সতের নম্বরের ঘর।
সতের নম্বরের ঘর।


ঘটনাটি আমার সাথে ঘটে প্রায় বছর সাত আট এক আগে। আমি তখন একটা মার্কেটিং কোম্পানিতে সিনিয়র সেলস এক্সাকাটিভ এর কাজ করতাম। মূলত: সারা দেশ জুড়েই আমাদের কাজ হতো । এক একজন এক্সিকিউটিভ কোম্পানির এক একটি একটি রাজ্যে মার্কেটিং এর দায়িত্ব সামলাত। প্রথমে আসাম ও পরবর্তীতে উড়িষ্যায় কাজ করতে হয়েছিল। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক ভালো-মন্দ লোকের সাথে যেমন পরিচয় হয়েছিল তেমনি রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রাম গঞ্জে ঘুরতে হয়েছিল। নানা রকম অভিজ্ঞাতার সাথে সাথে কিছু ভৌতিক , অতিপ্রাকৃতিক অভিজ্ঞাতাও সঞ্চয় হয়েছে , তারই একটি আজ অপনাদের সাম
ঘটনাটি ঘটে উড়িষ্যা র ভুবনেশ্বর রেল স্টেশনের খুব কাছেই সুমঙ্গল নামের একটা মাঝারি মানের হোটেলে । প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কটা দিন বুক করা থাকতো। খুব বড় নাহলেও ওয়েল ডেকোরেটেড পাঁচ তলার দক্ষিণ দিকরওই আঠেরো নম্বরের শেষ ঘর থেকে বাইরের দৃশ্য খুব ভালো দেখা যেত । আমার ক্লাইন্ট মিটিং এর উপযুক্ত পরিবেশ থাকায় ঘরটি আমার পছন্দের ছিল। সতের নম্বরের ঘরটি প্রতিবারই বন্ধ দেখতাম। এবং ফলস্বরূপ হোটেলের এই অংশটি একটু বেশিই শান্ত থাকত । প্রতি মাসের দশ থেকে পনের দিন থাকতাম বলে হোটেলের ম্যানেজার, কর্মচারীর সাথে একটা সু সম্পর্ক গড়ে উঠেছ
শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত মাসের বুকিং বাতিল করতে হয়েছিল। টেলিফোনে হোটেল ম্যানেজার রমেশ বাবুকে এমাসের বুকিং কথা বলতে উনি খুব দুঃখের সাথে জানালেন ওই ঘর টি এ মাসে পাওয়া যাবে না। ঘরটি গতমাস থেকেই আমার বুকিং বাতিলের পর পরই এক দম্পতি ব্যাবহার করছেন। আর এমাসে রথযাত্রা থাকায় এই সময়ে অন্য কোনো হোটেলে ঘর পাওয়া প্রায় অনিশ্চিত । এই অবস্থায় আমি ওনাকে রুম নম্বর 17 এর কথা বলি। শুনেই উনি এককথায় আমাকে না বলেন। অনেক জোরাজুরি করায় উনি বলেন যে বছর খানেক আগেও ওই ঘরটা খোলা থাকত কিন্তু একটা সুইসাইড ঘটনা ঘটার পর থেকে অনেকে ওই ঘরে ভুতের অস্তিত্ব আছে বলে রটোনা রটায়। আর তার পর থেকেই এটা বন্ধ। কিন্তু সাথে সাথে ঘরটি খোলার চেষ্টাও চলছে বলেও তিনি জানান। ভুতের কথা শুনে খুব হেসে আমি ওনাকে ঘরটি খুলে দেওয়ার জন্য বললাম এবং সেটা আমার জন্যই যাতে বুকিং করা হয় তার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করলাম। উনি মালিকের সাথে কথা বলে দু এক দিনের মধ্যেই জানা দুদিন পর আমি নিজে থেকেই ফোন করতেই উনি সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে বলে যেতে বললেন। এমনিতেই রথের সময় হোটেলের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। হোটেল মালিক সেই সুযোগেইর ই সদ ব্যাবহার করলেন বলে মনে হল। যাই হোক ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন ছাড়লা ঠিক সময়ে ট্রেন ভুবনেশ্বর পৌঁছলো। রামেশবাবু হোটেলের এম্বাসেডর টা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। রথের আগে পুরো শহর আগাম উৎসবে মেতে উঠেছে। চারিদিকে সাজো সাজো রব। মিনিট পনেরর মধ্যে হোটেলে পৌঁছে গেলাম। হোটেলের রেজিস্টার খাতায় সই করতে করতে রামেসবাবুর গলার আওয়াজ পেলাম। কিছু ফরমাল কথা বার্তার পর উনি নিজেই আমার সাথে ওই রুম এ এলেন। খোলাই ছিল বিশেষ পার্থক্য নজরে এল না। রমেশ বাবু আমাকে এই ঘরে মহিলার আত্মহত্যার ঘটনাটি কাউকে বলতে বারণ করলেন এবং সাথে সাথে উনি এটাও বললেন যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে তিনি অবশ্যই অন্য হোটেলেরও ব্যাবস্থা করে দেবেন । ধন্যবাদ জানিয়ে গর্ব করে বললাম সে আর দরকার হ
সারাদিনের ধকল ছিল, রাতের ঘুম টা খুব ভালো হল । পর দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম।বাইরে কিছু কাজ আর দু দুটো ক্লায়েন্ট ভিসিটে দিন টা কি ভাবে কেটে গেল টের পেলাম না। সে দিন শুতে একটু দেরিই হয়েছিল। রাতের খাওয়া শেষ করে খাটে শুয়ে ল্যাপটপে অফিসে রিপোর্ট করছিলাম । হঠাৎ ই ঘরের লইট টা একবার বন্ধ হয়ে অবার জ্বলে উঠল। আলো টাও মনে হল অনেক কম , আবার কখনো বেশি। সিলিং ফ্যান এর গতিটা মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক ভাবে কমে গিয়ে আবারও স্বাভাবিক হচ্ছে। মিনিট তিনেক। এরকম হওয়ার পর সব আবার ঠিক । মনে হয় ভোল্টেজ এর সমস্যার কারণে এমন হয়েছিল। ঘড়িতে তখন বারটা বেজে চল্লিশ মিনিট। কাজ সেরে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিক তাকাতেই এই ঘরে মহিলার আত্মহত্যার কথা মনে পড়ে গেল। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। মাঝরাতে হঠাৎ ই ঘুম টা ভেঙে গেল। প্রচন্ড গরম লাগছে, ফ্যান বন্ধ । মনে হল বুকের উপর শীতল ভারী কিছু স্পর্শ করে বেরিয়ে গেল। গলাটা কেমন শুকিয়ে গেছে। হাত বাড়িয়ে জলের বোতল থেকে জল খেতে খেতেই ফ্যান টা আবার চলতে শুরু করলো। কারেন্ট চলে গিয়েছিল হয়তো। কাচের জানালার বাইরে থেকে মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকানোর তীক্ষ্ণ আলো ঘরে এসে পড়ছে। আবার শুয়ে পড়লাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। হঠাৎ মনে হল বুকের উপর আবারও শীতল কিছু একটা স্পর্শ হছছে। তড়িৎ গতিতে বুকে হাত দিতেই প্রথমে কিছু মনে হয় নি কিন্তু বিশ্বাস করবেন না পরমুহূর্তে যেটা অনুভব করলাম বা দেখলাম তার জন্য আমার হৃদয় ও চোখ একদম প্রস্তুত ছিল না। রামেসবাবুর দেওয়া বর্ণনার মতো শাড়ি পড়া একটি মেয়ে আমার ঠিক বুকের ওপরে থাকা ফ্যানের সাথে দাড়িতে ঝুলছে। পায়ের বুড়ো আঙুল দুটো মাঝে মাঝে দোল খেয়ে বুকের উপর স্পর্শ করে যাচ্ছে। বাইরের বিদ্যুৎ চমকানোর আলো লাশের মুখে পড়তেই বীভৎস ভয়াবহ মুখটা দেখতে পেলাম। জিভ বেরিয়ে রয়েছে, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে যেনএখনই খসে পড়বে। কয়েক সেকেন্ডের মতো আমার হৃদপিন্ড থেমে গেল। শরীর ক্রমশ অবস হয়ে আসছে। কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। হঠাৎ ই মনে হলো আমি জ্ঞান হারালাম। চোখ খুললাম সকালে দরজায় কলিং বেলের শব্দে। ধীরে বিছানা থেকে উঠলাম। মাথাটা বেশ ভারী মনে হল। হোটেলের ছেলে চা দিয়ে গেল। আমি চা খেয়ে রমেশ বাবুকে অন্য হোটেলের ব্যাবস্থা করে দিতে বললাম। রমেশ বাবু কথা রেখেছিল। এত বছর পরেও ওই ঘটনাটিকে বিশ্বাস করতে মন চায় না। মনকে এই বলে সান্তনা দেই যে ,যেদিন নিশ্চই স্বপ্নই দেখেছিলাম।