Debdutta Banerjee

Abstract

3  

Debdutta Banerjee

Abstract

স্বর্ণচাঁপা

স্বর্ণচাঁপা

6 mins
811


সে বহুদিন আগের কথা। ঐ যে দূরের নীল পাহাড়, যার গা বেয়ে নেমে আসে সফেদ শীতল ঝর্ণা ধারা, সেই পাহাড়ের গায়ে এক গ্ৰাম ছিল অনিকপুর। গায়ের শেষ মাথায় যে ছোট্ট মাটির কুড়ে তাতে থাকত এক ফুল বিক্রেতা রূপাই ও তার মেয়ে স্বর্ণ। স্বর্ণর মা ছিল না। জঙ্গল থেকে বাপ মেয়ে মিলে ফুল তুলত, সাত বছরের স্বর্ণ খুব সুন্দর মালা গাঁথত, রূপাই সে মালা ঘুরে ঘুরে বিক্রি করত। 

একদিন জঙ্গলে ফুল তুলতে গিয়ে স্বর্ণ আর রূপাই দেখে একটি যুবতি মেয়ে বসে বসে কাঁদছে। ওরা প্রশ্ন করতেই মেয়েটি বলল তার বাবা মা তাকে ত্যাগ করেছে। সে কালো বলে তার বিয়ে হচ্ছিল না। তাই জঙ্গলে ফেলে গেছে। স্বর্ণর আব্দারে রূপাই মেয়েটিকে বাড়ি নিয়ে আসে। ওর নাম ছিল মায়া। এদিকে স্বর্ণদের ছোট্ট মাটির কুড়েতে একটাই ঘর। মায়াকে ও কোথায় রাখবে ওরা ভেবেই পায় না।প্রথম দুদিন রূপাই বারান্দায় শোয়। কিন্তু একটা যুবতি মেয়েকে ঘরে তুলেছে বলে গাঁয়ের লোক রূপাইকে বলে মেয়েটাকে বিয়ে করে নিতে। মা মরা মেয়ে স্বর্ণরও তাই ইচ্ছা। বাধ্য হয়ে রূপাই মায়াকে বিয়ে করে।

 কিন্তু বিয়ের পর মায়া একদম বদলে যায়। ও স্বর্ণকে ভালবাসত না ।কিন্তু স্বর্ণ নতুন মা কে খুব ভালো বাস্ত। মায়া সেই সুযোগে ওকে দিয়ে সব কাজ করাতো, খেতেও দিত না। রূপাইকে বড় শহরে কাজ করে পয়সা আনতে পাঠিয়েছিল মায়া। স্বর্ণ একাই ফুল তুলে মালা গেঁথে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করত।

 সেবার বর্ষা আসেনি ওদের গ্ৰামে। সব জলাশয় শুকনো, জঙ্গল সূর্যের তেজে ঝলসে গেলো। ঝর্ণায় জল নেই প্রায়। ফুল ফোটেই না তেমন। ওদিকে রূপাই শহরে। স্বর্ণদের বাড়ির স্বর্ণচাঁপা গাছটায় তবু কিছু ফুল ফোটে রোজ। সেই ফুলের মালা বানিয়ে স্বর্ণ বিক্রি করে যা পায় তাই মায়ার হাতে দেয়। এদিকে মায়া রোজ স্বর্ণচাঁপা গাছটার দিকে তাকায়, ভাবে এর ফুল কেন শেষ হয় না?

 আসলে মায়া ছিল একটা ডাইনি বুড়ি। ও যুবতীর রূপ ধরে ছলনা করেই রূপাইকে বিয়ে করেছিল। এখন স্বর্ণকে মেরে ফেলার চিন্তা করত সর্বদা। গাছে ফুল না ফুটলেই ও স্বর্ণকে বনে পাঠাবে ভেবেই রেখেছিল। বনেই ওকে মেরে ফেলত মায়া।

 কিন্তু স্বর্ণ রোজ ঐ স্বর্ণচাঁপার মালা গেঁথেই গায়ের মন্দিরে দিয়ে আসত, আর পুরুত মশাই ওকে দাম বাবদ চাল সবজি বেধে দিতেন। গায়ের মোড়লের বাড়িও যেত ওর মালা, সেখান থেকেও পয়সা পেত স্বর্ণ। 

এদিকে খরায় সারা গ্ৰাম শুকতে বসেছে। রূপাইও কাজ নেই বলে গায়ে ফিরেছে। মায়া তো রূপাইকে দেখেই মায়াকান্না জুড়ে দিল। ও নাকি ভোর রাতে স্বপ্ন দেখেছে ঐ স্বর্ণচাঁপা গাছটা কাটলেই গায়ে বৃষ্টি হবে। তাই ওটা কাটতেই হবে। সারা গায়ে ঐ একটি চাঁপা গাছ তখনো ফুল আর পাতায় ছেয়ে রয়েছে। বারো মাস ফুল দিত গাছটা। স্বর্ণর জন্মের সময় ওর মায়ের হাতে লাগানো গাছ ওটা। গাছ কাটার কথায় ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকে। ওদিকে মায়া বারবার গাছটা কাটতে বলে। ঐ গাছের কাঠ বিক্রি করে ওদের টাকা হবে তাও বলে রূপাইকে।রূপাই অবশেষে রাজি হয়ে যায়।

ওদিকে গাছটা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওখানেই ঘুমিয়ে গেছিল স্বর্ণ। ভোর রাতে ও স্বপ্ন দেখে ওর আসল মা নেমে এসেছে ওর কাছে, ওকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলে গাছ কাটলেও গুড়িটা যেন ও কখনো কাটতে না দেয় ওদের। গুড়িটা আগলে রাখতে। পরদিন রূপাই গাছটা কাটতে যেতেই স্বর্ণ বাবাকে সবটা খুলে বলে। রূপাই গুড়িটা রেখে গাছটা কেটে ফেলে। স্বর্ণ চোখের জল মুছে গাছের সব ফুল তুলে নেয়, প্রচুর মালা গাঁথে। পাতাগুলো রূপাই গায়ের লোকদের বিক্রি করে দেয়, খরায় গরু ছাগলের খাবার নেই। সবুজ কচি পাতা সবাই কিনে নেয়। কাঠও বিক্রি হয়ে যায়।

ওদিকে মায়া দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। ভাবে গাছ তো বিদায় হল। টাকাও শেষ হবে দু দিনে। তারপর হবে আসল মজা। পরদিন সকালে উঠে সবাই অবাক হয়ে দেখে মিষ্টি গন্ধ ছাড়ছে স্বর্ণচাঁপা ফুল, গাছটা রাতারাতি গজিয়ে উঠে দোল খাচ্ছে হাওয়ায়। 

মায়া নিজের মাথায় হাত দিয়ে বলে-'' কি অলুক্ষুনে গাছ গো!! এ গাছ দূর করো এখনি।''

ওর জেদে রূপাই ভয় পেয়ে আবার গাছটা কেটে ফেলে। কিন্তু পরদিন আবার গজিয়ে ওঠে চাঁপাগাছটি। পরপর সাত দিন গাছটা কাটিয়েও যখন কিছুই করতে পারে না মায়া তখন ও আরও রেগে যায়। গ্ৰামের সবাইকে ঘুরে ঘুরে বলতে থাকে ঐ গাছটা অপয়া, ওর জন্য গ্ৰামে খরা হয়েছে। ওটাকে গুড়িটা শুদ্ধু উপড়ে ফেললেই খরা কাটবে। না হলে রাতারাতি কোনো গাছ গজায় নাকি! গায়ের লোক অনেকেই ওর কথায় সায় দেয়। স্বর্ণ এ খবর শুনে ছুটে যায় গায়ের মন্দিরে, পুরুতকে বলে -''যে গাছের ফুলে মায়ের পূজা হয় তা কি কখনো অপয়া হয় ?'' কিন্তু পুরুত চুপ। মোড়লকে গিয়ে বলে-'' যে মালা আপনার গৃহদেবতার গলায় ওঠে রোজ তা কি অলক্ষুণে হতে পারে?'' মোড়ল চুপ। 

গায়ের লোক বলে -''সব মানলাম, কিন্তু গাছ কেটে ফেললে রাতারাতি গাছ গজায় এ তো কখনো শুনিনি আমরা!''

 অতএব গাছটা কাটা হবে গুড়ি থেকেই এটাই ঠিক হয়। স্বর্ণ সারারাত গাছের নিচে বসে কাঁদে। ভোর রাতের স্বপ্নে ওর মা এসে বলে -'' দুঃখ করিস না, যা হবে ভালোই হবে। গাছের গোরায় চারটে নীলচে শেকড় পাবি, যত্ন করে গায়ের চার কোনে পুতে দিবি। আর তোদের কোনো কষ্ট থাকবে না।''

 ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে স্বর্ণ, দু একটা চাঁপা ফুল খসে পড়ে টুপটাপ। ও গাছটাকে শেষ বারের মত জড়িয়ে ধরে। একটু পরেই দলে দলে গ্ৰাম বাসি চলে আসে গাছটা কাটতে। স্বর্ণ অবাক হয়ে দেখের গাছের গুড়িটা মাটির কত গভীরে, কাটছে তো কাটছেই সবাই, মাটি খুড়তে খুড়তে বিশাল বড় গর্ত হয়ে যায় তবু গুড়িটা তোলা যায় না। মায়া থমথমে মুখে দেখতে থাকে সবটা। সূর্য যখন মধ্য গগন পার করে, আস্তে আস্তে গাছের বিশাল গুড়িটা উপড়ে তোলে সবাই। অমনি কোথা থেকে কুলকুল করে জল এসে ঐ গর্ত ভরাট করে দেয়। একটা টলটলে দীঘি দেখে সবাই অবাক।

 মায়া তাড়াতাড়ি বলে -''বলেছিলাম না ওটা অলক্ষুণে গাছ। দেখো গাছ কাটতেই দীঘি জেগে উঠল। গায়ের জল কষ্ট মিটবে এবার।'' 

সবাই কিছু বলার আগেই ভীষণ জোরে বজ্রপাত হয়, আস্তে আস্তে ঈশান কোনে মেঘ জমতে থাকে। শীতল হাওয়া বইতে থাকে।মায়া সবাইকে বলে গাছের গুড়িটা পুরিয়ে দিতে। স্বর্ণ অবাক হয়ে দেখে গুড়ির গায়ে চারটে নীলচে মোটা শেকড়, ও সবার অলক্ষ্যে ওগুলো সংগ্ৰহ করে নেয়।

 মায়া ওদিকে বলেই চলেছে -''ঐ দেখো, মেঘ এসেছে। এবার বৃষ্টি আসবে।.….'' ওর কথার মাঝেই আকাশ থেকে দৈববাণী ভেসে আসে-'' হ্যাঁ, এবার গায়ের দুর্যোগ এবার কেটে যাবে। এই গ্ৰামে নজর লেগেছে এক ডাইনি বুড়ির।সে বোন জঙ্গল থেকে মানুষ সবাইকে ধ্বংস করতে চায়। সে লুকিয়ে আছে এই ভিড়েই। এই পবিত্র দীঘির জল গ্ৰামের সবাই স্পর্শ করতে পারবে। কিন্তু ডাইনি বুড়ি পারবে না। এই জল গায়ে লাগলেই সে ধ্বংস হবে। আর আসল দুর্যোগ তখন কেটে যাবে। ডাইনি বুড়ি স্বর্ণ সহ গ্রামের সবাইকে মারতে চেয়েছিল, কিন্তু এবার নিজেই ধ্বংস হবে।''

আকাশ বাণী শুনে সবাই সবার দিকে তাকায়। সকলের চোখে সন্দেহ। পুরুত আর মোড়ল একে একে সকল কে গিয়ে স্নিগ্ধ দীঘির জল স্পর্শ করতে বলে। মায়া কিন্তু লুকিয়ে পরতে চায় ভিড়ের ভেতর। কিন্তু রূপাই ওকে খেয়াল করে। জোর করেই ওকে দীঘির কাছে নিয়ে যায় রূপাই। জলাতঙ্ক রুগীর মত ছটফট করতে থাকে মায়া। পুরুত ওর গায়ে দীঘির জল ছেটাতেই ওর আসল রূপ বেরিয়ে আসে। চিৎকার করতে করতে ও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তখন সবাই বুঝতে পারে সবকিছু। 

স্বর্ণ ওদিকে শেকড়গুলো নিয়ে গায়ের চার কোনে পুতে দিয়ে আসে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে গ্ৰাম জুড়ে। গাছপালারা প্রাণ ফিরে পায়। ডাইনির জাদু শেষ হয়। সবাই স্বর্ণকে আদর করতে থাকে। গ্রামের সুখ শান্তি ফিরে আসে। পরদিন সকালে সবাই দেখে গায়ের চার দিকে চারটে স্বর্ণচাঁপা গাছ গজিয়েছে, মৃদু হাওয়ায় গাছগুলো দোল খাচ্ছে। এরচপর থেকে অনিকপুরে আর কখনো এমন দুর্যোগ আসেনি। 

যদি কখনো নীল পাহাড়ের কাছে অনিকপুরে যাও স্বর্ণ দীঘি দেখে আসতে ভুলো না। গ্ৰামের চার কোনে চারটে স্বর্ণচাঁপা গাছ ওদের রক্ষা করে চলেছে এখনো। গাছগুলোয় বারো মাস ফুল ফোটে। স্বর্ণচাঁপার গন্ধ মেখে শীতল মিষ্টি বাতাস বয় এখনো অনিকপুরে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract