সমর্পণ
সমর্পণ
‘তৃষা কেমন আছো?’ হঠাৎ করে এতবছর পর রাজীবের চেনা কন্ঠস্বরে চমকে ওঠে তৃষা। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে ‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? এতদিন পরে কি মনে করে ফোন করলে?’ রাজীব তৃষার কথার কোন উত্তর না দিয়ে শুধু বলে ‘আমি দুর্গাপুূজাতে দেশে ফিরছি। ভালো থেকো।
ছোটবেলা থেকেই তৃষা ও রাজীব একসঙ্গে বড় হয়েছে। দুই পরিবারের অভিভাবকরা ওদের বিয়েটা ওরা যৌবনে পর্দাপন করতেই নিজেদের মধ্যে একপ্রকার ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু সেই কথা রাজীবের বাবা-মা তাকে জানাতেই সে বলল ‘আমি একটা ভাল চাকরী পেয়েছি আমেরিকায়, প্রথম তিন বছর বাড়ি আসতে পারবনা। আর তৃষার সাথে বড় হয়েছি বলেই যে ওকে বিয়ে করব এরকম ভাববার কোন কারণ নেই। আমার ওকে ভালোলাগে কিন্তু আমি ওকে ভালবাসি না।।
রাজীবের মা, তৃষার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন ছেলের উত্তরের জন্য আর তৃষার হাত দুটি ধরে বলেছিলেন ‘আমি জানি তুই ওকে সত্যি ভালোবাসিস আর তোর এই ভালোবাসাই ওকে একদিন তোর কাছে ফিরিয়ে আনবে।’ তৃষা বলেছিল ‘সোনা জ্যেঠি তুমি চিন্তা কোরো না আমি সেইদিনটার জন্য অপেক্ষা করব কারণ কাউকে ভালবাসলে তাকে না পেলেও সারাটা জীবন কাটানো সম্ভব। কিন্তু শুধু ভাললাগা ও কর্তব্যবোধের সাহায্যে কারো সাথে সারাজীবন কাটানো সম্ভব নয়। তাই আমিও চাইনা কোনো চাপে পড়ে রাজীব দা আমাকে বিয়ে করুক।’
আর সেইদিন থেকেই শুরু হয়েছিল রাজীবের জন্য তৃষার অপেক্ষা। বিগত তিন বছর ধরে রাজীব দেশে আসতে পারেনি চাকরীর শর্তানুযায়ী। এই তিন বছরে শত কষ্ট হলেও তৃষা তার মনের কাছে তার অপেক্ষাকে কিছুতেই হার মানতে দেয়নি। কিন্তু আজ একি হল তার! রাজীবের ফোন আসার পর থেকেই তার অপেক্ষার বাঁধ যেন নিমেষে ভেঙে যেতে বসেছে।
গত তিন বছরেও প্রকৃতির নিজের নিয়মেই ঋতু পরিবর্তিত হয়েছে। তিনটে শরৎকাল কেটেছে তৃষার রাজীবকে ছাড়া। তাই হয়ত সেই শরৎকাল এত ভালোলাগেনি তৃষার।
সারা বাড়িতে সাজসাজ রব। একদিকে দুর্গাপূজা অন্যদিকে তিনবছর পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরছে। দেখতে দেখতে একমাস পর ষষ্ঠীর দিন সকালে এসে উপস্থিত হল রাজীব। ছেলেকে এতদিন পর কাছে পেয়ে সবাই ভীষণ খুশি। দরজার আড়াল থেকে সব দেখল তৃষা। তার চোখ এড়াল না রাজীবের সন্ধানী দৃষ্টি। রাজীব সকলের জন্য নিয়ে আসা উপহারগুলি একে একে নিজের হাতে তাদের দিল। হঠাৎ করে তার নজর পড়ল দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা তৃষার দিকে, বলল ‘তৃষা তোমার উপহার গুলি অন্য ব্যাগে আছে একটু আমার ঘরে এসে সেগুলো নিয়ে যাও।’এই বলে রাজীব নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল আর তাকে অনুসরণ করে রাজীবের ঘরে পৌঁছানোর পর রাজীব বলল ‘তুমি কি জানো আমি তোমার জন্য কি উপহার এনেছি?’ মাথা নাড়িয়ে তৃষা বলল ‘না।’ রাজীব বলল ‘তুমি আগে কথা দাও আমার দেওয়া উপহার তুমি স্বীকার করবে।’ তৃষা মনে মনে বলল ‘আমি যখন তোমাকে নিজের বলে মেনে নিয়েছি তখন তুমি যা দেবে সবই দুহাত পেতে নেব।’ মুখে শুধু বলল ‘হ্যাঁ’। ‘আমি নিজেকে তোমার কাছে সমর্পণ করতে চাই তৃষা। আমার হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা তোমাকে উজাড় করে দিতে চাই। তোমার কাছে থেকে বুঝতে পারিনি তোমাকেই আমি ভালোবাসি। কিন্তু তোমার থেকে এই তিন বছরের দূরত্ব আমাকে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে।’ প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল রাজীব। তৃষার দিকে তাকিয়ে দেখল, তার দুচোখ বেয়ে জল পড়লেও তার মুখটা শরতের মেঘমুক্ত আকাশের মত ঝলমল করছে।