Chitta Ranjan Chakraborty

Inspirational Others

4.2  

Chitta Ranjan Chakraborty

Inspirational Others

পঞ্চ জন

পঞ্চ জন

5 mins
219


শ্যামাপদ বাবু, নিতাই বাবু, রবিবাবু, সুমন্ত বাবু, প্রশান্ত বাবু, এই পাঁচজন ছোটবেলা থেকেই স্কুল, কলেজে একসাথে পড়াশোনা

 করেছেন। একসাথে থাকেন একসাথে আড্ডা দেন। কোথাও বেড়াতে গেলে এই পাঁচজন একসঙ্গে বেড়াতে যান। সবার সুখ দুঃখ ভালো মন্দ সবকিছু পাঁচজন এই দেখাশোনা করেন। ভারী হাসিখুশিতে আনন্দ ভরা জীবন তাদের। সবাই বয়সে দু এক বছরের ছোট বড়। সবাই সরকারি চাকরি করতেন। কিছুদিন হয় তারা সবাই অবসর গ্রহণ করেছেন।


এই পাঁচজনের জীবনধারাকে মানুষ খুব শ্রদ্ধা করে ভালোবাসে এবং সবাই নাম রেখেছে পঞ্চপান্ডব, আবার কেউ কেউ পঞ্চ জন নাম রেখেছেন। সবাই অত্যন্ত বিনয়ী সাহসী পরোপকারী। সবাই সচ্ছল পরিবার। কিন্তু সুমন্ত বাবু আর শ্যামাপদ বাবুর স্ত্রী বিয়োগ হয়েছেন কয়েক বছর আগে। তাই সংসার জীবনে এই দুজনের ভীষণ মনে কষ্ট। সবারই ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত চাকুরীজীবি অথবা ব্যবসায়ী। তাই পাঁচজনের সংসারের পিছুটান নেই। অনায়াসে এবং স্বাধীনভাবে এই পাঁচজন বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করেন তাতে কেউ বাধা দেয় না।


এই পাঁচজনের জীবনযাপনের মূল উদ্দেশ্য হলো নিজস্ব আয় থেকে কিছু কিছু টাকা জমিয়ে বিভিন্ন কাজ করা।

প্রতিবছরই এই পাঁচজন কখনো নিজেরাই কখনো পরিবারের লোকজন নিয়ে একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যান। এমনকি একবার বিশ্বকাপের খেলা দেখার জন্য এই পাঁচ বন্ধু জার্মানিতে গিয়েছিলেন।

এই পাঁচ বন্ধু একসঙ্গে রোজ বিকেলে লেকের ধারে গিয়ে বসেন, গল্পগুজব করেন, আগামী দিনের বিভিন্ন পরিকল্পনা তৈরি করেন। চাকরি জীবনে তারা সিদ্ধান্ত নেন, তাদের মাসিক বেতনের 30% টাকা ব্যাংকে জমাবেন। যেমন কথা তেমনি কাজ, প্রতিমাসে যত টাকা বেতনই পান তার কিছু অংশ জমাতে জমাতে এখন অনেক টাকা হয়ে গেছে। চাকরি শেষ হওয়ার পর পেনশনের টাকা থেকেও একইভাবে টাকা জমিয়ে আসছেন।

এভাবে টাকা জমিয়ে তারা শহরের মাঝখানে একটি ভালো জায়গাতে জমি কিনেছেন, এবং সেই জমিতে সুন্দর একটি বিল্ডিং তৈরি করে তার নিচ তলায় মস্ত করে বইয়ের দোকান দিয়েছেন। এবং উপরের ঘরগুলো কোন বিয়ে সামাজিক উৎসব এবং সভা সমিতির জন্য ভাড়া দেন। তাতে মোটা অংকের টাকা আয় হয় প্রতিমাসে।


তাদের কথা হচ্ছে, শুধু কাজ করলাম খেলাম এটাই জীবন নয়। জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে হলে যেমন সুন্দর মনের প্রয়োজন ঠিক তেমনি অর্থের প্রয়োজন। কেউ পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে না। যতদিন বাঁচবো ততদিন সুন্দরভাবে জীবনকে গড়ে তুলবো সবার সুখে দুঃখে পাশে থাকবো । সমাজের জন্য কিছু করব, এবং সারা জীবন আনন্দের মধ্যে সবাইকে নিয়ে থাকবো। শুধু ঘরে বসে থাকলেই হবে না আমাদের চারপাশে সুন্দর পৃথিবীতে রয়েছে তাকে দেখতে হবে জানতে হবে। তাই তারা প্রতি বৎসর তাদের জমানো টাকা থেকে একটি অংশ নিয়ে সারা ভারতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। এমনকি বারকয়েক সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া মরিসাস এবং শ্রীলংকা ঘুরে এসেছেন।

তাদের বইয়ের দোকানে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সুলভ মূল্যে বই এবং খাতাপত্র কিনতে পাওয়া যায়। এতে দূরদূরান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা এই দোকানে আসে বই এবং খাতাপত্র কিনতে।


প্রতি বৎসর দুর্গা পুজোর সময় এবং শীতের সময় বহু গরিব মানুষকে জামা কাপড় শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। এমনকি কোন দুস্থ পরিবারের মেয়ের বিয়ে অথবা অন্য কোন উৎসব অনুষ্ঠানে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন।

তাদের এই সমবায়িকা মানসিকতা এবং এই পদ্ধতিতে সঞ্চয় করার কৌশলকে কাজে লাগাতে বহু মানুষ তাদের কাছে এসেছেন পরামর্শ নিয়েছেন এবং সে মতে তারা ফিরে গিয়ে কাজ করে উপকৃত হয়েছেন। সঞ্চয় এর ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের ভূমিকা অনেক বেশি। তাই তারা পাড়ার প্রতিটি বউকে ডেকে এনে সঞ্চয় করার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে ছোট ছোট দল করে অর্থ সঞ্চয় করতে সাহায্য করেছেন। অনেক দুস্থ পরিবারে কেউ অসুস্থ হলে সেই সহায়-সম্বলহীন পরিবারে তাদের জমানো টাকায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পেরেছে। এবং ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার জন্য ওই জমানো টাকা অনেক সাহায্য হয়েছে।

এখনো অনেক পরিবার আছে যারা প্রতিটা দিন অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটান, এবং তাদের পরিবারে স্বামী স্ত্রী, ছেলে বাবা এদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে। এসব তাদের পরিবারে নৈমত্তিক ঘটনা। কিন্তু এসব পরিবারে অশান্তির মূলে দেখা গেছে বেহিসেবি জীবনযাপন অর্থের অপচয় সঞ্চয় না থাকায়, এদের জীবন প্রতিনিয়ত অশান্তিতে ঘেরা। তাদের সীমিত আয়ের থেকে কিছু কিছু করে প্রতিদিন সঞ্চয় করলে তাদের পারিবারিক জীবনে এই অশান্তি গুলো আসে না। এমন কি দেখা গেছে, অভাব আর অশান্তির তাড়না থেকে মুক্তি পেতে পুরুষেরা সন্ধ্যে হলে মদের ঠেকে যায়। মদ খায় নেশা করে সাময়িক সময়ের জন্য তারা তার জীবনের সবকিছু কে ভুলে থাকার চেষ্টা করলেও ভুলতে পারে না বরং বাড়িতে স্ত্রী সন্তানের উপর অত্যাচার করে। এমন অনেক পরিবারে আছে এসব দারিদ্রতা অন্যায় এসব থেকে মুক্তি পেতে ঘরের বউরা আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়। এবং অনেক ক্ষেত্রে সংসারে একমাত্র অবলম্বন পুরুষরা নেশা করে বড় রাস্তার উপরে এমনকি রেললাইনে উপরে পড়ে থেকে নিজের জীবন কে শেষ করে দেয়। অনেক দরিদ্র পরিবারে দেখা যায় তাদের মেয়ের বিয়ে অথবা কারো কঠিন অসুখে টাকার অভাবে তাদের জমিজমা সোনাদানা এসব অনেক সম্পদ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। এইসব পরিবারগুলোতে যদি সঞ্চয় থাকতো তবে হয়তো অনেক ক্ষেত্রে তাদের ধন সম্পদ বিক্রি করে নিঃস্ব অসহায় হতে হত


না।


অনেকের সীমিত আয়ের থেকে কিছু কিছু সঞ্চয় করে রেখে এস মহাবিপদ থেকে নিজেদের বাঁচাতে পেরেছে।


এই পাঁচজনের পরিবারে 5 জনকে নিয়ে ভীষণ গর্ব ছেলেমেয়েদের। শহরে তাদের আলাদা একটা পরিচিতি এনে দিয়েছে।

বারকয়েক জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের ডেকে নিয়ে সম্বর্ধনা দিয়েছে। এবং মানপত্র তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। তাদের এই সুন্দর কাজ পাঁচজনকে আরো বেশি সুন্দর করে তুলেছে।

তাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে পরিবারের থেকে একটি টাকাও না নিয়ে তাদের নিজস্ব জমানো টাকা থেকে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

কিছুদিন আগে রবিবাবুর হার্টের সমস্যার জন্য বাইপাস সার্জারি করে আনলেন। তিনি এখন সুস্থ। শ্যামাপদ বাবুর লিভারের সমস্যা দেখা দিলে তাকেও ভালো হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন করিয়ে এনেছেন। এমন বহু উদাহরণ আছে যা বলে শেষ করা যাবেনা।


বস্তিতে একটি শিশুর ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়েছিল, একথা এই পঞ্চজন জানতে পেরে নিজেরা গিয়ে শিশুর চিকিৎসা ব্যবস্থা করেছেন তার চিকিৎসার জন্য কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে তাকে সুস্থ করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছেন।


এবার তাদের পরিকল্পনা ছিল কন্যাকুমারী তে বেড়াতে যাবেন সে মত মার্চ মাসে যাবার কথা ছিল। যাওয়া-আসার প্লেনের টিকিট হয়েছিল।

কিন্তু হঠাৎ করে করোনা ভাইরাস এর জন্য সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের হাহাকার প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল প্রায় প্রতিটি দেশে। আমাদের দেশেও সব রাজ্যে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত বহু মানুষ। এর থেকে বাঁচার বাঁচার জন্য ভারত সরকার সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করেন। এই অবস্থায় তাদের কন্যাকুমারী যাওয়ার বিমানের টিকিট বাতিল করেন। এ বারই প্রথম বাইরে বেড়াতে যাওয়া হলো না। তাতে তাদের দুঃখ নেই। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করেন যে তাদের বেড়াতে যেতে যে টাকার বাজেট হয়েছিল, তার সঙ্গে আরো কিছু টাকা যুক্ত করে লকডাউন এ আটকে পড়া দুস্থ শ্রমিকদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার দেবার সিদ্ধান্ত নেন।

যেমন সিদ্ধান্ত তেমনি কাজ। প্রত্যেকটি দুস্থ পরিবারের জন্য চালডাল নুন তেল সবজি কিনে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন। এতে বহু দুস্থ পরিবারের যেমন উপকার হয় তেমনি তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠে।

এই সমাজে তারা শুধু চাকরি করে পয়সা উপর জারি করলেন না, এবং তার মাধ্যমে জীবনকে উপভোগ করার কৌশল শিখিয়ে দিলেন।

তাদের প্রেরণায় আমরা অনেকেই অনেক কিছু তাদের কাছে শিখলাম। একটি দিনের জন্যও তাদের সাধারণ অসুখ হতে দেখিনি, কোনদিন কাউকে দুঃখ বেদনা হতাশ হতে দেখিনি। প্রতিটি সময় হাসিখুশি থেকে সবার কুশল বিনিময় করে সবার সুখ-দুঃখের খোঁজখবর নিতেন। এমন আদর্শ জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে তারা উদাহরণ সৃষ্টি করলেন। এর জন্য তাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational