Mitali Chakraborty

Abstract Fantasy

3  

Mitali Chakraborty

Abstract Fantasy

শরৎ শোভা:- শরৎকাল

শরৎ শোভা:- শরৎকাল

5 mins
946



শিউলি ঝরা শরতের সকাল। বর্ষার অলস গানের সুর মূর্ছনা থেকে বিরতির অবকাশ প্রদান করে এই শরৎ। ঋতুরাজ নাম কি আর এমনি এমনি? সত্যিই তো শরৎ ঋতুর রাজা। শরৎকালের প্রাণময়তা ছুঁয়ে যায় সমীরণকেও। সমীরণ এই ছোট্ট গ্রাম পরশপুরের আদি বাসিন্দা। হ্যাঁ আদিই বটে, সেই কবে সমীরণ তারা বাবা মা সহ পরশপুরকে বিদায় জানিয়ে চলে গেছিলো শহরে। সে কি আর আজকের কথা? বহু বছর আগের কথা। তখন কতই বা বয়স ছিলো সমীরণের? এই তেরোর ঘর পেরিয়ে চোদ্দো ছুঁই ছুঁই। পরশপুরের সুখ স্মৃতিকে বুকে জড়িয়ে সে চলে গেছিলো তখন। সমীরণের বাবা ছিলেন ভারতীয় রেলের একজন উচ্চপদস্ত কর্মী। তিনি থাকতেন শহরে, রেল কলোনিতে। আর ওনার স্ত্রী, পুত্র সমীরণ থাকতো পরশপুরের গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে

রেল কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত এক সুবিশাল বাংলোতেই তিনি সংসার পেতেছিলেন স্ত্রী, পুত্র আর নিজের পিতা মাতাকে নিয়ে। সমীরণের পিসিদের তো অনেক আগেই পরশপুরের গ্রামের বাড়ি থেকেই বিয়ে থা হয়ে গেছিলো। সমীরণের কাকা তখনও জীবন সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে পরশপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী এক গ্রামের স্কুলেই শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে গেছিলেন। সমীরণ তখন বেশ ছোটো। ছোটবেলা থেকেই

কাকার সঙ্গে সমীরণের ছিলো মিত্রতার সম্পর্ক। কাকার সঙ্গে সমীরণ পরশপুরের পথঘাট চষে বেড়াতো তখন। সবুজ শ্যামলিমায় মোড়া থাকতো পরশপুরের মেঠোপথ। পথের ধারে ধারে থাকতো কাশফুলের সমাহার। কনক ধানের মনোমুগ্ধ কর কাঁচা সোনালী রঙ তদুপরি শিউলির গন্ধে মাতোয়ারা আকাশ বাতাস। পরশপুরের কানায় কানায় যেনো শরতের ছোঁয়া লেগে থাকত। কাশ কুসুমের বিকাশ দেখেই তো মন ভরে যেত ছোট্ট সমীরণের।

সমীরণ কখনো কাকার কোলে চেপে বা কখনো হেঁটে, দৌড়ে আস্বাদন করতে চাইতো প্রকৃতির স্বাদ। 


*******************

সুখেই কাটছিল পরশপুরে সমীরণের শৈশব। ঠাম্মা দাদুর সোহাগ, অভিন্ন হৃদয় কাকাই, বাবা মা আর দুই পিসির সঙ্গে। সময়ের সাথে সাথে পিসিদের বিয়ে হয়ে যায় আর পরিবারে নতুন অতিথি হিসেবে সমীরণ পায় তার ছোট কাকিকে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সমীরণের খেলার সঙ্গী হিসেবে আগমন হয় সন্দীপের। সমীরণের কাকাইয়ের ছেলে সন্দীপ। কাকাই তখন শিক্ষকতার কাজেকর্মে ব্যস্ত আর সমীরণ তখন ভাই সন্দীপের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্যে অস্থির। স্কুল থেকে ফিরেই তখন তার সন্দীপের কাছে যাওয়া চাই। সুমধুর দিন যাপন করছিল সমীরণ ছোট্ট সন্দীপের সঙ্গে। সমীরণের এখনও মনে পরে সেবার ছিলো শরতের এক সকাল। পুজো পুজো গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছিল চারিদিকে। সবাইকে চমকে দিয়ে সেদিন আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন সমীরণের ঠাকুরদা। কতো ডাক্তার বদ্যি করা হলো কিন্তু তার ঠাকুরদা সেরে উঠলেন না। সকলেই পরামর্শ দিচ্ছিল শহরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে সেই সুবাদে সমীরণের বাবা তড়িঘড়ি ব্যবস্থা করেন পুরো পরিবার নিয়ে শহরে আসার। শহর অভিমুখে তখনই যাত্রা শুরু সমীরণের।


ছোট্ট সন্দীপ আর কাকা কাকী রয়ে গেলেন পরশপুরের বাড়িতে আর সমীরণ বাবা, মা, ঠাকুরদা, ঠাম্মা সহ তখন শহরে। শহরের বড় বড় ইমারত গুলির দিকে চেয়ে এক সময় চোখ ফেটে জল আসতো। এখানে তো আকাশটাই ঢেকে আছে যেনো। সবুজের চিহ্ন কম শুধু কংক্রিটের জঙ্গলে ঘেরা শহর। থেকে থেকে তার মনে পড়তো পরশপুরের সুখের স্মৃতি। গ্রামের সেই বাঁধানো পুকুর পাড়, পুকুর পাড়ে বসে শরতের নীলাকাশ দেখা, কতো রং বেরংয়ের পাখিদের আনাগোনা, ডানা মেলে উড়ে চলা বলাকার দল। ছাতিম ফুলের মন মাতাল করা সুবাস। মাঠে মাঠে শ্বেত শুভ্র কাশ ফুলের মেলা। দিক দিগন্তে শুধুই হাসির আর খুশির আনন্দের জোয়ার। এসবের সঙ্গেই শরৎ নিয়ে আসত আগমনীর বার্তা। কিন্তু শহরের আনাচে কানাচে প্রকৃতির এত অমোঘ রূপ আকর্ষণ কোথায় পাবে সমীরণ। তার কেবল মনে পড়তো গ্রামের বাড়ির কথা, সন্দীপের কথা, কাকু কাকীমার কথা। কিন্তু তার ঠাকুরদার শারীরিক অবস্থার মান শহরে এসেও আর উন্নত হলো কই? অনেক চিকিৎসা করিয়েও সেরে উঠলেন না তিনি। গ্রীষ্মের ছুটিতে, পুজোয় অনেক বার পরশপুর গ্রামে গেছে সমীরণ। কিন্তু ফিরে আসার দিনে তার মন চাইতো না শহুরে বাঁধানো রাস্তায় পা রাখতে, গ্রামের চিরাচরিত মেঠোপথ গুলি যেনো আঁকরে ধরে রাখতে চাইতো সমীরণকে। ক্রমে ক্রমে সমীরণে বড় হওয়া, পড়ালেখার অতিরিক্ত চাপ, সময়ের নিয়ম মেনে তার ঠাকুর্দার গত হওয়া, সমীরণের নিজের জীবনের লক্ষ্যপথে ছোটা, সব মিলিয়ে ক্রমশ ঘোলাটে হতে থাকলো পরশপুরের স্মৃতি গুলো। আগের মতন সকল ছুটিছাটায় আর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া আসাও হতো না সমীরণের। বাধা ধরা যান্ত্রিক জীবনে হারিয়ে যাচ্ছিল সমীরণের কৈশোর। 


*************

পরশপুর গ্রামের বাঁধানো পুকুরপাড়ে বসে আছে সমীরণ। দু চোখ ভরে উপভোগ করছে শরতের সকাল বেলার রূপ মাধুরী।

সমীরণ এখন আর ছোটোটি নেই। বড়ো হয়ে গেছে। শহরের নামকরা কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করতে করতেই তার প্লেসমেন্ট হয়ে গেছে ভিন রাজ্যের এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। প্রায় এক বছর হয়ে গেছে সেখানে কাজ করছে সমীরণ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে ছুটি প্রায় থাকেই না। হাতে গোনা দু দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল গত পুজোয়। কিন্তু এই বারের পুজোর আগে অনেক দিনের ছুটি নিয়ে পরশপুর গ্রামে এসেছে সমীরণ। বাঁধানো পুকুর ঘাঁটে বসে বসে কতো কি ভাবছে সমীরণ। 


কতো স্মৃতি বিদ্যুৎ ঝলকানির মত উঁকি দিচ্ছে তার মনে। স্মৃতির কত কত পথ অতিক্রম করে চলেছে তার যুবক মন। হঠাৎ তার চিন্তার মধ্যে ছেদ পরে একজনের হাতের স্পর্শে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সন্দীপ দাঁড়িয়ে। সেই ছোট্ট সন্দীপও আজ কত বড়। আগামী বছর স্কুল ফাইনাল দেবে। সমীরণের দিকে তাকিয়ে খুব সংক্ষেপে প্রশ্ন করে সন্দীপ,

"দাদা তুই সত্যিই চলে যাবি সবাইকে ছেড়ে?"


সন্দীপের প্রশ্নটার আর কোনো উত্তর দিতে পারেনা সমীরণ। চুপ করে থাকে কেবল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এখনও চেয়ে আছে সন্দীপ তার দাদার দিকে। আর সমীরণের মনে পড়ছে তার অফিস ইনচার্জ হালদার বাবুর কথাটা। "মিস্টার সমীরণ, অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন তোমার প্রমোশনের জন্য। ইউ আর নাউ সিনিওর ম্যানেজার অ্যান্ড আওয়ার কোম্পানি উইল সেন্ড ইউ টু সিঙ্গাপুর ফর ট্রেনিং পারপাস। তুমি কিছুদিনের লিভ নিতে পারো সমীরণ। তোমার সিঙ্গাপুর যাওয়ার ব্যবস্থা কোম্পানি অর্গানাইজ করে দেবে...." 


হালদার বাবুর কথাগুলো শুনে সেদিন কি রকম মানসিকতায় ছিলো তা বোধকরি নিজেও জানে না সমীরণ। যেখানে একবার খুশি হচ্ছিল সেখানেই আবার মনে পড়ছিল পরশপুর, বাবা মা, সন্দীপ সহ বাকি সকলের কথা। বিদেশ বিভূঁইয়ে চলে যাওয়া মানেই তো সকলের থেকে কতো দূরে পাড়ি দেওয়া। যাওয়ার আগে সমীরন তাই দুচোখে ভরে নিচ্ছে শরতের রূপের ঝলক। শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা গুলো ভাসছে। তুলোর মতন ওড়ে যাচ্ছে আকাশের এদিক থেকে ওদিক। মেঘ গুলো কখনো সাদা রং বা কখনো কালচে রূপ ধারণ করে ছোটাছুটি করছে আকাশ জুড়ে। শরতের সজীব প্রকৃতি প্রশান্তির প্রলেপ এঁকে দিচ্ছে তার মনে। সন্দীপের দিকে চেয়ে স্মিত হেসে সমীরণ বলে,"ভাই, আমি যাবো ঠিকই কিন্তু আবার ফিরেও আসবো...শেকড়ের টান ভুলে অন্যত্র আর কতদিন থাকতে পারবো বল?"


     ________*________



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract