Chitta Ranjan Chakraborty

Abstract Romance

3  

Chitta Ranjan Chakraborty

Abstract Romance

প্রিয়ার সাথে

প্রিয়ার সাথে

6 mins
11.5K


আমি তখন ধুবড়ি কলেজে বিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সে সময় আসাম বাংলা মিলিতভাবে দলমত নির্বিশেষে, পশ্চিমবঙ্গের নিউ ময়নাগুড়ি থেকে আসামের যোগীঘোপা পর্যন্ত রেললাইনের দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু হয়েছিল।

আসাম বাংলা সীমান্তে বারকয়েক দু রাজ্য থেকে লোকজন জমায়েত করে জনসভা হয়েছে। প্রতিবারই সভাতে আসাম বাংলার বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে রেললাইনের দাবিতে বক্তব্য রেখেছেন।

একটি জনসভাতে পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। আসাম সরকারের বেশ কজন মন্ত্রী সেই সভাতে উপস্থিতি ছিলেন।

সেই সভাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি প্রস্তাব নেওয়া হায় ভারতবর্ষে জাতীয় নদীগুলির মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদীর সংস্কার করে ধুবুরিতে জাহাজ বন্দর স্থাপন ,করে জলপথ চালু করতে হবে।যে জল পথে বিগতদিনে পূর্ব পাকিস্তানের ,ব্রমদেশের, অনেক মালবাহী জাহাজ গৌহাটি যেত।এমনকি ধুবুরীথেকে অনেক যাত্রী বাহি জাহাজ চলতো। পুনরায় যাত্রীবাহী জাহাজ চালানোর

 দাবি নিয়ে আমরা কলেজ থেকে একটি দল অভিযানে যাবার ছাড়পত্র পেয়ে মোটর সাইকেলে করে ব্রহ্মপুত্র অভিযান নামে আমরা মোটরসাইকেল এর যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের যাত্রাপথ শেষ হবে অরুণাচল প্রদেশের রাজধানী ইটানগর। আমরা কুড়িজন এই অভিযানে যাবার ছাড়পত্র পেলাম। তারমধ্যে পাঁচজন মেয়ে ছিল। আমরা সবাই ভালো বন্ধু কেউ দ্বিতীয় বর্ষ এবং কেউ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছাত্রী।

মনে নতুন আনন্দ নিয়ে এই অভিযানে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম।

নির্ধারিত দিনে যথাসময়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো ধুবুরী নদী ঘাট থেকে।

এই ব্রহ্মপুত্র স্নানঘাটের বিশেষ ইতিহাস আছে। সেসব মহাভারতে বর্ণিত কাহিনী ।কিন্তু এখন প্রতিবছরই চৈত্র মাসে বাসন্তী পূজার অষ্টমী তিথিতে ব্রহ্মপুত্র নদীতে ধুবুরী র এই ঘাটে দেশ বিদেশের লক্ষ লক্ষ পূর্ণার্থী আসে অষ্টমী তিথিতে পুণ্য স্নান করতে। এই স্নান উপলক্ষে নদীর তীরে 15 দিন মেলা থাকে।


আমাদের অভিযান শুরু হল। এই অভিযাত্রী দলের নেতা নির্বাচিত হলাম আমি। মোট 15 টি মোটর সাইকেলে আমরা কুড়ি জন আরোহী রওনা হলাম। যে পাঁচজন আমাদের সহযাত্রী ছিল তারা পাঁচটি মোটর সাইকেলে দুজন করে বসলেন। আমার প্রিয়া বড়ুয়া আমার মোটরসাইকেল আমার সহযাত্রী হল।


31 নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আমাদের এই যাত্রা শুরু হল। গরিপুর হয়ে বিলাসিপারা সাপোট গ্রাম হয়ে বরপেটা তে আমাদের রেলি থামল। সেখানে আমাদের সম্বর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করেছে এবং সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে একটি জনসভার আকার ধারণ করেছে। আমাদের দলকে ফুলের তোড়া দিয়ে আসামের ঐতিহ্যবাহী গামছা দিয়ে বরণ করে নিলেন। সেখানে আলোচনা সভায় ওখানকার স্থানীয় গুণীজনেরা যেমন আলোচনা করলেন, আমাদের দলের পক্ষ থেকে আমিও সমস্ত বিষয়ে আলোচনা করলাম। সেখানে রাত্রি যাপনের পর, পরদিন সকালে আবার রওনা হলাম। তারপর গন্তব্যস্থান বিস্বনাথ চারিয়ালি।


এই অভিযানে একজন অভিযাত্রী হিসেবে আমি ভীষণ খুশি হলাম এবং আমার সঙ্গে প্রিয়া থাকাতে এই যাত্রাযেন আরো আমার কাছে বাড়তি আনন্দ পাও না হলো।


আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সবুজের বুক চিরে কালো পিচের রাস্তা আঁকাবাঁকা হয়ে চলছে। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি অসংখ্য শাল সেগুন গামারি বনজ গাছ গুলো মাথা দুলিয়ে আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। যেদিকে তাকাই সবুজ আর সবুজের সমারোহ বাঁদিকে দূর দূরান্তে দেখা যাচ্ছে ভুটানের সবুজ পাহাড় এবং তার কোলে অসংখ্য চা বাগান। সবুজ পাতা মেলে রোদের সাথে লুকোচুরি খেলা করছে। দেখতে দেখতে মন ভরে যায়। এর আগে কোনদিনও মোটর সাইকেলে করে এত দূরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। এই যাত্রা

আমার জীবনের নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে এবং এত আনন্দ এই কাজের মধ্যে এর আগে কোনদিনও আমি ভাবতে পারিনি।

এই অভিযানে বাড়তি আনন্দ যে প্রিয়া বড়ুয়া কে নিয়ে, যাত্রাপথে বিভিন্ন কথাবার্তা র মাঝে তাকে বুঝিয়ে দিতে ভুল করিনি।


বিভিন্ন জায়গায় আমাদের অভিযাত্রী দলকে স্বাগত জানাতে রাস্তার দু'ধারে অনেক লোক স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আমাদের উপহার ফুল ছিটিয়ে পতাকা নেড়ে অভিনন্দন জানায়। একটা বাড়তি পাওনা।


আমরা এক সময় নলবাড়ি পার হয়ে গোয়াহাটি বিস্বনাথ চারিয়ালি তে পৌঁছলাম। সেখানেও আমাদের সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য একটি সভার আয়োজন করেছিল ,আমাদের সম্বর্ধনা দিল ,এবং আমাদের অভিযাত্রা নিয়ে আলোচনা করে সেদিন রাত্রে ওখানেই থাকলাম। আমরা ঠিক করলাম গুয়াহাটি শহরের ভিতরে না গিয়ে ওখান থেকে বাঁদিকে রাস্তা ধরে তেজপুর চলে যাব। সে মত রোডম্যাপ করে তারপর দিন সকাল বেলায় আমরা রওনা হলাম। পথে মঙ্গলদৈ শহরে আমাদের কিছু সময় বিরতি ছিল। সেখানে আমাদের জন্য বেশ কিছু লোক অপেক্ষা করছিল, এবং আমাদের খাবার দাবারের ব্যাবস্থা করলো। তারপর বিশ্রাম নিয়ে আমরা সোজা রওনা হলাম দুপুরের দিকে সন্ধ্যার পরে আমরা তেজপুরে গিয়ে পৌঁছালাম।


সেখানেও যথারীতি সংবর্ধনা সভা শেষ করে আমরা একটি হোটেলে উঠলাম রাতে থাকার জন্য। কিন্তু হঠাৎ একটা সমস্যা সৃষ্টি হল। এ কয়দিন টানা মোটর সাইকেলের পিছনে বসে থাকা , এবং প্রচন্ড রোদে হেলমেট দিয়ে মাথা ঢেকে মোটরসাইকেল যাত্রায় প্রিয়ার শরীরটা আরো দুজনের শরীর ভীষণ খারাপ হয়ে পড়ল। প্রিয়ার তো ভীষণ জ্বর। তখন ওখানকার স্থানীয় গুণীজনেরা ভালো ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধের বন্দোবস্ত করে দিবেন। শেষ রাতের দিকে প্রিয়ার জ্বর কমলেও তা শরীর এত দুর্বল যে চলনশক্তি কমে গেছে। সে আমাকে বার বার বলতে লাগলো, এই অবস্থায়ও সে আমার সঙ্গে যাবেই। আমি ওকে বুঝালাম এখনো ইটানগর বহুদূরে রাস্তা, তুমি এভাবে কষ্ট সহ্য করে যেতে পারবে না। হয় তুমি এখানে থেকে যাও কয়েকদিনের জন্য। অথবা তুমি বাড়ি চলে যাও। সে কোন কথাই শুনে রাজি নয়। তার এক কথা সে যাবেই। আমি নিরুপায় হয়ে দলের সবার সঙ্গে কথা বললাম এবং স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললাম। তারাও আমার সঙ্গে একমত প্রিয়া এবং আর দুজনকে এভাবে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বরং কমপক্ষে দুটি দিন এখানে বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। আমি ফোনে আমাদের কলেজের প্রিন্সিপাল কে সব কথা খুলে বললাম। তুমি শুনে বললেন, কোন কথা নয়, দুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার তোমরা যাত্রা শুরু করবে। বিশ্রাম না নিয়ে তোমাদের বের হওয়া ঠিক হবে না। কারণ ওখান থেকে ইটানগর বহুদূর এবং দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা। অরুণাচলের ওদিকে এমন কোন সমস্যা হলে পাহাড়ে জঙ্গলে বস্তিতে থাকার ব্যবস্থা হয়তো হবে তোমাদের কিন্তু ডাক্তার দেখানো মুশকিল হবে।


অবশেষে দুদিন তেজপুরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রিয়া ভীষণ খুশি হলো। তার বিশ্রামের চেয়ে বড় পাওনা হবে আমার সঙ্গে এই দু'টি দিন আমার সঙ্গে কাটানো। পরদিন বিকেলে তেজপুর শহরটি ঘুরে দেখালাম। কি সুন্দর ছবির মত শহরটি ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারে ছোট পাহাড়ের উপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে একটি ছোট্ট লেক, ছোট হলেও খুব সুন্দর। আর সুন্দর ছবির মত শহরটি একটি পার্কে উঁচু টাওয়ার তৈরি করা আছে, সেখানে উঠে নগাওঁ যাওয়া ব্রহ্মপুত্র সেতু দেখতে পাওয়া যায় কি অপরূপ সুন্দর ব্রহ্মপুত্র নদী এখান থেকে তার সৌন্দর্য যেন আরও বেশি ফুটে উঠেছে।

তারপর দিন প্রিয়া সুস্থ হয়ে উঠেছে, জ্বর ছেড়েছে। আর ফিরে এসেছে মুখের লাবণ্যতা। পরদিন আমরা দুটো গাড়ি রিচার্জ করে কাজিরাঙ্গা অভয়ারণ্য ঘুরে দেখে এলাম। কি সুন্দর অপরূপ কাজিরঙা ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে। এখানকার গন্ডার বিখ্যাত তাছাড়া হাতি, হরিণ, মহিষ ,বাই সন এবং বাঘের দেখা পেলাম। সারাদিন কাজিরাঙ্গা ঘুরে হোটেলে ফিরে এলাম। দেখলাম প্রিয়ার মুখ খুশিতে ভরে গেছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে আমি যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি। আমার যত কষ্টই হোক আমি তোমার সঙ্গে এই যাত্রা শেষ করব। যাত্রা পথে বহু জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি এবং চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ও ছবি তুলেছি।

প্রতিদিন সেইসব ছবিগুলো বাড়িতে, এবং বন্ধু বান্ধবীদের কাছে পাঠিয়ে দিতাম। সবাই দেখে খুব খুশি ।


অবশেষে সবুজ দিগন্তের বুক চিরে আমরা কুড়ি জন অভিযাত্রী সবার মোটরসাইকেল রেডি করলাম। এবং আমাদের যাত্রা শুরু হলো। ক্লিয়ার চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি। মাঝে মাঝে আবৃত্তি করল গাইল ,দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে,,,,,। এ এ পথ যদি শেষ না হতো তবে কেমন হতো,,,,,,,।


আমরা মহানন্দে সৃষ্টিকর্তাকে প্রণাম জানিয়ে ছুটে চললাম সেই দিগন্তের দিকে। সামনে শুধু সবুজ আর সবুজ পাহাড় আঁকাবাঁকা পথ চারধারে বিভিন্ন পাখির কলতান আমাদের বারবার মুগ্ধ করে তুলছিল.…। আমি একবার জল খাবো বলে, মোটরসাইকেল থামিয়ে প্রিয়ার মুখের দিকে তাকালাম, শেও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, অনেকক্ষণ আমরা দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে একে অপরকে দেখছি আর পূব দিগন্তে দুজনে তাকিয়ে দেখে বলছি ওই সুদূরে আমাদের যাত্রা শেষ হবে।


কি ভাই মজা কি আনন্দ। প্রিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract