লোকগাথা।
লোকগাথা।
সময়টা ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাস। তখন আমি কলকাতায় একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী করি। আমার পাশের টেবিলে রমেন বসে। রমেনের আদি বাড়ি সুন্দরবনে। এখন কাজের সুবিধার জন্য কলকাতায় একটা মেসে থাকে। আমার সাথে রমেনের সম্পর্ক সহকর্মীর সম্পর্কের থেকেও বেশী বন্ধুত্বপূর্ণ। ও কয়েকবার আমার বাড়িতেও এসেছে, থেকেছে। আদতে খুব ভাল ছেলে, তবে গ্রামের ছেলে বলে কিনা জানি না, খুবই কুসংস্কার বিশ্বাসী। কথাবার্তা ছাড়াও তার গলায় , হাতে, ও কোমরে তার নিদর্শন বর্তমান। তবে এ নিয়ে আমাদের গাঢ় বন্ধুত্বে বিশেষ কোনো সমস্যা ছিল না।
ওই বছর জানুয়ারী মাসে রমেন আমাকে বলল,...
--- সামনের সপ্তাহে বাড়ি যাচ্ছি , চল আমার সাথে দেশের বাড়ী ঘুরে আসবি।
একটু ইতস্থত করার পর রাজি হয়ে গেলাম। একেই পিকনিকের সিজন, ঠান্ডাও পড়েছিল তেমন। তাছাড়া অনেকদিন ঘুড়তেও যাওয়া হয়নি।
শনিবার সকাল সকাল একটা রমেনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। শিয়ালদা থেকেও ক্যানিং হয়ে অনেকগুলি নদী নালা, সড়ক পথ পেরিয়ে সন্ধ্যার পর রমেনের বাড়ি পৌঁছলাম। পথে যেতে যেতে রমেনের সাথে অনেক কথা হল। কিছু গল্পও হল। ওদের এলাকার এমন একটা হাড়হীম করা ঘটনা শোনাল তাতে আমার বুক দুরু দুরু করতে লাগল।
তবে রমেন যা কুসংস্কার বিশ্বাসী ছেলে তা ভেবে মনকে কিছুটা অভয় দিলাম।
এবার ওর বলা সেই ঘটনার কথা বলি।
বেশ কয়ে কবছর আগের কথা। গ্রামের একমাত্র ক্লাব বালক সংঘের একটা ফুটবল টিম আছে। এখনও বালক সংঘের সুনাম সর্বজন বিদিত। সকালে বিকালে নিয়মিত এখনো ফুটবল খেলা চলে। বেশ কয়েক বছর আগে গ্রামে বিশু নামের একটা ছেলে ছিল। অসম্ভব ভালো ফুটবল খেলত। রোজ সকালে বিশু সবার আগে ফুটবল নিয়ে মাঠে নামতো। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব সময়ে তার হেরফের হত না। কেউ না আসলে ও বাড়ী বাড়ী গিয়ে ডাকত। এক বর্ষামুখর সকালে বিশু একই ফুটবল নিয়ে মাঠে নামে। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ঠাৎই বজ্রপাতে বিশু মাঠে মাঝেই তড়িতাহত হয়ে মারা যায়।
ওই ঘটনার প্রায় মাস তিনেক পর থেকে খুব ভোরের দিকে বালক সংঘের মাঠে অনেক ছেলেকে মড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে।
কানাঘুষায় শোনা যায় বিশু নাকি দরজার সামনে এসে ফুটবল খেলার জন্য ডাকে। কেউ যদি ভুল করে তার ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়ে তবে সেদিনই তার হতো অন্তিম দিন।
বিশুর ঘটনা শুনতে শুনতে একসময় রমেনের বাড়ী পৌঁছে গেলাম।
রাত ন টার মধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। রমেন আর আমি এক খাটে পাশাপাশি শুয়েছি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। একটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে ঘুমটা হটাৎ ভেঙে গেল। বালিশের তলা থেকে হাতঘড়ি টায় দেখলাম তিনটে কুড়ি। ঘরের মধ্যেই ভয়ানক ঠান্ডা লাগছে। পায়ের পাতাগুলি তখনও ঠান্ডা। রমেন নাকডেকে ঘুমোচ্ছে। মাথার কাছে থেকে জলের বোতল থেকে দু ঢোক জল খেয়ে পাস ফিরে শুলাম। মিনিট দশের পর মনে হল কে যেন অস্ফুটে আমার নাম ধরে ডাকছে।
--- রমেন!! না না সে তো আমার পাশেই। তবে কে? খুব খুব পরিচিত গলা ।
কি একটা আবেশে আমি উঠে বসলাম। বাইরে কাতর সুরে আমায় ডাকছে। সেই ডাককে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমি ক্ষণে ক্ষণে হারিয়ে ফেলছি। আমাকে যেতেই হবে। একটা তীব্র চুম্বকীয় ভাললাগার টান অনুভব করছি। মাটির ঘরে ধীরে ধীরে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজা থেকে কাঠের ডাসা নামিয়ে ছিটকিনি খুলতে যাব , হঠাৎই পিঠেকে যেন আলতো করে তার শীতল হাত রাখল। মুখ ঘুরিয়ে দেখি রমেন।
--- কিরে দরজা খুলছিস? অচেনা জায়গা, ডাকবি তো আমায়।
হঠাৎই আমার মাথাটা ঘুরে গেল। জ্ঞান ফিরলে সব ওকে বলি।
বাড়ির সবাই একবাক্যে বলল আমি নাকি বড় বাঁচা বেঁচে গেছি ।
বিশু এসেছিল আমাকে নিতে।
গ্রামে বিশুর লোকগাথা এখনো মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়।