স্কন্ধ কাটার প্রতিশোধ
স্কন্ধ কাটার প্রতিশোধ
চক্রধরপুর গ্রামের উত্তর দিক বরাবর মহানালা,বিস্তীর্ণ পুব মাঠের জল বর্ষায় বৃষ্টির জলে ছাপিয়ে যখন এই নিকাশি নালা দিয়ে বহে যায় যেন মনে হয় ছোট নদী।পুব মাঠের বড় বড় মেঠো পুকুর বড়াল সাঁতারা,এঢ়র কেউটা, সাত আট একরের এক একটা মস্ত বড় জলা বর্ষার জলের সাথে নানান ধরনের মাছ ভেঁসে যায়, মানুষ যত না ধরতে পারে,বেশীরভাগই পাশের গ্রাম কুড়মুন জোলা নালা দিয়ে খড়ি নদীতে গিয়ে পড়ে ।
এই সব বড় বড় মেঠো পুকুরে কেউ মাছ চাষ করত না, প্রাকৃতিক ভাবেই মাছের ডিম ফুটে শোল,মাগুর কই সিঙ্গি ল্যাটা মাছে ভাদ্র আশ্বিনে ভরে থাকত।কিন্ত এই পুকুরের জল মুলত,রবিশয্যার চাষের কাজে জন্য লাগে। চারদিকে পুকুরের পাড়, আর সংলগ্ন জমিতে, আলু পেঁয়াজ কুমড়ো, শশা বেগুন টমেটো কত সব্জির চাষের জন্য সেচের জল এইসব পুকুরের জল ভরসা। ফাল্গুন চৈত্র মাসে সেচের কারনে পুকুরে জল তাই প্রায় শেষ হয়ে যায়।
বড়জোর পুকুরের মাঝে গভীর খাতে দশ বিশ কাঠা নিচু অংশে দেড় দুফুট জল অবশিষ্ট থাকে।আর যে বছর নিয়মিত কালবৈশাখী ঝড়জল হত না,বৈশাখের শেষ বা জৈষ্ঠ মাসে, এই সব পুকুরে জল থাকত না। পুকুরের মধ্য ভাগ যা বর্ষার সময় মানুষ ডুবে তলিয়ে যায়,সেই গভীর খাতের মাটি ফেটে চৌচির হত। তবে বিস্ময়কর ভাবে,পুকুরে শুখোনো জমির নিচে অনেক গভীরে ভিজে জমির খাল গর্তে সুপ্ত কাদা জলে কিছু মাছ বেঁচে থাকার জন্য, বর্ষার জল পুকুরের জমলেই ওরা ডিম ছাড়ত আর ভরা ভাদ্র আশ্বিন মাসে,মাছের যেন পুকুর ভরে যেত।
বাগ্দি ও দুলে পাড়া বৌ মেয়েরা তখন খালুই আর বড় ঝুড়ি সাদৃশ্য জাল নিয়ে মাছ ধরতে মেঠো আগাছা জঙ্গলে ভরা পুকুরের জলে নামত।মেঠো পুকুরের জল জঙ্গল বিষধর সাপের যেন রাজত্ব। তাই গ্রামে, বছরে দু একটা সর্পাঘাতে মৃত্যু নিশ্চিত ছিল । আর সর্প দর্শনের ঘটনা আকছাড় হত,তবে সে দংশন সব সময়ই বিষধর সাপের না, বা বিষধর হলেও বিষ সব সময়ই ঠিকঠাক ভাবে ঢালতে পারত না,তাই দুর্ভাগ্যের সর্পঘাতে মৃত্যু ঘটত কম।
মেঠো পুকুরে বা মহানালায় মাছ ধরা ছিল বর্ষার সময় ঝুঁকিপূর্ণ,কিন্তু গ্রামের মানুষ পাত্তাই দিত না। ফাগুন চোতে বরং জল কমলে, পুকুরের জল এক পাশে বাঁধ দিয়ে অন্য অংশ সেচে এসব পুকুরে মাছ ধরা ঝুঁকি থাকত না, আর সেই সময়ে মাছের সাইজে ও অনেক বড় হত।
কিছু মানুষ আবার তীক্ষ্ণ অনুমান আর অভিজ্ঞতায় , গ্রীষ্মের কাঠফাটা শুষ্ক পুকুরের তলদেশের মাটি খুঁড়ে বড় বড়, মাগুর জিওল মাছ ধরত। সে মজাই আলাদা।
চক্রধরপুরে গগন খুড়োর বাড়িটি ছিল ঠিক এই মহানালার দক্ষিণ ধারে। শেষ বর্ষা আর শরতে তাই দিনের বেলা জাল ছুড়ে এই নালার মাছ ধরত সারাটা দিন সময় পেলেই হল, তার এ কমাস বাড়ির মাছের চাহিদা মিটেও যেত। কিন্তু তার সমস্যা হত রাতে, বর্ষার জল যখন নালা ভরে বইত, মাছের সাথে বিষধর সাপের আনাগোনা বাড়ত, আর জাতসাপ বা বিষধর সাপের রাতে উপদ্রব বেশী।কখন কখনও বাড়ীর ভিতর ঢুকে আসত, ঘরের ভিতর ঠাকুরের জমা ফুল পুষ্পের আবর্জনা এমন কী তক্তাপোষের নিচে তাদের দেখা মাঝে মধ্যেই মিলত।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হতো, শীত গ্রীষ্মের সময়ে এই মহানালা শূখিয়ে যেত,তার বাড়ির সংলগ্ন চক্রবর্তী পুকুর ,ছোট গড়ের পাড়ের বাঁশ পাতা আর শিরীস শিমুল,বেল তেঁতুল গাছের খসে পড়া শুখনো পাতায় এই নালা ভরে যেত। রাতে এই নালা বরাবর কোন ভারী জিনিস টেনে টেনে নিয়ে গেলে যেমন খস খস একটানা শব্দ হয়,শোনা যেত, কেন এই শব্দ কোন বাস্তব ব্যাখা ছিল না। এ শব্দ প্রায়দিন না ঘুমুলে বা বাথরুম টয়লেট যেতে গভীর রাতে উঠলে এক নিদিষ্ট সময়ে কানে আসত,আস্তে আস্তে শব্দটা বাড়ত তার পর আবার ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে যেত। পশ্চিম দিক থেকে যেন পূর্বদিকে শব্দটা ধেয়ে আসত।আবার একটু পর কোন মানুষের যেন এই সব শুখনো পাতা মাড়িয়ে নালা বরাবর হাঁটার শব্দ, যেটা পুব থেকে এসে পশ্চিমে মিলিয়ে যেত। রাতের ঘুমের বিঘ্ন, আর ভয় মনে চেপে বসত। উত্তরের জানালা তাই গরমেও বন্ধ রাখত।
এই সব আজগুবি ঘটনাটা খুব বেশীদিন নয়, শুরু গত ফাগুন মাসে শেষ থেকেই, পশ্চিম দিকে কিছুটা গিয়ে মহানালার পাশে তাঁতি গড়ের পাড়ে বসতি নবীন ,ডাক নাম নমনের অপঘাতে মৃত্যুর পর থেকেই শুরু ।
নিতাই বাগ্দীর পেশা মাছ ধরা। মেঠো পুকুর,আর খড়ি নদীতে সাঁজ বেলায়, ফাঁদি জাল ফেলে আসত,আর ভোড়ে জাল তুলে যা মাছ পেতো বাজারে বিক্রি করে জীবিকা চালাত। বাজারে নরেন ডাক্তার তার নিয়মিত মাঙ্গুর মাছের খদ্দের ছিল, দামটা কোন ফ্যাক্টর নয়, সাইজ আর টাটকা জ্যান্ত মাঙ্গুর তার বড় প্রিয়।নিতাই যত গুলোই হোক জ্যান্ত মাঙ্গুর ধরে নিয়ে আসুক সব প কিনে নিয়ে বড় মাটির ডাবার জলে ছেড়ে রাখত । মাঙ্গুরের ঝোল ভাত দিনের বেলা তার অতি প্রিয় মেনু।
নিতাই মাঝে মধ্যেই গরমে দিনে বড়াল সাঁতারা মেঠো পুকুরের শুখনো পাঁক অনুমান ভিত্তিতে সুগভীর গর্ত কাটতো, দুফুট তিন ফুট, এমনকি দরকারে পাঁচ ফুট, শুখনো পুকুরের পাঁক খুঁড়ে জল কাদার মাঝে বড় মাঙ্গুর মাছ পেতো, একটা দুটো নয়, একসাথে আট দশটা,ভাগ্য ভাল হলে পেয়ে যেত ।উচ্চ দামে নরেন ডাক্তার কে বিক্রি করত।
সেদিন এমন বড়ালের গাবায় শুখনো পাঁক খুড়তে গিয়ে, কিছু দুরে বড়াল পুকুরের গাবায় মাটি খুঁড়ে আবার চেপে বসানোর মত, আর খানিক টা শিয়াল বা কুকুরে হাঁচড়িয়ে মাটি সড়ানো দেখে নিতাই কিছু সন্দেহ হল,সদ্য ভরাট মাটি,কোঁদাল দিয়ে সড়িয়ে দেখে, কোন মানুষের যেন মৃতদেহ কবর দেওয়া,পচা গন্ধ বের হচ্ছে ,ভয়ে আর খুড়াখুড়ি না করে মাটি চাপা দিয়ে গ্রামের আরও মানুষ ডেকে আনে।
তার পর, সবাই মিলে,নাকে গামছা বেঁধে, আধ পচা মানুষের ধর বের করে,মুন্ড নেই।বাম হাতে তার ছটা আঙুল, গায়ের কোন পোষাক ছিল না। দুদিন আগে থেকেই নবীন গ্রামে নেই, তার বাম হাতে ছটা আঙুল, সন্দেহ করে,তারা নবীনের বাড়িতে যায়। তার বৌ আর ভাই ছিল, জাতে ও পেশায় ওরা তাঁতি। নিতাইদের পাড়াতেই বাড়ি।
নমনের ভাই বিমান বলে সে তো পুবে গেছে, তাঁতির কাজে নমনে খুবই দক্ষ তবে, সুতির কাপড় শাড়ি বুনত।সে নাকি, ঢাকায় গেছে মসলিনের কাজ শিখতে, অনেক টাকাও সঙ্গে নিয়ে গেছে ,বেশ কমাস থাকবে। গ্রামের মানুষের সন্দেহ হয়,চেপে ধরে বলে ,যে মৃত মুন্ড হীন দেহ তারা উদ্ধার করেছে,তার নবীনের মত বাম হাতে ছটা আঙুল, উচ্চতা দেহের গঠন পচা শরীর ফুলে ঢোল ঠিক বোঝা যাচ্ছে না । তারা পুলিশে খবর পাঠিয়েছে। সে সময় বৃটিশ যুগ, পুলিশ কে গ্রামের মানুষ তখন রীতিমত ভয় পেতো।
পুলিশ কথা শুনে,নবীনের ভাই কেমন থতমত খেয়ে বলে তবে কী দাদাকে কেউ খুন করে ওখানে পুঁতেছে! টাকা পয়সা তো সঙ্গেই ছিল ! গ্রামের মানুষজন বলে পুলিশ কুকুর আনলে অপরাধী ঠিক ধরা পড়বেই । এসব শুনে, নবীনের ভাই বিমান ডাক নাম বিমনে বলল , চলো তো আমি দেখি আসি ওটা দাদার দেহ কীনা!
নবীনের বৌ কান্না কাটি করছিল না, ঘরে ছিল, বলল, দেখে এসো ঠাকুরপো, আমার মনটা কেমন করছে। বিমনে বড়াল পুকুরে যাবার সময় হন হন হেঁটে সবার চেয়েও অনেক এগিয়েছিল, কিছুদুর গিয়ে বলিষ্ঠ লম্বা বিমনে এমন মরন পন মাঠে মাঠে দৌড়াল, তাকে ধরি কার ক্ষমতা!
তবে সন্দেহ স্পষ্ট হল, দাদাকে ভাই খুন করে পুঁতেছে। সঙ্গে তার স্ত্রীও জড়িত অনুমান করে এবার গ্রামের মানুষ নমনের বাড়ি আসে। প্রতিবেশী বৌ মেয়েরা ওকে পাকড়াও করে, দুচার ঘা মারতেই বলে "টাকা পয়সা নিয়ে দু ভায়ের বেশ কদিন বনাবনি হচ্ছিল না। হয়ত মারতে পারে তবে আমাকে কিছুই জানিনা। "
এক ঝাগড়াটে প্রতিবেশী মহিলা কাঁচা খিস্তি মেরে বলে, "স্বামী নেই, আর স্বামীর অবতর্মানে, যে দেওর তো স্বামীর সাথে ঝগড়া করছে ,বনাবনি নেই, সেই দেওরের সাথে দুটো রাত কাটালি!আর তুই কিছুই জানিস না খানকী! আবার স্বামী পুবে গেছে ,অনেক টাকা নিয়ে, ঢাকায় মসলিনের কাজ শিখবে ! আমরা গরু কিছু বুঝি না ! নষ্ট মেয়ে দেওর ভাতারী, পুলিশ যখন ওখানে লঙ্কা বাঁটা ঘষবে ভরবে , সব সত্যি বের হবে। "
সত্যি তাই পুলিশ এসেছিল, নবীনের ভাইকে পায়নি, বৌকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে জেরা করে সঙ্গে উত্তম মধ্যম দিলে সে অনেক সত্য সে স্বীকার করে।
আসল ঘটনা নবীনের স্ত্রী বন্দনা স্বামীতে পরিতৃপ্ত ছিল না। রোগা নিরীহ স্বভাবের নবীন, তাঁতের কাজে ভালো কারীগর, রাত বারোটা অবধি তাঁত ঘরে তাঁত বুনতো, নানা ডিজাইন নিজেই তৈরি করত । তখন হিষ্টপুষ্ট ভাই, বন্দনার ঘরে এসে,তাকে পরিতৃপ্ত করত, দাদার যেন অক্ষমতা ভাই পুষিয়ে দিয়ে বড় কর্তব্য পালন করত।
এই ভাবেই চলছিল কতদিন কে জানে ।
আপন ভোলা নবীন ভাই আর বৌ দুজনকেই বিশ্বাস করত ভালোবাসত। সেদিন শরীরটা ভালোছিল না, বার বার জল পিপাসায় ,রাতে তার গ্লাসের জল শেষ হয়েছিল।অন্য দিন, বারোটার পর তাঁত ঘর বন্ধ করলে শব্দ হলে বন্দনা আর অবিবাহিত বিমান সতর্ক হতো, পাশাপাশি ঘর, দুই ঘরের মাঝে আবার দরজা ,তাই কোন সমস্যাই ছিল না ,আনন্দ ফুর্তি ,পরিতৃপ্তি লাভ , অবাদে নিয়মিত ভাবে নির্বিঘ্নেই চলত ।
সেদিন নবীন তাঁত ঘরে কপাট না লাগিয়ে হ্যারিকেন হাতে ঘরে শুতে আসে নি, ঘরের কুজো থেকে গ্লাসে জল ভরতে এসে দেখে , দুই দেওর বৌদি যৌন মিলনে এতটা লিপ্ত, তাকে দেখলেও সর্তক হবার সুযোগ পেলো না। নবীন ক্রোধে চেঁচিয়ে ওঠে, বলে কালই তোদের বাড়ি থেকেই তাড়াবো, জমিদার বাবুকে সব বলব, বিচার চাইব।
ইতিমধ্যেই, বিমান, রান্নার ঘর থেকে মস্ত ধাড়ালো বঁটি আনে আর শক্তিশালী যুবতী স্ত্রী বন্দনা নবীনকে উল্টে ফেলে চেপে ধরে। হতচকিত নবীন এমন হটকারীতায় নিজের ভাই আর স্ত্রী তাকে হত্যা করবে স্বপ্নে ভাবেনি। সংসারে উপার্জনের সিংহভাগ সেই করে।
কোন প্রতিরোধই সে করতে পারে না। ধর থেকেই তার মুন্ড টা পৃথক করে ফেলেছিল। তারপর বস্তায় ভরে , মহানালা দিয়ে টানতে টানতে দুজনে গভীররাতে বড়াল মেঠো পুকুরের গাবায় কোঁদাল দিয়ে মাটি গর্ত করে তার মুন্ড হীন শব পুঁতে ফেলেছিল।
ভেবেছিল,যদি কোন ভাবে শিয়াল কুকুরে মাটি সড়িয়ে দুচারদিন পর ভিতরে তার গলা পচা আধ খাওয়া শবদেহ বের করেও ফেলে, মাথা না থাকলে দেখলেও কেউ চিনতে পারবে না। মুন্ড টা বাড়ি ফিরে অনেক গর্ত করে উঠানে পশ্চিম পাশে পুঁতে তার উপর একটা আম গাছের চারা বসিয়ে দিল, সেটি বাড়িতেই অন্য স্থানে লাগানো ছিল,রক্ত জল ঢেলে ঢেলে ধুয়ে ফেলল।
এই সত্য সবটাই চালাক বন্দনা পুলিশ কে বলেনি। শুধুমাত্র বলে আমাদের অবৈধ সম্পর্ক জানাজানি হলে দুই ভাইয়ের ভীষণ মারামারি শুরু হয় ,ধাক্কাধাক্কিতে নমনে উল্টে পড়ে অচেতন হলে , বিমনে তার ধর থেকেই মুন্ড কেটে ফেলে,আর আমাকে বলে, "যদি তুমি এসব ফাঁস করো, তোমারও জেল হবে। আর যদি ধরা না পড়ি পালাতে সক্ষম হই, তাহলে তোমার বাপ ভাইকেও খুন করব।" তবু বন্দনার কবছর জেল হয়। আর বিমান ফেরার থাকল। বৃটিশ পুলিশ মাঝে মধ্যেই বিমনের খোঁজে গ্রামে আসত,বাড়িটা সীল করেছিল।
সেটা গেল একটা দিক, কিন্তু নমনের অতৃপ্ত আত্মা মুক্তি হয় না। বার বার, সে মানুষকে জানাতে চাইত কীভাবে তার মুন্ড হীন শব রাতে টানতে টানতে মহা নালার শুকনো পাতা উপর দিয়ে টেনে টেনে ওরা দুই পাপীষ্ঠ বড়াল অবধি তাকে নিয়ে গেছে। আর তার মুন্ড হীন দেহ ঐ মহানালা বরাবর বড়াল থেকে তার বাড়ি অবধি আসত,হয়ত তার কাটা মুন্ডুর খোঁজে।
টাকা কড়ি গহনা সেই রাতেই শোবার ঘরের মাটির মেঝে গর্ত করে বিমনে সবকিছুই একটা ছোট বাক্সে ভরে পুঁতেছিল, আর পরদিন এমন ভাবে মাটির মেঝে মাটি দিয়ে, মেঝে নতুন করে এক পাতলা গোবর মাটি লেপন করে নিকিয়ে দিল। তিন দিন পর পুলিশ কিছু অনুমান করতে পারে নি। পুলিশের সীল করা বাড়িতে কেউ ঢুকতে সাহস করত না। তার চেয়ে এই বাড়িতে নমনে ভুত থাকে প্রচার হয়েছিল।
মাঝে মাঝেই প্রতিবেশীরা গভীর রাতে,তাঁত বোনার শব্দ পেতো, কোঁদাল চোপানো ,আর নমনের যেন করুন ক্ষীণ আর্তনাদ পেতো।
গগন খুড়ো, শব্দ পেতো কিছু ভারী জিনিস শুখোনো পাতার উপর টেনে নিয়ে যাওয়ার। তবে নজরে কিছুই দেখতে পেতো না,কারণ উত্তর জানালা রাত হলেই বন্ধ করত । মানিক বামুন, তা দেখেছিল, ছোট গড়ের পুকুরের পাশেই তার বাড়ি, এক রাতে প্রাকৃতিক কাজে হ্যারিকেন হাতে গভীর রাতে যখন বাঁশ বনের পাশে বসেছে ,হঠাৎই নজর এল এক মানুষ মুন্ড হীন, গায়ে কোন পোষাক নেই। দুহাত দুপাশে প্রসারিত করে সহসা জাপটে ধরছে, সামনে কেউ পড়লেই হল রক্ষে নেই, মৃত্যু নিশ্চিত। এক পা বাড়িয়ে আবার একই ভঙ্গিতেই সামনে যা কিছু জাপটে ধরছে।তবে ঐ মহানালার খাত বরাবর তার গতিপথ , অন্য কোন দিকে তার নিশানা নয়।
মানিকের কথা অনেকেই বিশ্বাস করে নাই। তবে এর পর অনেকেই গভীর রাতে এপথে এলে এই দৃশ্য তারা দেখেছিল। সন্তোষ বারুই এক প্রহর রাতে বর্ষার সময়, ছাতা বর্শা আর বস্তা নিয়ে হাতে হ্যারিকেন ঝুলিয়ে একা পাকা তাল কুড়োতে বের হত। প্রতিরাতে চল্লিশ পঞ্চাশ টা তাল সে কুড়োবেই। এক রাতে বৃষ্টির মধ্যেই ভরা মহা নালার এক কোমর জলে এমন বিচিত্র স্কন্ধ কাটা ভুত দেখেছিল, এক পা এগোচ্ছে আর সেই স্কন্ধ কাটা ভুত দুহাতে সজোরে সামনের শুন্যকে আঁকড়ে জাপটে ধরছে। এর পর ভয়ে তার সখের বর্ষার রাতে পাকা তাল কুড়োনোর নেশা ত্যাগ করতে সে বাধ্য হল । তখন মানুষ একটু বিশ্বাস করল।
এইভাবেই আরও পাঁচ ছ বছর কেটেছিল, এক দিন পুলিশের সীল করা নমনে বিমনে দের বাড়ীতে গভীর রাতে তীব্র ভয়ার্ত্ত চিৎকারে নিকট প্রতিবেশীরা জেগে যায়। তারা একসাথে জমায়েত হয়ে ভুতুরে বাড়ীর ভিতর কিসের চিৎকার ! লাঠি সোটা আর হ্যারিকেন টর্চ নানা উপকরণ নিয়ে দেখতে হাজির হয়। দেখে শোবার ঘরের দরজা খোলা সীল ভেঙ্গেই বিমনে ভিতরে। সে তীব্র ভয়ার্ত্ত চিৎকার তখনও করে চলেছে। আর কাকে যেন কাকুতি মিনতি করছে, যা তাদের চোখে দৃশ্য নয়।
বিমনে কেঁদে কেটে বলছে "হ্যাঁ আমি পুলিশের কাছে ধরা দেবো, সব দোষ কবুল করব। "
বিমনে পরে প্রতিবেশীদের বলে,"আমি দাদাকে খুন করে যে পাপ করেছি, ঈশ্বর এজন্মেই আমার সারা শরীরে কুষ্ঠে গলিয়ে দিয়েছেন। আমার আজ ভিখারী দশা,দাদা ভুত হয়েছে জানতাম না, শোবার ঘরে মেঝেতে কিছু টাকা গহনা মাটির নিচে লুকানো ছিল, সেটা নিতে আজ গভীর রাতে গোপনে এসে ছিলাম। যখন সব গহনা টাকা বের করে ব্যাগে ভরে পালাব, হঠাৎই দাদা আমাকে জাপটে ধরল, মুন্ড হীন পচা গন্ধ ঠান্ডা শরীর, আমি ভয়ে চিৎকার করলাম কিছুতেই ছাড়ছিল না, বলল তোকে মারব না, প্রতিবেশীদের হাতে ধরিয়ে দেবো,ওরা তোকে পুলিশে দেবে। তোমরা আসার পর ও আমায় ছেড়েছে ,কিন্ত পথ আগলে আছে, আমি শুধু দেখতে পাচ্ছি,"
প্রতিবেশীরা আজ বুঝল নমনের অতৃপ্ত আত্মার ইচ্ছা অভিপ্রায়, সে কখনও অন্য কারো ক্ষতি করে নি।
পরদিন পুলিশ আসে। পাড়ার মানুষ এই কুষ্ঠরোগীকে মারধর বা শারীরিক শাস্তি দুরে থাক স্পর্শ করেনি।পুলিশ কিন্তু দুচার ঘা ডান্ডা চালাল,হাতে কড়া পড়িয়ে পুলিশ ভ্যানে তুলছিল, বিমনে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, "আমি তো গলিত কুষ্ঠে মরছি ,ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দিয়েছেন, আর কী শাস্তি সরকার দেবে,ছেড়ে দাও আমাকে ছেড়ে দাও । "
পুলিশের এক আধিকারিক বলল,"তুই পাপীষ্ঠ, নিজের দাদাকে অকারনে নৃশংসভাবে হত্যা করছিস,তোকে মরা অবস্থায় উদ্ধার করলেও, তোর মৃত দেহটাকেই ফাঁসীতে ঝুলাতাম।তুই তো জীবিত! আর সোনা টাকার লোভ এখনও যায়নি।তোর দাদার অতৃপ্ত আত্মা তোকে শুধু মারেনি, আমাদের উপর ভরসা রেখে। তোর ফাঁসী হুকুম বলবত আছে, ধরা পড়লেই ফাঁসী। "
বিমনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ,আর গ্রামের মানুষ সেদিন যারা উপস্থিত ছিল ,হৈহুল্লোর করে আনন্দে মাতল।
বিমনের ফাঁসী হয়েছিল। আর এরপর নমনের উপস্থিত বা উৎপাত, বিলাপ সব থেমে গেছিল।
( স্কন্ধ কাটা ভুত নমনে ,আর লমপট খুনে ভাই বিমনে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ফেরার থেকেও বৃটিশ আমলে কঠোর আইনে রেহাই পায় না, ফাঁসীতে ঝুলতে হয়, নমনের অতৃপ্ত আত্মা তাকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করে । স্কন্ধ কাটা ভুতের মহানালা বরাবর আনাগোনা আর এক পা অন্তর দুহাতে জাপটে ধরা।এই তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ, শেষে একদিন নমনেকে ধরে বৃটিশ পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে প্রতিশোধ নেয়। তারপর আর তার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়নি ,একটি সত্য ঘটনা , বাবার মুখে শোনা)

