সহোদর
সহোদর
রতন আসানসোলে একটি কারখানায় ঠিকা কর্মী। সে শিক্ষিত হোক পরিস্থিতির চাপে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তাকে সামান্য উপার্জন করতে হয়। ইদানিং সে শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল অসুস্থবোধ করছিল ।কাজও পাচ্ছিল না।জমানো টাকা প্রায় শেষ।কোনো রোগে আক্রান্ত কীনা তার ধারনা ছিল না। এই তীব্র আর্থিক সংকটে ডাক্তার দেখানোর বিলাসিতা তার মনেই আসেনি।ছোট থেকেই সে ডাক্তার আর ওষুধ ট্যাবলেট উপর ভরসা করে না।আর আজ এই আর্থিক সংকটে!
ক্লান্তি দুর্বলতা সব সময়ই সে অনুভব করে আর মাঝে মধ্যেই আবার শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়।শেষে একরকম সে নিরুপায় হয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরব মনস্থির করল।
রাত তখন দশটা পেরিয়ে গেছে ,সদরের কড়া নাড়ার শব্দ শুনে,মীরা কপাট খুলে দেখে রতন। খানিকটা হতভম্ব হয়ে মীরা বলে ,
"তুই এত রাতে !"
"চলে এলাম অনেকদিন আসিনি, তোমরা কেমন আছো মা!" রতন মাকে প্রনাম করল।
মীরা থতমত মুখে, দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে ।
রাতের খাবার চুকেছিল, বৌমা রেখা রান্নার ঘর থেকে বলে,
"কে মা? এত রাতে!"
কেমন অপরাধী স্বরে কাঁচুমাচু হয়ে মীরা বলে,
" রতন এসেছে বৌমা।"
"এটা কী হোটেল না ধর্মশালা! যখন খুশী যে কেউ এলেই হল!"
তাড়াতাড়ি রেখা রান্নাঘরে চাবি লাগাল।তারপর রাগে ক্রোধ দ্রুত উপরে দোতলায় সে তার নিজের ঘরে চলে গেল।
মীরা রতনকে বলে " অশান্তি আর ভালো লাগে না, মরনটা হলে বাঁচি। "
"আমি এসে তোমাদের খুব সমস্যায় ফেললাম!বাবার পেনশনে খাও ,এত ভয় কেন বৌকে!"
"চুপ কর,বাড়িটা ওর নামে,আর তোর বাবার এখন যা হাল! ঐ সামান্য পেনশনেরর টাকায় কী হবে ! ডাক্তারের ফি,ওষুধ, আয়া, চিকিৎসার খরচেই সব চলে যায়!"
"কী হয়েছে বাবার!"
"স্ট্রোক হয়ে বামদিকটা অসার ।তুই আর কী জানিস!"
"সত্যিই আমি জানি না মা!"
সদরের দরজা লাগিয়ে মীরা বলে "চল,আজ রাতটা কোনমত আমাদের ঘরে থাক।"
"কেন বাকী ঘরগুলো!"
"নিচের দুটো ঘরে একটা আমরা থাকি,অন্যঘরে তোর বৌদির খুড়তুতো দাদা থাকে,এখন তোর দাদা, ওর পরামর্শে গ্রামের কটা পুকুরের লিজে মাছচাষ করে, তোর দাদার টাকা, ওর শ্রম, লাভ আধাআধি। উপরের দুটো ঘরের একটা ওরা বাচ্চাটাকে নিয়ে শোয় ।আর অন্য ঘরে তোর দাদার শালি, বর্ধমানে এম এ ভর্তি হয়েছে, হোস্টেলে থাকে না,গোলাপবাগ তো এগ্রাম থেকে মোটে আট কিলোমিটার, এখান থেকেই নাকি যাতায়াতে সুবিধা, নিরাপদ। মানিককে শ্বশুর এজন্য টাকা দেয় শুনেছি। টাকা আর বৌ ছাড়া কিছুই তো হতভাগাটা চিনল না !"
রতনদের গ্রাম মির্জাপুর বর্ধমান শহরের কাছেই ,আর রতনের দাদা মানিকের শ্বশুর বাড়ির সেই মালডাঙ্গা অনেক দুর। বর্ধমান দৈনিক এতটা পথ যাতায়াত করা খুবই কষ্টকর।আবার বড় লোকের আদুরে মেয়ে! মানিকের শ্বশুর মেয়েকে আবার ইউনিভার্সিটির হোস্টেলেতেও রাখবে না,যতসব লীলাক্ষেত্র। তাই শ্বশুরের ছোট মেয়ে দিদির বাড়ি থেকেই পড়াশোনা করত।
রতন কেমন হতাশ আর বিরক্ত প্রকাশ করে বলে,
"তার মানে বাড়িটা এখন দাদার নয়, বৌদিদের বাড়ির দখলে ! তোমরা অতিথি।পূর্ব পরিকল্পিত, নাহলে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে বৌদি কেন আমাকে তাড়াল ! তোমারই বুঝলে না।"
"বুঝে কী হবে!তোর বোনের বিয়ের টাকা কে দিতো! বাধ্য হয়েই তোর বৌদির বাবার কাছে এ বাড়িটা বন্ধক রাখতে হয়, আর তোর বৌদির নামেই বাড়ির দলিল হল।"
"তখন বলেছিলাম ব্যাঙ্কে লোন নাও,বাড়িটা ব্যাঙ্কে বন্ধক দিলে কী এই সমস্যাই হত ?"
" তাড়াহুড়ো করে ব্যাঙ্ক লোন হত না। এরা সুদ নেবেনা। তোর মুরোদ নেই, আয় কর ! পাঁচ লাখ দিয়ে বাড়িটা ছাড়িয়ে নে!"
"যাক তোমরা যা খুশী করো,আমি কাল ভোরেই চলে যাব।"
রতন একবছর বাড়ি ছাড়া। রতনের দৃঢ় ধারনা, দাদা নিজের টাকা শ্বশুরের নাম করে সে বোনের বিয়েতে দিয়েছিল,তাই বৌদির নামেই বাড়িটার বন্ধকী দলিল করা হয়েছিল।তারপর থেকেই বৌদির দাম্ভিক ব্যবহার, অহংকার, বেপরোয়া আচরণ হেনস্থা, রতনের সাথে তীব্র ঝগড়ার কারনে ,রতন বাড়ি ছাড়ে। অন্যথা রেখা হুমকি দিয়েছিল সে বাড়ি বেচে দিয়ে, স্বামীর কর্মস্থলে পালাবে।শ্বশুর শাশুড়ি দেবর কোথায় থাকে দেখব!
অবসরকালীন পাওনা রতনের বাবা,আগেই স্ত্রীর চিকিৎসাতেই শেষ করে ফেলেছিলেন। তার বেশ কিছুদিন পরে বড়পুত্র মানিকের ব্যাঙ্কের চাকরী হল , ধনীর কন্যাকে বিয়ে করল।এখন তো সে বৌ শ্বশুরবাড়ির একান্ত অনুগত।
অসুস্থ দুর্বল শরীরে রতন পরদিন ভোরেই বাড়ি ছাড়ল,রাতে তার আহার হয়নি।মায়ের ঘরের মেঝে রাতে কোনমত সে শুয়েছিল। আর মাকে নিজের অসুস্থতাও বলেনি। তার শীর্ন মূখ, দুর্বল অশক্ত শরীর রাতের আঁধারে মায়ের নজরে আসেনি । মীরার দৃষ্টি শক্তি এমনিতেই এখন দুর্বল।
গতকাল রাত দশটার পর গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে বর্ধমান থেকে আসা লাস্ট বাসে রতন নেমেছিল। আর আজ ভোরেই ফাস্ট বাস চারটে পঞ্চাশ ধরবে। রাতে কিছুই খায়নি । আসানসোল বর্ধমান লোকাল ট্রেনটা বর্ধমানে রাত নটার পর এসেছিল। তারপর রতন একটা চায়ের দোকানে ,একটা ছোট কেক আর চা খেয়েছিল।এরপর গ্রামে যাবার রাতের লাস্ট বাস ধরেছিল।
দুর্বলতা আর রাতে প্রায় ঘুম না হওয়ার কারনে হয়ত মাথাটা ঘুরছে ,রতন ভাবছিল।এত সকলের বাস,তাই হালকা ভিড় নেই,বসার জায়গা পেয়েছিল তাই রক্ষা।ভাবছিল সীমিত টাকা তার অনেটাই তো যাতায়াতে করতে চলে গেলে, তবে মা ,শয্যাশায়ী বাবাকে অনেকদিন পর দেখল। এবার সে কী করবে ! রতন আজ প্রচন্ড মানসিক চাপে ছিল। একদিন আগেও অসুস্থ রতন গ্রামের বাড়ি মা বাবা দাদার উপর একটা শেষ ভরসা করত।শেষ আশ্রয়।
কয়েকজন তার মতই বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক কর্মীদের মেসে সে থাকে ।এতদিন মেস খরচ আর ঘরের বেড ভাড়া দিয়েছিল এবার কি করবে! বিনা খরচে তারা থাকতে দেবে না। কিছুই সে ভাবতে পারছিল না।এই দুর্বল শরীরে ট্রেনে হকারী সম্ভব নয়। ভিক্ষা ! মরে গেলেও সে করবে না।
সকালে বাস থেকে বর্ধমানে নেমে স্টেশনের একটা ফুটের দোকানে হাফ পাউন্ড পাউরুটি আর চা খেল। ক্ষীদেটা যেন আজ তার রাক্ষুসে ! আবার একটা খেলো।তারপর ট্রেনের টিকিট কেটে ছটার চল্লিশ ট্রেন ধরল। অসহ্য ক্লান্তিতে চোখদুটো তার জড়িয়ে যাচ্ছিল। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। মায়ের দুঃখের বারোমাস্যা, আর তাকে নানা জ্ঞান পরামর্শ! শুনতে হচ্ছিল, ভালো লাগুক আর না লাগুক। খানিকক্ষন পর মা ঘুমিয়ে গেলেও তার ঘুম আসছিল না। তার সঙ্গে চাদর মশারী ছিল, কিন্তু মশারী টাঙ্গানো মত ঘরে পরিস্থিতি ছিল না।
বারো বাই দশ ছোট ঘরে,বাবা আর মায়ের দুদিকে তক্তাপোস, মাঝের সংকীর্ণ স্থানে মেঝেতে চাদর পেতে সে শুয়েছিল । অসুস্থ বৃদ্ধ মা বাবার রাতে ঘুমের কোন ব্যাঘাতের কারণ যেন সে না হয় !
অযোগ্য ব্যর্থ সন্তানের হীনমনত্যার তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।বাবার সামান্য পেনশনের ভরসাই তার আসা! যদি একটু, কদিনের রেস্ট পাই,একটু সুস্থ সবল হই, আবার কারখানায় কাজ করার সাধ্য শক্তি পাই!
নিজের উপর খুব গ্লানি লাগছিল। বাবার যে স্ট্রোক হয়েছিল সে জানেই না।একটা আয়া সকল থেকে থাকে।রাতটা মা, বাবার দেখভাল করে। কত ওষুধ! ডাক্তার খরচ সামান্য বাবার পেনশন! এই আটাশ ত্রিশ বছরের জওয়ান ছেলে বাবা মায়ের দ্বায়িত্ব কর্তব্য পালন না করে নিজের স্বার্থ ধান্ধায় এসেছে! নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণা হচ্ছিল। সারারাত এপাস ওপাস আর মশার গান শুনছিল,মশার কামড় খাচ্ছিল।
চারটে উঠে রেডি হয়ে ভেবেছিল মাকে উঠিয়ে কষ্ট দেবো না। কিন্তু সদরের দরজার চাবিটা মায়ের বালিশে তলায় থাকে।নিতে গেলে মা জেগে গেল।মা বলল,
"এখুনি যাবি!"
রতন বলল, "দেরী করে লাভ নেই মা,গরমের সময় তাড়াতাড়ি আসানসোল পৌছে যাব।মেসে রান্না চেপে গেলে সমস্যা,খেতে হোটেল ছুটতে হবে, আর তাতে খরচ বেশি।"
মা দুঃখ করে বলে,"বৌমা রান্নার ঘরে চাবি দিয়েছে।তোকে যাতে কিছু খেতে দিতে না পারি, একটু চা করে দিতেও পারব না। " মায়ের চোখে জল দেখে রতন বলে,
"আমার কোন অসুবিধা হয়নি মা। তোমার হাই সুগার চোখের সমস্যা,আবার কেঁদে কষ্ট পারছ। এবার যদি তেমন ক্ষমতা হয়, তবেই আসব, তোমাদের আমার কাছে নিয়ে যাব।"
"ততদিন বাবা আমরা বাঁচব না। নিজে সুখী হ,বিয়ে থা করে সংসারী হ ,আমার তাতেই সুখ।"
সদরের চাবি মা খুলে দিলে রতন মাকে প্রনাম করে রওনা দিল। গ্রীষ্মের দিন তখন আলো ফুটে গেছিল।
বর্ধমান আসানসোল লোকাল ট্রেনটা সেই কখন বর্ধমান স্টেশন থেকে ছটা চল্লিশে ছেড়েছিল।অনেকটা পথ রতন কেমন আলস্য ঘুম আর ক্লান্তির ঘোরে চলে এসেছিল। হঠাৎই তার কেমন শ্বাস কষ্ট ,আনচান শুরু হতেই রতন জেগে গেল।কেমন চোখে ঘোর ঘোর লাগছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা।পোষাকের নিচে সারা শরীর কেমন ঘামে ভিজে গেছে।
তখন দুর্গাপুর পার হয়েছিল মানুষের ভিড় অনেক বেড়েছিল, তাদের কথাবার্তা কোলাহল রতন কেমন অস্পষ্ট শুনেছিল,ঠিক বুঝতে পারছিল না।মনে হচ্ছিল সে কোন অন্য জগতে !
অসহ্য এক অজানা চাপা কষ্টে দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক রতন তাকাচ্ছিল , কেমন আবছা দেখছিল।আপন জনই যেখানে পর। অপরিচিত, চিনতে না পারা মানুষের ভরসা সে করেনি।হদ হদ করে একগাদা বমি করতেই যত ভিড় কমে গেল । দুর থেকে কেউ কেউ গালিগালাজ করছিল, কেউ অবাক, কেউ বা একটু শুখনো মায়া সহানুভূতির চোখে দেখালেও কাছে আসেনি। একটা সময় রতন অচেতন হয়ে পড়েছিল । তারপর--- তার আর জ্ঞান ফেরেনি।
সমাপ্ত
