Chitta Ranjan Chakraborty

Abstract Others

2  

Chitta Ranjan Chakraborty

Abstract Others

শৈশব চুরি

শৈশব চুরি

7 mins
198


বিকেলে বারান্দায় বসে আছি এমন সময় পাপন ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল, বাবা তুমি মাকে বলোনা আমি একটু ভিডিও গেম খেলি। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম, ওদিকে গিন্নির গর্জন শুনতে পেলাম। রাগে গজগজ করতে করতে পাপনকে টেনে নিয়ে বলল, ফের বাবার কাছে এসে আবদার। আমি তো বলেছি অংকের দাদামনি এক্ষুনি আসবেন। বই, খাতা, কলম নিয়ে পড়ার ঘরে পড়তে বস। পাপন নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, বলল না না না, আমি আজ পড়বো না। আমি আজ গেম খেলব কম্পিউটারে। আমাকে কম্পিউটার খুলে দাও। ওর মা বললো, এবার মারবো কিন্তু। আগামী কাল স্কুল আছে, পড়া না করলে স্কুলে মারবে। চল এক্ষুনি পড়তে বসবি। পাপন বারবার বাবা বাবা বলে চিৎকার করতে লাগলো। আমি ওর কান্না দেখে ওর মা মৌপ্রিয়া কে বললাম, থাক না- ও যখন বারবার বায়না করছে দাদা মনি আসার সময় পর্যন্ত ওকে একটু খেলতে দাও। মৌপ্রিয়া আমাকে ধমক দিয়ে বলল, চুপ করো তুমি। তোমার আস্কারা পেয়ে ছেলেটা বাঁদর হয়ে যাচ্ছে। এখন খেলা বড় না পড়া বড়। এই বলে পাপনকে পিঠে একটি চড় মেরে নিয়ে গেল। পাপন কাঁপতে লাগলো, আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আঃ কি করছো, ছেলেটাকে কি মেরে ফেলবে? মৌপ্রিয়া মুখ খিঁচিয়ে বলল, থাক আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না, অনেক হয়েছে। কাঠের হিসাব করা কেরানি আমার জীবনটাকে তো রসাতলে দিয়েছে, ছেলেটার জীবনও নষ্ট করবে। ছেলেটা যেন শুধু আমার, তোমার কোন দায়বদ্ধতা নেই। অফিস থেকে ফিরে এসে শুধু চা খাওয়া আর ক্লাবে গিয়ে আড্ডা দেওয়া। আস্কারা দিয়ে দিয়ে ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট করছো। এই বলে মৌপ্রিয়া পাপনকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না, শুধু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।


তাকিয়ে থাকতে থাকতে মৌপ্রিয়ার কথা গুলো ভাবতে থাকলাম। আজ নয় শুধু, প্রায়ই আমাকে কাঠের হিসাব করা কেরানি বলে অপমান করে। কিন্তু ও জানে না, এই কেরানি বাবুর দৌলতেই সংসার চলে। তার সাজগোজ, জামা কাপড়ের কিছুরই খামতি থাকে না। আমার মতের বাইরে দাম স্কুলে পাপনকে ভর্তি করে দিয়েছে। প্রতিমাসে ছেলেটার স্কুলে অনেক টাকা ফিস গুনতে হয়। ও সবই জানে ওদের কোন অভাব রাখিনা আমি নিজের জন্য কিছুই করি না। অফিস থেকে ফিরে এসে ছেলেটাকে কাছে ডেকে একটু আদর করলেই মৌপ্রিয়া রেগে যায়। শুধু পড়া পড়া পড়া...। আমার আমার কাছে এলেই নাকি ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। মৌপ্রিয়া কে আমি দামি মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছি। কিন্তু আমি একটা পুরোনো মডেলের মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। ও নামি স্কুলে পড়িয়ে ছেলেকে ডাক্তার বানাবে। নামি ইস্কুলে পড়লেই কি ডাক্তার হওয়া যায়? আমাদের সময় তো আমরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম। বাংলা স্কুলে লেখাপড়া করে কি কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়নি? আমার কজন বন্ধু আছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক।


এসব ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে ছেলেটার শৈশবকাল নষ্ট করে দিচ্ছে, বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে। বাইরে বের হতে দেয় না, কোন খেলাধুলা না, কারোর সাথে মেলামেশা না। শুধু ঘরে বন্দি করে পড়া পড়া পড়া।এসব ভাবতে ভাবতে আমার মনের কোণে ভেসে ওঠে হারিয়ে যাওয়া শৈশব কাল আর শৈশবের স্মৃতি গুলো। আমাদের বাড়ি গ্রামের ছিল। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। মাঝখানে ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছোটবেলায় কত কিছুই না করেছি। আমার বন্ধু হরেন, সুমন্ত, সবিতা, বাসন্তী এদের কথা মনে পড়ে। আমরা প্রতিদিন সকালে লেখাপড়া করে দল বেঁধে নদীতে স্নান করতে যেতাম। নদীতে সাঁতার কাটতাম, সে কি মজা। তারপর বাড়ি এসে খেয়েদেয়ে স্কুলে ছুটে যেতাম সকলে মিলে। রোজ বিকেলে দলবেঁধে স্কুলের মাঠে যেতাম হাডুডু, দারিয়া বাধা, কানামাছি, এসব কত কি খেলতাম। দাদারা পাশের মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতো। আমরা কখনো কখনো বসে দেখতাম। কখনো মাঠের বাইরে বল চলে গেলে কুড়িয়ে এনে দাদাদের হাতে দিতাম। বৈশাখ মাসে আমরা সবাই আম গাছে ঢিল দিয়ে আম পারতাম, আম পেড়ে কলার পাতায় আমমাখা খেতাম সবাই মিলে। সবাই মিলে কাঁঠাল গাছ থেকে পাকা কাঁঠাল পেরে ভেঙে খেয়ে নিতাম। হাতে মুখে কাঁঠালের আঠা লেগে যেত, আবার সেগুলো সরষে তেল দিয়ে ওঠাতাম। সন্ধ্যে হলে টিমটিম কপি অথবা হ্যারিকেনের আলোতে বই পড়তাম।


একবার তো গাছে আম পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে হরেনের ডান পাটা মচকে গেল। কি ভয় পেয়ে গেছিলাম, ওর মা ওকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে জলপট্টি, আর চুন হলুদ গরম করে লাগিয়ে দেয়। নদীতে সবাই মিলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে যেতাম, একদিন আমার বড়শিতে একটি মাছ ধরেছে, আমি হ্যাচকা টান দিতেই মাছটি ছুটে গেল, আর খালি বড়শিটা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সবিতার কানে এসে গেঁথে গেল। সে কি কান্ড। ওতো চিৎকার শুরু করে দিলো। আমরা কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, পরে সুভাষ কাকা এসে ওর কান থেকে বড়শিটা খুলে দিল। আর সে কি রক্ত পড়তে লাগলো। সুভাষ কাকা দুর্বার পাতা হাতে ঘষে রস বের করে ওর কানে লাগিয়ে দিল। এর জন্য ওর মায়ের কাছে কম বকা খেতে হয় নি আমাকে। গ্রামের স্কুল পাশ করে পাশের গ্রামে হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। আমার সাথে হরেন, সবিতারা সবাই ভর্তি হল। সেখানেও নিজেদের বন্ধুবান্ধবদের পেয়ে আবার আগের মতো স্কুলে পরিবেশ তৈরি করে নিলাম। আমি ভালো গোলকিপার ছিলাম। প্রতি শনিবার স্কুলের শেষে আমরা ফুটবল খেলতাম। দূরে দূরে অনেক জায়গাতেই আমাদের টিম জয়ী হয়ে এসেছে। শ্রেষ্ঠ গোলকিপারের সম্মান দুবার পেয়েছি।আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক নারায়ন বাবু বলতেন, শোনো তোমাদের শুধু পড়াশোনাই নয়, খেলাধুলোও করতে হবে। কারণ খেলাধুলার মধ্যে দিয়ে সুস্থ শরীর এবং সুস্থ মন তৈরি হবে। তবে তো পড়াশোনায় মন বসবে। প্রতিবছর বার্ষিক খেলা প্রতিযোগিতায় আমি খেলতাম। আমি দৌড়ে বরাবরই প্রথম হতাম। খেলার শিক্ষক মন্টু স্যার আমার পিঠ চাপড়ে বলতো, তাপস, তোকে আরো জোরে দৌড়াতে হবে। জেলায় প্রথম হয়ে রাজ্যের খেলায় যেতে হবে। রাজ্যের খেলায় যদি তুই একবার প্রথম হতে পারিস, তোকে আর পায় কে। বড় বড় ক্লাবগুলো তোকে নিয়ে নেবে, তোর পড়ার খরচ আর খেলার খরচ তারা তোকে দেবে। ভবিষ্যতে ভালো সরকারি চাকরি ও পাবি। মন্টু স্যারের কথা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনেছি এবং দুবার আমিরাত যে দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছি। সার্টিফিকেট এবং মেডেল পেয়েছি।দুটো ক্লাবের লোক এসে আমাকে তাদের ক্লাবে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু আমার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে আমি। স্নেহের বসে আমাকে আর যেতে দিল না। যদি যেতাম তবে হয়ত আমি সারাদেশে নাম করতাম। হয়তো এর চেয়ে ভালো চাকরীও পেতাম


আমি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরই চাকরির জন্য আবেদন করি,ইন্টারভিউতে আমার রাজ্য স্তরের দুটো সার্টিফিকেট দেখে অবাক হয়ে আমাকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর হঠাৎ কয়েক মাসের ব্যবধানে বাবা-মা মারা যান। তারপর মামা আমার জন্য মেয়ে দেখে মৌপ্রিয়ার সাথে বিয়ে দেয়।

আমাদের সময়ে এত বই ছিল না, এত পড়ার চাপ ছিল না, স্কুল-কলেজেও ছিলনা। কিন্তু এইসব গ্রামের বউ ছেলেমেয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, আমার বন্ধু দুজন মেদিনীপুরে আছে। একজন ডাক্তার আর অন্যজন কলেজে পড়ায়।ফুটবল খেলি আমার এক বন্ধু রাজ্যের হয়ে ফুটবল খেলে অবশেষে রেলে ভালো চাকরি করছে।


আমরা তো কোনদিন এত ছোট বয়সে স্কুল কি বুঝতাম না আর এত ভারী ভারী বইখাতা নিয়ে বাবা মায়ের হাত ধরে স্কুলে যেতাম না।

এখন সময় পাল্টেছে মানুষের চাহিদা বেড়েছে,চাহিদার সাথে সাথে নামিদামি স্কুল-কলেজ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আর মানুষের মধ্যে বেড়েছে প্রতিযোগিতা। পারলে মায়ের গর্ভেই শিশুকে পড়ার পাঠ শেখাতে চায় অনেক বাবা-মা।


আমরা হতাশ হয়ে পড়ছি, প্রতিযোগিতা, শুধু সব জায়গাতেই প্রতিযোগিতা। আর সেই প্রতিযোগিতার খুঁটি তৈরি করছি এইসব শিশুদের। প্রতিদিন আমরা নিষ্ঠুরের মতো শৈশব চুরি করছি এদের। খেলার মাঠ নেই পার্কের জায়গা কমে যাচ্ছে, অট্টালিকায় ছেয়ে যাচ্ছে। ঘরের বাচ্চারা একাকীত্ব সময় কাটাচ্ছে। বই ছাড়া আর অন্য ভাবনার সময় তাদের নেই। বর্তমান সময়ে বড় নিষ্ঠুর। কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট এসব কিছু শিশুর জন্মের পরেই তাদের গ্রাস করছে।এখন কোন শিশুকে খাওয়াতে বা ঘুম পাড়াতে গেলে সেই ঘুম পাড়ানি গান আর কাকাতুয়ার গল্প, বর্গীর গান শোনে না। শোনে স্মার্টফোনে অদ্ভুত সব কার্টুন আর শিশুদের না বোঝা ভাষা আর গান।


প্রতিদিন শিশুদের টিফিনে ও চলে প্রতিযোগিতা। কার মা অন্যের মায়ের চেয়ে দামি সুন্দর টিফিন দিয়েছে চলে মায়েদের ও বাচ্চাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা।

তারপর একদিন অফিস থেকে ফেরার পর দেখি, পাপন আর ওর মা দুজনেই কাঁদছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাপন এসে আমাকে বলল, বাবা, আজ না মা ভালো টিফিন দেয়নি। বন্ধুরা ওদের টিফিনে অনেক কিছু দিয়েছিল। ওরা আমার টিফিন দেখে হাসাহাসি করছিল আমার কি লজ্জা বাবা। আমি মৌপ্রিয়া কে বললাম, টিফিনে কি দিয়েছিলে আজ? যাতে ওর লজ্জা পেতে হল? ঝাঁঝালো সুরে বলল, ওসব শুনে তোমার কি কাজ? তোমার তো অফিস বাড়ি, আড্ডা এই তো, সংসারের কোন খবর তুমি রাখো না। একদিনও অফিস বাদ দিয়ে ছেলেটাকে স্কুলে নিয়ে যাওনা, নিয়েও আসনা। যত ঝামেলা আমার। আজ শরীরটা ভাল ছিলনা তাই, দু পিস পাউরুটি বাটার চিনি মেখে দিয়েছিলাম। আমি বললাম টিফিন তো ভালোই হয়েছে। এতে দোষের কি?-তুমি বুঝবে না। অন্য বাচ্চাদের টিফিনে ডিম সেদ্, ক্রিম বিস্কুট, চকলেট, এগচাউ এসব নিয়ে যায়। আর আমার ছেলে....। বলেই থেমে গেল আর কান্নার বেগ বেড়ে গেল। আমি কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ভাবলাম হায়রে সময় আরো কত কিছুর প্রতিযোগিতা দেখতে হবে। হ্যাঁ প্রতিযোগিতা। পাপন পড়াশোনায় ভালো, কিন্তু গতবার ত্রৈমাসিক পরীক্ষায় ইংরেজিতে এক নাম্বার কম পেয়েছে বলেই দুদিন মৌপ্রিয়ার কান্না থামেনি। তারপর পাপন বারবার নিজের ভুল স্বীকার করে আর ভুল করবে না কথা দিলে মৌপ্রিয়া কান্না থামে। মৌপ্রিয়া একদিন পাপনকে বেশ মেরেছিল। পাপনের অপরাধ স্কুলের মাঠে বৃষ্টির জলে পড়ে গিয়ে জামা প্যান্টে কাদা লাগিয়েছিল। তাই স্কুল থেকে মৌপ্রিয়া কে ফোনে বলেছে পাপনকে বাড়ি নিয়ে যেতে। তারপর পাপনের কি জ্বর! টানা পাঁচ দিন জ্বর থামেনি। ডাক্তার, হাসপাতাল কতবার দৌড়োদৌড়ি করার পর জ্বর ছাড়ে সেই থেকে পাপনকে জোরে মারে না। ছেলেটাও এমন ওর বিপদে আশ্রয় হল আমার কোল। আমার কোলে এলেই আর যেতে চায় না। আর মৌপ্রিয়ার বকুনি খেতে হয় আমাকে। তবু পাপন যেতে চায়না, গলা জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে থাকে ঘাড়ে।


এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখের জল গড়িয়ে পড়ে বুঝে উঠতে পারিনা। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মৌপ্রিয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ধরো চা‌ নাও আমি কাপটা হাতে নিই, সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে একি তোমার চোখের জল কেন? শরীর খারাপ হয়নি তো? বলেই কপালে হাত দেয়। আমি বলি কিছু হয়নি এসময় তুমি চা নিয়ে এলে বলেই খুশিতে চোখে জল। মৌপ্রিয়া মুচকি হাসি হেসে চলে গেল। আমি মনে মনে ভাবলাম পাপনের দাদামনির জন্যই এই বাড়তি চা পেলাম এসময়ে। ভাবতে ভাবতেই একছুটে পাপন এসে লাফ দিয়ে কোলে চড়েই আমার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগলো।ধ


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract