উপহার
উপহার
অরুণিমা আর অর্ক্যর আজ বিয়ের সাত বছর পূর্ণ হবে।
পড়াশুনায় অরুণিমা খুবই ভালো ছিল বরাবর। ওদিকটায় মন দিতে গিয়ে প্রেমটা করে ওঠা হয়নি। তাই বাবা-মা ভরসা। তাঁরাই পছন্দ করে অর্ক্যর সাথে মেয়ের বিয়ে দেন।
অর্ক্য খুবই ভালো ছেলে মার্জিত, উচ্চশিক্ষিত, ভালো বংশ, ভালো চাকরী, চেহারা, কোন কিছুতেই ত্রুটি নেই। একটি বড় ফ্ল্যাটে তাদের দুজনের ছোটো সংসারটি বেশ ভালোই চলছিল।
বিয়ের পাঁচ বছর পর সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করে তারা ডাক্তারের কাছে গেল। কিছু টেস্ট করার পর ডাক্তার দত্ত একদিন ওদের দুজনকে নিজের চেম্বারে ডেকে বললেন ‘টেস্টের রিপোর্ট যে পুরোপুরি নগেটিভ তা বলব না। তবে অর্ক্যর একটি প্রবলেমের জন্য চান্স খুবই কম বলা যায়। তবে কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি—হোপ ফর দ্য বেস্ট। ’
এই ঘটনার পর প্রায় দুটি বছর কেটে গেছে। গত কয়েকদিন হল অরুণিমার শরীরটা ঠিক ভালো লাগছিল না। কিরকম যেন একটা ম্যাজম্যাজ করছিল, কিছু খেতে ইচ্ছা করছিলনা, অল্প মাথা ঘোরা ও গা বমি ভাব। অর্ক্য অফিসের কাজে পনের দিনের জন্য দিল্লি গিয়েছে। আজ তার ফেরার কথা। সে অর্ক্যকে কিছু জানায়নি অযথা চিন্তা করবে বলে। বাবা মাকেও বলেনি কিছু। গত পরশুদিন একজন ফিজিসিয়নের কাছে যায় অরুণিমা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন ‘ম্যাডাম লাস্ট মান্থের ডেট টা কি মিস করেছেন?’ অরুণিমা উত্তর দেয় ‘হ্যাঁ। ’ ডাক্তার বলেন ‘বেটার হবে আপনি একজন গাইন্যাকোলজিস্টের সাথে কনসাল্ট করুন। ’
এই কথা শুনে অরুণিমা ডাক্তার দত্তর কাছে যায় সেইদিনই। গতকাল ইউরিন টেস্টের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার দত্ত বললেন ‘অরুণিমা কন্গ্রাচুলেশন। রিপোর্ট পজিটিভ, তুমি কনসিভ করেছ। বাট্ যেহেতু কেস টা আলাদা তাই বাকী রিপোর্টগুলো হাতে আসা অবধি আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।’ সে জিজ্ঞাসা করল ‘বাকী রিপোর্টগুলি কবে আসবে স্যার ?’ ডাক্তার দত্ত বললেন ‘হোপফুলি কাল, ডোন্ট ওরি, আমি ফোন করে তোমায় জানিয়ে দেবো।’ অরুণিমা বাড়ী ফিরে এল এবং ঠিক করল ডাক্তার দত্তর ফোন না আসা অবধি কাউকে কিছুই জানাবেনা।
সে বসে বসে এইসব ভাবছে ঠিক এইসময় অর্ক্য ফিরে এল। অরুণিমা কে ডেকে বলল ‘একটু এদিকে এসো, দরকার আছে।’ অরুণিমা ভাবল আজকে ওদের বিবাহবার্ষিকী তাই হয়ত অর্ক্য ওর জন্য কোন উপহার এনেছে। কিন্তু সে গিয়ে দেখল অর্ক্যর হাতে একটা কাগজ। অর্ক্য বলল ‘অরু, আমি তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম আমি অফিসের কাজে বাইরে যাইনি।
আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা নেওয়ার জন্য তোমার থেকে দূরে যাওয়া দরকার মনে হয়েছিল তাই আর কি।’ একটু থেমে সে কাগজটা অরুণিমাকে দেখিয়ে বলল ‘আমি জানি তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুবই কষ্ট হবে তাই বলে তো আমি তোমার সারাজীবনটা নষ্ট করতে পারিনা। এইটা তোমার উপহার, তোমার খুশীর, তোমার জীবনের ছাড়পত্র। আমি সই করে দিয়েছি। তুমিও সই করে দিও এবং পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।’ এই বলে অর্ক্য বাথরুমের দিকে চলে গেল— হয়ত ফ্রেশ হতে, হয়ত বা অরুণিমার থেকে নিজের চোখের জল লুকাতে। অরুণিমাও কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকার পর সেখান থেকে চলে গেল। যাওয়ার আগে একটা কাগজে লিখে রেখে গেল ‘আমি মায়ের কাছে গেলাম,তুমি ভালো থেকো।’
অর্ক্য বাথরুম থেকে বেরিয়ে কাগজটা পড়ল। একা একা বসে ভাবতে লাগল তার জীবনে আগামী দিনে আসাএকাকীত্ব সর্ম্পকে। ঠিক এইসময় তার চারদিকের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বেজে উঠল ফোনের ঘন্টা। ফোনের ওদিক থেকে ভেসে এল অতি পরিচিত কন্ঠস্বর। অর্ক্য ফোনটা তুলে বলল ‘ডাক্তার দত্ত আমিও ভাবছিলাম আপনাকে ফোন করব। আমার আর ওষুধগুলোর প্রয়োজন হবে না।’ ডাক্তার দত্ত বললেন ‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। কন্গ্রাচুলেশন অর্ক্য, তুমি বাবা হতে চলেছ এন্ড এভরিথিং ইজ নরম্যাল। আমি অরুণিমাকে বলেছিলাম ফাইনাল রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত তোমাকে ও কাউকে কিছু না জানাতে কিন্তু এতবছর পর এই আনন্দের খবর কারুর পক্ষেই চেপে রাখা অসম্ভব। যাক্ ওষুধগুলো আর খেওনা। কালকে একবার অরুণিমাকে নিয়ে আমার চেম্বারে এসো। আগের ট্রিটমেন্ট শুরু করতে হবে। শুভরাত্রি।’
অর্ক্যর দুচোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ল। সে নিজের মনে বলল ছেলেদের দুঃখে নাহলেও আনন্দে তো কাঁদবার অধিকার আছে।
নিজের চোখের জল মুছে সে পৌঁছে গেল অরুণিমার বাড়ী। এত রাতে দরজা খুলে জামাইকে দেখে একটু অবাক হলেন অরুণিমার মা-বাবা। বললেন ‘অর্ক্য তুমি এত রাতে?’ অর্ক্য স্মিত হেসে বলল আমার বিবাহবার্ষিকীর এত বছরের সব থেকে ভালো উপহারটা আপনাদের মেয়ে নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছে সেটাই নিতে এলাম।’
অরুণিমা, অর্ক্যর গলার আওয়াজ শুনে অনেক আগেই দরজার আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্ক্যর সব কথা শুনে বুঝতে পারল যে ডাক্তার দত্তর ফোন এসেছিল এবং তিনিই খবরটা অর্ক্যকে জানিয়েছেন। সে দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তাকে দেখে অর্ক্য বলল ‘সব ঠিক আছে অরু, কালকে ডাক্তার দত্ত একবার যেতে বলেছেন তোমার ওষুধগুলো সব বুঝিয়ে দেবেন।’
অরুণিমা চোখে জল ও মুখে হাসি নিয়ে মাকে বলল ‘আমি মা হতে চলেছি।’