রূপকথার দেশ ঘাটশিলা
রূপকথার দেশ ঘাটশিলা


কোলকাতা থেকে আড়াইশো কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই ছোট্ট সুন্দর পাহাড়ে ঘেরা ছবির মতো শহর ঘাটশিলা। কোলকাতা থেকে হাওড়া-মুম্বাই মেনলাইনে টাটানগরগামী বহু ট্রেন যাতায়াত করলেও আমার পছন্দের দুই ট্রেনের মধ্যে একটি হল সকালের হাওড়া টিটলাগড় ইস্পাত এক্সপ্রেস আর দ্বিতীয় ট্রেনটি ভোরের হাওড়া বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস। ঝাড়খণ্ডের সিংভূম প্রদেশের অংশ এই ঘাটশিলা,গালুডি,রাখা মাইনস,যদুগোডা ইত্যাদি ছোটনাগপুর মালভূমিরই অংশ। দিগন্তবিস্তৃত রহস্যের কুয়াশায় ঘেরা শাল,সেগুন,পলাশের গভীর অরণ্য আর দিগন্তরেখায় ধূম্র পাহাড়ের হাতছানি এই অঞ্চলের প্রকৃতির মূল বৈশিষ্ট্য। শহর থেকে দূরে অরণ্যের যতো গভীরে যাওয়া যাবে,ততো প্রকৃতি পলকে পলকে খুলবে তার অন্তর্বাস। ঘাটশিলা মানেই রাজপুতদের পরম আরাধ্যা রঙ্কিনী দেবীর মন্দির,লেখক বিভূতিভূষণের বাড়ি,চিত্রকূট পাহাড়,ফুলডুঙরি পাহাড়শ্রেণী ও তিরতির করে বয়ে চলা খরস্রোতা উদ্ভিন্নযৌবনা সুবর্ণরেখা।
প্রকৃতির কোলে এই স্বপ্নের মায়াপুরী সম্পর্কে কিছু কাহিনী প্রচলিত আছে। তাদের মধ্যে কিছু কাহিনী বেশ অপ্রাকৃতও বটে। বিভূতিভূষণ নাকি মৃত্যুর পূর্বে অদূরে শাল অরণ্যের মুণ্ডাদের পরিত্যক্ত সাসানডিরিতে নিজের মৃত্যুকে উপলব্ধি করেছিলেন। কাছেই আছে চোখ জুড়ানো ধারাগিরি ফলস আর মন মাতানো বুরুডি ড্যাম। বিকেলের সোনালী আলোয় এই বুরুডি ড্যামে সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়। আর এই ধারাগিরি ফলস বা ফুলডুঙরি পাহাড়ে অন্তরঙ্গ মানুষের সাথে কিছু ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত কাটানো সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকে।
ঘাটশিলার থেকে কিছু দূরেই পাহাড়ের গায়ে এক ছোট্ট স্টেশন রাখা মাইনস। রাখা মাইনস তামার খনির জন্য বিখ্যাত।
এখান থেকে শাল সেগুনের গভীর বনের মধ্য দিয়ে লাল মোরাম বেছানো পথে এক কুয়াশামাখা ভোরে পৌঁছানো যাবে যদুগোড়ায়।যদুগোড়া ভারতের ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার।
যদুগোড়া মানেই ঝাড়খণ্ডের এক ছোট্ট পাহাড়ী শহর,বন পাহাড় ঘেরা এক রূপকথার রাজ্য। সেখানেই পাহাড়ের গায়ে আছে রাজা জগন্নাথ দেবের প্রতিষ্ঠিত রাজপুতদের পরম আরাধ্যা দেবী রঙ্কিনীর মন্দির। মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলে আরোও দুটি মন্দির আছে,একটা পাহাড়ের শিখরে হরিমন্দির,অন্যটা রঙ্কিনী মন্দিরের পাশে শিবমন্দির।মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব,শীতের সোনালী সকালে নরম রোদ আর উত্তুরে হাওয়ার মধ্যে যদুগোড়ার সেই অপরূপ জনহীন পরিবেশে প্রকৃতির কোলে অবস্থিত সেই রঙ্কিনী মন্দির যদি কোনো নাস্তিক মানুষও দর্শন করে,তাহলে তার মনে যে আধ্যাত্মিকতা প্রবেশ করবে সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যিনি রঙ্কিনী তিনিই কালী,তিনিই চামুণ্ডা আবার তিনিই তারা।
সিংভূমের এই অঞ্চলটির বৈশিষ্ট্য হল বন্ধুর প্রান্তর,দিগন্তবিস্তৃত অরণ্য আর স্থানে স্থানে গ্রাণাইটের মোনাডনক। ঘাটশিলা থেকে পাহাড় আর অরণ্যে ঘেরা দুয়ারসিনিঘাট আর ধলভূমগড় খুব কাছেই। এছাড়া এখান থেকে টাটানগর এক্সপ্রেস ট্রেনে পঞ্চাশ মিনিটের জার্নি। টাটানগর বা জামশেদপুর মানেই ডিমনা লেক আর শহরের অদূরেই মেঘ পাহাড়ের দেশ-দলমা পাহাড়। এছাড়া ঘাটশিলার কাছে আছে গালুডি ড্যাম এবং গালুডিতে সুদৃশ্য রঙ্কিনী মন্দির। বাঙালিরা আগে এখানেই হাওয়া বদল করতে আসত। গালুডিতে বহু বাঙালিদের কুঠিবাড়ি আছে। তাদের মধ্যে কিছু কুঠিবাড়ির আবার হন্টেড হবার বদনাম আছে।
আঞ্চলিক বাসিন্দাদের অধিকাংশই মুণ্ডা। এদের সাথে মিশলে উপলব্ধি করা যায় এদের ধর্মবিশ্বাস,জানা যায় এদের সংস্কৃতি। রঙ্কিনী মন্দিরের পুরোহিতের কাছে শুনেছিলাম,রঙ্কিনী মন্দিরে যখন পশুবলি হয়,তখন সেই মাংস এই দূর দূরান্তের মুণ্ডাদের মধ্যেই বিতরণ করা হয়।মুণ্ডারা এই রঙ্কিনী মাতারই সন্তান।
এছাড়া কাছাকাছিই আছে সারান্দা অরণ্যের প্রবেশদ্বার মনোহরপুর,কিরিবুরু হিলস,মেঘটাবুরু-ছবির মতো সব জায়গা। শীতকালে উত্তুরে হাওয়ায় ভ্রমণের আমেজ,পর্যটনের হাতছানি। একদিন ঘুরে আসুনই না এই ঘাটশিলা।