Rima Goswami

Horror Fantasy

3  

Rima Goswami

Horror Fantasy

রুদ্রানীর সাধনা

রুদ্রানীর সাধনা

11 mins
473



ত্রিধোদিতা। সা শর্বা চন্ডিকা দূর্গা ভদ্রা ভগবতীর্যতে।। যোগনিদ্রা হরেরুক্তা মহাকালী তমোগুণা। মধুকৈটভনাশার্থং যাং তুষ্টাবাম্বুজাসনঃ।

ওম কালি কালি মহাকালী কালিকে পাপহারিনি

ধর্মার্থমোক্ষদে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে।'


দুই ফুট চার ইঞ্চি একটা কষ্টি পাথরের কালী মূর্তির সামনে বসে রুদ্রানী । চার প্রহরে চার বার পুজো হবে আজ অমাবস্যাতে । নিশি রাতেই হৃদ দীঘি থেকে ঘটের জল এনে , তা স্থাপিত করে ফেলেছে রুদ্রানী । তার পর এক হাজার এগারোটি জবাকুসুম , বিল্য পত্রর আহুতি দিতে দিতে বীজ মন্ত্র উচ্চারিত করে যাচ্ছে ক্রমাগত । মূর্তির চোখ দুটো যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে , দেবীর মূর্তি যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে । হোমাগ্নির তেজ ফুটে উঠেছে দেবী ও পূজারিণী উভয়ের মুখমণ্ডলিতে । আজ সিদ্ধি লাভ নয় মৃত্যু , যে কোন একটা প্রাপ্তি করবে রুদ্রানী । অনেক হয়েছে মায়ের সঙ্গে বেটির লুকোচুরির খেলা । আর না , সে আজ মাকে নিজের সামনে থেকে দেখবে তার স্নেহের ওম সে নেবে না হয় প্রাণ ত্যাগ করবে ।


এই বিশাল একটা অট্টালিকাতে পুরোনো কাজের লোক বাবুলাল ছাড়া কেউ থাকে না রুদ্রানীর সঙ্গে । দেউলের রাজবাড়ী আজ তার গর্ভে ধারণ করে রেখেছে এই বংশের একমাত্র উত্তরসূরী কে । রায় বাড়ির জনসংখ্যা কমতে কমতে একসময় দাঁড়ায় তিন জনে , লালমোহন রায় , ওনার স্ত্রী শ্যামা আর একমাত্র কন্যা রুদ্রানী । তার পর একটা একসিডেন্ট রুদ্রানীর মা বাবাকে কেড়ে নেয় ওর কাছ থেকে । সেই থেকে রুদ্রানী একাই মালিক এই দেউল রাজবাড়ীর । তার ছোট থেকেই একটু অন্তর্বর্তী থাকার স্বভাব ছিল তার পর মা বাবার এই হঠ্যাৎ প্রয়ান তাকে আরো চুপচাপ করে দেয় । নিজেকে সে জড়িয়ে ফেলে ভক্তির সঙ্গে , ঠাকুরঘরে ঘন্টার পর ঘন্টা তার উপাসনা , দীর্ঘ অযত্নে ওই জটাজুটও ফলে তাকে ভয় পেতে শুরু করে বাড়ির কাজের লোকেরা । এবাড়িতে লোক কুটুম আসা তো বন্ধ হয়ে গেছে গেছিলো রায় দম্পতির মৃত্যুর পর থেকেই এবার বাগানের মালী , রাঁধুনি , সাফাইএর লোক সব পালালো ভয়ে । রয়ে গেছে শুধুমাত্র একজনই বাবুলাল । সে তার বাপ ঠাকুরদা সবাই এ বাড়ির কাজের লোক ছিল তাই সে দিদিমণি কে একা ছেড়ে চলে যেতে পারেনি । তবে একা বাবুলাল কি কি কাজ করতো ? রান্না না হয় দুটো মানুষের কিন্তু এই এত বড় অট্টালিকার দেখাশোনা ! বাগানের যত্ন ! তা কি সম্ভব হয় ? তাই দিদিমনিকে বলায় সে বলে বাবুলাল আমরা কাকা ভাইঝি দু মানুষে এই ঠাকুর ঘরের দিকটায় থাকি নিচ তলায় , বাকি সব ঘর তুমি বন্ধ করে দাও গে কাকা । আর বাগানে আমার যা যা দরকার তা তো মায়ের আশীষ অযত্নেও বেড়ে যায় জবা ফুলের গাছ গুলো আর ওই বেলপাতা , তুলসী পাতা , দুৱা ঘাস এসেবর জন্য মালী লাগে না তাই বাগান পরিস্কার করার ও দরকার নেই । আমি কোথাও যাই না তো গাড়ির গ্যারেজ ও লক করে দাও , ড্রাইভার এর দরকার নেই । শুধুমাত্র আমার ঠাকুরের ঘরখানা তকতকে রেখো দিকি কাকা তা হলেই হবে । বাবুলাল সেই থেকে পুরো বাড়ি বন্ধ করে শুধুমাত্র এই একতলা টার দেখরেখ করে । রান্না করতে যা যা বাজার হাট লাগে দেরাজ খুলে টাকা নিয়ে সে নিজেই কিনে নিয়ে আসে । দিদিমণি ওসব দেখতে নারাজ , সে ইদানীং এমনও হয় গোটা দিন রাত ওই ঠাকুর ঘরেই পরে থাকে সারাদিন খায় ও না । রুদ্রানী তাদের বাড়ির সঙ্গে যে দীঘির শুরু হয়েছে যা শেষ হয়েছে বহু দূর গ্রামের শেষে সেখানেই স্নান আচমন সেরে নেয় ।


তার সংসারে আসক্তি শেষ , তার ভক্তি ছাড়া আর কিছুই শেষ নেই । মায়ের প্রকট অস্তিত্বের টের সে পায় , তার সঙ্গে যে মায়ের এই লুকোচুরি সেটা অনেক দিনের । বাবুলাল ও বোঝে এবাড়িতে আরো কারো অস্তিত আছে , হঠাৎ করে ধুনোর গন্ধ নাকে আসে । মাঝ রাতে ছমছমিয়ে কে যেন হেঁটে যায় । সবাই এই কারণেই ভয় পেয়ে এ বাড়ির ধারে কাছেও আসে না আর , কিন্তু বাবুলাল জানে অদৃশ্য হলেও সে শক্তি আলোর , অন্ধকারের নয় । যে শক্তি বাবুলালের ক্ষতি করবে না । কাক ভোর রাতে উঠে দিদিমণি কি যে করছে বাবুলাল জানে না , সে ওঠেও নি বিছানা ছেড়ে , নিজের ঘর থেকেই শুনতে পায় মন্ত্র আউড়ানোর শব্দ । সত্যি বলতে সব মিলিয়ে অনেক কাজ সারাদিন করে বাবুলাল আর পারেনা , তারও তো বয়স থেমে নেই । উঠেও লাভ কি ? দিদিমণি চা জল কিছুই খায় না । নিয়মমাফিক খাবার সে খায় কখন ? বাবুলাল একা রেঁধে একাই খায় , দিদিমণির যখন মন হয় চেয়ে নেয় । রুদ্রানীর ভক্তির আজ চরম পরীক্ষা , সে আজ প্রস্তুত হয়েছে । ভোর রাতে উঠেই সে প্রায় বনে রূপান্তরিত হয়ে আসা বাগান থেকে জবা ফুল , দুৱা ঘাস , বেল পাতা সব জোগাড় করে দীঘিতে ডুব দিয়ে ঘট নিয়ে এসে বসে গেছে পুজোতে । তাদের পূর্ব পুরুষের স্থাপিত এই কালি মূর্তি টি যে ভীষণ ভাবেই জাগ্রত সেটা রুদ্রানী অনেক আগেই বুঝে গেছিলো । তবে সাধনার ইচ্ছা থাকলেও মা শ্যামা তাকে কিছুতেই পুজো অর্চনার সঙ্গে জড়িত হতে দিত না । তার পর নিজের উচ্চ শিক্ষার জন্য দীর্ঘ দিন বর্ধমান ইউনিভার্সিটির গার্লস কলেজে থাকা , এই ভাবেই রুদ্রানী দূরে সরে যেতে থাকে সাধনার মার্গ থেকে । তার পর ওর এম এস সি পরীক্ষার পর বাড়ি ফিরে আসার পর পরই মা বাবার মৃত্যু । সাধনার ব্যতীত অন্য কিছু অবশিষ্ট আছে কি রুদ্রানীর জীবনে ? এ বাড়িতে প্রতি অমাবস্যার পুজো করতেন যোগেন্দ্র ঠাকুর আর মায়ের বাৎসরিক পুজো হতো দীপান্বিতা কালিপুজোর দিন । রুদ্রানীর নারী হয়ে ঠাকুরের মূর্তি পুজোতে ভীষণ আপত্তি জানায় যোগেন্দ্র ঠাকুর । রুদ্রানী কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারে না , যে শাস্ত্রে কোথাও উল্লেখিত নেই যে নারী পুজো করতে পারে না । শেষে সে যোগেন্দ্র ঠাকুরকে বিনয়ের সাথে এ বাড়ির নিত্য পুজো থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করে । রাগে অগ্নিশর্মা যোগেন্দ্র বাধ্য হয় এই জাগ্রত গুহ্য কালীর পুজো ছাড়তে ।


তার পর থেকে দীর্ঘ সাত বছর ধরে রুদ্রানী নিজের হাতে মায়ের সেবা করে আসছে । আজ এটাই দেবী পূজার প্রশস্ত সময়। কার্তিক মাসে সাড়ে পাঁচটায় সূর্যাস্ত। তারপর আবার চার ঘন্টা বাদ দিয়ে পূজায় বসতে হবে এবং রাত্রি একটার মধ্যে পূজো সমাপ্ত করতে হবে রুদ্রানী কে । যদিও ঈশ্বরের প্রার্থনা করার বা ডাকার কোনও বাঁধাধরা নিয়ম হয় না। ভক্তিই হল মূল মন্ত্র। বৈদিক মতে পুজো-অর্চনার তো বিধিবদ্ধ নিয়ম আছেই। তা ছাড়া কালীপুজোর দিন পুজোর জন্য উপবাস থেকে জপতপের ভীষণ সুফল পাওয়া যায়। মা কালী যে স্বয়ং সময়ের প্রতীক। কাল’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে: ‘নির্ধারিত সময়’ ও ‘মৃত্যু’। কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের মানে "সময়ের থেকে উচ্চতর"। তন্ত্র অনুসারে কালী দশমহাবিদ্যা-র প্রথম দেবী। শাক্তমতে কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ , রায় বাড়ির এই প্রাচীন মূর্তির মধ্য রক্ষিত আছে ভীষণ শক্তির উৎস । সেটা জানা ছিল যোগেন্দ্র ঠাকুরের , সুযোগ মেলেনি দেবী মূর্তিকে হস্তগত করার । তার পর এবাড়ির শেষ পুরুষ লালমোহন রায়কে যোগেন্দ্র চক্রান্ত করে সস্ত্রীক সরিয়ে দেয় পৃথিবী থেকে । সে ভেবেছিল শোকে কাতর রুদ্রানী কে বিয়ে দিতে আর কতক্ষণ ! তার পর কুলপুরোহিত হাওয়ায় এ বাড়িতে পুজোর অছিলায় এসে সাধনা করে চরম শক্তি লাভ করে নেবে । মা বাবার মৃত্যুর পর ওই মেয়ে যেন কেঁচো থেকে ফনাধর সর্পিনি তে পরিণত হলো , যোগেন্দ্র কে সরিয়ে আজ পর্যন্ত সে নিজেই সাধনা করে যাচ্ছে । বোকা বাবুলাল এর কাছে ভালোমানুষ সেজে যোগেন্দ্র সব খবর নেয় রায় বাড়ির অন্তরমহলের । সে জানে আজ রাতেই দেবীকে এ ধরাধামে অবতরণ করাবেই ওই রুদ্রানী । আর ওই মাহেন্দ্র ক্ষনে যোগেন্দ্র রুদ্রানীর বলি দিয়ে দেবীকে তুষ্ট করে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী হবে । সেই মতো বাবুলাল কে যোগেন্দ্র বুঝিয়েছে রাত্রে তার দিদিমনির অজান্তেই যেন সে যোগেন্দ্র কে বাড়িতে ঢুকিয়ে নেয় । সে যদি এটা না করে তবে তার দিদিমনির বিশাল বিপদ হয়ে যাবে । বাবুলাল ছোট থেকেই শুনে আসছে এ বাড়িতে স্থাপিতা দেবী হলেন গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ আর এই রূপ গৃহস্থের নিকট অপ্রকাশ্য। তিনি সাধকদের আরাধ্য। কেন আর কিভাবে এ মূর্তি রায় বাড়ি প্রতিষ্ঠা করে তা যদিও জানা নেই ।

রুদ্রানীর পুজো চলছে , সামনে মায়ের মূর্তি ,তার রূপকল্প ভয়ংকর: গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা; নারদাদিঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন; তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। রুদ্রানী পুজো করতে করতে বিভোর হয়ে যাচ্ছে , দিন রাত কোনকিছুই যেন তার বাধ্য নেই আজ । নিজের হাতে পাক করা ভোগ চালের পায়েস , খিচুড়ি , নয় রকম ভাজা আর মদ পরিবেশেন করেছে সে দেবীর সামনে । যদিও শাস্ত্র মতে গুহ্যকালী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা । তবু এ বাড়িতে নিত্য পুজো এই ভোগ দিয়েই সম্পন্ন হয়ে আসছে বরাবর । বাৎসরিক পুজোতে তিনটি ছাগ বলি প্রথা ছিল তবে তা রুদ্রানী তুলে দিয়েছে । মা যে সকলের মা , তিনি সন্তানের রক্তের আকাঙ্খা করতেই পারেন না । হিন্দু শাস্ত্রে কোথাও পাঠা বলির কথা লেখা নেই, লেখা আছে ছাগ বলির কথা। এই ছাগ কথার মানে "ছাগল" নয়। এই ছাগ কথার অর্থ হল ষড়রিপু। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মতসয্য এই ষড়রিপুকে এক কথায় ছাগ বলে। প্রকৃত অর্থে এই ষড়রিপুকে বলি দিতে হয়। রুদ্রানী তো সেই বলি কবেই প্রদান করে বসে আছে । রায় বাড়িতে মায়ের আগমন হয়েই ছিল তার উপযুক্ত সাধিকার সাধনায় পরিতৃপ্ত হতে । আর সে আর কেউ না রুদ্রানী নিজেই । গুহ্যকালী দেবীভাগবত পুরাণ মতে, তিনি দেবী শতাক্ষীর শরীর থেকে উৎপন্না অন্যতমা মহাশক্তি। শেষ চূড়ান্ত প্রহর আগত , পুজোর শেষ বিধি করতে করতে রুদ্রানী তার অপার্থিব জলদগম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারিত করছে মন্ত্র ,


ওঁ খড়্গং চক্রগদেষুচাপপরিঘান শূলং ভুসূণ্ডিং শিরঃ| শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্বাঙ্গভূষাবৃতাম্ || নীলাশ্মদ্যুতিমাস্যপাদদশকাং সেবে মহাকালিকাম্ | যামস্তৌচ্ছয়িতে হরৌ কমলজো হন্তুং মধুং কৈটভম্ ||



সারা বাড়ি জুড়ে ধনিত হচ্ছে সেই মন্ত্র । রাত্পাখিরা আজ এ বাড়ি থেকে বহু দূরে সরে আছে । মূর্তি থেকে নির্গত হতে শুরু করেছে এই জ্যোতির্ময় কিরণ ।

এদিকে নিকৃষ্ট সাধক যোগেন্দ্র সরলমতি বাবুলাল কে বোকা বানিয়ে ঢুকে পড়ে বাড়ির ভিতরে । তার হাতে চকচক করছে খড়্গ । সেটি চোখে পড়ে বাবুলালের , সে বোকা সরল হলেও বুঝে নিতে পারে পুরোহিত ঠাকুরের উদ্দেশ্য ঠিক নয় । বাধা দেবার চেষ্টা করে সে বলে , ঠাকুর তুমি কোন বিবাদে জড়িও না দিদিমনির সঙ্গে । ও কিন্তু এখন আর সাধারণ মেয়ে নয় কো । মরবে তুমি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ওঘরে গেলে ঠাকুর , মরবে । বাবুলাল কে খাঁড়ার বাট দিয়ে আঘাত করে যোগেন্দ্র । বাবুলাল অচেতন রক্তাক্ত জখম হয়ে পড়ে থাকে বৈঠকখানায় । যোগেন্দ্র এগিয়ে যায় ঠাকুর ঘরের দিকে । রুদ্রানী জানে বাবুলাল কাকা এ ঘড়ে তার অনুমতি ছাড়া ঢোকে না তাই সে দরজা ভেজিয়েই রাখে । সাধনাতে লীন রুদ্রানী জানেই না এক পিশাচ তার অলক্ষে প্রবেশ করে গেছে এই দেবভূমি তে ।

মা সন্তানের পরীক্ষা তো আগেই অনেক নিয়েছে তাই আজ বিধিমত পুজো শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার সামনে ধরা দেয় । রুদ্রানীর পুজোর শেষ মুহূর্তে নিজের হাতে তুলে নিয়ে ছিল একটা ধারালো ভোজালী , সে স্থির করেই ছিল যদি মা আজ না দেখা দেয় তবে এ প্রাণ সে মায়ের পায়ে ত্যাগ করে দেবে । তবে তার প্রয়োজন আর হলো না রুদ্রানী দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুই ফুটের ওই কষ্টিপাথরের মূর্তির বদলে স্বয়ং মা কালী নিজে । প্রবল জ্যোতির্ময় মায়ের রূপ দেখে বিভোর রুদ্রানী ...


তার মায়ের গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ ।।


রুদ্রানী কে দেবী বলেন , বল কি চাস তুই মেয়ে ? আমায় এবাড়িতে মূর্তি রূপে আগমনের উদেশ্য সফল । আমি সন্তুষ্ট তোর ভক্তিতে । রুদ্রানী বলে , মা তোকে দেখছি নিজের সামনে , আর কি চাইবো রে ? তুই শুধু আমার অন্তরে বাস কর আমায় মৃত্যু পর্যন্ত এই কামনা করছি । দেবী বলেন তথাস্তু , আজ থেকে তুই আমি আবার আমিই তুই । এ পর্যন্ত সময়েই ঢুকে পড়ে যোগেন্দ্র , আর ঝাঁপিয়ে এসে নিজের হাতের খড়্গ খানি সে চেপে ধরে রুদ্রানীর গলায় । আর নিকৃষ্ট লোভী স্বয়ং মা কালীকে বাধ্য করতে চায় তাকে বরদান প্রদান করতে । মা যোগেন্দ্র কে দেখেই অদৃশ্য হয়ে যান । হেরে যাওয়া যোগেন্দ্র রাগে ধারালো খড়গ খানি চালিয়ে দিতে চায় রুদ্রানীর গলায় । কিন্তু এ কি পোচ এর উপর পোচ দিয়েই যাচ্ছে যোগেন্দ্র কিন্তু রুদ্রানী দাঁড়িয়ে আছে একই ভাবে । তার কিছুই হচ্ছে না আঘাতের ফলে । যোগেন্দ্র বুঝে যায় , মা কালি কেন রুদ্রানী কে রক্ষা না করেই যোগেন্দ্র কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে গেলেন । রুদ্রানী এখন মায়ের আশীর্বাদ পেয়ে অবধ্য । সে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় খড়্গ খানি ফেলে দিয়ে বাইরের দিকে । তবে একি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রুদ্রানী , ঠাকুর ঘরের ভিতরে রুদ্রানী ! যোগেন্দ্র দেখে মাটিতে পড়ে থাকা খড়্গ খানি তুলে নেয় রুদ্রানী । তার পর তার দীর্ঘ সাধনার ফলে ক্লিষ্ট শরীর , জটা ময় মাথা সব পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে এক ভীষনা রূপে ! এখন যোগেন্দ্রর উত্তর , দক্ষিণ , পূর্ব , পশ্চিম সব দিকেই দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়াল দেবী । সে আর কেউ না রুদ্রানী , যে পরিবর্তিত হয়ে গেছে মহাকালী পঞ্চবক্ত্রা ও পঞ্চদশনয়নাতে । রায় বাড়ির শ্রেষ্ঠ বংশধর রুদ্রানী এখন অসুর দমনে দশবক্ত্রা, দশভূজা, দশপাদা ও ত্রিংশল্লোচনা রূপে ।


তার দশ হাতে রয়েছে যথাক্রমে খড়্গ,চক্র,গদা,ধনুক,বাণ,পরিঘ,শূল,ভূসুণ্ডি,নরমুণ্ড ও শঙ্খ। ইনি এখন দমন রূপী ভৈরবী । যোগেন্দ্র দূর থেকেই পায়ে পড়ে যায় মায়ের , বলে এই অধমকে ক্ষমা করে দে মা । আমি এ গ্রাম ছেড়ে চলে যাবো কথা দিচ্ছি । আমি তো চির কাল তোর পুজো করে এসেছি বল । ভীষণ ক্রোধীতা দেবী হুঙ্কার ছাড়ে , বলে ওঠে .. তুই আমার সাধনার ফল পেয়ে গেছিস আজ আমার দর্শন পেয়ে । আর তোর ফলই তোর কাল যোগেন্দ্র । তুই লালমোহন আর শ্যামা কে খুন করিয়েছিস । তুই আজ আমার অহিত করতে চেয়েছিস । আমার সাধনা লোভ কে ত্যাগ করে করতে হয় , তার পর তো আমি মা , তাই আমার সন্তানকে আমি না চাইতেই ভরিয়ে দি । তুই নিকৃষ্ট সাধক , তোর শাস্তি পাওয়াই উচিৎ । তুই রিপুর দমন করতে পারিসনি তোর লোভ তোকে শেষ করে দিচ্ছে । এই পর্যন্ত বলে চার দিক থেকে খড়্গ নেমে আসে যোগেন্দ্রর উপর । চার খণ্ডে খণ্ডিত হয়ে যায় সে , ধীরে ধীরে তার পার্থিব শরীর , লোহিত ধারা সব ঠাকুর ঘরের মেঝের নিচে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় । রুদ্রানী নিজের রূপে ফিরে আসে আর বেরিয়ে আসে বাইরে । বৈঠকখানায় অচেতন বাবুকাকাকে নিজের যোগশক্তির বলে সুস্থ করে দেয় । চেতনা ফিরে এলে বাবুলাল ধড়মড় করে ওঠে , দিদিমণি তুমি ভালো আছো তো ? রুদ্রানী হাসে , বলে কাকা রাতের শেষে ভোর হয়ে এসেছে । আমাকে খেতে দেবে না , কাল থেকে যে আমি কিছুই খাইনি !

বাবুলাল বলে কিন্তু ওই পুরুত ঠাকুর ? রুদ্রানী বলে কৈ কেউ আসেনি তো ? তুমি মনে হয় স্বপ্ন দেখেছিলে এখানে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে । বাবুলাল তার মাথায় হাত দিয়ে দেখাতে যায় , খড়্গের বাটের সেই ঘা খানি । কিন্তু কৈ কিছুই নেই ! সে ভাবে সত্যি হয়ত স্বপ্ন ই ছিল । রুদ্রানী দীঘির দিকে এগিয়ে যায় স্নান সারতে , বাবুলাল লক্ষ্য করে না রুদ্রানীর কোন ছায়া মাটিতে পড়ছে না ।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror