সন্ধ্যাআরতি
সন্ধ্যাআরতি
সন্ধ্যাআরতি
মিনাদেবী ভোরবেলা গঙ্গাস্নানে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনই না,আজ কি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা যায়! কত গল্প তার জমে আছে,কত খুশি প্রাণে আজ,রাতে ভালো করে ঘুমই তো এল না,কখন রাত পোহাবে সেই জন্য তীব্র ছটফটানি,সবাইকে বলতে হবে না তার আনন্দের কথা, খুশির কথা! সঙ্গী সাথীরা সবাই এসে হাজির হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন মিনাদেবী গঙ্গার ঘাটে। ওরা পাঁচজন বৃদ্ধা এই গঙ্গা ঘাটে আসা যাওয়া করতে করতেই বড্ড ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছেন,বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে নিজেদের মধ্যে,কত প্রাণের কথা আদান-প্রদান হয় এই গঙ্গাস্নানের অছিলায়। আনন্দে,দুঃখে,অসুস্থতায় এরাই যেন বড় আপনজন হয়ে উঠেছে মিনাদেবীর। বাড়িতে আজকাল সবাই ব্যস্ত, যে যার মত ছুটছে দিনরাত,তার জন্য আর কারই বা সময় আছে,তবু এত ব্যস্ততার মধ্যেও যে ছেলে মায়ের কথা এমনভাবে ভেবেছে তাই মা আজ খুশিতে ডগমগ।
কমলা,বাণী,মন্দিরা,সুধা ও মিনা পাঁচ বন্ধু এখন একেবারে হরিহর আত্মা,একদিন কেউ না এলে বাকিরা অস্থির হয়ে পড়ে। সবাই এসে হাজির হলে মিনাদেবী বলেন, "তোদের আজ আমি এমন একখানা খবর দেব না যে তোরা চমকে যাবি "। বাকিরা মিনাদেবীর খুশিতে ঝলমল মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে খুশির খবর শুনবে বলে, মিনাদেবী বলেন,"চল আগে চান টা সেরে মহাদেবের মাথায় জল ঢেলে নিই তারপর জমিয়ে বলা যাবে"।
স্নান সেরে মহাদেবের মাথায় জল ঢালার সময় মিনাদেবী বারবার মাথা ঠুকে প্রণাম করতে লাগলেন ঠাকুরের সামনে তার মনস্কামনা পূর্ণ করার জন্য। সঙ্গীরা এবার আর ধৈর্য রাখতে পারে না," হল তোর পুজো,বল তোর খুশির খবর"। ফলাও করে বলতে শুরু করেন তিনি তার গুণধর পুত্রের মাকে ভালোবাসার কথা,"এতদিন কত ভুল বুঝেছি রে আমার ছেলেকে,তোদের কাছে তো কতই বলেছি সেসব কথা,কতই না দুঃখ করেছি। ছেলে আমাকে বেনারসের গঙ্গায় স্নান করাতে নিয়ে যাচ্ছে রে,বাবা বিশ্বনাথের মাথায় জল ঢালতে নিয়ে যাচ্ছে,এমন খুশির কথা তোদের মত বন্ধুদের না বলতে পারলে যে আমার ভীষণ অস্থির লাগছিল"। সাথে ছেলের গুণকীর্তন করেন ও বলেন,"আমি জানতাম ছেলে আমার খুবই ভাল,কেবল সময় পায়না তাই,আর তাই তো মা গঙ্গা স্নান করতে ভালোবাসে বলে মাকে নিয়ে যাচ্ছে বেনারসের গঙ্গা দর্শন করাতে"। আনন্দ করে বন্ধুদের বলেন মিনাদেবী,"তোদের সবার জন্য বেনারসের বিখ্যাত পানমশলা নিয়ে আসব"। বন্ধুরা একবাক্যে বলল সবাই, "কপাল করে ছেলে পেয়েছিস,আমাদের কপালে আর কোনোদিনই শিকে ছিঁড়বে না"।
নির্দিষ্ট দিনে যাত্রা হল শুরু। ছেলে,বউমা,নাতি সবার সাথে এই প্রথমবার বেড়াতে যাওয়া,তাও আবার তার নিজের পছন্দের জায়গায়। ছেলে মাকে বলে,"বেশি করে জামা-কাপড় নিও সঙ্গে,কোথাও তো যাওয়া হয় না,পরাও হয় না ভালো কাপড়গুলো তাই বলছি"। মায়ের জন্য আলাদা একটা ব্যাগও দিয়েছিল জামাকাপড়, নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেবার জন্য। এত সুখও কি ছিল তার কপালে! বারবার ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকাতে লাগলেন তিনি। বেনারসে পৌঁছে ঘোরা,বেড়ানো দেব দর্শন সবই ভালো হল। চারদিন পর পঞ্চমদিন সন্ধ্যায় দশাশ্বমেধ ঘাটে সন্ধ্যা আরতি দেখার সময় মিনাদেবী ভক্তিপূর্ণ চিত্তে জোড়হাতে আরতি দেখছিলেন আর বারবার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন তার এমন সৌভাগ্যের জন্য,ছেলের,পরিবারের সকলের মঙ্গল কামনা করছিলেন,সেই সময় ছেলে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,"মা তুমি আরতি দেখো,আমরা একটু কেনাকাটা করে আসি "। মিনাদেবী মাথা নেড়ে সম্মতি জানান, তিনি তখন বিভোর হয়ে আরতি দেখছিলেন। সময়মতো আরতি শেষ হলে মিনাদেবী ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। গঙ্গার ঘাট ফাঁকা হতে হতে ক্রমে জনশূন্য হয়ে পড়লে মিনাদেবী ভীত হয়ে পড়লেন, এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন সন্ত্রস্ত হয়ে। কোথায় ছেলে,কোথায় বউ,কোথায় বা নাতি। ছেলে যে ততক্ষনে হোটেল থেকে লাগেজ নিয়ে বিল মিটিয়ে ট্রেন ধরেছে হাওড়ার উদ্দেশ্যে।
মিনাদেবী পায়ে পায়ে গঙ্গার ঘাট থেকে উঠে এলেন রাস্তায়। কিছু বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছেন ততক্ষণে। দুচোখ দিয়ে তার অবিরাম জলের ধারা, একটাই সন্তান তার, আর যে কেউ নেই, কার কাছেই বা যাবেন, কোথায় থাকবেন। কিছুটা হলেও বোধহয় পুণ্য তিনি অর্জন করেছিলেন আর তাই হঠাৎই এক পরিচিত মুখ সুমন সামনে এসে দাঁড়ায়। "মাসিমা না? বিমলের মা তো?" " হ্যাঁ বাবা",বলে চোখ মুছলেন মিনাদেবী। "কি হয়েছে মাসিমা? চোখে জল কেন? কার সঙ্গে এসেছেন?" মিনাদেবীর মুখে সব শুনে বুঝতে কিছু বাকি রইল না সুমনের, সঙ্গে করে নিয়ে গেল যে হোটেলে সে তার মা ও পরিবার নিয়ে উঠেছে।
মায়ের কাছে মিনাদেবীকে রেখে যে হোটেলে মিনাদেবী ছেলের সাথে উঠেছিলেন,ওনার কাছে সে হোটেলের নাম জেনে নিয়ে সেখানে গেলে জানতে পারলেন তারা একটা লাগেজ ফেলে গেছে তাতে মিনাদেবীর নাম লেখা। সুমন বুঝল এটা ইচ্ছাকৃত এরপর মিনাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে এসে হোটেল থেকে তার ব্যাগ নিয়ে গেল।
কলকাতায় ফিরে মিনাদেবীকে নিয়ে সুমন উঠল তার নিজের বাড়ি, পাড়ার ক্লাবে যোগাযোগ করে সব জানালে পাড়ায় মিটিং হয় ও সেখানে বিমলকে ডেকে শাসানো হয়, জানানো হয় সেখানে ভবিষ্যতে মিনাদেবীর ওপর কোনো রকম মানসিক অত্যাচার হলে আইনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিমল বাধ্য হয়ে মাকে ঘরে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু মিনাদেবী আর ফিরতে চান না, তিনি এবার স্ব-ইচ্ছায় কাশীবাসী হতে চান।
ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল। দূর থেকে আরতির কাঁসর-ঘন্টাধ্বনি শুনে পায়ে পায়ে বার হলেন মিনাদেবী দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে,যেখানে একদিন তিনি পরিত্যক্ত হয়েছিলেন।