Chitta Ranjan Chakraborty

Romance Tragedy

4  

Chitta Ranjan Chakraborty

Romance Tragedy

টমি ও কালু

টমি ও কালু

7 mins
306


আমাকে না জানিয়ে বনানী একদিন কুকুরটাকে নিয়ে এলো বাড়িতে। বাড়িতে কুকুর পোষা আমি পছন্দ করতাম না


। কারণ একে নিয়ম করে স্নান করানো, খাওয়ানো ,ডাক্তার দেখানো এসব কাজ করা আমি বরাবরই পছন্দ করতাম না। বেশ কিছুদিন ধরে বনানী বলতে থাকে একটি বিলেতি কুকুর বাড়িতে আনার জন্য।একটি কুকুর থাকলে বাড়ির পরিবেশটি ভালো হবে। রোজ অফিসে যাওয়া বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া এটা আমার প্রতিদিনের রুটিন। আর রবিবারটা আমার কাছে একটা বিশেষ দিন ঘুমিয়ে থাকি বেলা দশটা পর্যন্ত। রবিবারের ঘুমের মধ্য দিয়ে আমার সপ্তাহের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।কোন কোন রোববার বনানীর আবদারে খোকাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়।সেটাও আমার কাছে একটু বিরক্ত কর কারণ অফিসের চাপ ভীষণ তাই আমি প্রতি রবিবার বাড়িতে শুয়ে বসে ভালোমন্দ খেয়ে কাটাতে চাই। কুকুর বাড়িতে থাকলে ওর সঙ্গে সময় দিতে হবে সেটা আমি পারবো না। বনানী কেও সে কথা বুঝিয়ে বলেছি কিন্তু বনানী একটু একগুঁয়ে তার চিন্তাভাবনার সঙ্গে কেউ দ্বিমত হলে সে ভীষণ রেগে যায়। তাই আমি ওর সঙ্গে বেশি কথা বলিনি।

একদিন অফিস থেকে এসে দেখি ধবধবে একটি সাদা কুকুর নিয়ে এসে ঘরের মেঝেতে বসে কুকুর নিয়ে খেলা করছে। আর পাশে বসে আছে বাবাই, সে বসে বসে কুকুরটিকে দেখছে আর হাসছে। আমাকে দেখে বনানী বলে উঠে দেখো দেখো কি সুন্দর সাদা ধবধবে বাচ্চাটি পেয়েছি ওর বয়স বেশি নয় ভারী সুন্দর কি মিষ্টি ওর মুখটা। কি নাম রাখবো গো? আমাকে জিজ্ঞেস করে বনানী। আমি একটু বিরক্ত হয়ে বলি ওসব নাম আদিখ্যেতা আমার দ্বারা হবে না।


তুমি যখন ওকে নিয়ে এসেছো তুমি ওর নাম রাখ।আর ওকে নিয়ে কী করবে তুমি বুঝবে কিন্তু দেখো বাবাইয়ের খাবারে কুকুরের লোমে যেন কোনো সমস্যা না হয়। আর ওকে রাখবে কোথায়?বনানী শান্তভাবে আমাকে এক গ্লাস জল দিয়ে বলে নাও এবার কাপড়-চোপড় ছাড়ো তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না তুমি শুধু বলো ওর কি নাম রাখবো। আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম তোমার মনে যা চায় রাখোনা।বনানী বলে, না ওর নাম তোমাকে রাখতেই হবে।আমি বুঝছিলাম যদি ওর কথা না রাখি তবে ও ভীষণ রেগে যাবে তাই আমি অনেক ভেবে চিন্তে বললাম, ওর নাম রাখ টমি। বনানী খুব খুশি হল বলল বাহ ভীষণ সুন্দর নাম তো। এ নামেই ডাকবো ওকে।একথা বলে টমিকে আমার কোলে দিয়ে চা করতে চলে যায় আমি প্রথমে একটু বিরক্ত হয়ে ওকে কোলে নেবো কি নেবো না ভাবছিলাম কিন্তু দেখি টমি এত ভালো আমার গা মাথা চেটে আদর করে দিল।লেজ নাড়তে নাড়তে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাল আমি যেনো হঠাৎই সব ভুলে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর মুখ টিপে আদর করলাম। বাবাই আস্তে আস্তে আমার কোলে এলো দেখলাম এই সময়ের মধ্যেই বাবাইয়ের সঙ্গে টমির খুব ভাব হয়ে গেছে।

বনানী চা নিয়ে এলো দুজনে চা খেতে খেতে আমি বললাম ওর খাবার দাবার সব এনেছ তো স্নান করানোর সাবান-শ্যাম্পু এসব তো লাগবেই।ও বললো এসব নিয়ে তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবেনা আমি সব এনেছি আসার পথে ডাক্তার দেখিয়ে ওকে ইনজেকশন দিয়ে এনেছি। দেখো না একদিনে বাবাই এর সঙ্গে কেমন ভাব জমিয়েছে। বাবাই এরও একজন খেলার সাথি হল। আমি বললাম সব ঠিক আছে তবে দেখো খারাপ কিছু যেন না হয়।


বনানী বললো ওসব নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। তারপর দেখলাম টমিকে নিজের হাতে বানানো খাবার খাইয়ে দিল মুখ মুছে দিয়ে ওকে ছাদে নিয়ে গেল সেখানে পটি করিয়ে পা গুলো মুছে দিয়ে খাটে ওর শোয়ার ব্যবস্থা করে দিল। আমি বললাম, ওর জন্য আলাদা শোবার ব্যবস্থা করে দাও। বনানী বলল, না ও আমাদের সঙ্গেই শুবে।আমি মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হলাম কিন্তু মুখে কিছু বললাম না বনানীর ভয়।


কদিনের মধ্যেই টমি আমাদের সংসার এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠল। সে সকালে উঠে ছাদে গিয়ে পটি করে এসে বনানী তাকে খায়িয়ে দেয়। তারপর সারাদিন চলে বাবাইয়ের সঙ্গে ওর খেলা। বাবাই এমন একজন খেলার সাথী পেয়ে খুব খুশি ।আমিও রোজ অফিস যাবার আগে ওকে আদর করে তারপরে অফিসে চলে যাই, টমিও আমাকে রোজ বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। আমি হাত নাড়লে সে লেজ নেড়ে আমাকে বিদায় জানায়।


আমরা যখন রোববার করে সবাই মিলে বেড়াতে যাই ও আমাদের সঙ্গে থাকে। সে বেড়াতে খুব পছন্দ করে। এভাবেই চলছিল টমি কে নিয়ে আমাদের সংসার।

একদিন আমি অফিসে যাচ্ছি গেট খুলে বেরিয়ে দেখি একটি পথের কুকুর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে।ওকে দেখে আমার ভীষণ মায়া হয় আমি তখন ফিরে ঘরে গিয়ে ওর জন্য কয়টি বিস্কুট এনে খেতে দিয়েছি, বিস্কুট গুলোর দিকে তাকিয়ে লেজ নারে। এভাবে যেন সে কৃতজ্ঞতা জানাল।অফিস থেকে ফেরার পথে দেখি সেই কুকুরটি আমার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রোগা শরীর শীর্ণ চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি বুঝলাম ও সারাদিন আর কিছু খায়নি ও কিছু খাবার চাইছে।আমি ওকে কিছু না বলে উপরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে চা খেয়ে পরে বিস্কুট নিয়ে গেটের এখানে এসে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে আমি ওকে বিস্কুট গুলো খেতে দিই। এমনি করে বেশ কয়েক দিন কেটে যায়।একদিন আমি বনানী কে ডেকে কুকুরটাকে দেখালাম বললাম রোজকার ঘটনা। বনানী বলল, বেশ তো রোজ ওকে টমির খাবার থেকে কিছু খাবার ওকে রোজ দুবেলা দেব। বনানী আরো বলে ওর একটা নাম রাখ না, আমি বলি ও দেখতে যখন কালো ওর নাম হবে কালু। বনানী হাসে আর বলে বেশ সুন্দর নাম। আজ থেকে তুমি থাকবে ঘরে কালু থাকবে বাইরে। তারপর থেকে প্রতিদিন দু'বেলা টমির খাবার থেকে কিছু খাবার কালুকে খেতে দেয় তারপর এমন হয়ে গেল সে আর আমাদের বাড়ির গেটের বাইরে থেকে অন্য কোথাও যায় না। ধীরে ধীরে ওর শরীর সুন্দর হল ওর চোখ দুটো যেন আরো বেশি মায়াবী লাগছিল।আমি অফিস থেকে বাড়ি এলে টমিকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যেতাম কালুও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বেড়াতে যেত।টমি আর কালুর মধ্যে বেশ ভাব জমে গেল। ওদের ভাব দেখে আমি খুব খুশি হলাম। 


ঝড়-বৃষ্টি রোদে যাতে কালুর কোন অসুবিধে না হয় সেজন্য আমি বাড়ির গেটের ওখানে ছাদের নিচে ওর থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। কালু সুবোধ বালকের মতো ওখানে থাকতে লাগল।

লক্ষ্য করলাম সন্ধ্যেবেলায় যখন বনানী ঠাকুরঘরে সন্ধ্যে বাতি দেয় কাসর বাজা শঙ্খ বাজায় ঠিক সেসময় উপর দিকে মুখ করে আওয়াজ করতে থাকে।প্রথম থেকে আমি বুঝতে পারিনি ওর ডাকে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগতো।কিন্তু রোজ সন্ধে হলে পরেই ডাক শুনে পরে বুঝতে পারলাম সন্ধ্যেবেলায় ঠাকুরের নাম নেয়। এতে ওর প্রতি আমার এবং বনানীর ভালোবাসা গভীর হয়ে গেল বুঝলাম একটি পশু কিভাবে বুঝে নিল সন্ধ্যে হলে ঠাকুরের পুজোর সময় সেও বিভিন্ন আওয়াজ করে ঈশ্বরকে ডাকে। যা এখনকার মানুষ করে না।পাড়ার সব লোকজন ওর এরকম ডাক শুনে প্রথমে সবাই বিরক্ত হতো পরে সবাই বুঝতে পারল এটা খারাপ কিছু নয় তাই পাড়ার লোকজন ও ওকে ভীষণ ভালোবাসতো ডেকে খেতে দিত।

বইয়ে পড়েছি পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মানুষের পোষ মানে কুকুর। সে ঘরের ই হোক বা বাইরের হোক ওরা একটু আদর এবং খাবার পেলেই পোষ মেনে যায়। টমি আর কালু হচ্ছে তার উদাহরণ।


এমনি কিছুদিন চলার পর আমি লক্ষ্য করলাম টমি আর কালু দুজন দুজনকে দেখতে না পেলে ভীষন ছটফট করে।রোজ বিকেল হলেই টমি কে আমি বাইরে নিয়ে আসতাম তাকে দেখে কালু ভীষণ আনন্দ পেত লেজ নেড়ে নেড়ে মুখে বিভিন্ন আওয়াজ করে ওকে ভালোবাসা জানাতে টমি ও বিভিন্ন আওয়াজ করে কালু উপরে উঠে আদর করতো ওদের এই ভালোবাসা দেখে ভাবতাম এমন ভালোবাসা যদি মানুষের মধ্যে থাকত তাহলে এত দ্বন্দ্ব যুদ্ধ অশান্তি কিছুই থাকত না। এদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।


এমন ভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর একদিন আমরা টমি কে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি গেলাম সেখানে রাত্রি থাকলাম। পরদিন সকালে বাড়ি ফিরে দেখি আমাদের বাড়ির সামনে অনেক মানুষের জটলা আমি বনানী দেখে চমকে উঠলাম বাড়িতে না হয় কিছু হয়েছে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? সেই দাদা আমাকে নিয়ে কালুর পাশে গেল আমি দেখলাম কালুর নিথর দেহটি মাটিতে পড়ে আছে শরীরে ক্ষত চিহ্ন রক্ত জমাট বেধে আছে । আমি বললাম কি করে কখন ঘটনা ঘটলো। প্রতিবেশী দাদা টি তখন আমাকে বলল গতকাল রাতে একটি ডাকাতের দল এসেছিল ডাকাতি করতে তোমার বাড়ির গ্রিল ভাঙার চেষ্টা করে তখনই কুকুরটি ডাকাত দলের উপর লাফিয়ে পড়ে দুজনকে ডাকাতকে ঘায়েল করে। তখন ডাকাতেরা নিরুপায় দেখে ওকে গুলি করে মেরে ফেলে। পাশেই তখন পুলিশ গাড়ি করে পাহারা দিচ্ছিল গুলির আওয়াজ শুনে দ্রুত এসে দুজনকে ধরে ফেলে আর বাকি সব পালিয়ে যায় । কালু কাল না হলে তোমার বাড়িতে ডাকাতেরা লুটপাট করে নিয়ে যেত কারণ নিজের জীবন দিয়ে তোমার বাড়ি কে রক্ষা করেছে। একথা শুনে আমি এবং বনানী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম দেখি টমি ওকে চোখে মুখে বিভিন্ন আওয়াজ করে কালু কে ডাকল কিন্তু কালু আর কোনো সাড়া দিল না।টমিও বুঝতে পারল কালু আর নেই সেও কারো পাশে শুয়ে কাঁদতে লাগলো পশুরা যে তার বন্ধুর জন্য এভাবে কাঁদতে পারে শোকাহত হয় আমি টমি কে দেখে বুঝলাম। পাড়ার সব লোকজন বলল কালু যে মহান কাজ করেছে তা কিছুতেই ওর ঋণ শোধ করা যাবে না।আমি আমার বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই দুষ্কৃতীরা দরজার গ্রিল ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিল।


আমি টমি কে জোর করে কোলে নিয়ে আসতে চেষ্টা করলাম কিন্তু টমি কিছুতেই সেখান থেকে নড়তে চাইছে না অবশেষে বনানী অনেক কষ্টে টমিকে তুলে বাড়িতে নিয়ে গেল।

তারপর আমি বনানী ঠিক করলাম কালুকে এভাবে ফেলে দেবো না ওকে নিয়ে আমরা নিজে হাতে সৎকার করব। ঠিক তাই করলাম আমাদের গাড়িতে ওর মৃতদেহ তুলে নিয়ে নদীর তীরে গেলাম।আমাদের সঙ্গে পাড়ার বহু লোকজন ওর সৎকার করতে আমাদের সাথে গেল। টমিও গেল সবাই মিলে আমরা বালুচরে কালুর সৎকার করলাম টমি ভীষণ কাঁদলো ওর বন্ধুর জন্য।আমরাও সবাই কালুর জন্য চোখের জল ফেলতে ফেলতে টমি কে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance