জলের উৎস সন্ধানে
জলের উৎস সন্ধানে


বিকেলে আমি বারান্দায় বসে আছি। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ঝাপটা আমার গায়ে এসে পড়ছে। এমন মধুর বৃষ্টির ঝাপটা বেশ ভালো লাগছে, আর মনটা মেঘের দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি মিষ্টি বিকেল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাটির সোঁদা গন্ধ, গাছের পাতা থেকে টুপ টুপ করে জল পড়ার শব্দ, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলক কেমন যেন একটি মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে।
আমি গতকাল রাত্রে এখানে এই বাংলাতে উঠেছি। জল নিয়ে গবেষণার কাজে আমি রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। কয়েকদিন আগে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স থেকে এলাম। এবার বীরভূম পুরুলিয়া বাঁকুড়া এসব লাল মাটির দেশে রুক্ষ জায়গায় জল নিয়ে গবেষণা করতে এসেছি। হয়তো বেশ কয়েকদিন এখানে থাকতে হবে। গতকাল রাতে যখন এখানে এসে পৌঁছলাম, তখন আকাশে মেঘ ছিল বিস্তর। বাংলোর ছেলেটা আমাকে বলেছে ঠিক সময়ে এসে পৌঁছেছেন বাবু। আরেকটু দেরী করে আসলে পথেই হয়তো বৃষ্টিতে ভিজে যেতেন। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এখানকার বৃষ্টি হত ক্ষণস্থায়ী অল্পবিস্তর হবে,। কিন্তু গতকাল রাত থেকে অবিরাম বৃষ্টি হয়ে চলছে সকালে কিছুটা সময় রোদ ছিল, ভাবলাম হয়তো দিনটি ভালো যাবে আমিও সকালে খাবার খেয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছি বাইরে বেড়াতে যাব কিন্তু দেখে আবার কালো ঘন মেঘ করে চারিদিক ছেয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বাংলোর কেয়ারটেকার ছেলেটা মংলু আমাকে বলল এত বৃষ্টিতে আপনি বাইরে যাবেন না বাবু শরীর খারাপ করবে। বরং একটু অপেক্ষা করুন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে।
বৃষ্টির মধ্যে বারান্দায় বসে সুতপাকে ফোন করে সব কথা জানালাম। ও বলল কখনোই বৃষ্টিতে বাইরে বের হবে না। না হয় দুদিন দেরি হবে বৃষ্টি কেটে গেলে তবেই তুমি কাজে যাবে। আমি ওকে বাংলোর ছবি এবং বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য কেমন করে গাছগুলো স্নান করে যাচ্ছে এসব ভিডিও করে ওকে পাঠালাম। সুতপা ভিশন খুশি হলো।
জল নিয়ে আমি গবেষণা করছি দিনের পর দিন পৃথিবীতে জলের স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বৃষ্টি কমে যাচ্ছে, নদী নালা শুকিয়ে যাচ্ছে। আগামীতে আমাদের উত্তর প্রজন্ম প্রচন্ড জল কষ্ট পড়বে। পৃথিবীতে তখন একমাত্র বড় সমস্যা হবে জল। এখনই পৃথিবীর অনেক দেশ আছে সেসব দেশে নদী নেই। আরব কান্ট্রির অনেক দেশ আছে যারা এরো প্লেনে করে ভারত থেকে জল নিয়ে যায়। আজকে আমরা বাইরে 1 লিটার জল 10 থেকে কুড়ি টাকা কিনে খাচ্ছি, আগামী 2030 সালে এক বোতল জলের দাম হবে 100 টাকা। 2050 সালে এক লিটার জলের দাম দাঁড়াবে 2 থেকে 3 হাজার টাকা। এভাবে এভাবে জলের দাম বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছাবে তখন হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে এক বোতল জল মিলবে না।
তখন দেখা যাবে সারাবিশ্বে জলসম্পদ এর দখলদারির নিতে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তারপর মনুষ্য জাতি অন্য পশু পাখি গাছপালা সব ধ্বংস হয়ে যাবে।
এর মূল কারণ হচ্ছে মাটির গর্ভে জলস্তর দিনের পর দিন অনেক নিচে চলে যাচ্ছে। নদী নালা শুকিয়ে যাচ্ছে। নদী-নালার উৎস সেখানে উপযুক্ত বৃষ্টি না হওয়ার ফলে নদীর উৎসমুখ শুকিয়ে যাবে। সেদিন অন্য কোন মহামারীর চেয়েও সবচেয়ে বেশি মহামারী হাহাকার হবে জলের জন্য।
এর মূলে হচ্ছে গাছপালা বন জঙ্গল যথেচ্ছভাবে ধ্বংস করা, পৃথিবীর অক্সিজেন যাকে বলা হয় আমাজান জঙ্গলের মত বহু জঙ্গল দিনের পর দিন মাসের পর মাস দাবানলে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বিষাক্ত ধোঁয়ায় বায়ুস্তরে প্রভাব ফেলছে এবং প্রতিনিয়ত আমরা বিলাসিতা জীবন যাপনের জন্য যেভাবে জীবন যাপন করছি তাতে করে বায়ু দূষণ শব্দ দূষণ পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। দিনের পর দিন আমরা কৃষি কাজের জন্য যেভাবে ভূগর্ভস্থ জল তুলে নিচ্ছি তাতে করে জলস্তর অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। এবং যে জলসা টা আমরা পাই দেখা গেছে সেখানে আর্সেনিকের মত অনেক দূষিত পদার্থ ভরপুর। তার ফলে আমাদের দেহে বহু মারণ রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।
গাছপালা বন ধ্বংস হওয়ার ফলে দিনের পর দিন বৃষ্টি কমে যাচ্ছে। উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুতে বরফ গলে গিয়ে নতুন বিপদের সংকেত দিচ্ছে। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই অনেক দ্বীপরাষ্ট্র এবং সমুদ্রের তীর ঘেষা অনেক রাষ্ট্র চিরদিনের মত সাগরে বিলীন হয়ে যাবে। সেখানেও দেখা যাবে মানুষগুলোর বাঁচার জন্য জায়গার অভাব। তারপর যদি এই জলের সমস্যা প্রতিদিন বেড়েই চলে তাহলে খুব তাড়াতাড়ি আমাদের বিপদ ঘনিয়ে আসবে। আমরা বুঝতে পারছি না বোঝার চেষ্টা করছি না আগামীতে মানবজাতি ভবিষ্যত বিপন্ন ভয়ের।
রাতে বৃষ্টি থেমে যায়। পরদিন সকালে উঠে আমি জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে স্থানীয় প্রশাসক ভিডিও এবং থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে আমার গবেষণার বিষয় আলোচনা করি এবং তাদের সাহায্য সহযোগিতা কামনা করি। তারা আমাকে সাহায্য করবেন বলে কথা দিলেন। তারপর এলাকার বিভিন্ন গণ্যমান্য লোকদের সঙ্গে নিয়ে আলোচনা করে বুঝলাম আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে গেলে। জলের প্রয়োজনীয়তা, এবং তার গুরুত্ব। সবাই আমার কথা শুনলেন। আমার সঙ্গে একমত হয়ে তারা কাজ করতে চাইলেন। প্রথমে আমি তাদেরকে প্রত্যেকের বাড়ির চারধারে, ফেলে রাখা জমিতে গাছ লাগাতে বললাম এই গাছ লাগানোর ব্যাপারে সরকারের বহু কর্মসূচি আছে, সেগুলি পালনের কথা বললাম।
সেচের কাজে ভূগর্ভস্থ জলের পরিবর্তে কি করে আমরা বৃষ্টির জল ধরে রেখে চাষের কাজে এবং পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করতে পারি সে বিষয়ে আলোচনা করলাম। সবাই তো শুনে অবাক বৃষ্টির জল আবার কি করে ধরে রাখা যাবে। আমি ওদের প্রাথমিক ধারণা দিলাম যে সমস্ত জমিগুলো রুক্ষ অনাবাদি সেই সব জমিতে দীঘি খনন করে তাতে মোটা শক্ত প্লাস্টিক যদি আমরা নিচে এবং চারধারে ভালো করে বিছিয়ে দি। তাহলে বৃষ্টি হলে ওই দিঘী জলে ভরে যাবে, সেই জল আমরা অনায়াসে চাষের কাজে ব্যবহার করতে পারব এবং ওইদিকে গুলিতে কিছু কিছু মাছ চাষ করা যাবে। তাতে চাষীদের বাড়তি আয়ের এর উৎস হবে।
তাছাড়া গ্রাম ও পাড়ার মাঝে যে সমস্ত নালাগুলো আবর্জনায় ভরে আছে সেগুলি পরিষ্কার করে নালা গুলো গভীরভাবে খনন করে তারমধ্যে নদীর জল অথবা বৃষ্টির জল একইভাবে ধরে রেখে আমরা চাষের কাজে ব্যবহার করতে পারি। এমনকি যাদের বাড়িতে ছাদ আছে সেই ছাদে এরকম প্লাস্টিকের তাতে বৃষ্টির জল ধরে রেখে আমরা ছাদে ফুল, সবজি, নানারকম ফলের চাষ করতে পারি।
আমার গবেষণার কাজে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে একথা সুতপাকে জানালাম, সে শুনে প্রথমে ভীষণ মন খারাপ করলো কিন্তু পরে সব বুঝতে পেরে বলল, যত দিন সময় লাগে লাগুক তুমি তোমার কাজ সঠিকভাবে করে এসো। সুতপা ভারী মিষ্টি মেয়ে, কলেজ জীবন থেকেই একসঙ্গে আমরা পড়াশোনা করছি ছোটবেলা থেকেই আমাদের ভালোবাসা। অবশেষে আমরা দু বছর হলো বিয়ে করেছি। সুতপা এবং আমি দুজনেই কলেজে পড়াই, কলেজ থেকেই দুজনে দুটি বিষয়ে গবেষণা করছি।আমি বৃষ্টির জল ধরে রাখার বিষয় নিয়ে গবেষণা করছি। আর সুতপা পাখিদের নিয়ে গবেষণা করছে। দিনের পর দিন কেন পৃথিবীতে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে, এবং কিছু কিছু পাখি আছে যারা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্তির পথে।
আমি স্থানীয় ভিডিও সাহেবের এবং পঞ্চায়েতের সহযোগিতায় কয়েকটি এলাকা বেছে নিয়ে , বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য জলাধার তৈরি করলাম। এবং যে সুস্থ নালাগুলো আবর্জনা মৃতপ্রায় অবস্থায় ছিল, সেইসব নালাগুলো পরিষ্কার করে এবং খনন করে তাতে জল ধারণের উপযুক্ত করলাম। এবং প্রত্যেক বাড়িতে এবং অনাবাদী জমিতে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করলাম।
কয়েকদিনের মধ্যেই আবার বৃষ্টি শুরু হল। এবং প্রত্যেকটি জলাধার নালা জলে ভর্তি হয়ে গেল। তা দেখে তো ভিডিও সাহেব এবং পঞ্চায়েত এর কর্মকর্তারা সাধারণ মানুষ সবাই খুব খুশি হলো। ভিডিও সাহেব আরও উৎসাহিত করলেন। এবং এই কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করলেন।
প্রথম স্তরে আমার গবেষণার কাজ শুরু করে কদিনের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলাম। সুতপা এবং মা আমার গবেষণার বিষয়ে আমার মুখে সব শুনে ভীষণ খুশি হলো।
বাড়িতে কয়দিন থাকার পর, আমি আবার বীরভূমে আমার গবেষণার কাজে সেই গ্রামে গেলাম। গিয়ে দেখি জলাধারের পাশে লাগানো সবজি গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর জলাধারে চারপাশে, নালার চারপাশে লাগানো গাছ গুলো বেশ সতেজ হয়ে পাতা মিলছে। যে কে আমার ভীষণ আনন্দ হল।
মনে হল এভাবে যদি জল ধরনের কর্মসূচি এবং নদী-নালা সংরক্ষণ সংস্কার এবং গাছ লাগাতে পারি, তবে হয়তো পৃথিবীতে জলের অভাব থাকবে না, এবং মরুভূমির সংখ্যাও কমে যাবে।
জীবনে এমন কাজের সফলতা পেয়ে সফল আনন্দ নিয়ে বাড়ির দিকে চললাম।