আয়েশা
আয়েশা
বসন্তের রঙ লেগেছে ফাগুনের চারিদিকে গাছের ডালে ডালে সবুজের উঁকিঝুঁকি পলাশ বনে লেগেছে আগুন রঙের পরশ। মাধবীলতা ফুল ফোটার অপেক্ষায় জড়িয়ে আছে গাছে।
কদিন বাদেই বসন্ত উৎসব সবার মনে এখনই ফাগুনের রংয়ের দাগ কাটার গন্ধ। ভরা বসন্ত রঙের সুগন্ধিতে ঝলমল। ফাগুনের ছোঁয়া
লেগেছে আমাদের মনে।
প্রতিবছরই আমরা বসন্ত উৎসব পালন করি সমারোহে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে কলা ভবনে প্রতি বৎসর রবি ঠাকুরের আদর্শকে মনে রেখে আমরা এইসব পালন করি। আমি এই উৎসব কমিটির একজন কর্মকর্তা।মহাসমারোহে আয়োজন চলছে উৎসব প্রাঙ্গণ আনন্দমুখর করে তোলার জন্য প্রতি বছরের মতো এবারও থাকবে প্রভাতফেরী গীতিনাট্য গান আবৃত্তি এবং বসন্ত উৎসব এর তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা সভা। এখানে শহরের বিশিষ্ট মান্যগণ্য গুণীজনেরা উপস্থিত থাকবেন।
যথারীতি সঠিক কর্মসূচি মেনে প্রভাতফেরী সকালের গীতিনাট্য গান-বাজনা এবং অবশেষে ফাগুনের রঙে রাঙা হয়ে উঠলো উৎসব প্রাঙ্গণ। কেন এ রঙের উৎসব নয় প্রাণোচ্ছলভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার রংতুলিতে মাখা আঁকিবুকি সবার মনের আরশিতে দাগ কাটে এখানে সব জাতিভেদ ভুলে গিয়ে সব সম্প্রদায়ের মানুষ ছেলেমেয়েরা মেতে ওঠে মনের আনন্দে।
রঙিন সন্ধ্যায় আবৃতি আর গান-বাজনার আয়োজন থাকে সেগুলি সব রবি ঠাকুরকে মনে করেঅনুষ্ঠান চলে।
আমি সঞ্চালক মাইকে ঘোষনা করছিলাম কে কখন আবৃত্তিকরবে এবং গান গাইবে। আয়েশা নামের একটি মেয়ে মাইকের সামনে এসে দাঁড়াল।আমি এক পলকে ওর মুখের দিকে তাকালাম খুব সুন্দর মুখশ্রী গায়ের রং উজ্জল শ্যামবর্ণ স্লিম চেহারা শরীরে একটা তারুণ্য তার উত্তাপ দেখতে পেলাম। হঠাৎ করে আমার মনের ভালোবাসার খাতায় আয়েশা দাগ কেটে দিল। আবৃতি করল সুন্দর রবি ঠাকুরের দুই বিঘা জমি আবৃত্তি শুনে আমি খুব অভিভূত হলাম। অবশেষে আবৃত্তি শেষে ওর কানে কানে বললাম পরে দেখা করবে।
আয়েশা কথা রেখেছে।
অনুষ্ঠান শেষ হয়েও যেন আমার মনে অনুষ্ঠানের আজ লেগে থাকলে অনেক দিন শুধু আয়েশার জন্য। মেয়েটি আমাদের শহরের নয় শুনলাম ওর বাড়ি রাঙাপানি মামার বাড়ি এসেছে বেড়াতে কলেজে পড়ে। ভালো গান ও আবৃত্তি করতে পারে।ও যে আমার মনে দাগ লাগিয়ে দিল আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না হাজারবার ভোলার চেষ্টা করলেও প্রতিটা ক্ষণে তোর মিষ্টি মুখখানা আমার সামনে ভেসে উঠে।
অনিক আমার বন্ধু ,সে এমনি ফাগুনের উৎসবে তুমি যাকে খুঁজে পেয়ে দুজনে ভাব করে বিয়ে করেছে। ওরা ভীষণ সুখী। তনুজা আমাকে বারবার বলে শেখর দা, আর কত দিন সময় নিবে? যা হোক একটা কিছু করে ফেলো আমি বললাম সময় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ও বলে তবে কি তাহলে কাউকে কথা দিয়ে রেখেছো? আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে বলি, বললাম তো সময় হলে সব দেখতে পারবে।
আয়েশার সাথে প্রতিদিনই কথা হয় ফোনে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আয়েশা। পড়াশোনায় খুব ভালো বিয়ের পাশ করার পর বাংলা নিয়ে এমএ ভর্তি হয়েছে। ওর ইচ্ছে পড়া শেষ করে, কলেজে পড়াবে।
আমি ওকে উৎসাহ দিয়েছি বলেছি ভালো করে পড়াশোনা করো তোমার তোমার লক্ষ্যে পৌঁছবে।
এভাবে বেশ কিছুদিন চলছে আমাদের মধ্যে ফাগুন রাঙ্গা সম্পর্ক। কিন্তু একদিন ও সকাল বেলা ফোন করলো, বলল দু'একদিনের মধ্যেই ওদের বাড়িতে যেতে। আমি ওকে বললাম কেন এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেতে হবে তোমার শরীর ভালো তো? ও বলল না আমার শরীর মন ভালো নেই, তুমি তাড়াতাড়ি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও নইলে হয়তো চিরদিনের মতো আমি হারিয়ে যাব তোমার জীবন থেকে। আমি বললাম, কি সব পাগলের মত বকছো, কি হয়েছে খুলে বল। ও বলল আমি ভীষণ বিপদে আছি বাড়িতে এসো সাক্ষাতে সব কথা খুলে বলবো।
আমি ওর কথা শুনে ভীষণ শঙ্কিত হলাম। ভাবলাম নিশ্চয়ই কোন বিপদ ঘটেছে নয়তো ওর বাবা-মা অন্য কোথাও ওর বিয়ে ঠিক করেছে। আমি দেরী না করে তার পরের দিনই রাঙাপানি তে গিয়ে পৌঁছলাম। বাড়িতে গিয়ে শুনলাম আয়েশা ভীষণ অসুস্থ ওকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। আমি পাগলের মত ছুটে গেলাম হাসপাতালে, কিন্তু আমার যাবার আগেই সব শেষ। আয়েশা আর বেঁচে নেই। আমি ওর বাবা মাকে জিজ্ঞাসা করলাম হঠাৎ কি হলো হঠাৎ আয়েশা মারা গেল। আয়েশার ভাই আমাকে ওর মৃতদেহের পাশে নিয়ে গেল দেখলাম আয়েশার সারামুখ শরীর এসিডে পোড়া। ওর ভাইয়ের কাছে শুনলাম গতকাল বিকেলে ও যখন বাড়ি ফিরছিল তখন কয়েকজন দুষ্কৃতী ওর পথ আগলে ওর মুখে সারা গায় এসিড ঢেলে দেয়। এসিডের মাত্রা এত বেশি ছিল যে ওই ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই আয়েশা মারা যায়। একথা শুনে আমার মাথায় বাজ পড়ল যেন। আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম কি করব কি করা আমার করনীয় কিছুই ঠিক করতে পারলাম না। পাগলের মতো ঘর থেকে বের হয়ে বেরিয়ে এলাম।
জীবনের প্রথম প্রেম আর তার এই পরিনতি হবে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না বাড়িতে এসে বহুদিন আমি পাগলের মত ঘুরে বেড়িয়েছি কেঁদেছি বিলাপ করেছি ওর ছবি বুকে আগলে রেখেছি।
বন্ধু বান্ধবীরা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে
কিন্তু আমি মন থেকে কিছুতেই আয়েশাকে ভুলে যেতে পারছিনা। আমার অবস্থা দেখে আমার বাবা-মা ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। আমাকে ডেকে বলে খোকা তুই এবার বিয়ে কর, বিয়ে করলে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া আমাদেরও বয়স হয়ে যাচ্ছে তোর বিয়েটা দিয়ে আমাদের কর্তব্য শেষ করতে চাই। আমি আমার মনের অবস্থা বাবা-মাকে কিছুতেই বুঝাতে পেলাম না।
কিছুদিন পর একটি স্কুলে আমার চাকরি হয়ে গেল। তখন স্কুল বাড়ি এই পরিবেশের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকলাম আয়েশাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু স্মৃতির দহন বড় কঠিন কিছুতেই আয়েশা আমার মনের মনিকোঠায় থেকে চলে যায় না।
চাকরি হবার পর সবাই আমাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে থাকে। অবশেষে আমি আয়েশার দূর সম্পর্কের বোন চন্দ্রিমা কে বিয়ে করি। বিয়ের পর চন্দ্রিমা কে আমি সবকিছু আয়েশার কথা খুলে বলি। চন্দ্রিমা আমাকে বুঝায় এখন তো আর তাকে ফিরে পাওয়া যাবেনা, তবে কেন তাকে ভেবে ভেবে নিজেকে এত কষ্ট দাও। ও আর কোনোদিনও ফিরে আসবেনা। তুমি চাকরি করছ বিয়ে করেছ। অতীতের কাহিনী সব ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবনের পথ চলা শুরু করতে হবে।
চন্দ্রিমা ভীষণ বুদ্ধিমতী মেয়ে, অল্প সময়ে আমার ব্যথিত মনকে প্রাণচঞ্চল করে তুলে। আমিও চন্দ্রিমার মধ্যে আয়েশা কে খুঁজে পাই। আমি চন্দ্রিমা কে জড়িয়ে ধরে বলি তুমি আমার আয়েশা। তোমাকে নিয়ে নতুন করে সংসার বাঁধতে চাই এবং সব স্মৃতি ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাই। চন্দ্রিমা বলে এটাই তো জীবন। জীবনের মাঝে জীবনকে খুঁজে পাওয়ায় জীবনের সার্থকতা। আমি সাধ্যমত সব চেষ্টা করি তোমাকে আমি নতুন করে গড়ে তুলবো। তুমি শুধু লক্ষ্মী ছেলের মত আমার কথা শুনবে, মানবে।
তারপর থেকে শুরু হলো আমার জীবনে নতুন পথ চলা। কিন্তু কিছুতেই আশাকে ভুলতে পারিনা। প্রতিবছর বসন্ত উৎসবে ফাগুন রঙে সবাইকে রাঙিয়ে দিতে গিয়ে আমি বারবার আয়েশাকে খুঁজি। যেন আমার আয়েশা নতুন করে এই বসন্ত উৎসবে আমাকে রাঙিয়ে দিতে আসবে।
আমি চন্দ্রিমাকে রঙে রাঙিয়ে বলি এ আমার আয়েশা আমি তোমাকে খুজে পেয়েছি।