Maheshwar Maji

Fantasy

1  

Maheshwar Maji

Fantasy

রূপান্তর

রূপান্তর

10 mins
781


সৌমী বাড়ির বড় বউ।ননদের বিয়ে হয়ে গেছে।আর একমাত্র দেওর।বাড়িতে কম সময়েই থাকে।ভিন রাজ্যে কাজ করতে যায়।স্বামীর নাম আনন্দ। চাষবাস করে।তারসাথে কাঁচা শব্জি ফলায়।সাইকেলে করে আশ পাশের হাঁটে বেঁচে আসে।তাই দিয়ে ছোট সংসারটা কোন রকমে চলে যায়।

শ্বশুরমশাই বেঁচে নেই। শাশুড়ীর অবস্থাও ভাল না।

সৌমীর সাথে আনন্দর বিয়েটা দেখাশুনো করেই হয়েছিল। বিয়েতে আনন্দ এক টাকাও পণ নেইনি।তবু শ্বশুরমশাই যৌতুক হিসেবে আনন্দকে বেশ কিছু জিনিস দিয়েছিলেন।

আনন্দ কখনো সে সব হিসেব করতে বসেনি।শুধু তার মা প্রায়ই বলেন।নিজের মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলাম।নগদ একলাখ টাকা পণ সাথে খাট,আলমারি।আর তুই কিনা বিয়ে করলি বিনা পয়সাই!..মেয়েটাও তো দেখতে ভাল নয়।তা নাহলেও কথা ছিল।তোকে ভাল ছেলে পেয়ে তোর শ্বশুর ঠকিয়েছে রে খোকা!..অবশ্য সারা জীবন ধরে আমরা তো ঠকেই আসছি।না হলে তোর বাবা আধ বেলাতে স্বর্গলাভ করে!..তারপর তোর জেঠু,কাকুদেরও তো বিচার দেখলি!..সবাই যখন ঠকাল।তখন তোর শ্বশুরই কেন বাকি থাকে?

সৌমীর কানে শাশুড়ীর এরকম কথাবার্তা এখনো এসে পৌঁছাইনি।তবে শাশুড়ীর নজর দেখে এই কদিনে সৌমী ভালই বুঝে গেছে যে তাকে তিনি মোটেও পছন্দ করেন না।

সৌমী সেসব গ্রাহ্য করে না।এই কদিনেই পাঁকা গৃহিনীর মত সংসারটার হাল ধরে নিয়েছে।সে কাজকে খুব ভালবাসে।এইভাবেই সে একদিন তার শাশুড়ীমায়ের মন জয় করে দেখাবে।

কদিন ধরে সৌমী এই সংসারে একটা জিনিসের বড় অভাব বোধ করছে। আনন্দকে বলতে গিয়েও থেমে গেছে। পাছে শাশুড়ী উল্টো ভাবেন।ভাবতেই পারেন।সংসারে পা রাখতে না রাখতেই মহারাণীর মত আদেশ করা শুরু হল!

আসলে রোজ,রোজ একহাত ঘোমটা টেনে ভিজে চুল নিয়ে পাশের বাড়িতে শীল,নড়ার খোঁজে যেতে হয়।মশলা বাটতে।এটা তার মোটেও ভাল লাগে না। তার উপর একগাদা ভাসুরের অনরবত আনাগোনা।লজ্জা,অপমান দুটোই লাগে।কিন্তু এতদিন এভাবেই সব হয়ে আসছে।সে যদি হঠাৎ করে বাড়িতেই একটা শীল,নড়া আনায়।শাশুড়ীর চোখ যে তাতে জ্বলবে।সৌমী বিলক্ষণ জানে।

তবু আজ আর থাকতে পারল না। আনন্দ প্রেমের বাহুডোরে যেই না তাকে আদর করে কাছে টেনে নিল।সৌমী নকল অভিমান দেখিয়ে হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করল।আনন্দ একটুও রাগ করল না। বরং আরো শক্ত করে নিজের বুকে টেনে এনে বলল,জানি রাগ করেছ।পুজো পেরোল।একটা নতুন শাড়ি দিলাম না।আমাদের পুজো মানে তো লক্ষ্মীপুজো।গাঁয়ে তো আর দূর্গাপুজো হয় না। এবারের শব্জি বেচার টাকায় তোমার জন্য হাট থেকে নতুন একখানা কাপড় আনব।এই তোমার মাথা ছুঁয়ে কথা দিলাম।

সৌমী তৎক্ষণাৎ আনন্দর হাতটা মাথা থেকে সরিয়ে বলে উঠল, কি করো কি?

আমি বুঝি সে কথা কখনো বলেছি?

সে তোমার যখন মন চাইবে দেবে।আমি নিজে কখনো তোমার কাছে চাইব না।

আনন্দ একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল,তাহলে রাতের বেলায় এমন অভিমান কেন?

সৌমী আনন্দর দিকে তাকিয়ে বলল,রোজ রোজ অন্যের বাড়ি গিয়ে আমার মশলা বাটতে একটুও ভালো লাগে না। তুমি আমার জন্য একটা শীল,নোড়া এনে দেবে?

আনন্দ হেসে বলল,এই কথা!..কালকেই শুশুনিয়া থেকে সাইকেলের পিছনে বেঁধে নিয়ে আসব।

আনন্দর এমন কথা শুনে সৌমী খুশিতে ডগমগিয়ে উঠল।

ঠিক তারপরেই বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মত করে আনন্দকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল।


সৌমীর আন্দাজটা অনেকটা মিলে গেছে। তার শাশুড়ী শীল,নড়াটা আনার পর থেকে মাঝে,মধ্যেই তাকে শুনিয়ে বলে ওঠেন,পটের বিবি ঘরে এসেছে।এই তো সবে শুরু।এবার চিবিয়ে,চিবিয়ে আনন্দর পুরো মাথাটা না খেয়ে ছাড়ে!..আলাদা সংসার পাততেই আর দেরী কোথায়?আমাকে ভাত দিবি না।না দে।গতর যতদিন আছে।খেটে খাব।

সৌমী এতদিন পর্যন্ত চুপচাপ সব শুনেই যাচ্ছিল।আজ আর পারল না। রান্না ঘর থেকেই শাশুড়ীর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,এ কী অলুক্ষণে কথা বলেন আপনি!..আপনি কি আমায় শাপ দিচ্ছেন?

শাশুড়ী ফোস করে উঠেন,আমি শাপ দিলেও লাগবে না। পাপী লোকেদের সে ব্রহ্ম তেজ কোথায়?

সৌমী রান্নাঘর থেকে বের হয়ে শাশুড়ীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে উঠল, তাহলে ওসব কথা আমাকে কেন শোনাচ্ছেন?শীল,নড়াটা আনায় আপনি কি নিন্দা,চর্চা করার জন্য এবাড়ি,ওবাড়ি করতে পারছেন না?..তা আপনি যান না। কিন্তু আমার ওসব ভাল লাগে না।

শাশুড়ী এবার নাকি সুরে বলে উঠলেন,কি এত বড় কথা!..আসুক আজ খোকা।স্বামী নেই বলে কী আমার সংসারে আত্মসম্মানও নেই?

সৌমীর কান্না পেয়ে গেল।নিজের এমন হতভাগা কপালের কথা চিন্তা করে।শাশুড়ীকে কুটোটি পর্যন্ত নাড়তে দেন না। নিজের ইচ্ছেতে যেটুকু পারেন,করেন।সৌমী তার বাইরে একটা কাজও শাশুড়ীমাকে করতে বলে না।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে সেই যে কোমরের কাপড়টা শক্ত করে বেঁধে সংসারের কাজে নেমে পড়ে।সময়ে দুটো খাবারো খেতে পায় না।তবু শাশুড়ী নিজে মুখে আজ পর্যন্ত কোনদিন তাকে খেতে বলেননি। সবসময় মুখে একটাই বুলি,টেপা আর টেপি।এই তো সংসার!..কী কাজটাই আছে শুনি?যে সবসময় দৌঁড়ে বেড়াতে হবে?

তার শাশুড়ীর কোন কিছুটাই অজানা নয়।সব জানেন।সকালে গোয়ালের কাজ মিটিয়ে দুধ,চায়ের ঝামেলা শেষে ধোয়া,মোছার পর দৌঁড়ে ঢুব দিয়ে এসে চুলোর জন্য কয়লা ভেঙে সব গুছোতে দশটা বেজে যায়।আগে দয়া করে মশলাটা কোন কোনদিন বেটে আনতেন।কেন যেতেন।সেটাও সৌমী জানে।

পাঁচকানে সেও অনেক খবর শুনেছে।সারাক্ষণ শাশুড়ী তার নিয়ে নিন্দে করে বেড়ান লোকের কাছে।

সৌমীর রাগ হয়।তবে ঝগড়া করতে মন চায় না। আর আনন্দকে এসব কথা শুনিয়ে মাথার বোঝা বাড়ানোর ইচ্ছে নেয়।

আজ আর পারলো না। মনের সমস্ত জমা অভিমান আর রাগ একসাথে গলে গলে দুচোখ বেয়ে নামতে শুরু করল।

সে যত চেষ্টা করছে একটু শান্তিতে থাকার।শাশুড়ী তত চেষ্টা করছেন।সব লন্ডভন্ড করার।আর ভাল লাগে না। বুকটা তার চাপা কষ্টে ফুলে,ফুলে উঠছে।


একমাস যেতে না যেতেই শাশুড়ীর পেটে খুব যন্ত্রণা শুরু হল। সৌমী দিন-রাত এক করে শাশুড়ীর সেবাই লেগে থাকল।সাময়িক সুস্থতার পর আবার যন্ত্রণা শুরু হল।পাশের গায়ের রবিন ডাক্তার এসে বলে গেলেন,পেটের ফটো করতে হবে। সৌমীও সাথে গিয়েছিল।ফটোতে দেখা গেল শাশুড়ীর কিডনিতে পাথর জমেছে।অবিলম্বে অপারেশন করতে হবে।

গরীবের ঘরে হাজার তিরিশেক জোগাড় করতেও কিছুদিন সময় লাগে।আনন্দ সৌমীকে বলল,একবার পরমাকে ফোন করলে হয় না। ও যদি কিছু দিত।

পরমা মানে তার সহোদর ভাই পরমানন্দ।ঘরের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করে না।যখন বাড়ি আসে ভিক্ষের মতো কিছু দিয়ে যায়।বাকি সময় ঘরে ফোন করে খবর পর্যন্ত নেয় না।

সৌমীই চেষ্টা চরিত্র করে দেখল।আনন্দর এত সময় এবং আগ্রহ কোনটাই নেই।

এদিকে শাশুড়ীমায়ের অবস্থা যে দিন,দিন অবনতি হচ্ছে।

সারাদিন খাটে শুয়ে থাকেন।যদিও চোখের চাউনিতে কোন রকম পরিবর্তণ ঘটেনি।সৌমীর এত সেবা,যত্নও শাশুড়ীর পাষাণ মনে একটা ঢেউ পর্যন্ত খেলাতে পারেনি।

ওঠতে পারলে এখনো তিনি বউমার মুন্ডুপাত করতে ছাড়বেন না।


অমর বলে ছেলেটার কাছ থেকে কোনরকমে পরমার ফোন নাম্বারটা সৌমী জোগাড় করল।

অমরকে দুদিন আগেই বলে রেখেছিল।পরমার নাম্বারটা যেন একটু জোগাড় করে দেয়।আজকে দুপুরের দিকে ছেলেটা নিজে এসে নাম্বারটা দিয়ে গেল।

বাড়িতে একটাই ফোন।সেটা আবার আনন্দর কাছেই থাকে।অগত্যা সৌমীই বলল,এত যখন করলে।আর একটু উপকার করো ভাই।নাম্বারটা একটু লাগিয়ে আমাকে দাও তো।তোমার দাদা কখন ফিরবে কি জানি।খবরটা তো জানিয়ে রাখি।

ও প্রান্তে অবশ্য পরমানন্দকে পাওয়া গেল।কিছু টাকা পাঠাবার ব্যবস্থা করবে বলেছে।


সন্ধ্যের সময় সৌমী শাশুড়ীর জন্য এক গ্লাস দুধ আনতে গেল ওপাড়াতে।সকালে ঘরের গাইটাও অল্প মত দেয়।সবটা মিলিয়ে শাশুড়ীর জন্য সকালবেলায় একটু ছানা বসিয়ে দেয়।

এদিকে আনন্দ হাট থেকে এসে সাইকেলটা রেখে প্রথমেই মায়ের ঘরে গিয়ে বসল।

তারপর কপালটা ছুঁয়ে বলল,আজ কেমন আছো মা?

তার মা গলাটা যতটা সম্ভব নিচু করেই বলে উঠল,আছি বাবা।সব ঠাকুর মালিক।তারপর কষ্ট করে ওঠে বসলেন।এদিক,ওদিক তাকিয়ে বললেন,একটা কথা বলি খোকা শোন।..বউমার চাল,চলন আমার আজকাল মোটেও ভাল ঠেকছে না। যখন,তখন বাইরের ছেলেদের ঘরে ঢুকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা কীসের শুনি?

একটু নজরে রাখিস।এইসব মেয়েছেলেরা তুকতাক জানে।স্বামীকে নিজের ছলনায় বন্দি করে পরপুরুষদের নিয়ে খেলা করে।একদম সাবধান আনন্দ।..যা এবার হাত,পা টা ধুয়ে মুখে কিছু দে গিয়ে।


আনন্দ সব বোঝে।সৌমী যে তার মায়ের জন্য কত কি করছে।আনন্দ সব দেখে।তাইতো সৌমীকে আরো বেশি করে ভালবেসে ফেলেছে।ও এবাড়িতে আসার পর থেকে আনন্দ নিশ্চিন্ত মনে কাজে যেতে পারে।সে জানে সৌমী সব কিছু আগলে রাখবে।

তবু মায়ের কথাটা তার মনের গোপন দেওয়ালে কোথাও একটু ফুটো করে দিল।যেখানে ভালবাসা,সেখানে সন্দেহ একটু হতেই পারে।তারপর মা বলে কথা।কিছু একটা তো ব্যাপার হয়েছে।

সৌমী এত বোকা নয়।সন্ধ্যেবেলায় তার শাশুড়ী যে কিছু একটা কুমন্ত্র ছেলের সহজ,সরল মাথাটাই ঢুকিয়েছেন।সে ব্যাপারে সৌমী একদম নিশ্চিত।

তাইত আজ প্রথম আনন্দ এভাবে পাশ ফিরে চুপচাপ শুয়ে পড়েছে।মুখে রা টি পর্যন্ত নেই।

সৌমীর এভাবে থাকতে ভাল লাগে না। একে তো শাশুড়ীর দিন-রাত বাঁকা চোখের চাউনি।তার উপর স্বামীও যদি এভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকে।তাহলে সে কার দিকে চেয়ে বাঁচবে?

সৌমী তাই একরকম জোর করেই আনন্দকে ধরে বলল,কী হয়েছে কী তোমার আজ?

আনন্দ ছোট্ট করে বলল,ঘুম পাচ্ছে খুব।

সৌমী জোর গলায় বলে উঠল, এবার আমি একটা সন্তান চাই।

আনন্দ একটু ব্যঙ্গ করেই বলল,তা আমি কী করব?

সৌমী ভাবল,সত্যি সত্যিই কী আনন্দ রসিকতা করছে! না তাকে প্রশ্ন করছে?

সৌমী সহজভাবে বলল,এটা কী রকম উত্তর শুনি?...এতদিন আমি তোমার কথা রেখেছি।এবার আমার কথা তোমাকে রাখতে হবে।না হলে আমি আর বেশিদিন বাঁচব না।এই তোমায় বলে দিলাম।

সৌমী কথাটা শেষ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

আনন্দ আস্তে করে সৌমীকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে শর্ত পূরণের জন্য সচেষ্ঠ হয়ে উঠল।


পরমা কী ভাগ্যে কথা রেখেছে।আজ দিন দশেকের ভিতর দুবারে মোট কুড়ি হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে।টাকাটা পাঠিয়েছিল তার একজন বন্ধুর একাউন্ট নাম্বারে।সে দুবারের সব টাকা তুলে নিজের হাতে সৌমীকে দিয়ে গেল।

প্রানবন্ত ছেলে।অমরের মতই।সব এক বয়সী।এরা সুপুত্র।তাই এখনো পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছে।সরকারি চাকরী না হলেও একেবারে ভেসে যাবে না। হয়ত প্রাইমারি লেবেলে পরমার সহপাঠি ছিল।তবু যে আজো বন্ধুত্বটা টিকিয়ে রেখেছে।সেটাই বড় ব্যাপার।তারও একটা কারণ আছে।সেটা পরমা এলে ক্লাবঘরে হয়। সবাই বলে ফিস্ট।

সে যায় হোক।ছেলেগুলো পরোপকারী।না হলে পুরো টাকা কেউ ঘরে বয়ে এনে দেয় না! সৌমীও খাতির,যন্ত যতটুকু করার করেছে।একটু চা,দুটো নিমকি দিয়ে দুদন্ড গল্পও করেছে।সব তো তার সেই শাশুড়ীর মুখের দিকে চেয়ে।যতই হোক তিনি যে মায়ের সমান।তার ব্যথায় সেও তো কুকিয়ে ওঠে।

..কিন্তু সৌমি তো আর জানে না।আসলে তার ভাগ্যটাই যে তাকে নিয়ে খেলছে।

তা না হলে ছেলেটা হেসে বেরিয়ে যাওয়ার সময়েই আজ হঠাৎ করে আনন্দর মুখোমুখি পড়ে যায়!

 দৃশ্যটা দেখে তার শাশুড়ীর মরা গালেও দুটো টোল পড়ে গেল।এসবের নৈপথ্যে যে তার ভুমিকা কতখানি সেটা একমাত্র তিনিই জানেন।ঈশ্বরও টের পাননি।

ছেলেটা বাইক নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরই বিস্ফোরণটা ঘটল।

আজকের সূর্যটা তাপ একটু বেশিই ঝরাচ্ছে।তার উপর মনের উত্তাপটা মিলেমিশে আনন্দর সমগ্র শুভবুদ্ধিকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল।তাই সাইকেলটা উঠোনেই ফেলে সৌমীর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,বলি ঘরের মধ্যেয় কী তাহলে মৌচাক বসিয়েছ!..ভালই তো। সাক্ষাৎ দর্শণ লাভ হল!

সৌমীর মাথায় যেন আচমকা আকাশ ভেঙে পড়ল।আনন্দ যে এসব বাজে কথা তাকে শোনাতে পারে।কল্পনাও করেনি।তবু গলায় বিশ্বাসের তেজটুকু বঝায় রেখেই বলে উঠল, এসব আজে বাজে কী বলছো তুমি?..ছেলেটা এমনি আসেনি।টাকা দিতে এসেছিল।

আনন্দ রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বলে উঠল,টাকা ছাড়া কেউ কি এমনি ফুর্তি করবে ভেবেছ?..ছিঃ..ছিঃ সৌমী।তুমি এত নিচে নেমে গেলে!..টাকার জন্য শেষে সম্মান বিক্রি করলে!..আমার রোজগারে তোমার আল্হাদ পূরণ হয় না। সে কথা আগে বললেই পারতে।নিজের কিডনি দুটো বেঁচে দিতাম।

সৌমী আর থাকতে পারল না। আত্মসম্মানবোধ তারও আছে।তাই চিৎকার করেই বলে উঠল,খবরদার বলছি।আমার সম্বন্ধে আর একটা বাজে বকলে।আমি কিন্তু ছেড়ে কথা কইব না।

আনন্দ হিতাহিতজ্ঞানশুণ্য হয়ে পড়ল।দৌঁড়ে গিয়ে সৌমীর চুলের মুঠিটা ধরে সজোরে ছুঁড়ে মারল।সৌমীর মাথাটা লাগল গিয়ে শীলের একটা কোণে।অনেকটা কেটে গেছে।ঝর্ ঝর্ করে রক্ত পড়ছে।সৌমী তবু উঠল না।

আনন্দর ভিতর রাক্ষসটা কিছুতেই ক্ষান্ত হতে চাইছে না। তাই এবার শক্ত নড়াটা হাতের মুঠোই তুলে সৌমীর মাথাটা কে গুড়িয়ে দেবার জন্য উদ্ধত হল।

ততক্ষণে পাশের বাড়ির লোকজন এসে আনন্দকে জাপটে ধরে ফেলেছে।তা না হলে ভয়ানক কিছু ঘটে যেত।

উপস্থিত সকলে ঘটনার আকস্মিকতা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তাই একজন বলে উঠল,কিরে আনন্দ.. এসব হচ্ছেটা কি?আজ কি তুই কিছু খেয়ে,টেয়ে এসেছিস?বরাত জোরে এমন গুণের বউ পেলি!..আজ তাকেই কিনা নিজের হাতে মারছিস?..ছিঃ

আনন্দর হয়ত এতক্ষণে একটু জ্ঞান ফিরেছে।তবু বলে উঠল, বাইরের ছেলেদের ঘরের ভিতর ঢোকান কেন?..বদ মতলব ছাড়া কেউ ওসব করে?

এবার সম্পর্কে তার এক দাদু লাঠি ঠুকে বলে উঠলেন,এক ঠ্যাঙানিতেই বাছা তোর পাদুটো গুড়ো করে দেব।এইটুকু দোষে কেউ এমনভাবে ঘরের লক্ষ্মীর গায়ে হাত তোলে?..কত দরকার থাকতে পারে।তুই তো সকাল হলেই সাইকেলটা বাগিয়ে হাটে চলে যাস।মেয়েটা দৌঁড়ে,দৌঁড়ে সারাটা দিন শাশুড়ীর সেবা করে।দুদন্ড কোন মেয়ের সাথে দুটো কথা বলার সময় পর্যন্ত পায় না। আমরা দেখছি না?...কার কুমন্ত্রণাই তুই এসব কান্ড করলি বল তো?..না কুসঙ্গে মেতে উঠেছিস?

এতক্ষণে আনন্দর ভিতরে মৃত মানবিকবোধটা হঠাৎ করে জেগে উঠল। বুঝতে পারল।সে ক্ষমার অযোগ্য কাজ করে ফেলেছে।

সৌমীকে মহিলারা উঠিয়ে কপালটা মুছে অল্প চুন লাগিয়ে দিয়েছে।

তার শাশুড়ী মিছে কান্না জুড়েছে।খেলাটা যে শেষ চালে ঘুরে যাবে।ভাবতে পারেন নি।না হলে কুলক্ষ্মী আজকেই বিদেয় হত।

আনন্দ এবার মাথায় হাত রেখে উঠোনে ধপাস করে বসে পড়ল।

দাদুটা যেতে,যেতে আর একবার বলে উঠলেন,উল্টো পাল্টা কিছু ঘটলে।আমরা কিন্তু মোটেও সাথ দেব না।সেইভাবে সবকিছু মিটিয়ে ফেল।..এই তোরা সকলে চল।ওরা,ওদের মত করে সবকিছু মেটাক।


সৌমী ব্যথা নিয়েই সংসারের বাকি কাজগুলো করে ফেলল।আনন্দর একটা কথারো জবাব দিল না। আনন্দও হাল ছেড়ে শুয়ে পড়েছে।শুধুমাত্র শাশুড়ী খাবার খেল।বিকেলের দিকে খবর পেয়ে সৌমীর বাবা এসে মেয়েকে সাথে নিয়ে গেলেন।


মাঝ রাতে আনন্দর মা আবার অসহ্য ব্যথায় কুকিয়ে উঠলেন।অপারেশন ছাড়া গতি নেই।এদিকে টাকা,পয়সার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি।গাড়ি ডাকা হল।আনন্দ জমান টাকাগুলো একটা টিনের কৌটোতে ভরে রাখে।আপাতত ওইটুকু নিয়েই হাসপাতালে পৌঁছতে হবে।হাতটা ঢোকাতে গিয়েই চমকে উঠল।একগোছা টাকা।গুনে দেখল।মোট তিরিশ হাজার।আর একদম নিচে পড়ে আছে সৌমীর সোনার হারটা।তারমানে।কম পড়লে।ওটা বেঁচে দেবে।

আনন্দর বুক ঠেলে কান্না বের হলো।কিন্তু এখন তার কাঁদলে চলবে না। তাই একটা পাথর সমান শক্ত ঢোক গিলে টাকাগুলো সাথে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল।


অপারেশনের পর যখন আনন্দর মা অনেকটা সুস্থ বোধ করলেন।তখন আনন্দ ধীরে, ধীরে ওর মায়ের বেডে গিয়ে বসল।তার মা বললেন,এতগুলো টাকা কোথায় পেলি খোকা?শেষে কি আমার জন্য মাটিহারা হলি নাকি?..কোন ক্ষেতটা বেঁচলি খোকা?

আনন্দর দুচোখ বেয়ে অশ্রু টপ টপ করে পড়ছে।মাটি আমি হারায়নি মা।মাটি আমাকে হারাতে দেয়নি তোমার কুলক্ষ্মীটা।...সেদিনের ছেলেগুলো আর কেউ ছিল না মা।ওরা সবাই পরমার পুরনো বন্ধু।সৌমী ওদের সাথে যোগাযোগ করে পরমার কাছ থেকে বলে,কয়ে ওই টাকা কটা আদায় করে রেখেছিল।তোমার অপারেশনের জন্য।শেষে নিজের হারটাও খুলে গেছে।যদি কম পড়ে।তোমার কথা শুনে আমি এমন অলক্ষ্মীকে মেরে বিদেয় করে দিয়েছি মা।আর তোমার কোন যন্ত্রণা থাকবে না মা।এবার তুমি খুশি তো ?

আনন্দ কথাগুলো শেষ করে তার মায়ের দিকে চাইল।

একি!..তার মায়ের চোখে জল!..নাকি অভিনয়? চোখের জল কখনো মিথ্যে কথা বলে না।

তার মা হাতদুটো তুলে কাকে ডাকছেন বুকের মধ্যে ভরার জন্য?..আনন্দ অবাক বিস্ময়ে পিছন ফিরে চাইল।দুচোখে কান্না নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার স্ত্রী।সৌমী।তবে কি অপারেশনে তার মায়ের মরা মমতার স্রোতগুলো খুলে গেছে!!.নাকি সত্যি সত্যিই এমনো হয়?

আনন্দ সৌমীর দিকে সজল চোখে হাতজোড় করে দাঁড়াল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy