধকারে কি করছিস!” তাঁর গলায় অগাধ বিস্ময়, “তোর এক বান্ধবী এসেছে, কি যেন নাম বললো, দিতিপ্রিয়া না কি যেন! যাইহোক, পাঠিয়ে দিচ্ছি তোর ঘরে!”

দিতিপ্রিয়া! কেন! শোভন জানে সামনে পেছনে অনেকেই ওর রূপমুগ্ধ, তার ওপর এই “রোম্যান্টিক রাইটার” ট্যাগটার সৌজন্যেও কিছুটা হলেও ইউনিভার্সিটির অনেক মেয়েকেই ওর অনুরক্ত করে তুলেছে; দিতিপ্রিয়াও তাদেরই একজন, হয়তো বা তাদের চেয়েও কয়েক কদম এগিয়ে। আর তাইতো আজ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চলে এসেছে মেয়েটা। 


  “মাই গড! কি অবস্থা করেছিস নিজের!” ঘরে ঢুকেই কৃত্রিম আর্তনাদ করে উঠলো দিতিপ্রিয়া। শোভন কোনো উত্তর দিলো না। 

“শোভন তুই করছিসটা কি নিজের সাথে?” খাটে বসতে বসতে বললো মেয়েটা। 

শুষ্ক গলায় শোভন উত্তর দিলো, “কিছু না।”

“বললেই হলো? তোর অবস্থা দেখ একবার। কার জন্য এরকম করছিস! সে কি ফিরবে এভাবে? বরং যারা তোর কাছে আছে, যারা তোর সাথে আছে তাদের কথা ভাব একবার।”

“তোর কি কোনো দরকার ছিলো?” সোজাসুজি জিজ্ঞেস করে বসল শোভন। 

খানিকটা দমে গেল দিতিপ্রিয়া, “হ্যাঁ, মানে… এই ম্যাগাজিনটা দেখ। আমার মামা বের করেন এটা; এর পুজোসংখ্যার জন্য তোকে কিন্তু একটা লেখা দিতে হবে।”

“পসিবল নয়।”

“হোয়াট! এসব কিন্তু আমি শুনবোনা। আমি মামাকে কথা দিয়ে দিয়েছি, একটা প্রেমের গল্প দিতেই হবে ব্যাস।”

“কেন কথা দিলি? আমি এখন মেন্টালি…”

“প্লিজ শোভন, যে হারিয়ে গেছে তার জন্য কতদিন শোক পালন করবি? ইউ হ্যাভ টু মুভ অন। দেখ আমার মনে হয় লোকাল লোকেরা যা বলছে ওটাই ঠিক, ও সেলফি নিতে গিয়েই… প্লিজ ইয়ার, আমি জানি তুই মিহিকাকে কতটা ভালোবাসতিস বাট... লাইফটা অনেক বড়, কে জানে কেউ হয়তো তোর আশেপাশেই আছে যে তোকে মিহিকার থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসে!”

“রেখে যা, আমি চেষ্টা করে দেখবো। এখন আমি একটু একা থাকতে চাই রে।”

“ওকে ওকে।” বিদায় জানিয়ে চলে যায় দিতিপ্রিয়া, ওর রেখে যাওয়া ম্যাগাজিনটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শোভন।


#কারণ_যখন_গভীরে


“গল্পটা ভালো কিন্তু বাবু প্রথম আর তৃতীয় পর্বটা মনে হচ্ছে যেন একই পর্ব দুবার লেখা হয়ে গেছে। আর... কিছু মনে করিস না কিন্তু গল্পে আত্মহত্যার পেছনে যে মোটিভটা দিচ্ছিস সেটাও না ঠিক যেন জোরদার নয়, মানে, একজন এই কারণে সুইসাইড করলো…!”

“মিহি”

“হুম?”

“কেসটা কি বলতো?"

"মানে?"

" আজকাল মনে হয় যেন আমার লেখার মধ্যে খুঁত ধরে এক বন্য আনন্দ পাস!”

“কিসব বলছিস শোভন, আনন্দ কেন পেতে যাবো? আমি তো… দেখ দোষত্রুটি গুলো না ধরিয়ে দিলে কি করে লেখাটা নিখুঁত হবে বল?”

“এই রাখ তো এসব, আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছিস? আসলে তুই জেলাস। আমার এতো পপুলারিটি মেনে নিতে পারছিসনা, ইনফিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগছিস। ”

“তুই কি পাগল হলি? তোর সাফল্যে আমি জেলাস হবো! বাবু আমাকে ভুল বুঝছিস তুই; আমি চাই তোর সাফল্যটা ফেসবুকের মলাট পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ুক আরও। একজন লেখক হয়ে সমালোচনা নিতে পারবিনা এ কেমন কথা!”

“এই শোন আমি যার তার থেকে সমালোচনা শুনতে রাজি নই। লেখালিখির তুই কি বুঝিস রে? কখনো ছোটো একটা দশ লাইনেরও কিছু অন্তঃত লিখে দেখা তো মেনে নেবো তোর কথা।”


  বাড়ি ফিরে আসে মিহিকা, একটা বড় পাথর যেন চেপে বসে আছে তার বুকে। অন্তর্মুখী হওয়ার বড্ড জ্বালা, না নিজের কথা ঠিক করে কাউকে বোঝানো যায় না অন্য কেউ খারাপ কিছু বললে সেটা মেনে নেওয়া যায়। মিহিকার আজকের কষ্টটা হয়তো আরও অনেক বেশি তীব্র কারণ আজ যে মানুষটা তাকে অপমান করলো তার নামটা যে শোভন, যে মানুষটাকে মিহিকা মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। 


  নিজের রুমে এসে চাবি ঘুরিয়ে একটা নির্দিষ্ট কাবার্ড খোলে মিহিকা। কাবার্ডের পাল্লাটা সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেআব্রু হয়ে পড়ল থরে থরে সাজানো প্রায় খান কুড়ি ডায়েরী। ওদের গায়ে একবার আলতো করে হাত বুলিয়ে নিল মিহিকা। লেখালিখির অভ্যেসটা ওর সেই কোন ছোটবেলাতে শুরু, যখন থেকে বোধহয় খাতায় বাক্য গঠন করতে শিখেছে। পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে স্থায়ীও হয়েছিল ওর বহু লেখা, সব মূলত ভৌতিক অলৌকিক গল্প। কিন্তু বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই পাল্টে যায়। মিহিকার কল্পনাগুলোও তাই ওর মতোই অন্তর্মুখী হয়ে লুকিয়ে পড়ে ডায়েরীর পাতায়, জনসমক্ষে আসতে বড়ই লজ্জা পেতে শুরু করে তারা, আত্মবিশ্বাসের অভাব হয়তো থাবা দিয়ে বসে তাদের বুকে। ডায়েরীগুলোর দিকে তাকিয়ে জোরে একটা নিশ্বাস নেয় মিহিকা। শোভনের বলা শব্দগুলো এখন যেন কান থেকে নেমে এসেছে বুকে, হাতুড়ির মতো ধাক্কা মারছে ওর আত্মসম্মানে। একটা লাল ভেলভেট কভার দেওয়া ডায়েরী নামিয়ে নেয় মিহিকা…


  “বস তোদের কর্তা গিন্নিকে সেলাম।” এম.ফিল স্কলার রূপমদার কথায় থমকে দাঁড়ায় শোভন।

“মানে?”

“সিরিয়াসলি তোর মিহিকা তো ছুপা রুস্তম রে। ওরকম শান্ত মেয়েটা যে এরকম বোম ব্লাস্টিং লেখা লিখতে পারে আমাদের তো ধারণাও ছিলোনা।” বলে ওঠে কেয়াদি।

“তোমরা কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা!”

“আরে “নব সাহিত্যিকের খোঁজে” এর জন্য মিহিকা যে লেখাটা দিয়েছে... উফফ… মাই গড… ইটস আউটস্ট্যান্ডিং ব্রো। বহুদিন অমন হাড়হিম করা ভুতের গল্প পড়িনি। আমার বিশ্বাস ইউনিভার্সিটি থেকে ওর লেখাটাই কম্পিটিশনের জন্য সিলেক্ট হবে দেখিস।”

“আর আমার “ভালোবাসার একদিন”?”

রুপম আর কেয়া পরস্পরের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নেয়; তারপর ঢোঁক গিলে রুপম বলে, “দেখ ভাই তুই ভালো লিখিস সে সবাই জানে, ডিপার্টমেন্টাল ম্যাগাজিনে তোর লেখাকে স্যারেরা কতো প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু এবার… আসলে বি.এম স্যার বললেন তোর লেখাটায় একটু ভ্যারিয়েশন থাকলে ভালো হতো। কম্পিটিশনের জন্য একটু কিছু হটকে চাই তাই না?”

“মিহিকা ইজ সুপার্ব শোভন, ইউ শুড বি প্রাউড অফ হার।” এই বলে চলে যায় রুপমদা আর কেয়াদি। শোভন একলা দাঁড়িয়ে থাকে করিডোরে, ওর মাথা থেকে শুরু করে সারা শরীরটা যেন জ্বলে ওঠে মুহূর্তে। শেষমেষ মিহিকা!


#দৃশ্য - ২


“দেখতে দেখতে সময় কেমন পেরিয়ে যায়, আমাদের ট্যুরে গিয়ে মিহিকার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পুরো তিনমাস হয়ে গেল আজ। আর কদিন পরেই তো পুজো, কোথায় আছে মেয়েটা কে জানে! আদৌ আছে কিনা…” দীর্ঘশ্বাস ফেললো আকাশ।

“শোভন বলছি যে ঘরে এরকম তিন তিনটে আলো জ্বেলে রাখার কি কোনো দরকার আছে! বড্ড চোখে লাগছে রে, আর ইলেক্ট্রিসিটিও তো বেকার বেকার নষ্ট হচ্ছে…” এই বলে দিতিপ্রিয়া উঠে দাঁড়ালো হয়তো এক আধটা আলো বন্ধ করার উদ্দেশ্যে; কিন্তু খাটের এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা শোভন সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠলো, “না… খবরদার না, বন্ধ করবিনা…”

“কেন!”

“ক্ক… কিছুনা, কিছুনা। বসে পড় বলছি, বন্ধ করবিনা।” হতবাক হয়ে আবার বসে পড়ল দিতিপ্রিয়া। এবার আচমকা গম্ভীর হয়ে ওঠা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আকাশ বলে উঠলো, “ভাই তুই এরকম হরর স্টোরি লিখতে পারিস আমাদের তো ধারণাতেই ছিলনা। তুই আমাদের দ্য গ্রেট রোম্যান্টিক রাইটার থেকে এরকম হরর এক্সপার্ট হয়ে গেলি কি করে রে! প্রিয়ার কাছে ম্যাগাজিনটা নিয়ে পড়তে পড়তে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, পুরো মিহিকার মত…” বেফাঁস কথাটা বলতে গিয়েও থমকে গেল আকাশ, সামলে নিলো নিজেকে।


  আবহাওয়াটা কেমন যেন গুমোট হয়ে উঠেছে। খাট থেকে উঠে দিতিপ্রিয়া এগিয়ে গেল শোভনের টেবিলের দিকে। ওটার ওপর রাখা একটা চকচকে মলাটের বই, একটি নামি পত্রিকার পুজোসংখ্যা। অনেকটা যেন প্রতিবর্ত ক্রিয়ার বশেই বইটা উঠে এলো ওর হাতে, প্রচ্ছদটা ওল্টাতেই বেরিয়ে পড়লো সূচীপত্র যার লেখক তালিকায় বড় বড় করে লেখা শোভন ও তার গল্পের নাম, গল্পের পাশে লেখা রয়েছে গল্পের বিভাগ, “গা ছমছমে ভৌতিক গল্প”। সূচীপত্রে নির্দেশ করা নম্বর অনুযায়ী নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায় পৌঁছে গেল দিতিপ্রিয়া। রোম্যান্টিক রাইটার বলে ইউনিভার্সিটি এবং ফেসবুকে খ্যাত শোভনের ভৌতিক গল্পের প্রথম দুটো পরিচ্ছদ পড়েই কেঁপে উঠলো সে; নাহ ঠিক ভয়ে নয়, অন্যরকম একটা শিহরণ শুরু হয়েছে তার শরীরে...


  আকাশও কখন যেন নিজের বেফাঁস মন্তব্যের অস্বস্তি কাটতে উঠে এসে অন্যমনস্কভাবে তুলে নিয়েছিল শোভনের লেখার ডায়েরী। বিগত তিনমাসে লেখা প্রায় খান দশেক ভুতের গল্পের ওপর চোখ বুলিয়ে ওর শরীরেও আস্তে আস্তে জেগে উঠলো দিতিপ্রিয়ার মতো সেই একই রকমের এক শিহরণ। দ্রুত পায়ে দুজনেই বেরিয়ে এলো শোভনের বাড়ি থেকে, “মিহিকাকে ছেলেটা বড্ড ভালোবাসতো রে, তাই তো ওর নিখোঁজ হওয়ায় এমন মেন্টাল শক পেয়েছে যে এখন হুবহু মিহিকার মতো লেখা শুরু করে দিয়েছে, সেই ওর মতোই ভুতের গল্প, লেখনীর ধাঁচও হুবহু এক…”

“যেন মিহিকার লেখক সত্তা এসে ভর করেছে ওর কলমে...!”

“এক্সাটলি… আর ছেলেটা কেমন যেন হয়েও গেছে তাই না?”

“হুমম। চল তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই।”


#শেষ_দৃশ্য ...


খাটের কোণে গুটিসুটি হয়ে বসেছিল শোভন। হঠাৎ দপ দপ করতে করতে নিভে গেল ওর রুমে জ্বলতে থাকা তিনটে আলো, নেমে এলো একটা নীলাভ অন্ধকার... সেই অন্ধকার ভেদ করে শোভনের মনে হল যেন ওর খাটের পাশের দেওয়াল আর মেঝেটা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, পরিবর্তে খাটের পাশ থেকেই যেন সৃষ্টি হচ্ছে এক গভীর খাদ। আর শোভন বিক্ষিপ্তভাবে বসে রয়েছে তার কিনারে, ঠিক যেমন মিহিকা বসেছিল সেইদিন। একটা ছায়ামূর্তি আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ওর দিকে… চিৎকার করে উঠলো শোভন, 

“না… না… বিশ্বাস কর…আমি ইচ্ছে করে করিনি… ভাবিনি তুই পড়ে যাবি… তোর গল্পটা রাজ্যেও ফার্স্ট হয়েছে শুনে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি… রাগের মাথায়… প্লিজ আমায় ছেড়ে দে… প্লিজ… নাআআআআ…”


  ছেলের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নিরূপা দেবী, তারপর ধীর পায়ে সরে এসে মোবাইলে ডায়াল করলেন সাইকোলজিস্ট শ্রীজাতা বসুর নম্বর, “হ্যালো ম্যাডাম আজ আবার ছেলেটা…”


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract