STORYMIRROR

Pronab Das

Fantasy

2  

Pronab Das

Fantasy

শবদেহ ছিনতাই।

শবদেহ ছিনতাই।

5 mins
683


     বর্ষাকালে মৃতদেহ দাহ করা সত্যি এক ঝক্কির বিষয়। অনেক রকম সমস্যা হয়। এখন পর্যন্ত কয়েকশ মৃতদেহ দাহ করা হয়ে গেছে আমার। গ্রামের কেউ মারা গেলে আমরা কয়েক জন তা উৎসাহের সহিত দাহ করার ব্যবস্থা করি। এখন বয়স হয়েছে । শরীর দেয় না। তাই খুব কম যাই । 


 

        গ্রামের মোড়ল গোপালখুড়োর অবস্থা ভালো নয় । কদিন যাবৎ ভুগছেন বার্ধক্য জনিত বিভিন্ন রোগ ব্যাধিতে। রাত টা মনে হয় আজ তাঁর কাটবে না। কোবরেজ মশাই এক প্রকার জবাব দিয়েই দিয়েছেন। খবরটা কানে আসতেই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে একটা প্রস্তুতি সেরেই ফেললাম। মানুষ হিসেবে গোপাল বারুজ্যে খুব বড় মাপের। আমরা তাকে গোপাল খুড়ো নামেই ডাকি। গ্রামের খুব কম মানুষ আছেন যিনি গোপাল খুড়োর সাহায্য পাননি। গ্রামের একমাত্র স্কুল ভাবদেবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। অবসর করেছেন বহু বছর। তবুও সময় পেলে মাঝে মধ্যেই ছাত্র পড়াতে স্কুলে যান। এইসব কারণে সবাই তাঁকে খুব সম্মানের চোখে দেখেন। আমরা কয়েকজন সকাল থেকেই তাঁর বাড়ির আশেপাশেই ছিলাম। সন্ধ্যে ছ-টা নাগাদ খুড়োর স্ত্রী, পুত্ৰ-কন্যার তারস্বরে কান্নার আওয়াজে আমরা টের পেলাম যে গোপালখুড়ো সদ্য গত হলেন। অতএব আমরা কয়েকজন খুড়োর মৃতদেহ দাহ করার ব্যাপারে উঠে পড়ে লাগলাম । 


          সকাল থেকেই গুমোট গরম পড়েছে। দু পশলা হালকা বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ স্বরে খুড়োর বাড়ীর কান্নার রোল আশপাশের পরিবেশটাকে কেমন ভারী করে তুলছে। নিশিকান্ত ইতিমধ্যে শবদেহ বয়ে নেওয়ার খাট, বাঁশ, ধুপ, কাপড় ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে হাজির। সবাই মনে মনে দাহকার্য দ্রুত যাতে সম্পন্ন হয় তার প্রার্থনা করছি। এখানে থেকে শ্মশানের দূরত্ব হাঁটা পথে পৌনে এক ঘন্টা। এ ছাড়া শ্মশানে পৌঁছনোর আর একটা সহজ পথ আছে। নদীর চরের বাদাবনের ভেতর দিয়ে গেলে পঁচিশ মিনিটেই পৌঁছনো যায়। কিন্তু সে পথের দুর্নাম আছে। গ্রামের কেউ ওই পথে শব নিয়ে যাতায়াত করে না। দু একজন প্রবীণ লোকের মতে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বিশেষ করে শব নিয়ে যাওয়ার সময় একটু অসতর্ক হলেই মৃতদেহ নাকি ছিনতাই হয়ে যায়। আধ খাওয়া বা বেশিরভাগ খুবলে খাওয়া সেই লাশ পরদিন দিনের আলোয় এদিক সেদিক পাওযা যায়। বলার অবকাশ রাখে না, এই সব ছিনতাইয়ের কাজটা অন্ধকারে গাছের মগডালে বসে তেনারাই করে থাকে। এখন সোয়া দশটা বাজে। নিশিকান্ত নিপুণ হাতে গোপাল খুড়োর দেহ কাতার দড়িতে পোক্ত করে বেঁধে ফুল, মালা, ধুপ, অগুরু দিয়ে সাজিয়ে ফেললো।পারিবারিক কিছু নিয়মকানুন শেষ করে শবদেহ নিয়ে বেরোতে বেরোতে রাত এগারটা বেজে গেল। বাইরে তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সবাই বেশ চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। নিয়ম অনুযায়ী মৃতদেহ একবার শ্মশান উদ্দেশ্য রওনা হলে তা বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয় না, সে যতই সমস্যা হোক না কেন। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আর হরিবোল ধ্বনির সাথে শুকনো খই ছড়াতে ছড়াতে আমরা জনা ত্রিশ জন গোপাল খুড়োর পার্থিব শরীর নিয়ে শ্মশানের দিকে এগোতে লাগলাম। সবার প্রথমে নিশিকান্ত, তার হাতে জ্বলন্ত মশাল । যে ভাবে বৃষ্টি পড়ছে তা যেকোনো সময় নিভে যেতে পারে। যদিও বেশ কয়েক জনের হাতে কেরোসিনের লণ্ঠন আছে।



         বৃষ্টির পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। সবাই কম বেশি ভিজে গেছি। হঠাৎ মুষল ধারায় বৃষ্টি নামায় আমরা বুড়ো শিবতলার বড় বট গাছের নিচে আশ্

রয় নিলাম, খুড়োর খাট নামালাম। ঠিক এখানথেকেই বাদাবনের রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আমাদের মধ্যেই কয়েকজন অল্প বয়সী ছোকরা এই শর্টকাট রাস্তা ধরার কথা বলতেই আমি তাদেরকে কষে ধমক দিলাম । সবাই চুপ করে গেল। মিনিট খানেক পর বৃষ্টি একটু ধরতেই গোপাল খুড়োর ছোট ছেলে রমেন আমাকে বাদাবনের পথ ধরতে বলল। রমেন ছোট থেকে তার মামার বাড়ী কলকাতায় থেকে বড় হয়েছে। লাশ ছিনতাই এর ব্যাপারটা বরাবরই তাঁর গল্প মনে হয়। আমরা দু তিন জন বয়স্ক ব্যক্তি বাদ দিয়ে সবাই যখন বাদাবনের পথ ধরতে একমত হওয়ায়, এক প্রকার অনিচ্ছায় ওই অলুক্ষণে পথ ধরলাম।



         রাস্তাটা গ্রামের পেছন দিকে নদীর চড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। লোকজনও সাধারণত কম চলাচল করে, কোন বসতি নেই আসেপাশে। এ রাস্তায় দিনের বেলাতে কয়েকবার যাতায়াত করেছি আমি, কেমন যেন গা ছমছমে। আর রাতের বেলা তা আরও ভয়ানক মনে হয়। নিশিকান্ত বেশ জোর গলায় হরিবোল দিতে লাগল। ছেলেছোকরা রা নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা ইয়ার্কি মারতে মারতে এক সাথে এগোচ্ছে। রাস্তার দুপাশের বড় বড় গাছ গুলো যেন মাথা ঝুকিয়ে নীরবে আমাদের পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। কাছে পিঠে কোন গাছে কোন অজানা রাতের পাখি হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে খুব জোরে ডেকে উড়ে গেল। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অজানা কোন সংশয়ে কেন জানিনা চঞ্চল হয়ে উঠল। সবাই আমরা জোরে জোরে পা চালাচ্ছি। গোপাল খুড়োর ছোট ছেলে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল,....

  

        "আরে,.......খাট টা যেন নড়ে উঠল !!! " 


       যেই না বলা অমনি খাট নামিয়ে দেখি খুড়োর দেহ খাটে নেই, খোলা দড়ি ও সাদা থান পড়ে আছে। খুড়োর দুই ছেলে বাবা..... বাবা...… করে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। সাথে সাথে ঠিক পাশের উঁচু গাছের ডাল থেকে ভারী কিছু হুড়মুড়িয়ে দূরে সরে গেল। ছেলে ছোকরা-রা খুব ভয় পেয়ে একত্রে আমার পাশে এসে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে পড়ল। ঠিক কি করা উচিৎ বুঝতে পারছি না। তবে এটা বুঝলাম আমি ভেঙে পড়লেই বিপদ আরও বাড়বে। মন কে যতটা সম্ভব সংযত রেখে বিপদ থেকে রেহাই পাওয়াই এখন প্রথম কাজ বলে মনে হল।


       মনে করতে লাগলাম বাবার মুখে শোনা ঠিক একই ঘটনার কথা, সেখানে ছিনতাই হওয়া মৃতদেহ ফেতৎ পাওয়ার জন্য মৃতদেহের বদলে সদ্য মৃত এক গভীন গরু ওই স্থানে রেখে অসার ঘন্টা খানেকের মধ্যে ওই মৃতদেহ প্রায় অক্ষত অবস্থায় ফেরৎ পাওয়া গিয়েছিল। আমি নিশিকান্ত কে বললাম দুজনকে নিয়ে এক্ষুনি গফুর আলীর বাড়ি যেতে । সে আজ বিকেলে হাটের পাশের পুকুর থেকে কয়েক মন রুই, কাতলা ধরেছে। সেখানে থেকে যতটা সম্ভব নিয়ে আসা। যেমন বলা তেমনি কাজ। নিশিকান্ত ঘন্টা খানেকের মধ্যেই এক ঝুড়ি মাছ ওই গাছতলায় রাখে। একটু দূরে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। এরপর খালি চোখে ওখানে উপস্থিত প্রায় সবাই যা দেখলাম সেটা প্রত্যেকের হৃদগতি বন্ধ হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। দুটো সাদা লম্বা কঙ্কালসার হাত গাছের মগডাল থেকে ঘুমন্ত শিশুর মত গোপাল খুড়োর মৃতদেহ ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে আনছে। মৃতদেহ রেখে মাছের ঝুড়িটাকে ওপরে তুলে নিল।  


        ততক্ষণে মৃতদেহ ফেরৎ পেয়ে দ্রুত পায়ের শ্মশানের দিকে হাটা লাগলাম সৎকারের উদ্দেশ্য। সৎকার করে ফেরার সময় আমরা আর ওই পথ আর মাড়াইনি। এই ঘটনার পর থেকে আজও ওই পথে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy