Rima Goswami

Horror Crime Thriller

3  

Rima Goswami

Horror Crime Thriller

রূপান্তরিত রক্ষাকালি

রূপান্তরিত রক্ষাকালি

14 mins
216


চৈত্র মাসের প্রথম মঙ্গলবার ধূপদাঙ্গা গ্রামে ঘটা করে রক্ষাকালীর পুজো হয় । দিনু বাগদী র পরিবার সেই কোন আমল থেকে ঠাকুর গড়ার কাজ করে । অদ্ভুত নিয়ম এই পুজোর মায়ের মূর্তি পুজোর দিনই তৈরি করতে হয় আর পুজোর শেষে সাথে সাথেই সেই মূর্তি গ্রামের পাশে শ্মশান ঝিলে বিসর্জিত করতে হয় । এই নিয়মের অন্যথা কোন দিন হয়নি । অমাবস্যা লাগতে কয়েক প্রহর মাত্র বাকি দিনু বাগদী ঠাকুর গড়তে ব্যাস্ত , অঙ্গের সাজ এখনো বাকি যে । রক্ষাকালী তলায় সকলে ব্যস্ত পুজোর জোগারে , কেউ ফল কাটছে কেউ মুড়কি কদমা সাজাচ্ছে কেউ ফুল দিয়ে মন্দির থান সাজাচ্ছে । তিথি আলপনা দিচ্ছে মায়ের মন্দিরে , বেদিতে । লোকমুখে শোনা যায় তিথিদের পরিবারের এক ছেলে রহস্যময় ভাবে মারা যায় এই পুজোর দিন সেও বহু কাল আগের কথা । সেবার পুজো সময় প্রাণ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর পুরোহিত খুব অসুস্ত হয়ে পড়ে । তার হয়ত হার্ট এট্যাক বা একটা গুরুতর কিছু হয়েছিল । সবাই তাকে সরিয়ে নিয়ে আসে আর সে সময় তুমুল বৃষ্টি শুরু হয় । পুজো অর্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে সবাই সে স্থান ত্যাগ করে কিছু সময়ের জন্য । এর মধ্য অন্য এক পুরোহিত বৃষ্টি একটু ধরলে পুজো পুনরায় আরম্ভ করতে এগিয়ে আসে । রক্ষা মায়ের থানে এসে তারা দেখে বাজ পরে সেখানে ঝলসে পরে আছে একটা ছেলে । পুজো সেবার বন্ধ হয়ে যায় , মায়ের মূর্তি চক্ষু দানের পর ও পুজো ছাড়াই বিসর্জিত হয় ভোররাতে । সে বছর ভয়াবহ বন্যা হয় গ্রামের প্রচুর ক্ষতি হয় । তার পর থেকেই ভীষণ সাবধানে পুজো সম্পন্ন করা হয় । তিথিদের বাড়ির এই ছেলের ও ভাবে অপঘাতে মৃত্যুর পর ওদের বংশের কেউ এই পুজোয় অংশগ্রহণ করত না । বহু বছর পর তিথির জন্মর পর সে যখন সদ্য চলতে শিখলো কি জানি কোন মায়ায় সে মায়ের থানে এসে পড়ে থাকত । যত বড় হতে থাকলো সে তত রক্ষা মায়ের থানে বেশি করে পড়ে থাকত । বাড়ির কারো বারণ সে শুনত না । বাড়ির লোকেরাও আস্তে আস্তে তার মায়ের প্রতি এই ভক্তি কে মেনে নিল , বহুকাল আগে স্বজন হারানোর বেদনা তিথির ভক্তির কাছে নত হলো । তিথির বৈশাখ মাসে বিয়ে , বর্ধমানের শেয়ারবাজারে পাত্রর বাড়ি । হিসেব মত এটাই তার শেষ পুজো এ গ্রামে , বিয়ের পর প্রতিবছর কি আর সম্ভব হবে পুজোয় জোগাড় করতে আসার । হলুদ শাড়ি , এলো খোপা তে শ্যামবর্না মেয়েটা যেন অসম্ভব দীপ্তময়ী । তার রূপে লাস্য নেই , ছলনা নেই আছে শুধুই ভক্তি , মায়া , ত্যাগ আর ভালোবাসা । তিথি পুজোয় অধিষ্ঠিত হবেন যে পুরোহিত তার সাথে মায়ের আলোচনায় মগ্ন , তার জ্ঞানের পরিধি দেখে ঠাকুরমসাই ও অবাক


এক টানা সে বলে চলেছে মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর প্রথম চরিত্র শ্রী শ্রী মহাকালীর ধ্যানমন্ত্র এইরূপ

ওঁ খড়্গং চক্রগদেষুচাপপরিঘান শূলং ভুসূণ্ডিং শিরঃ| শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্বাঙ্গভূষাবৃতাম্ || নীলাশ্মদ্যুতিমাস্যপাদদশকাং সেবে মহাকালিকাম্ | যামস্তৌচ্ছয়িতে হরৌ কমলজো হন্তুং মধুং কৈটভম্ ||


তিথির মন্ত্র উচ্চারণ এর স্পষ্টতা ঠাকুরমসাইকে আরও উৎসাহিত করে তিথির তন্ত্র জ্ঞান সমন্ধে জানতে তাই তিনি বলেন মা তুমি আর কি কি জানো বলো , বেশ লাগছে শুনতে তোমার মুখে কথাগুলো তিথি অনর্গল বলে চলে :

পুরাণ ও তন্ত্র সাহিত্যে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। এগুলি


হল: দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্মশানকালী, মহাকালী, রক্ষাকালী,কৃষ্ণকালী ইত্যাদি।আবার বিভিন্ন মন্দিরে "ব্রহ্মময়ী", "ভবতারিণী", "আনন্দময়ী", "করুণাময়ী" ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা পূজা করা হয়।এই সব রূপের মধ্যে দক্ষিণাকালীর বিগ্রহই সর্বাধিক পরিচিত ও পূজিত। দক্ষিণাকালী চতুর্ভূজা। তার চার হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্ন মুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা রয়েছে। তার গলায় রয়েছে নরমুণ্ডের মালা। দেবীর গায়ের রং কালো। মাথায় আলুলায়িত চুল এবং তিনি শিবের বুকে ডান পা আগে রেখে দণ্ডায়মান। কালী বা কালিকা হলেন একজন হিন্দু দেবী। তার অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায় কালীপূজা করে থাকে। তন্ত্র অনুসারে, কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত দশজন প্রধান তান্ত্রিক দেবীর প্রথম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। এত পর্যন্ত বলে সে চুপ করে , পুরোহিত মশাইকে বলে মায়ের ঘট প্রতিষ্ঠান র সময় হয়ে এসেছে যে ঠাকুরমসাই !


মায়ের পুজো আরম্ভ হয় , তিথি মন দিয়ে পুজো দেখছে আর মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন যা ও মায়ের কাছে মনে মনে বলে যাচ্ছে । তিথি সমন্ধে একটা কথা কেউ জানে না এমন কি তিথি নিজেই দ্বিধায় । সে মানুষের মৃত্যুকে দেখতে পায় , কোনও মানুষের মৃত্যুর বেশ কিছু মাস আগে থেকেই ও তাকে দেখেই বুঝতে পারে । আরো অনেক কিছু যা পাঁচ জনের মত স্বাভাবিক নয় কিন্তু তা তিথি নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে । একমাস পর তার বিয়ে আর ওর এই অস্বাভাবিকতা কেউ জানে না , যেদিন স্বপন মানে ওর হবু বর ওকে দেখতে এসেছিল সেদিন ওর সাথে ওর ছোট দাদু মানে ওর বাবার ছোট কাকা এসেছিল । ছোট দাদুকে দেখেই ওর সামনে ভাসছিল দাদুর মৃত্যুর দৃশ্য , ও স্পষ্ট জানে এর অর্থ ভদ্রলোক এর মৃত্যু শিওরে । আশি বছরের বৃদ্ধর মৃত্যু তো যখন তখন হতে পারে স্বাভাবিক কিন্তু ভবিষ্যতে ঘটিত হবে যে মৃত্যুর দৃশ্যে তা স্বাভাবিক নয় । ছোট থেকেই একটা লোকের মুখ ওর চোখে ভাসে , ভিড়ের মধ্যে অজান্তেই ও লোকটিকে খোঁজে কিন্তু পায়না । লোকটা কে জানে না , তবে স্বপনের দাদুর মুখের সাথে লোকটির মিল আছে হতে পারে ব্যাপারটা নেহাতই কাকতালীয় । এই নিয়ে তিথির মাথা ঘামানোর সময় নেই । পুজো নির্বিঘ্নে সমাপন হলো , তখন প্রায় রাত তিনটে । ঠাকুরকে মাথায় নিয়ে ছেলেরা চলল বিসর্জিত করতে , সাথে ঢাকির দল । এ সময়টা তিথির খুব কষ্ট হয় , যেন একটা তীব্র শ্বাসকষ্ট । কেউ জলে যদি মাথাটা চুবিয়ে রাখে যেমন হয় , তাই সে বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ে প্রসাদ খেয়ে । বৈশাখের আট তারিখ বিয়ের সাজো সাজো রব , চারদিকে প্যান্ডেল লাইট সানাই । তিথি লাল বেনারসী , গয়নাতে সজ্জিত হয়ে অপেক্ষমান । বর এসেগেছে উলু ধনি তে চারদিক মুখরিত । শুভ দৃষ্টি হবে পানপাতায় ঢাকা তিথি স্বপন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে পাশে অকৃতদার দাদুভাই বিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় । পানপাতা সরিয়ে শুভ দৃষ্টি শুরু হচ্ছে এমন সময় বিরাজ বাবু ভূত দেখার মত তিথিকে দেখে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন । বিয়ে মাথায় ওঠে , সবাই বিরাজ বাবুর চোখে মুখে জল দিতে থাকে ওনার জ্ঞান ফিরে আসে । স্বপন তার দাদুভাই কে বলে কি হয়েছিল যে এরকম চেঁচিয়ে উঠলে ? উনি কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে তিথির দিকে ইশারা করেন ।


      

বিরাজ বাবুর আঙুলের ইশারা তিথির দিকে , সবাই তিথিকে দেখলো কৈ কিছুই অস্বাভাবিক নেই । সবাই কিছু দেখতে না পেলেও বিরাজ বাবু দেখতে পাচ্ছেন তিথির ত্রিনয়ন , লাল বেনারসীতে সুসজ্জিত শ্যাম বর্না তিথির কপালে আর একটি চোখ । তবে তিথিও কিন্তু কিছু অনুভব করতে পারছে না যে তার মধ্যে এমন কি দেখলেন তার দাদাশশুর যে উনি এরকম অস্বাভাবিক আচরণ করছেন । বিরাজ বাবু ইশারা করে চলেন কিন্তু মুখে কথা বলতে পারছিলেন না তাই ওনাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুয়ে দেওয়া হলো । বিয়ে সম্পন্ন হলো , আর সিঁদুর দানের পর তিথির যেন মনে হলো কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে তার ভিতর , তবে সে কাউকে কিছু বলল না । সকালে তিথি শশুর বাড়ী চলে গেল , বিরাজ বাবু ও সাথে গেলেন । রাতের ঘটনার কথা সকালে আবার সবাই তাকে জিজ্ঞাসা করলেও তিনি যেন ব্যাপারটা চেপে গেলেন । বৌভাত এর অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত সকলে বউ দেখে গেলেন , সমাজ মনে হয় সৌন্দর্যের প্রাথমিক শর্ত হিসাবে ফর্সা রংকে প্রাধান্য দেয় তাই লাবন্যময়ী তিথিকে তাদের সুন্দরী মনে হলো না । গোলাপি বালুচরি পড়ানো হয়েছে বলে পাড়ার এক ভদ্রমহিলা রগর করে বললেন কি গো স্বপনের মা তুমি বুঝি বৌমার গায়ের রঙ না দেখেই শাড়ী খানা কিনে এনেছিল ? অনেকে মুখ টিপে হাসলো । স্বপনের পরিবারে এ নিয়ে কোন কুণ্ঠা বোধ নেই তারা তিথিকে খুব পছন্দ করেন । রাতে ফুলশয্যার ঘরে তিথি আর স্বপন প্রবেশ করে , অনেক গল্প করতে করতে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে ।ভোর বেলা ঘুমন্ত তিথিকে দেখে স্বপন ভাবে ' না নারী মানেই কাম নয় , নারী তো বন্ধু , নারী তো প্রকৃতি ' । তিথিকে দেখে স্বপনের মনে কামের উদ্রেক হয় না , তিথিকে দেখে স্বপনের মনে হয় যেন কোন ঘুমন্ত দেবী যার সাথে মনুষ্যচিত আচরণ শোভা পায় না । বৌভাতের পর দিনই ওদের আসামের টিকিট করা ছিল ওখান থেকে ফিরে ওরা ডিরেক্ট তিথিদের বাড়ি অষ্টমঙ্গলা করতে চলে যাবে । তাই বিকেলের ফ্লাইটে ওরা গুয়াহাটি রওনা দিলো । কি কারণে বিরাজ বাবু বাড়িতে কলকাতা যাওয়ার বাহানা দিয়ে চুপি চুপি ওদের ফলো করতে আসাম রওনা দিলেন । ওনার মনে দীর্ঘ পঞ্চান্ন বছর আগের কথা ঘুরছে । বিরাজ বাবু বুঝে গেছেন তিথিই সেই রূপান্তরিত রক্ষাকালী যে শাস্তি দিতে স্বয়ং ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন । কিন্তু তিনি এটা বুঝতে পারছেন না যদি তিথি সব জানে অতীতের কথা তা হলে এ ভাবে চুপ করে আছে কেন ? তার কি কিছু মনে নেই ! সে কি তার শক্তি সম্বন্ধে অবগত নয় ! এসময় যদি তিথির পার্থিব শরীরটা ধ্বংস করে দেওয়া যায় তা হলে দেবীর আধারটি শেষ হয়ে যাবে তিনি জাগরিত হয়ে বিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দন্ড দিতে পারবেন না । বৃদ্ধ বয়সে এসে যদি দেবীর প্রকোপ এর সামনে পড়তে হয় তা হলে ভয়াবহ মৃত্যু নিশ্চিত ।


উনি হিসাব মেলাতে লাগলেন কামাখ্যা মন্দির হল ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত দেবী কামাখ্যার একটি মন্দির। এটি ৫১ সতীপীঠের অন্যতম। এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দিরও আছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্যান্য দেবীর জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা মন্দির। তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ। অর্থাৎ এখানে তিথির মধ্যে অতীত ফেরত আসার সম্ভাবনা প্রবল । শিবের তরুণী স্ত্রী ও মোক্ষদাত্রী শক্তিই কামাখ্যা নামে পরিচিত। কালিকা পুরাণ অনুসারে, কামাখ্যায় পূজা করলে সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয়। তবে যে পাপ সে রাতে বিরাজ করছিল তাতে দেবীর কাছে সে অপরাধী । আর দেবী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড র জন্য শাস্তি দেন সেটা পঞ্চান্ন বছর পর হলেও দেন । এ সব ভেবে ঘেমে উঠছিলেন উনি । স্বপন আর তিথির ফ্লাইট গুয়াহাটিতে ল্যান্ড করে গেছে ওরা গুয়াহাটি র একটা হোটেলে চেক ইন করে তখন রাত সাড়ে নয়টা । ওদের সাথে যে ওদের ছোট দাদুভাই ও আছে সেটা ওরা জানতো না । তিথি বলে স্বপন কে তুমি কিছু জানো এই কামাখ্যা পিঠ সমন্ধে ? স্বপন এর ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান খুব কম সে মাথা নাড়িয়ে জানায় সে কিছুই জানে না । তিথি বলে তবে শোনো , যেখানে দেবীর যোনি পতিত হয়েছিল সেই স্থানকে বলা হয় তীর্থচূড়ামণি। সব তীর্থের মধ্যে সেরা এই তীর্থচূড়ামণি। এ কারণেই কামাখ্যাকে বলা হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পীঠ।

বলা হয় একসময় এখান থেকে কেউ ফিরে আসতো না! মন্ত্র ও যাদুবিদ্যার এক রহস্যময় স্থান বলা হয় কামাখ্যা মন্দিরকে। স্বপন বলে তবে গিয়ে কাজ নেই চলো মেঘালয়ের দিকে চলে যাব । তিথি বলে আমাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করার আগে কাম্যাখা দর্শন করবে না ? স্বপন জানে তিথি ভক্তিমতি মেয়ে সে আর না করে না ।



তিথি আর স্বপন রাতে শুয়ে পড়ে । আর ওদিকে বিনিদ্র রজনী যাপন করছে বিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় । পঞ্চান্ন বছর আগে যৌবনের ভুলে যে অন্যায় তিনি করেছিলেন তার জন্য তিনি অনুতপ্ত । চিরটাকাল তিনি বিয়ে না করে একা রয়ে গেলেন । মৃত্যুর ভয়ে চিরদিন বাড়ির বাইরে রইলেন সেই সুদূর লন্ডনে । এই শেষ বয়সে এসে মনে হয়েছিল অতীত আর ঘুরে আসবে না । তাই ফিরে এসেছিলেন নাতির বিয়ে দেখতে , আর বয়সের কারণে ধূপদাঙ্গা গ্রামের নামটাও মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল । মনে থাকলে তিনি কখনোই ওই গ্রামের মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনতেন না । যার সাথে নিজের বিয়ে ঠিক হয়েছিল সেওতো ওই গ্রামেরই মেয়ে , সময়ের অন্ধকারে আজ সবাই ভুলে গেছে যে বিরাজ বাবুর ওই গ্রামে বিয়ে পাকা হয়ে ছিল । সেই মেয়ে পালিয়ে যাওয়াতে বিরাজ বাবু চির কুমার থেকে যান । কারো মনে থাকার কথাও না , যারা ওই সময়ের সাক্ষী তারা আজ কেউ নেই , না ওনার মা বাবা না বড় দাদা বৌদি । স্বপনের বাবা তরুণ কাকার বিয়ের সমন্ধে র সময় দুধের শিশু ছিল । রাত পেরিয়ে ভোর এর আলো ফুটে উঠেছে , বিরাজ বাবুর তন্দ্রা ভাঙলে তিনি ধড়মড় করে ওঠেন , তৈরি হয়ে এগিয়ে যান কামাখ্যা র দিকে । ওদের পৌঁছনোর আগেই পৌঁছে যেতে হবে যে । কিন্তু দেরি হয়ে গেছে , বিরাজ বাবু যখন পৌঁছালেন দেখেন তিথি আর স্বপন পুজো দিয়ে বেরিয়ে এসেছে , তবে ওরা বেশ হাসি খুশি কোনো রকমের অস্বাভাবিকতা তিনি তিথির মধ্যে লক্ষ্য করলেন না । কিছুটা অসাবধানতাবশত তিনি গাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এমন সময় ওনাকে স্বপন দেখে ফেলে । ওরা দুজন এগিয়ে যায় দাদুভাই এর দিকে । এই যে দাদুভাই তুমি কি শার্লক হোমসের মত আমাদের পিছু নিয়েছ ? চমকে ওঠেন বিরাজ বাবু , থতমত হয়ে তোতলাতে থাকেন তিনি । বলেন না রে নাতি আমি আসলে কলকাতা থেকে আসছি এখানে হটাৎ চলে আসি , জানিস তো কত খামখেয়ালি তোর দাদুভাই । তাই তো ! তুমি তো এমনই , তবে ভালোই হলো চলো আজ মেঘালয় যাবো সাথে চলো । বিরাজ বাবু ভাবেন ধরা পড়ে যখন গেছি এদের সাথে না গেলে সন্দেহ বাড়বে । আর এখানে এসে যখন অস্বাভাবিক কিছু তিথির মধ্যে দেখা যায়নি , তখন নিশ্চিত ভাবে এদের সাথে ঘোরা যায় । পরে ফেরার পথে পথের কাঁটা উপরে তুলে দিতে হবে । মেঘালয়ের জয়ন্তী পাহাড়ে দেবীর বাম ঊরু পতিত হয়। দেবীর নাম জয়ন্তী। মহাদেব ক্রমদিশ্বর নামে পরিচিত। এসব গল্প তিথি বলছিল , স্বপন শুনতে শুনতে যাচ্ছিল আর বিরাজ বাবু মনে মনে ভাবছিলেন তার ধারণা ভুল হতে পারে না ।


এ মেয়ের যা জ্ঞান , যা মুখের দীপ্তি , সেদিন দেখা সেই ত্রিনয়ন এসব প্রমান তিথি সেই রক্ষাকালী , রূপান্তরিত রক্ষাকালী যে এসেছে শাস্তি দিতে । তিথি বলে দদাদুভাই জানো ! শক্তিপীঠ হিন্দুধর্মের পবিত্রতম তীর্থগুলির অন্যতম। লোকবিশ্বাস অনুসারে, শক্তিপীঠ নামাঙ্কিত তীর্থগুলিতে দেবী দাক্ষায়ণী সতীর দেহের নানান অঙ্গ প্রস্তরীভূত অবস্থায় রক্ষিত আছে। সাধারণত ৫১টি শক্তিপীঠের কথা বলা হয়ে থাকলেও, শাস্ত্রভেদে পীঠের সংখ্যা ও অবস্থান নিয়ে মতভেদ আছে।পীঠনির্ণয় তন্ত্র গ্রন্থে শক্তিপীঠের সংখ্যা ৫১। শিবচরিত গ্রন্থে ৫১টি শক্তিপীঠের পাশাপাশি ২৬টি উপপীঠের কথাও বলা হয়েছে। কুব্জিকাতন্ত্র গ্রন্থে এই সংখ্যা ৪২। আবার জ্ঞানার্ণবতন্ত্র গ্রন্থে পীঠের সংখ্যা ৫০। এসবের মধ্যেই গাড়ি পৌঁছে গেল মেঘালয়ের জয়ন্তী পাহাড়ে । গাড়ি থেকে নেমে একটা ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে তিথির মুখে , শিকার যে এখন তাঁর হাতে ।


পঞ্চান্ন বছর আগের কথা তখন বিরাজ বন্দোপাধ্যায় যুবক আর বাড়ির ছোট ছেলে । তার বিবাহ স্থির হয় ধূপদাঙ্গা গ্রামের মুখোপাধ্যায় বাড়ির স্বাতীলেখার সাথে । তিথির দাদামসাই এর ছোট ভাই অজিতের সাথে স্বাতীলেখার একটা প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল । গ্রামের রক্ষাকালী মায়ের বড় পুজো উপলক্ষে আমন্ত্রিত ছিল সেবার বিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়দের পরিবারের সকলে । বিরাজ তার দুই বন্ধুকে নিয়ে আসে হবু শশুর বাড়ী । সেখানে পৌঁছে সে লোকমুখে জানতে পারে স্বাতীলেখার সাথে অজিতের সম্পর্কের কথা । শান্ত , ভদ্র ছেলেটা যেন হটাৎ আসুরিক হয়ে ওঠে । এই নিয়ে বিরাজের স্বাতীলেখার সাথে এক পর্যায়ে ঝামেলাও হয় । স্বাতীলেখা স্পষ্ট জানায় যদি বিরাজের আপত্তি থাকে সে এ বিয়ে ভেঙে দিতে পারে । রাগে অন্ধ হয়ে যায় বিরাজ । পুজোর দিন রাতে গ্রামের বাইরের ঝিলের ধারে তুলে নিয়ে যায় সে স্বাতীলেখাকে , তার পর তাকে নৃশংস অত্যাচার করে হাত মুখ বেঁধে জীবন্ত ঝিলের জলে ফেলে দেয় । এদিকে পূজারী হটাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় পুজোয় বাধা পরে আর প্রচন্ড বৃষ্টির প্রকোপে কিছুক্ষণএর জন্য মন্দির চত্বর ফাঁকা হয়ে যায় । ঝড় জলের মধ্যেই মন্দির আগলে একাই বসে ছিল অজিত । একা পেয়ে বন্ধুদের সাহায্যে তাকে গলা টিপে হত্যা করে বিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় । তার পর বজ্রপাতের ফলে অজিতের সমস্ত শরীর ঝলসে যাওয়ায় খুনের আর কোনো প্রমান থাকে না । সকলে ভাবে পুজোয় বাধা পড়াতে দেবী তার ক্রোধের শিকার বানিয়েছে অজিতকে । চক্ষু দানের পরও পুজো হয় না , দেবী মূর্তি বিসর্জিত হয় । অর্ধ সমাপ্ত রয়ে যায় পুজো , পরের দিন সকালে স্বাতীলেখার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না । বিরাজ গ্রামে রটিয়ে দেয় প্রেমিকের মৃত্যুর খবর পেয়ে স্বাতীলেখা পালিয়ে গেছে । ঝিলের পাকে স্বাতীলেখার শরীর চাপা পড়ে যায় , কেউ কোনো দিন তার লাশ ও খুঁজে পায়না । তাই সে কলঙ্কিনী হয়েই রয়ে যায় । গ্রাম থেকে ফিরে এসে বিরাজ বুঝতে পারে তার ভুল কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে । ওর দুই বন্ধুরই অপঘাতে মৃত্যু হয় , একজনের বজ্রপাতে আর একজনের দলদলের কাদায় পরে শ্বাসরোধ হয়ে । মৃত্যুর ভয় চেপে ধরে বিরাজকে , প্রতি রাতে দেবী রক্ষাকালীর ক্রোধ পূর্ণ মুখ ভেসে ওঠে তার স্বপ্নে । বিরাজ বাঁচতে পালিয়ে যায় লন্ডনে , এই পঞ্চান্ন বছরে হাতে গোনা কয়েক বার দেশে ফিরে ছিল সে । তবে এবার মনে জোর পেয়েছিল কারণ গত কুড়ি বছর ধরে সে আর স্বপ্ন দেখেনি । তাই নাতির বিয়েতে ফিরে আসে দেশে । কিন্তু এটা তার মস্ত বড় ভুল ছিল , আসলে তিথির জন্ম র পর থেকেই দেবীর স্বপ্ন আর দেখত না বিরাজ । তিথির মধ্যেই রূপান্তরিত হয়ে বিরাজকে শাস্তি দিতে ফিরে এসেছিলেন দেবী । আর যেকোনো সময় তিনি তিথির মধ্য জেগে উঠতে পারেন । মেঘালয়ের জয়ন্তী মন্দিরের বাইরে বসে এসব পুরোনো দিনের স্মৃতি মন্থন করছিল বৃদ্ধ বিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় । যে মৃত্যুকে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি আটকে রেখেছেন শেষ বয়সে এসে তাকে কিছুতেই জিততে দেবেন না । শেষ করে দিতে হবে তিথিকে , ও শেষ মানে দেবীর আধার শেষ । এই পাহাড়ী খাদের মধ্যেই গেঁথে দিতে হবে তিথির মধ্য বাস করা রূপান্তরিত রক্ষাকালীকে । এসব ভাবতে ভাবতে সামনে এসে হাজির হয়েছে স্বপন আর তিথি । ওরা তিন জন গাড়িতে উঠে পড়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে যেতে । পথে তিথি হটাৎ বলে ওঠে তার কিছু জিনিসপত্র প্রয়োজন তাই স্বপন যেন বাজারে নেমে যায় সেগুলো নিতে আর তিথি দাদুভাই কে নিয়ে হোটেলে চলে যাবে । বিরাজ বাবু খুশি হয়ে ওঠে কারণ এই তো সুযোগ একা পেয়ে তিথিকে চিরঘুমের দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার । স্বপন নেমে যায় আর গাড়ি এগিয়ে যেতে থাকে পাহাড়ি পথে । রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে বিরাজ বাবু বলেন তার শরীরটা ঠিক লাগছে না তাই ড্রাইভার যেন ঘুরিয়ে নিয়ে যায় বাজারে স্বপনকে ফিরিয়ে আনতে । উনি তিথিকে বলেন ওনার সাথে ওখানে অপেক্ষা করতে , গাড়ি বাজারের দিকে ফিরে যায় । তিথি পাহাড়ি খাদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে , বিরাজ বাবু র হাত এগিয়ে যায় তিথিকে ধাক্কা দিতে । কিন্ত এ কি ! তিথি কৈ ! তিথির বদলে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তার বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুগলে বর ও অভয় মুদ্রা। তার গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। তার গলায় মুণ্ডমালার হার; কর্ণে দুই ভয়ানক শবরূপী কর্ণাবতংস; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। তার দন্ত ভয়ানক; তার স্তনযুগল উন্নত; তিনি ত্রিনয়নী ।


সেই 

ত্রিনয়ন যা সেদিন শুভ দৃষ্টির সময় বিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় তিথির মধ্যে দেখেছিল । বৃদ্ধ বিরাজ বুঝে যান তিথি তার সাথে ছল করছিল এতক্ষণ , সে অনেক আগে থেকেই নিজের শক্তি সমন্ধে ওয়াকিবহাল । এখন প্রতিশোধ নিতে নিজের রূপ ধারণ করেছে । পালাতে চেষ্টা করে বৃদ্ধ বিরাজ , দীর্ঘ পঞ্চান্ন বছরের লড়াই এ ভাবে কিছুতেই শেষ হয়ে যেতে পারে না । তার এ ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে না , ছুটতে শুরু করে সে । প্রবল হুঙ্কার ছেড়ে ওঠে দেবী , এক হাত দিয়ে পিঁপড়ের মত করে ধরে নেয় বিরাজকে । প্রবল আক্রোশে ছিড়ে নেয় তার মুন্ডুটা , তখনো তীর তীর করে কাঁপতে থাকা দেহটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় খাদের গহনে । এক ফুলের মতো মেয়ের কলঙ্কের বোঝা , এক ভক্তর তার দেবীর সামনে হত্যা ও তা দেবীর ক্রোধের কারণে প্রমান করে সন্তানের হত্যার দায় জগৎ জননীর উপর চাপানোর মত সব অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয় স্বয়ং রূপান্তরিত রক্ষাকালী দীর্ঘ পঞ্চান্ন বছর পর । তার পর তিথির শরীর ত্যাগ করে চলে যান চিরতরে । স্বপন কে ড্রাইভার নিয়ে এলে ওরা দেখে তিথি অচৈতন্য অবস্থায় খাদের ধারে পরে আছে আর আশেপাশে দাদুভাই কোথাও নেই । মুখে চোখে জল দিলে তিথির জ্ঞান ফিরে আসে তবে কি হয়ে ছিল সে কিছুই বলতে পারে না , তার সব স্মৃতি যেন লোপ পেয়েছে । বিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না । পুলিশ কেস ক্লোজ করে দেয় এই রিপোর্ট দিয়ে যে হয়ত বিরাজ বাবু গভীর খাদে পরে গেছেন । তিথি আর স্বপন আসাম থেকে ফিরে আসে আর দুর্ঘটনার শোক কাটিয়ে ওঠে ধীরে ধীরে । বিয়ের এগারো মাস পর চৈত্র মাসে রক্ষাকালী পুজোয় বাপের বাড়ি আসে তিথি , মায়ের মূর্তি দেখে ধন্দে পরে যায় সে । মায়ের হাতে ধরা অসুরের কাটা মুন্ডুটা যেন অবিকল তার মৃত দাদাশশুরের মুখের আদলের মতো । মায়ের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠেছে , এক তৃপ্তির হাসি ।







Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror