Rima Goswami

Horror Fantasy Thriller

2.6  

Rima Goswami

Horror Fantasy Thriller

রক্তবীজ সংহার

রক্তবীজ সংহার

66 mins
1.0K


         

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ।।যদা, যদা, হি, ধর্মস্য, গ্লানিঃ, ভবতি, ভারত,অভ্যুত্থানম্, অধর্মস্য, তদা, আত্মানম্, সৃজামি, অহম্ ।।

অনুবাদঃ হে ভারত ! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।

এই কাহিনী সেই অধর্মের অভ্যূত্থানের উপর ধর্মের বিজয়ের এক কাহিনী বিন্যাস যা সম্পূর্ণ কল্পিত । ধর্মের বিষয় গুলি বাদে সব চরিত্র কাল্পনিক ।

ভালো বেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি ...


গুনগুন করে গাইছে জমিদার কন্যা পারমিতা সকলের আদরের মিতা । এই মিতা তুমি জানো ভগবান বিষ্ণুর শঙ্খ কে কি বলে ? রোদ্দুর জিজ্ঞাসা করলো । বিলেত ফেরত উকিল পুত্র রোদ্দুর আর মিতার বিয়ে ঠিক হয়েছে আগামী বছর। এই রোদ্দুর ভালো হবে না বলে দিলাম কিন্তু একি ! এই সময়টা কি তোমার সোও কলড ধর্ম চর্চার জন্য ? হোয়াট রাব্বিস , একটা গান গাইছি কোথায় প্রেম ভাব জাগবে ওনার মনে তা না , সেই নিরস চর্চা । আচ্ছা আচ্ছা আর বলতে হবে না আমিই বলছি ম্যাডাম , বিষ্ণুর শঙ্খ এর নাম পাঞ্চজন্য , গদার নাম কৌমদকী আর চক্রের নাম সুদর্শন । ওনার বাহন গড়ুর দেব আর স্ত্রী দেবী লক্ষী । জপ মন্ত্র হলো ওমঃ নমোঃ ব্রাক্ষন্য দেবায় গোঃ ব্রাক্ষন্য হিতায়ঃ চঃ জগঃধ্বিতায় কৃষ্ণায়ঃ নমঃ নমঃ ।।


ব্যাস ব্যাস চুপ কর প্লিস রোদ্দুর জাস্ট আর নিতে পারছিনা , মিতা বলে উঠলো । ও সরি সরি আর বলবো না , জানোই তো আমার এগুলো মুদ্রাদোষ সহজে যাবার না । তবু সব সময় ভালো লাগে না , সকালে ঘুম থেকে উঠে তুমি দু ঘন্টা কি সব জপ তপ কর তার পর আ জীবন নাকি তুমি নিরামিষ খাবে সব মেনে নিয়েছি তবে এই সব সময় ধর্মচর্চা সহ্য হবে না । মিতা সরি , রাগ করো না রোদ্দুর অনুনয় করতেই থাকে । হিন্দু পুরাণে বর্ণিত আছে ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতার সম্পর্কে ৷ মৎস, কূর্ম, বরাহ, রাম, বলরাম, পরশুরাম, নৃসিংহ, বুদ্ধ, বামণ, কল্কি ৷ তখন সত্য যুগের শেষলগ্ন । একের পর এক সৃষ্টি করে ব্রহ্মা ক্লান্ত । তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিলেন | তাঁর নাক ডাকার আওয়াজ থেকে সৃষ্ট হল দৈত্য হয়গ্রীবা | সে ঠিক করেছিল‚ শুধু হয়েছিল মহাপ্রলয় ৷ প্রলয়ে হাত থেকে মুক্তি দিতেই মৎস অবতারে ভগবান বিষ্ণু আবির্ভূত হয়েছিলেন ৷ কূর্ম অবতারেই ভগবান বিষ্ণুর সমুদ্র মন্থনের সময়ে বিপুল ধন-সম্পত্তি নিয়ে মর্তে এসেছিলেন তিনি ৷ পুরাণ মতে ভগবান বিষ্ণুর তিন নম্বর অবতার বরাহ এক মহিষাসুর হিরণ্যয়ক্ষ পৃথিবীকে সমুদ্রে লুকিযে রেখে ছিল তখনই প্রজাপতি ব্রহ্মার নাক থেকেই ভগবান বিষ্ণুর ভগবান নাক থেকে জন্ম নিযেছিলেন বিষ্ণুর এই বরাহ অবতার ৷ভগবান বিষ্ণু নৃসিংহ অবতারে দৈত্য হিরণ্যকোশিপু করে বধ করেছিলেন ৷ যখন সারা পৃথিবীতে প্রলয শুরু করেছিল অত্যাচারী হিরণ্যকোশিপু ৷ প্রহ্লাদকে রক্ষা করতেই হিরণ্যকোশিপুকে বধ করেছিলেন তিনি ৷ 


কে কে তুমি এত জ্ঞানের পরিধি তোমার ? রোদ্দুরে চোখ খুঁজতে থাকে কথার উৎস টিকে । পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটা আঁচল দেখা যায় । মিতা তাকে ধরে বের করে আনে , খুব বেশি হলে আট নয় বছরের একটা মেয়ে , গাছ কোমর করে শাড়ি পরে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মিতা হেসে বললো এই যে সুগ্রীব দোসর , তোমারই মত আর এক ধর্ম জ্ঞানী এর নাম জুঁই , আমাদের নায়েব মশাই এর নাতনি । রোদ্দুর অবাক এত টুকু মেয়ের জ্ঞানের পরিধি দেখে , তার তেজদীপ্ত মুখ মন্ডলী যেন কোন দেবীর মত , যার কাছে জমিদারের দুলালী পারমিতা র মত সুন্দরী অপ্সরা ও ফিকে ।          


সময়টা বিদ্রোহের , একদিকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আপামর ভারতবর্ষের নাগরিকরা । দলে দলে প্রাণ দিচ্ছে স্বদেশীরা , জালিয়ানাবাগের হত্যা কাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে ব্রিটিশদের দেওয়া নাইট উপাধি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । অপর দিকে পারমিতার বাবা জমিদার রঘুবীর ঠাকুরের মত কিছু লোভী ইংরেজদের পা চাটা লোকেদের দেখা যাচ্ছে যারা রায়বাহাদুর উপাধি মাত্র পাওয়ার জন্য বিভিন্ন তদারকি করছে , যেমন তিনি শিক্ষক নিয়োগ করে তার একমাত্র কন্যা পারমিতা কে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ তৈরি করেছেন । কলকাতার ব্রিটিশদের অনুগত উকিল জনার্দন মুন্সির পুত্র রবিকান্ত মুন্সি ওরফে রোদ্দুরের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে পাকা করেছেন । মেয়ের মুখে রবি ঠাকুরের গান জমিদার মশাইয়ের ভালো লাগে না তাই একটি পিয়ানো কিনছেন মেয়ের বিদেশি গান শেখার জন্য । এদিকে নায়েব মশাই এর একমাত্র পুত্র অখিলেশ দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে , ইংরেজদের গুলি তার মাথা এফর ওফর করে দিয়েছে । অখিলেশ রেখে গেছে তার বিধবা স্ত্রী নীরুপমা ও আট বছরের কন্যা জুঁইকে । বৃদ্ধ নায়েব প্রাণ থাকতে থাকতে নাতনির একটা গতি করে দিতে চান তাই জুঁইয়ের বিয়ে স্থির করেছেন গ্রামেরই এক মুদির সাথে , যদিও বয়সে সে জুঁইয়ের স্বর্গত পিতা অখিলেশের থেকে বহু বড় তবু কথায় আছে পুরুষ মানুষের বয়স দেখে না । নীরুপমার ইচ্ছা না থাকলেও উপায় নেই , সে যুবতী বিধবা শশুর মশাইয়ের বয়সও হয়েছে আর পুত্ৰ শোকে তিনি মৃতপ্রায় । শশুর মশাইয়ের ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে সে জুঁইকে নিয়ে অথৈ জলে পড়বে তাই মেনে তো নিতেই হত । এদিকে বিলেত ফেরত তেইশ বছরের ধর্মপ্রাণ রোদ্দুর হবু শশুর বাড়ী বেড়াতে এসে জুঁইকে দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে যায় । এতটুকু মেয়ের জ্ঞানের ব্যাপ্তি তাকে নাড়িয়ে দেয় , তুলনা করতে বাধ্য করে সপ্তাদশী সুন্দরী জমিদার কন্যা পারমিতার সাথে জুঁইয়ের । মিতা র কাছে কথায় কথায় রোদ্দুর জানতে পারে জুঁইয়ের আজ বিয়ে আধ বুড়ো মুদির দোকানির সাথে । রোদ্দুর অবাক হয়ে যায় কি করে এটা সম্ভব , একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে বিয়ে হচ্ছে দুই সন্তানের পিতার যার এক স্ত্রী বর্তমান আছে ! দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও এ গ্রামে এখনো পর্যন্ত সতী দাহ প্রথার মত , বাল্য বিবাহ র মত কুপ্রথা বর্তমান । নায়েব মশাইয়ের পুত্র অখিলেসের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী নীরুপমাকেও সতী করতে বলে এ গ্রামের মোড়লরা কিন্তু ইংরেজদের হস্তক্ষেপের কারণে শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠে না । মিতার সাথে রোদ্দুর ও পৌঁছায় নায়েব মশাইয়ের বাড়ি , জুঁইকে লাল চেলি পড়ানো হয়েছে সে আনমনে বসে ছিল মাটির বারান্দায়। রোদ্দুর আর মিতাকে দেখে শিশু সুলভ হাসি ফুটে ওঠে ওর মুখে , বলে দিদি তুমি এসেছো ? রোদ্দুরের বুক চিনচিন করে ওঠে এত সুন্দর একটা মেয়ের অন্ধকার ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে । লগ্ন বয়ে যায় এদিকে বরের দেখা নেই , উদ্বিগ্ন নায়েব মশাই টহল দিয়ে বেড়াচ্ছেন উঠানে । খবর এলো বিয়ে করতে বেরোনোর সময় সাপে কেটেছে বরকে , সে তার গৃহিণীর কোলে মাথা রেখে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে । নায়েব মশাই খবর পেয়ে বিছানা নিলেন , তার প্রাণবায়ু যে বেশিক্ষন নেই সে সকলেই বুঝলো । নীরুপমা হাহাকার করে উঠলেন , তার লগ্নভ্রষ্ট মেয়ের কি গতি হবে ? জুঁইয়ের এসবে বিন্দুমাত্র নজর নেই , সে ব্যস্ত দাদুর সেবায় । দাদুর শেষ নিঃস্বাস ফেলার আগে পর্যন্ত দাদুকে যে দুধ গঙ্গা জল দিতে হবে ।তার সাথে জুঁই একনাগাড়ে হরি নাম জপ করে যাচ্ছে ,


                              "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ,কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে,হরে রাম হরে রাম,রাম রাম হরে হরে" ।

          

নায়েব মশাই নাতনির কোলে চোখ বুজে ছিলেন সে রাত্রে । তার পর গ্রামবাসীদের কুসংস্কারের অসভ্য খেলা শুরু হয় জুঁইকে নিয়ে , যে মুদির সাথে জুঁইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার ছেলে এসে দাবি করে , যেহেতু জুঁইয়ের সাথে তার বাবার বিয়ে এই লগ্নে হত তাদের গায়ে হলুদ পর্যন্ত হয়েছে তাই বিয়ে সম্পূর্ণ না হলেও জুঁই মৃত ব্যক্তির অর্ধ স্ত্রী । জুঁইকে তার বাবার সাথে সহমরণে যেতে হবে । নিজের মাকে বাঁচাতে ছেলেটা মোক্ষম চাল চেলেছিলো , সে জানতো সকলে এবার জুঁইয়ের ক্ষতি করতে উঠে পরে লাগবে । জমিদার বাবুও মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন , নায়েবই যখন আর নেই তো তার পরিবারের ব্যাপারে পড়ার কি দরকার । নীরুপমা সকলের পায়ে পরে গেল , কিন্ত কারো পাষান মন একবার ভেবে দেখলো না যে এই নিষ্পাপ মেয়েটার কি দোষ হতে পারে । রোদ্দুর অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ সব দেখছিল , ও ভেবেছিল ব্যাপারটা মিটে যাবে তবে সে সম্ভাবনা যখন আর নেই তখন তাকে সামনে আসতেই হলো । রোদ্দুর বললো , এক পুরুষের বহু পত্নী হতে পারে , উপপত্নী হতে পারে কিন্তু অর্ধ পত্নী হয় না । সতী এক কুপ্রথা যা আইনত দণ্ডনীয় , তবু ধৰ্ম মতে যদি ঐ মুদির জন্য কেউ সতী হয় তবে সে তার ঘরণী গৃহিণী এই বালিকা জুঁই নয় । গ্রামের সকলে হৈহৈ করে ওঠে , মোড়ল বলে দেখুন আপনি বিলেত ফেরত মানুষ এ গ্রামের হবু জামাই । আপনাকে আমরা সন্মান করি কিন্তু আপনার কথা যদি মেনেও নি তবুও এই মেয়েকে মরতেই হবে এযে লগ্নভ্রষ্টা । একে যদি বাঁচাতে হয় তা হলে কি করতে হবে মোড়ল মশাই ? আজ সন্ধ্যা ও রাত্রির দিকে দুটো লগ্ন ছিল বিয়ের , সন্ধ্যার লগ্ন পেরিয়ে গেছে আর একটা লগ্ন যদিও আছে কিন্তু বিয়ে হবে কি করে পাত্র তো চিতেই উঠতে চলেছে । রোদ্দুর বললো তা হলে জুঁই এখনো লগ্নভ্রষ্টা হয়নি কি বলুন ? আরে বাবা একে কে বোঝায় বলো দিকি , আরে বাবু পাত্রই যখন নেই তো লগ্ন থাকা আর না থাকা , মোড়ল বিরক্তির সাথে বলে ওঠে । তা কি তুমি হবে পাত্র হে ? চলো বাড়ি ফিরে চলো , জমিদার বাবু গম্ভীর হয়ে বলে ওঠেন । হ্যাঁ আমি পাত্র হব যদি জুঁই বা ওর মায়ের আপত্তি না থাকে , আমি বাবু জনার্দন মুন্সীর পুত্রর রবিকান্ত মুন্সি সজ্ঞানে জুঁই রায়চৌধুরী র পানিগ্রহন করতে আগ্রহী দীপ্ত কণ্ঠে বলে রোদ্দুর । জুঁইয়ের মা নীরুপমা এসে পায়ে পড়তে যায় রোদ্দুরের , তাকে আটকে নেয় রোদ্দুর । জমিদার বাবুর কন্যা আমার নিজ কন্যাসম তার হবু স্বামী তুমি বাবা তবু এ বিকট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তুমি যদি একরাতের জন্যও আমার মেয়েকে বিয়ে করো আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো , নীরুপমা বলে । জমিদার বাবু রাগে চিৎকার করে ওঠেন , বলেন এ কি তামাশা হচ্ছে রোদ্দুর ? তুমি ঘরে চলো । পারমিতা সমানে কেঁদে চলে । রোদ্দুর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে , পুরোহিত জানায় নায়েব মশাই দেহ রেখেছেন ওনার দাহ কার্য হলে অশৌচ শুরু হবে । তাই বিয়ে এখনই সমাধা করে বর কনেকে বিদায় দিতে হবে তার পর পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করতে হবে । রোদ্দুর জুঁই বিয়েতে বসে , পারমিতা নিজের ভালোবাসার মানুষটির হস্তান্তর সহ্য করতে না পেরে সেখান থেকে চলে যায় । জমিদার বাবু রোদ্দুরকে জোর করতে পারেন না এতে প্রজারা অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে তিনি জানতেন । তিনিও সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বিয়ের , এদিকে পারমিতা ক্ষোভের আগুনে পুড়ে , এমন এক কাজ করে যা সবার জীবনে নিয়ে আসে রক্তবীজ নামক এক ভয়াল দানবকে ।          


অসুরদের প্রধান রক্তবীজ-এর ছিল ব্রহ্মার বর। যার জেরে রক্তবীজের শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত ভূতলে পতিত হলেই তা থেকে জন্ম নিচ্ছিল একাধিক অসুর। এমন পরিস্থিতি থেকে স্বর্গ-কে রক্ষা করতে এবং দেবতার মানসম্মান রক্ষার্থে অবতীর্ণ হন দেবীদুর্গা। সব অসুর দেবীদুর্গার হাতে নিহত হলেও ব্রাক্ষ্মার বরপ্রাপ্ত রক্তবীজ বারবার বেঁচে যায়। ক্রোধাম্বিত দেবীদুর্গা তাঁর ভ্রু যুগলের মাঝ থেকে জন্ম দেন কালীকে। কালীর ভয়াবহ রুদ্রমূর্তি আর নগ্নিকা রূপে রক্তবর্ণ লকলকে জিভ বের করে কালী গ্রাস করে নিতে থাকেন একের পর অসুর এবং তাদের রণবাহিনীকে। হাতি, ঘোরা সমতে অসুরের দলকে কালী গ্রাস করতে থাকেন। রক্তবীজকে অস্ত্রে বিদ্ধ করে তার শরীরের সমস্ত রক্ত পান করে নেন কালী। রক্তবীজের শরীর থেকে একফোঁটা রক্ত যাতে মাটিতে না পরে সেজন্য কালী তাকে শূন্যে তুলে নেন। রক্তবীজকে এক্কেবারে রক্তশূন্য করে দেহ ছুঁড়ে ফেলে দেন। রক্তবীজ তো শেষ হয়ে যায় কিন্তু কালো অশুভ শক্তির একটাই মহিমা সে বারংবার ফিরে আসে যদি তাকে ডাকা হয় নিয়মমাফিক । বঙ্গে একসময় পিশাচ শক্তির আরাধনা করার একটা রব উঠেছিল সেই রেশ পরে কেটে গেলেও কিছু কিছু স্থানে সেই সব আচারের প্রমান বিদ্যমান ছিল । জমিদার বাড়ির নীচে গুপ্ত কক্ষে এক সময় জমিদার বাবুর পিতা পারমিতার দাদু এইসব নিম্ন শ্রেণীর তন্ত্রচার করতেন । ওনার কোন অশুভ উদেশ্য ছিল না , শুধুমাত্র কৌতূহল নিবারণের জন্য তিনি পিশাচ রক্তবীজ নামক এক অশুভ শক্তির ঘট স্থাপনা করেছিলেন বাড়ির নিচের এই গুপ্ত কক্ষে । ওনার মধ্য সংযম ছিল তাই তিনি শুধুমাত্র কৌতূহল নিবারণ করেই ক্ষান্ত হয়েছিলেন ভয়াল পিশাচ কে জাগ্রত করে সমগ্র গ্রামের ক্ষতিসাধন করেননি । সাধনা এক স্তরে পৌঁছনোর পর তিনি ওই ঘর চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেন । ওনার পুত্র পারমিতার পিতার এসকল বিষয়ে কোনদিন কোন আগ্রহ ছিল না , তবে পিতার মৃত্যুর পর ওই ঘরের চাবি তার কাছেই থাকত । পারমিতা কথায় কথায় তার দাদামসাই এর এই সাধনার কথা পিতার মুখে শুনেছিল কিন্তু তারও কোনদিন মনে হয়নি ওই ঘরে যাবার । তবে সেই রাতে নিজের অধিকার হস্থান্তর সে মেনে নিতে পারেনি । তার মত উচ্চ বংশের সুন্দরী , ইংরেজি শিক্ষাতে শিক্ষিতা মেয়েকে ছেড়ে রোদ্দুর শুধুমাত্র ঝোঁকের বসে জুঁইয়ের মত একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করে নেবে এটা জমিদার নন্দিনীর পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি । ফলস্বরূপ সে চুপিসারে জমিদার বাবুর দেরাজ থেকে চোরা কুঠুরির চাবি খানা নিয়ে সোজা চলে যায় সেখানে । তার মনে হয় তন্ত্রচার যার সমন্ধে সে কিছুই জানত না , সেই দিয়েই রোদ্দুরকে আবার ফিরে পেতে পারে । আসলে সম্পূর্ণ মিতার ইচ্ছায় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তা নয় , দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ পড়ে থাকা ঘরে বন্দি পিশাচ তার শিকার খুঁজে ছিল সেই শিকার আর কেউ না মিতা নিজেই ছিল । সে রাত ছিল পূর্ণিমার , আকাশ ভেসে যাচ্ছিল চাঁদের আলোয় । মানুষ এক সম্পূর্ণ ভুল ধারণা পোষণ করে যে শুধু অমাবস্যা র কালো রাত ই ভয়াল , যা পিশাচ সমাগম করে । মানুষ ভুলে যায় যে অন্ধকার রাতে পিশাচ শক্তিশালী হয় সে রাতে মা মহামায়া অদ্যাশক্তি ও বিরাজিতা হন ভক্তদের রক্ষা করতে । পূর্ণিমা র চাঁদে পাশবিক শক্তি পুনর্গঠিত হয় বাধাহীন ভাবে । একদিকে ছোট্ট জুঁইকে বিয়ের পিঁড়িতে বিধি অনুযায়ী গ্রহণ করছে রোদ্দুর অপরদিকে বহুকাল বন্ধ পরে থাকা ঘরে প্রবেশ করে মিতা । ঝুল , মাকড়সা , পোকামাকড় ভরা ঘরে ঢুকে একবার পিছিয়ে আসে মিতা , ভয় পায় সে । তার পর পুনঃ সাহস সঞ্চয় করে ঢুকে পড়ে ঘরে । মশালের আলোয় সামনে এগিয়ে সে দেখে এক বিকট মূর্তি বিরাজমান , সামনে ঘট উল্টানো আর একটা হাঁড়িকাঠ যা বহুদিনের রক্তের পিপাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।           


রোদ্দুর ও জুঁই এক এক করে  বৈদিক আচারগুলির পালনের মধ্য দিয়ে কুশণ্ডিকা, লাজহোম, সপ্তপদী গমন, পাণিগ্রহণ, ধৃতিহোম ও চতুর্থী হোম সম্পন্ন করতে থাকে বৈদিক মন্ত্র "যদিদং হৃদয়ং তব

তদিদং হৃদয়ং মম" উচ্চারিত হয় , একে অপরকে দুজনে কথা দেয় এই মন্ত্রর মাধ্যমে , তোমার হৃদয় আমার হউক


আমার হৃদয় তোমার। বিবাহিত নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করে জুঁইয়ের মা নীরুপমা । অশৌচ এর কারনে রাতেই বর কনে বিদায় করতে হবে , এদিকে এত রাতে রোদ্দুর জুঁইকে নিয়ে কোথায় যাবে ? সে বিলক্ষন জানতো জমিদার বাড়িতে আর তাদের ঠাঁই হবে না । সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে পারমিতা ওখানে উপস্থিত হয় আর রোদ্দুর জুঁইকে জমিদার বাড়িতে যেতে অনুরোধ করে , জমিদার বাবুর ইচ্ছা না থাকলেও উপায় নেই তাই তিনিও ওদের নিজের আগ্রহ প্রকাশ করেন । জুঁইকে রোদ্দুর জমিদার বাড়ি নিয়ে চলে যায় আর এদিকে সকলে নায়েব মশাইয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া তে লেগে পরে । এক ঝটকায় একা হয়ে যাওয়া নীরুপমা চোখের জল আটকিয়ে রাখে এই সন্তোষে যে তার মেয়ে সুপাত্রর হাতে পড়েছে । রোদ্দুর পারমিতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ও জানায় সকাল হলেই সে তার স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতা রওনা দেবে । জমিদার বাবু এই বিপত্তি যত তাড়াতাড়ি বিদায় হয় ততই ভালো মনে করে সম্মতি দেন । বাধ সাধে মিতা , সে জোর জুঁই আর রোদ্দুরকে এখানে কিছুদিন কাটিয়ে যেতে । মিতা বলে নিয়ম অনুযায়ী ওদের অষ্টমঙ্গলা করতে এখানে আসতেই হত অত দূর থেকে আবার তার থেকে এখানে থেকে অষ্টমঙ্গলা পার করে যাওয়াই ঠিক হবে । রোদ্দুর বলে জুঁই দের বাড়িতে অশৌচ হেতু অষ্টমঙ্গলা করা সম্ভব হবে না তাই এখন কলকাতা চলে যাওয়াটাই শ্রেয় । মিতার পীড়াপীড়ি তে রোদ্দুর আর না করতে পারে না , মিতা তার ঘরে নিয়ে যায় জুঁইকে তার সঙ্গে শোবার জন্য । রোদ্দুর অতিথি ঘরে শুয়ে পড়ে , রাত বাড়ে চারদিক নিশুতি হয়ে যায় । সারা জমিদার বাড়ি যখন ঘুমিয়ে মিতা উঠে পড়ে আর চুপিচুপি আবার মাটির নিচে গুপ্ত কক্ষে প্রবেশ করে সাথে সংজ্ঞাহীন জুঁই । পিশাচ কে জাগ্রত করতে হবে , তার সাহায্য চাই আর তার জন্য প্রয়োজন এক নরবলি । মিতা পিশাচ জাগাবে তার পর তার পায়ে জুঁইকে বলি দিয়ে পিশাচের সাহায্যে রোদ্দুরকে আবার ফিরে পাবে । শুতে যাবার সময় ছল করে পিতার ঘুমের বড়ি দুটো দুধে মিশিয়ে জুঁইকে খাইয়ে দিয়েছিল মিতা । সম্পূর্ণ নির্বসনা হয়ে পিশাচের আরাধনা শুরু করে মিতা । পিশাচকে আমন্ত্রণ করে সে নিজের শরির বিনিময়ে । চারদিকে ঝড় ওঠে , ঘন ঘন বাজ পড়তে আরম্ভ করে , বিকট ভয়াল মূর্তি জেগে ওঠে । জীবন্ত পিশাচ রক্তবীজকে সামনে দেখে বিষম খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মিতা । পিশাচ রক্তবীজ আজ মুক্ত একশত বছর এই চোরা কুঠুরিতে বন্দি সে , এত বছর ধরে পিপাসিত । মিতা তাকে নিজের শরীরের বিনিময়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাই মিতার সত্ত্বা এখন পিশাচের । নিজের শরীরটা মায়ায় মানুষের শরীরে পরিবর্তন করে পিশাচ , তার পর নিজের লালসা মেটায় মিতার সংজ্ঞাহীন শরীরটাকে ভোগ করে । তীব্র যন্ত্রণাতে জ্ঞান ফিরে আসে মিতার , সামনে মানুষ রূপী পিশাচকে দেখে সে অবাক হয়ে যায় । পিশাচ নিজের পরিচয় দেয় । আমি রক্তবীজ এক পিশাচ , মানুষের কাম , ক্রোধ , জিঘাংসা , অহংকার থেকে পুষ্ট । তোমার দাদামসাই যৌবনে ছিল এক ভীষণ অহংকারী মানুষ , এক বন্ধুর সাথে তর্ক করে সে অশুভ শক্তির উৎস খুঁজতে আমাকে এখানে প্রতিষ্ঠা করে কিন্তু আমার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা সে করে উঠতে পারে না । কিছু ছাগ , মহিষ বলি ও দেয় সে । কিন্তু আমাকে জাগাতে স্বইচ্ছায় এক নারীকে তার সঙ্গে মিলন করতে আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে , আর আমার কাছে এক বিবাহিত নারীর বলি দিতে হবে , এসব নিয়ম সে জানত তবু এই নিয়মের পালন সে করেনি । কি জান পারমিতা তোমার দাদামসাই তোমার মত এতটা নিষ্ঠুর ও অহংকারী ছিলোনা । সে নিজের জিজ্ঞাসা পূরণের জন্য কোন অসহায় মেয়ের জীবন নিয়ে খেলতে আগ্রহী ছিলোনা তাই সে যা পারেনি তুমি তা পেরেছ ।  

         

পারমিতা তোমার মত একজন মানুষ আমার প্রয়োজন ছিল যে তার উদ্দেশ্যেপূর্তির জন্য শেষ সীমা অতিক্রম করতে পারে । তুমি নিজের শরীর নিজের আত্মা আমাকে আহুতি দিয়েছো , আমি সন্তুষ্ট হয়েছি আমি তোমার সাহায্য অবশ্যই করবো । আমার জন্য বলিও দেখছি তুমি তৈরি রেখেছো , শীঘ্র তা অর্পণ কর আমাকে , পিশাচ রক্তবীজ বললো । পারমিতা যে ক্রোধের আগুনে নিজের মনুষত্ব বিসর্জন দিয়েছিল সে তখনো বুঝতে পারেনি কি ভয়াবহ পরিণতির দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে । পারমিতা অচৈতন্য জুঁইকে এগিয়ে নিয়ে আসে হারিকাঠের দিকে বলি দানের জন্য । জুঁইয়ের ছোট্ট শরীরটা কে তুলে এনে ওর গলাটা হারিকাঠের মধ্য দিয়ে দেয় । তার পর একটা চন্দ্রোহাস খাঁড়া কে এগিয়ে নিয়ে আসে তার দিকে । পিশাচ লোভাতুর দৃষ্টিতে জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে , এ মুখ যে তার বহুদিনের চেনা ! বহু কাল আগে থেকেই এই মুখের প্রতি তার অদম্য ভয় । দাঁড়াও পারমিতা ! পিশাচ চিৎকার করে ওঠে । এ কাকে তুমি নিয়ে এসেছ ? তুমি কোথায় পেলে এই কন্যাকে ? পারমিতা ভয় পেয়ে যায় , থতমত খেয়ে বলে কি হয়েছে প্রভু ? এ সদ্য বিবাহিত সেই কন্যা যার জন্য আমি আমার ভালোবাসা, অধিকার সব হারিয়েছি , এর নাম জুঁই । একে বলি হিসেবে গ্রহণ করতে বাধা কোথায় ? পিশাচ রাগে পারমিতাকে আঘাত করে , ছুঁড়ে ফেলে দেয় তাকে । তীব্র ব্যথার কঁকিয়ে ওঠে মিতা । পিশাচ বলে , তুমি মূর্খ তা আমি জানতাম কিন্ত এত মূর্খতা তোমার মধ্যে রয়েছে তা জানতাম না । এই মেয়ে কোনো সাধারণ মেয়ে নয় এ দেবী চন্ডিকার মনুষ্য রূপ। যুগে যুগে যেমন আমি এই পৃথিবীতে কোন না কোন মানুষের সাহায্য ফিরে আসি তেমনি দেবীও সাধারণ মানুষের মধ্যে দিয়েই এ পৃথিবীতে ফিরে আসেন জগৎ রক্ষা করতে । একে তোমার সাধারণ মানুষ মনে হয়েছে কারণ এর মধ্য দেবী এখনো জাগ্রত হয়নি । ভালোই তো প্রভু আপনি একে বলি গ্রহণ করলে এ মরে যাবে দেবী ও জাগবে না এর মধ্য আর আপনি আমি দুজনেই মুক্ত হয়ে যাব । চুপ করে যা মূর্খ , পিশাচের চোখ দুটো রাগে জ্বলে ওঠে । তুই কি জানিস ? একে যদি আমরা একটুও আঘাত করি এর দেবী সত্বা এখনই জেগে উঠবে । তুই একে ফেরত রেখে অন্য কোন বলি আমার জন্য নিয়ে আয় । এভাবে প্রতি অমাবস্যা আর পূর্নিমা তে একটা করে বলি জোগাড় করে আন । এভাবে কিছুদিন পর আমি প্রভূত শক্তির অধিকারী হয়ে উঠবো আর এই জুঁই নামক চন্ডিকার রূপকে আমি শেষ করে দেব । মিতা বাধ্য হয়ে জুঁইকে ফেরত রেখে আসে নিজের ঘরে । তার পর চাকরদের ঘর গুলোর দিকে এগিয়ে যায় , কিছুদিন আগেই নতুন কাজে ঢোকা রান্নার জোগারে বউটাকে মুখ চেপে ধরে ছেচরে নিয়ে যায় গুপ্ত কক্ষের দিকে । আচমকা হামলায় ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া বউটা বুঝতে পারে না এত রাতে এই অন্ধকার ঘরে জমিদার বাবুর মেয়ে তাকে কেন এভাবে নিয়ে এসেছে । অন্ধকার চোখে সয়ে এলে সে সামনে দেখে এক বিকট পিশাচ তার সামনে দাঁড়িয়ে । ভয়ে ভীত সে পারমিতার পিছনে লুকাতে যায় , তখনই সে আবিস্কার করে পারমিতার হাতে একটা খাঁড়া চকচক করছে আর সামনেই একটা হারিকাঠ । গ্রামের মূর্খ মেয়েমানুষ হলেও তার এটুকু বুদ্ধি ছিল , সে বুঝে ছিল তার সাথে কি হতে চলেছে । তবে বাধা দেবার সময় সে পাইনি , তার আগেই নৃশংস পারমিতা তার মাথাটা জোর করে ঢুকিয়ে দেয় হারিকাঠের মধ্য আর হাত পা গুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে যাতে আঘাত পেয়ে সে হাত পা না ছুঁড়তে পারে । বউটা মুখ খোলা থাকায় চিৎকার করতে থাকে তার পর সেই চন্দ্রোহাস খাঁড়া ঝপ করে তার উপর দিয়ে নেমে যায় , তার মাথাটা গড়িয়ে পড়ে পিশাচের পায়ের কাছে । শরীরটা তীব্র যন্ত্রনায় কাঁপতে কাঁপতে শান্ত হয়ে যায় । সারা মেঝে রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় , রক্তের গন্ধে ভরে যায় ঘরটা । প্রথম বলিদান সম্পন্ন হলে পিশাচ তা নিমেষে চিবিয়ে খেয়ে নেয় , এসব দেখে বমি আসে মিতার তবে সে সহ্য করে নেয় । ভোর হয়ে আসে , পিশাচকে শান্ত করে চোরা কুঠির দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে আসে মিতা । দু চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে সে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পরে ।        


সে রাতের পর আর ওই রান্নার জোগারে বউটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি , তার মধ্যে পারমিতা নিজের কিছু গয়না ওদের ভদ্রাসনের পিছনের পচা ডোবাতে ফেলে দিয়ে চারদিকে রটিয়ে দেয় যে তার কিছু গয়না চুরি গেছে । এদিকে বউটাকে খুঁজে না পাওয়ায় সবাই হতভাগ্য মৃত বউটাকে চোর ভেবে নিল । তার দেহের এক অবশিষ্টাংশ ছিল না সবই পিশাচ ভক্ষণ করে নিয়েছিল তাই কোন প্রমাণ আর রইল না অপরাধের । সেদিন নবদম্পতির বিবাহের কিছু আচার অনুষ্ঠান ছিল সবাই সেই জোগারে লেগে গেল । ছোট্ট জুঁই যেন একরাতে অনেক পরিণত বড় হয়ে গেছে । তার দাদুর মৃত্যু , তাকে সতী করতে চাওয়া , জমিদার বাড়ির হবু জামাইয়ের সাথে তার বিয়ে হওয়া সব নিয়ে হটাৎ এত পরিবর্তন একসাথে সকলের পক্ষেই মেনে নেওয়া অসম্ভব । জুঁইয়ের পক্ষেও সহজ হয়নি এসব কিছু , তবু নিত্যদিনের মতোই জমিদার বাড়ির দুর্গা দালানে গিয়ে সে পুজো করতে বসে । জপ সে রোজই করত , আজ যেন সে ভক্তিতে লীন হয়ে গেছে , দিন রাতের খেয়াল নেই ধ্যানস্থ অবস্থায় সে দেখতে পাচ্ছে এক পিশাচ মূর্তি । এদিকে বেলা বয়ে যায় অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে জমিদার বাবু পারমিতা কে বলে জুঁইকে নিয়ে আসতে ঠাকুর দালান থেকে । মিতা নিজে না গিয়ে রোদ্দুরকে বলে জুঁইকে আনতে , সে যে গত রাতেই অধিকার হারিয়েছে ঈশ্বরের মন্দিরে পা রাখার , তার শরীর মন সব সে অশুভ শক্তির হাতে তুলে দিয়েছে । রোদ্দুর দুর্গা দালানে গিয়ে দেখে জুঁই ধ্যানস্থ হয়ে আছে , মুখে তার অপূর্ব দীপ্তি , প্রসস্থি বিরাজমান । ঈশ্বর তা হলে তার জন্য এই বালিকা বধুই নির্বাচন করে ছিলেন , পারমিতার সাথে বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে ওর সাথে মেলামেশা ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সব নিয়ে একটা প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তা ভুলে যাওয়া অত সোজা হবে না নিশ্চই তবে তাকে চেষ্টা তো করতেই হবে । বিয়ের সিদ্ধান্ত তার নিজের ছিল এবার তার দায় তাকেই বইতে হবে , এসব ভেবে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছিল রোদ্দুর । তার ভালোবাসা এক মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে গেল এই ভাবনা তার মনে ঝড় তুলেছে ।তার সম্বিত ফিরলো জুঁইয়ের ডাকে , আপনি এখানে কি করছেন ? আমাকে ডাকছিলেন ? হ্যাঁ জুঁই চল বিয়ের পরবর্তী আচার গুলো করতে হবে , রোদ্দুর বলে । এক এক করে থালা হারানো , করি খেলা সব আচার অনুষ্ঠিত হয় । পারমিতা সহ্য করতে বাধ্য , তাই সে হাসি মুখে সবকিছুতেই অংশগ্রহণ করে । পরের দিন রীতি অনুযায়ী বৌভাত ও ফুলশয্যার অনুষ্ঠান হলেও বৌভাতের অনুষ্ঠান টুকুই অনুষ্ঠিত হয় , ফুলশয্যা হয়না কারণ বধূ যে এখনো ঋতুমতী হয়নি । যতক্ষণ বালিকা ঋতুমতী না হয় সে কুমারী থাকে বিবাহ হলেও তার সাথে মিলিত হতে পারে না তার স্বামী , সে যে তখনো দেবীমা এর রূপ । রোদ্দুর রাতের বেলা শুয়ে ছিল নিজের ঘরে , তার মন বড্ড অশান্ত । স্বইচ্ছায় যে বাঁধনে সে নিজেকে জড়িয়েছে তা ভাঙাও সম্ভব নয় আবার পারমিতা কে পাবার আশা ও তাকে ত্যাগ করতে হবে তার পিতা যে বড্ড রাগী মানুষ । তার অনুমতি ছাড়া এ বিয়ে যদিও তিনি মেনে নেবেন কিন্তু তার পুত্র দুই স্ত্রী নিয়ে ঘর করবে এ কখনোই মানবেন না । এসব চিন্তা করতে করতে ঘুম জড়িয়ে এলো তার চোখে । রাত গভীর শয়তান জেগে উঠেছে , পারমিতা পৌঁছে যায় গুপ্ত কক্ষে । তার প্রভুর সেবার সময় হয়ে গেছে ।          

 

ডাকযোগে একখানা চিঠি পিতা জনার্দন মুন্সিকে পাঠিয়ে রোদ্দুর অপেক্ষা করছিল পিতার উত্তরের । এদিকে জুঁই জমিদার বাড়িতেই রোদ্দুরের সাথে থাকে আর মাঝে মাঝে মা নীরুপমার কাছেও যায় । সব স্বাভাবিক লাগলেও ছন্দপতন তো ঘটতই , প্রতি পনেরো দিন অন্তর অন্তর বাড়ি থেকে কখনও গ্রাম থেকে আস্ত মানুষ উধাও হয়ে যায় , তাকে বা তার লাশ কোনোটাই পাওয়া যায় না । এবার সবাই হিসেব কোসতে বসলো ঘটনার সূত্রপাত কোথা থেকে শুরু ? পনেরো দিন অন্তর কোনদিন কোনদিন মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে ? জমিদার বাড়ির দরদালানে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জমিদার বাবু , নতুন নায়েব , রোদ্দুর আর গ্রামের পঞ্চায়েত এর পাঁচ সদস্যের সাথে আরও কিছু গ্রামবাসী । রোদ্দুরই প্রথম বিষয়টার উপস্থাপনা করে যে তার বিয়ের রাতেই প্রথম ঘটনা ঘটে এবাড়ির রান্নার জোগারে মহিলা নিখোঁজ হয় , সেদিন ছিল পূর্ণিমা । তার পনেরো দিন পর অমাবস্যা তে রাখু বলে মালী , ঠিক তার পনেরো দিন পর আবার পূর্ণিমাতে গ্রামের এক এগারো বছরের ছেলে । জমিদার বাবু সহ সকলেই রোদ্দুরের সাথে সহমত পোষণ করেন। জমিদার বাবু বলেন জোগারে বউটা তো মিতা মার গয়না চুরি করে পালিয়েছিল বলে জানতাম , সে যদি ইচ্ছা করে পালায় অন্য কথা আর যদি গুম হয়েছে তা হলে সত্যি তা চিন্তার বিষয় । আলোচনা করে বোঝা গেল মানুষ হারানোর ঘটনাটি অমাবস্যা আর পূর্ণিমার দিন রাতেই ঘটে । এবার অপেক্ষা আগামী পূর্ণিমার যা দুদিন পরই আগত , পাহারার ব্যবস্থা করা হলো , সকলকে আগাম সতর্কতা জারি করা হল । এসব কিছুর পরও আর একটা চিন্তা রোদ্দুরের মনে ঘা দিচ্ছে , পত্র পাঠানোর এত দিন পরেও পিতা কোন উত্তর দিলেন না কেন ? উনি কি তা হলে রোদ্দুরের এই বিয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন না ? এখন থেকে কলকাতা ফিরে যাবার কথা কিন্তু গ্রামের এই বিপদের দিনে হট করে চলে যাওয়া যায় না । বিয়ের পর দুই মাস কেটে গেছে , তবু সে যেন যত দিন যাচ্ছে ততই মিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠেছে । আজকাল তার শরীরটাও ঠিক থাকে না কেমন ঘোর ঘোর লাগে ওর , ধর্মচর্চা যা ওর প্রিয় বিষয় তাতেও সে আগ্রহ হারিয়েছে । জুঁইয়ের মত ধর্মপ্রাণ মেয়েকে বিয়ে করে বিষ্ণু ভক্ত রোদ্দুর ভেবেছিল আরও হয়ত সে ধর্মচর্চা করতে সুযোগ পাবে কিন্তু কি যে হচ্ছে সেটাই সে বুঝতে পারছে না । নিরামিষভোজী রোদ্দুরের এখন আমিষ খেতে ইচ্ছা করে , অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করতে ইচ্ছা হয় মিতার সাথে । এ গ্রামের বাতাসে কেমন যেন একটা অশুভ শক্তির উৎস খুঁজে পায় সে , কিছুই বুঝে উঠতে পারে না রোদ্দুর । এদিকে মাটির নিচে গুপ্ত কুঠুরিতে দিনদিন বাড়তে থাকে রক্তবীজ নামক পিশাচের শক্তি । মিতা এখন অনেক বেশি ধূর্ত শিকারি , সে শিকার করতে এখন অনেক সতর্কতা অবলম্বন করে । গভীর রাতে সে গ্রামের মধ্যেই ঘুরে ঘুরে শিকার করে , বার বার নিজের বাড়ি থেকে শিকার তোলাটা বোকামি । মিতা নিজের মনেই হাসে , রোদ্দুর পত্রের অপেক্ষায় আছে তার পিতার , সে তো জানেই না সেদিন তার পাঠানো পত্র কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছায়নি । রাস্তায় সে পত্র মিতা বদলে নিয়েছিল , তার পরিবর্তে সে রোদ্দুরের হাতের লেখা নকল করে এখানে আরও কিছুদিন থাকার আগ্রহ প্রকাশ করে চিঠি পাঠিয়ে দেয় । কলকাতাতে জনার্দন মুন্সি ভাবেন তার পুত্র বেশ আছে হবু শশুর বাড়িতে এবং আরও কিছুদিন সে কাটাতে চায় সেখানে , এই ভেবেই তিনি নিশ্চিত হয়ে আর প্রত্যুত্তর দেননি । মিতা হিসাব কসে রক্তবীজের প্রয়োজন আর তিনটি বলি তার মানে আসছে পূর্ণিমা থেকে আরও তিন বার তাকে শিকার করতে হবে । রক্তবীজ তার প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করেছে , তার মায়ার প্রভাব পড়ছে গোটা গ্রামে । সারা গ্রাম মানসিক ও শারীরিক শক্তি হারাচ্ছে , ঈশ্বরের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ নেই কোথাও । সব থেকে প্রভাবিত রোদ্দুর , কোথায় সে ছিল ধর্মপ্রাণ , নিরামিষাশী । এখন তার চোখে মিতা কাম দেখেছে , ভক্তির প্রতি আস্থা হারিয়েছে সে । গোটা গ্রামে শুধু একটি প্রাণ যার মধ্যে রক্তবীজের প্রভাব বিস্তার হয়নি সে জুঁই । জুঁই জমিদার বাড়ির ভদ্রাসনের মধ্যেই স্নানঘর থাকলেও পুকুরেরই প্রতিদিন স্নান করতে যেত । সেদিন খুব ভোরে ভোর সে স্নানে যাচ্ছিল পথেই পরে সেই পচা ডোবাটা , সেই ডোবা পেরিয়ে যাবার সময় তার কিছু একটা চকচকে জিনিস চোখে পড়ে । জুঁই এগিয়ে যায় , কৌতূহলবসত সে হাতে তুলে নেয় সেই চকচকে জিনিসটা । স্নানে না গিয়ে সে ফিরে আসে জমিদার বাড়ি । একবার ভাবে মিতা দিদির কাছে যাই তার পর তার মনে হয় এ বিষয়ে প্রথমেই স্বামীকে জানানো প্রয়োজন । রোদ্দুর অতিথি ঘরেই রাতে শুয়ে ছিল , জুঁই প্রথম দিন থেকেই মিতার সাথে শুত । জুঁই চুপিচুপি রোদ্দুরকে ডাকে , রোদ্দুর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল সে জুঁইকে মিতা ভেবে নিজের কাছে জড়িয়ে নেয় । জুঁই চেষ্টা করে রোদ্দুরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর । কিন্তু ঘুমন্ত স্বামীর কাছে থেকে অতটুকু মেয়ের সাধ্য নেই নিজেকে ছাড়ানোর তাই সে অপেক্ষা করতে থাকে স্বামীর ঘুম ভাঙার । সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা ছেলেটা এখন অশুভ শক্তির কবলে পড়ে দেরিতেই ওঠে ঘুম থেকে , রোদ্দুরের যখন ঘুম ভাঙে তখন বেলা বয়ে যাচ্ছে । সে চোখ খুলে নিজের আলিঙ্গনে পায় জুঁইকে , হতচকিত হয়ে সে ঠিলে ফেলে দেয় জুঁইকে । পালঙ্ক থেকে ছিটকে পড়ে ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে জুঁই , হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনায় লজ্জিত রোদ্দুর তাকে তুলে বসায় । রোদ্দুর তাকে জানতে চায় সে তার বিছানায় কি করছিল ? ভয় পাওয়া জুঁই কিছুক্ষণ চুপ থাকে তার পর মেঝেতে পড়ে থাকা সেই ডোবায় পাওয়া জিনিস গুলো রোদ্দুরের সামনে তুলে এনে দেয় । রোদ্দুর চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করে , ' জুঁই তুমি এগুলো কোথা থেকে পেলে , এগুলো তো .....

জুঁই , ' হ্যাঁ এগুলো মিতা দিদির গয়না যেগুলো আমাদের বিয়ের রাতে চুরি গিয়েছিল ।


রোদ্দুর , ' তুমি এগুলো কোথা থেকে পেলে বলো দয়া করে ।


জুঁই , ' আমি স্নানে যাচ্ছিলাম পুকুরে তখন পচা ডোবার ধারে এগুলো আমি পাই আর তার পর সোজা চলে আসি আপনার কাছে , আপনি গভীর ঘুমে ছিলেন আমাকে মিতা মিতা বলে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েন । আমি চেষ্টা করেছিলাম নিজেকে ছাড়ানোর কিন্তু পারিনি তাই আপনার ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছিলাম ।

রোদ্দুরের অনুতাপ হয় নিজের কৃতকর্মের জন্য সে ঘুমের ঘোরে মিতাকে কামনা করে জুঁইকে জড়িয়ে ধরে এই বিষয়টা তাকে লজ্জায় মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছিল । তবু এসব ভাবার সময় এখন নয় তাই সে এই চুরি যাওয়া গয়না গুলোর উপর মনোনিবেশ করে । জুঁইকে সে এই ব্যাপারে কাউকে কিছু জানাতে মানা করে , যেহেতু বিষয়টা সন্দেহের । তার পর জুঁই যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সে আবার জুঁইকে আটকায় , তাকে ক্ষমা প্রার্থনা করে আর কৈফিয়ত দেওয়ার মত করে বলে সে ঘুমের মধ্যে ছিল তাই তার মনে ছিল না সে এখন জুঁইয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ , মিতার সাথে অতীতের দীর্ঘ দিনের সম্পর্কর কারণেই ঘুমে সে মিতার নাম করেছিল । জুঁই হাসে কিছু বলে না , সে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে । মিতা প্রতি রাতে পিশাচ সাধনা করার জন্য বেলা পর্যন্ত ঘুমাত , আজ সে ঘুম থেকে উঠে দেখে জুঁই বেরিয়ে যাচ্ছে রোদ্দুরের ঘর থেকে আর তার পরনে রাতের বাসী কাপড় । যদিও জুঁইয়ের সাথে রোদ্দুর এখনো কয়েক বছর শারীরিকভাবে মিলিত হতে পারবে না সে জানত তবু তাদের মধ্যে মনের মিল যে সংঘটিত হয়েছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে । যা করার খুব শীঘ্রই করতে হবে জল মাথার উপর দিয়ে বইছে এবার । রোদ্দুরকে ভাবাতে শুরু করেছে গয়না গুলোর ওভাবে বাড়ির পিছনের ডোবায় উদ্ধার হওয়াটা । সে নিজেই ওই ডোবার কাছে গিয়ে পৌঁছায় বিষয়টা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করার জন্য । ডোবা টা ছোট ও পানাতে ভর্তি , ডোবার সামনাসামনি দোতলার ঘরটায় থাকে মিতা আর তার সাথে বর্তমানে জুঁই । তা হলে কি সেদিন জুঁই বা মিতা এদের মধ্যে কেউ একটা গয়না গুলো রাতের বেলা জানালা দিয়ে ডোবায় ফেলে দেয় ? কিন্তু কেনই বা ফেলে? জুঁই যদি ফেলতো তা হলে সে কুড়িয়ে এনে নিশ্চই রোদ্দুরের হাতে আবার ফেরত দিত না গয়না গুলো । বাকি রইল মিতা সে কেন ফেলবে নিজের গয়না ? তবে এটা স্পষ্ট প্রথম গায়েব হয়ে যায় যে বউটা সে চুরি করে পালিয়ে যায়নি সেও নিশ্চিত খুন হয়ে গেছে বা অপহরণ করে নিয়েছে কেউ তাকে বাকিদের মত । রোদ্দুর এখন কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না , তাকে একাই খুঁজতে হবে অপরাধীকে , রহস্যর জট খুলতে সে এবার সকলের উপর সে নজর রাখতে শুরু করে । শারীরিক অলসতার কারণে রোদ্দুর দুপুরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়ে , হটাৎ মনে হয় কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে আছে তার বুকে মুখ ঘষছে । ঘুম ভেঙে যায় দেখে মিতা , সিক্ত বসনা এলোকেসি মিতা রোদ্দুরের শরীরে শরীর মিশিয়ে দিচ্ছে । প্রাথমিক উত্তেজনা রোদ্দুরকে মিতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেও সে নিজেকে সামলে নেয় দ্রুত । মিতার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে উঠে আসে সে । কামাক্ত মিতা আবার উঠে আসে আর তাকে জড়িয়ে ধরে , কিন্তু রোদ্দুরের মধ্যে যে এখনো অবশিষ্ট আছে ন্যায় বোধ , ঈশ্বরের প্রতি আস্থা তাই সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয় মিতার থেকে । সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আর সোজা চলে যায় ঠাকুর দালানে । সে আশা করেছিল মিতার সাথে একা ঘরে থাকলে মিতা এবং সে নিজেও সামলাতে পারবে না তবে ঠাকুর দালানে এলে তার পিছু পিছু মিতা ও আসবে আর রোদ্দুর তাকে বোঝাতে পারবে যে সে এখন জুঁইয়ের স্বামী । সে অপেক্ষা করবে জুঁইয়ের পরিনত হওয়া পর্যন্ত , মিতার এগিয়ে যাওয়া উচিৎ ভবিষ্যতের দিকে । রোদ্দুরের মধ্যে যত দিন যাচ্ছে ততই মিতার প্রতি বাসনা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে এখানকার সমস্যার সমাধান করে জুঁইকে নিজে কলকাতা রওনা দিতে হবে । অনেক ক্ষণ বসে বসে এসব সাত পাঁচ ভাবছিল সে কিন্তু মিতা আর এলো না , মিতার পক্ষে মন্দিরের মত পবিত্র স্থানে আসা সম্ভব নয় সেটা রোদ্দুরের অজানা , মিতা সোজা নিজের ঘরে চলে যায় । এর মধ্যে জুঁইকে আসতে দেখলো সে , ওকে দেখলে বিশ্বাস আসে মনে , জোর পায় মনে । জুঁই এসে বসলো তার পাশে , হাতে এক বাটি কয়েত বেল মাখা যা সে রোদ্দুরের দিকে এগিয়ে দেয় । বিলেতে বড়ো হওয়া রোদ্দুর এসব কোনদিন খাইনি তবু জুঁইয়ের খারাপ লাগতে পারে এই ভেবে সে একটু খানি মুখে দেয় আচারটা। জুঁই মিষ্টি হেসে বলে , আপনার এবার উচিত বাড়ি ফিরে যাওয়া । রোদ্দুর থতমত খেয়ে যায় , তা হলে কি জুঁই আজকে মিতার সাথে ওকে দেখে ফেলেছে ? ও জিজ্ঞাসা করে জুঁইকে , ' কেন ফিরে যেতে হবে কেন ? আর আমি একা না ফিরলে তুমিও যাবে আমার সাথে আমার বাড়ি কলকাতাতে । ওখানে আমার বাবা আছেন । ' জুঁই বলে , ' আমি যাব আপনার সাথে ? কিন্তু আমার মা তো তা হলে একা হয়ে যাবে । আপনি আমার মা কে নিয়ে যাবেন স্বামী ? আর আপনার বাড়িতে বাবামসাই আছেন আমি জানি আর আপনার মা মানে আমার শাশুড়ি মা ?' রোদ্দুর হাসে বলে মা তো সেই ছেলেবেলা থেকেই নেই , মানে উনি আমার জন্মের পর পর মারা যান । আমার পিতা জনার্দন মুন্সী একবিবাহে বিশ্বাসী তাই দ্বিতীয় বার বিয়ে করেননি উনি । জুঁই তুমি আমার সাথে চলো বাবামসাই এর আশীর্বাদ নাও তার পর তোমার মা কেও আমি নিয়ে যাবো আমাদের কাছে । জুঁই হট করে বলে , সে তো ঠিক আছে তবে মিতা দিদির কি হবে ? দিদি না কেমন পালটে গেছে জানেন । রোদ্দুরের ক্ষমতা নেই এই ছোট মেয়েটাকে বোঝানোর যে তার মিতা দিদিকে রোদ্দুর ছাড়াই এবার জীবন যাপন করতে হবে । মিতার পরিবর্তন স্বাভাবিক , সে বিরহে পুড়ছে রোদ্দুরের মতনই তবে কেন জানে না রোদ্দুরের এ মিতাকে চেনা মনে হয় না , এর মধ্য সেই আগের মিতা নেই । সন্ধ্যায় জুঁই সন্ধ্যা প্রদীপ দেয় , তার পর সে মিতার ঘরেই বসে এটা ওটা সেলাই ফোরাই করে বা মা নীরুপমা র কাছে যায় । আজ পূর্ণিমা সারা গ্রামে সতর্কতা জারি করা হয়েছে , লেঠেলরা পাহারায় বসেছে জমিদার বাড়ির বাইরে তাই জুঁই আজ আর মায়ের কাছে যায় না । সে হেঁসেলে দেখতে যায় কি রান্নার জোগাড় হচ্ছে । মিতা জুঁইকে হেঁসেলে ঢুকতে দেখে সোজা রোদ্দুরের ঘরে যায় আর ঘরের কবাট বন্ধ করে দেয় । রোদ্দুর বই পড়ছিল এক মনে , সে জানত আজ রাতে আবার সেই অজানা শিকারি শিকার খুঁজতে বেরোবে তাই সে এখন অপেক্ষায়। মিতাকে এভাবে ঘরে আসতে দেখে বুঝে উঠতে পারে না কি হতে চলেছে । মিতা তীর্যক হেসে জিজ্ঞাসা করে কি জুঁইয়ের পতিদেব আমি কি এতোই খারাপ যে আমার দিকে ফিরেও চাওয়া যায় না । আমার মত পূর্ন যৌবনসম্পন্ন রমণীর আহবান উপেক্ষা করে তুমি ওই অপরিপক্ক ফলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছ ? রোদ্দুরের এবার বিরক্তি লাগে , তুমি কি পাগল হলে মিতা ? কেন এমন করছ তুমি ? তুমি নিজের ক্ষতি করছো আর আমাকেও দুর্বল করে দিচ্ছ । প্রজাপতি ব্রহ্মহার সিদ্ধান্তে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ আমি জুঁইয়ের সাথে , সে বালিকা তবু সে আমার স্ত্রী । আই হ্যাভ টু লয়াল উইথ হার মিতা । আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইতাম , আমাদের দুই পরিবারের সিদ্ধান্তে এই বিয়ে স্থির হয়ে ছিল কিন্তু বিধি বাম । আমার কপালে জুঁই ছিল তাই আমাকে এখন তোমায় ভুলে তার প্রতি নিজের কর্তব্য পালন করতে হবে । আমাদের পরিবারে এক বিবাহ রীতি তাই জুঁই প্রথম জুঁই শেষ , ওই আমার একমাত্র স্ত্রী । তুমি আমাকে ভুলে এগিয়ে যাও , মিতা । মিতার চোখ দুটো জ্বলে ওঠে প্রতিশোধ স্পৃহাতে । সে তবু সামলে নেয় নিজেকে , তার প্রথম উদ্দেশ্য রোদ্দুরকে শারীরিকভাবে নিজের করে নিতে হবে , পিশাচ রক্তবীজ তাই নির্দেশ দিয়েছেন । সে বলে তুমি স্ত্রী হিসাবে আমাকে গ্রহন নাই করতে পারো , আমি তো তোমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি সেই কবে , আর স্ত্রীর অধিকার আমি আজ তোমার কাছে নিয়েই ছাড়বো । মিতা নিজের শাড়ি খুলে দেয় এক ঝটকায় তার পর রোদ্দুরের কোলে গিয়ে বসে পড়ে । রোদ্দুরের সারা শরীরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় সে , ও বুঝতে পারে বাধা দিলেও রোদ্দুরের পৌরুষ জেগে উঠেছে । রোদ্দুরকে বিছানায় ফেলে ওর পাঞ্জাবী টা খুলে দেয় মিতা , ওর রোমশ বুকে নিজের নরম তাম্বুল রঞ্জিত লাল ঠোঁট দুটো ঘষতে থাকে । রোদ্দুর আর পারে না সামলাতে সে মিতাকে গ্রহণ করতে বাধ্য , সে আর নিজের কামোত্তেজনা কে বশীভূত করে রাখতে পারছে না ।        


মিতার সেমিজের বোতাম গুলো খুলতে রোদ্দুর হাত রেখেইছিলো এমন সময় মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে যায় দ্রুত সামলে নেয় নিজেকে তার পর উঠে পড়ে সে মিতার উপর থেকে । মিতার চোখে রক্তবীজের প্রতিচ্ছবি দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় রোদ্দুর , কিন্তু বুদ্ধি করে সে কিছু বলে না । মিতা হঠাৎ থেমে যাওয়া রোদ্দুরকে আবার কাছে টানতে যায় কিন্তু সে অসুস্থতার বাহানা দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয় । মিতার হাতে আর সময় নেই কিছুক্ষণ পরেই তাকে শিকারে বেরোতে হবে তাই রোদ্দুরের এখন ঘুমিয়ে পড়াই মঙ্গল । মিতা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে , কি এমন হলো যে রোদ্দুর হঠাৎ করে উঠে গেল ওর কি কিছু সন্দেহ হয়েছে ? যাই হোক ওই জুঁইটা যতক্ষণ না ঘুমাবে মিতা ততক্ষণ পর্যন্ত শিকারে যেতে পারবে না । রাতের খাবার খেয়ে সকলে নিজের নিজের ঘরে শুয়ে পড়ে , এদিকে অস্থির রোদ্দুর মিতার চোখের মনির মধ্য এক পিশাচের প্রতিচ্ছবি দেখেছে । রোদ্দুর বুঝতে পারছে , এ গ্রামে কোন পিশাচ আছে যে প্রতি পনেরো দিন অন্তর একটা করে মানুষের শিকার করে আর কোন ভাবে মিতা এখন পিশাচের দাসিতে পরিণত হয়েছে তাই তার মধ্য সব ভালো গুলো শেষ হয়ে গেছে । আজ পূর্ণিমা আর প্রতিবারের মতো আজ পিশাচের শিকার হতে চলেছে কেউ , মিতা যখন পজেস্ট তার কাছে রাতে জুঁইকে রাখাটা নিরাপদ নয় । জুঁই এখন তার দায়িত্ব , হতেই পারে পিশাচ সতর্ক পাহারার কারণে শিকার না পেলে মিতাকে দিয়ে জুঁইকে তুলে নিয়ে যেতে পারে । রোদ্দুর সোজা মিতার ঘরে ঢুকে পড়ে , দেখে জুঁই আর মিতা খাটে ঘুমিয়ে আছে । ধীরে ধীরে সে জুঁইকে কোলে তুলে নিয়ে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আর নিজের ঘরে এনে জুঁইকে খাটে শুয়ে দেয় । মিতা ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল সে দেখে রোদ্দুর এসে জুঁইকে ঘরে নিয়ে গেল । ও ভাবে হয়ত রোদ্দুর বাবুর বউয়ের সাথে শুতে মন করেছে তাই সে জুঁইকে নিয়ে গেছে ঘরে । মিতা ঘুণাক্ষরেও বোঝে না যে রোদ্দুরের তার উপর সন্দেহ হয়ে গেছে । জুঁইকে নিরাপদে রেখে রোদ্দুর মিতার ঘরের দিকে নজর রাখতে শুরু করে , ঠিক রাত সাড়ে বারোটা এমন সময় মিতা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সোজা চলে গেল সিঁড়ি বেয়ে নিচের তলা । রোদ্দুর সন্তর্পণে ওর পিছু নেয় , ও দেখে মিতা একতলার সিঁড়ির নীচে একটা গোপন কুঠুরিতে ঢুকে গেলো । এতদিন এই জমিদার বাড়িতে সে আছে কিন্তু এই গুপ্ত ঘরটির কথা সে জানতো না , আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে ও মিতাকে ফলো করে ওই কুঠুরির দরজার আড়ালে লুকিয়ে ভিতরে কি হচ্ছে দেখে । অন্ধকার চোখে সয়ে আসলে ও ভিতরে সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পায় । রোদ্দুর দেখে ওই গুপ্ত কক্ষ একটা বিশাল ঘর যার মধ্যে তন্ত্রচার করা হয় , সেখানে আছে বিশাল এক চন্দ্রোহাস খাঁড়া , হাড়িকাঠ বলি দেবার জন্য আর মিতা কথা বলছে কারো সঙ্গে । অপর জনকে রোদ্দুর দেখার চেষ্টা করে কিন্তু মিতা সামনে দাঁড়িয়ে থাকাতে সেই লোকটিকে কিছুতেই দেখতে পায় না । ঘরটার বাইরে দরজার কাছে দাঁড়িয়েই রোদ্দুরের র অন্নপ্রাসনের ভাত উঠে আসার জোগাড় এত দুর্গন্ধ ঘরটাতে । গন্ধটা তার খুব চেনা , কেমন আসটে গন্ধ নাকে আসছে । হ্যাঁ এত বাসী রক্তের গন্ধ , রোদ্দুর দেখেছে কোন জায়গায় পশু জবাই বা বলি হলে সেখানে পরে এমন একটা বিকট গন্ধ হয় । তার মানে এখানে বলী দেয়া হয় এখনো আর মিতা এসবের মধ্যে রয়েছে তা রোদ্দুরের কাছে খুব স্পষ্ট । ফিরে গিয়ে লোকজন ডেকে আনবে সে ভাবছিল এমন সময় মিতা সরে গিয়ে লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে যায় আর রোদ্দুর লোকটি যাকে এতক্ষণ সে দেখার চেষ্টা করছিল , স্পষ্ট দেখতে পায় তাকে । এতো সেই পিশাচ যাকে মিতার চোখের মনিতে সে আজ সন্ধ্যায় দেখেছিল । রোদ্দুরের সাড়া শরীরে রোমকূপ গুলো ভয় ও উত্তেজনাতে খাঁড়া হয়ে যায় । এক পর্যায়ে বিকট ভয়াল দানব যার পাঁজর গুলোতে মাংসপেশি নেই , সাড়া শরীর কাঁচা মাংসর লাল দলা , বড় বড় সুলের মত দাঁত , ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ , মাথায় উল্টানো দুটো সিং মহিষের মতন , হাতে বড় বড় নখ যা একটা মানুষকে নিমেষে চিড়ে ফেলতে সক্ষম । রোদ্দুর ভয় পায় কিন্ত বুদ্ধি বিবেচনা হারালে মৃত্যু অবধারিত তা বুঝে সে লুকিয়ে থাকে । মিতার কথা গুলো শোনার জন্য সে কান পেতে থাকে , পিশাচ মিতাকে বলছে পারমিতা আমার বলি এখনো জোগাড় করতে পারোনি তুমি ? এই তুমি আমার সেবা করছো ? মিতা থতমত খেয়ে বলে প্রভু রক্তবীজ এই প্রায় দিন মানুষ অপহরণের জন্য চারদিকে পাহারা বসানো হয়েছে । আমি কিছুক্ষনের মধ্যেই আপনার ভোগের ব্যবস্থা করে দেব । রোদ্দুরের ভীষণ রাগ হয় তার মানে মিতা বেচারা মানুষ গুলো অপহরণ করে এনে এই পিশাচ কে বলি দেয় । তবে আজ যদি রোদ্দুর এদের বাধা দেয় তা হলে তাকে এরা মেরে ফেলবে , এদের সাথে যুদ্ধ করতে হলে সবাই মিলে সংঘটিত হয়ে লড়তে হবে । তাই আজ যদি কারো প্রাণ যায় তবুও রোদ্দুরকে চুপচাপ সব দেখতে হবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুই করার নেই তার এছাড়া । এসব ভাবতে ভাবতে রোদ্দুর দেখে মিতা ওই পিশাচের সাথে শারীরিক ভাবে লিপ্ত হয়েছে , ভীষণ আক্রোশের সাথে ওই পিশাচ মিতার শরীরকে ভোগ করছে । ঘেন্নায় বমি আসে রোদ্দুরের তবু সে সামলে নেয় আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় যে পরমপিতা তার জন্য সঠিক জীবন সাথী বেছে দিয়েছেন । হোক জুঁই গরীব ঘরের মেয়ে , ওর থেকে অনেক ছোট তবু সে ভালো মানুষ , ঈশ্বরের ভক্ত সে । আর এই শিক্ষিতা জমিদার কন্যা পারমিতা সে পিশাচ সাধিকা , এক পিশাচের সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার । রোদ্দুর ভাবে তার মধ্যেও যে পরিবর্তন আসছিল তা এই অশুভ শক্তির সাথে থাকার ফল , তাকে যে ভাবেই হোক এই রক্তবীজের সংহার করতেই হবে । মিতা পিশাচকে শারীরিকভাবে তুষ্ট করে বেরিয়ে পড়ে ওই গুপ্ত কুঠুরি থেকে শিকারের খোঁজে আনমনে থাকায় সে রোদ্দুরকে দেখতে পায় না । প্রায় একঘন্টা পর রোদ্দুর দেখে মিতা এক বিশালাকার লোককে টানতে টানতে নিয়ে ঢোকে গুপ্ত কুঠুরির মধ্য । লোকটির গলার আওয়াজ শুনতে পায় রোদ্দুর , সে কাতর অনুরোধ করছে , আমায় ছেড়ে দে , আমায় ছেড়ে দে । এতো জমিদার বাবুর গলার স্বর ! রোদ্দুর আশা করিনি বাইরে পাহাড়া থাকার ফলে মিতা নিজের পিতাকে অপহরণ করে আনবে । জমিদার বাবুর ভবিষ্যত চিন্তা করে চোখে জল এসে যায় তার , সে ভাবে একটা মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে ! শেষে নিজের বাবাকে বেঁধে নিয়ে এসেছে বলী দিতে ? জমিদার বাবু বলছেন মিতাকে তুই এ কি খেলা শুরু করেছিস মিতা মা ? আমার দেরাজ থেকে এই ঘরের চাবি চুরি করে তুই পিশাচ জাগিয়েছিস ? তুই জানিস এর ফল কি হবে ? এ গোটা গ্রামকে শেষ করে দেবে , তোকেও ছাড়বে না রে মা । তোর মা নেই বলে আমি তোর মা , আমিই তোর বাবা হয়ে তোকে মানুষ করেছি আর তুই আমাকে এই পিশাচের কাছে বলী দিতে এনেছিস ?  


জমিদার বাবুর গলায় আসন্ন মৃত্যুর ভয়ের থেকে ক্ষোভ বেশি ফুটে উঠেছে , উনি এখনো পর্যন্ত বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না তার নিজের সন্তান তাকে বলী দিতে চাইছে । তিনি মিতাকে জিজ্ঞাসা করেন কেন সে এই ভয়াবহ পথ বেছে নিয়েছে ? তখনই রক্তবীজ নিজের রক্তের পিপাসা মেটাতে মিতাকে বলী দেবার ইশারা করে । মিতা বিচ্ছিরি ভাবে হেসে ওঠে , সে তার প্রভু কে বলে ' পিশাচ দেব আপনি নিশ্চয়ই বুঝেছেন আমি আপনার কতটা আজ্ঞাবহ দাসী , কোন বলী আজ জোগাড় করতে পারিনি বলে নিজের পিতাকে আপনার পায়ে সমর্পণ করছি । আপনি কিছুক্ষনের মধ্যেই ভোগ পাবেন তবে আপনার কাছে আমার কাতর অনুরোধ আপনি একটু সময় আমাকে দিন , আমার মনে হয় আমার পিতার মৃত্যুর আগে তার সবটা জানার অধিকার আছে । আমি ওনাকে সবটা বলেদি তার পর উনি আপনার ভোগ হবেন ' । পিশাচ সম্মতি দেয় মিতাকে তারপর সে একটা মোটা রশি দিয়ে জমিদার বাবুর পা দুটো আর হাত দুটো কষে বেঁধে ওনার মাথাটা হাঁড়িকাঠে ঢুকিয়ে দেয় । মিতা তার পর তার নিজের পিতাকে সব বলতে শুরু করে , ' তুমি তৈরি থাকো বাবা পিশাচ দেবের ভোগ হতে তার আগে আমার কথা গুলো তুমি মন দিয়ে শুনে নাও , তুমি হয়ত ভাবছ বাড়িতে তুমি ছাড়াও জুঁই রোদ্দুর ও আছে আরও কাজের লোকজন আছে তাদের ছেড়ে তোমাকে কেন আমি বেছে নিলাম বলীর জন্য ? তো বলি শোন , রোদ্দুরকে মারলে আমার চলবে না , ওকে পাবার জন্যই এত আয়োজন ওকে মারলে চলে বলো ! জুঁই , ওকে তো আমি মারতেই চাই তাই ওদের বিয়ের দিন আমি তোমার দেরাজ থেকে এই গুপ্ত কক্ষের চাবি চুরি করে আনি তার পর পিশাচ দেবকে জাগানোর পদ্ধতি যা এই ঘরের দেওয়ালে লেখা ছিল তা পড়ি । সেখানে দাদামসাই স্পষ্ট লিখেছেন রক্তবীজ পিশাচকে জাগাতে কোন নারীকে স্বইচ্ছায় নিজের কৌমার্য পিশাচকে দান করতে হবে , তার আহ্বানে যখন পিশাচ আসবে তাকে এক সধবা নারীর বলী দিয়ে তুষ্ট করতে হবে , এই পর্যন্ত পরে আমি আর ধৈয্য রাখতে পারিনি বাকিটা না পরেই আমি ফিরে যাই । রোদ্দুরকে পাবার আশায় আমি জুঁই সহ রোদ্দুরকে এই জমিদার বাড়িতে নিয়ে আসি । রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে তখন ঘুমন্ত জুঁইকে কোলে করে এখানে নিয়ে আসি আমি । মন্ত্র তন্রের সাহায্য নিজের শরীরের বিনিময়ে পিশাচ দেবকে আহবান করি উনি এলে নিজের কৌমার্য ওনাকে দান করি , তার পর এই হারিকাঠের মধ্য যেখানে তোমার মাথা আছে বাবা সেখানে সেদিন জুঁইয়ের মাথাটা ছিল । আমি ভেবেছিলাম জুঁইকে বলি দিয়ে আমি পিশাচ দেবকে সন্তুষ্ট করে রোদ্দুরকে ফিরে পাবো কিন্তু বিধি বাম পিশাচ দেব জুঁইয়ের বলি নিতে অস্বীকার করলেন ও নাকি দেবী চন্ডির রূপ , যেই চন্ডিকা একসময় পিশাচ দৈত্য রক্তবীজের সংহার করেছিলেন । কোন দৈব শক্তিকে বলী দেওয়া সম্ভব নয় , এতে সাথে সাথে জুঁইয়ের ভিতরে ঘুমন্ত দেবী জেগে উঠেতে পারে আর এবার মর্তে ফিরে এসে পিশাচ দেব সেই শক্তির অধিকারী ছিলেন না যা তার মধ্যে পূর্বে ছিল তাই উনি আমাকে কিছু নরবলি দিয়ে ওনার শক্তি পুনঃজীবিত করতে আদেশ দেন । সব বলির মধ্য আর তিনটি বলি বাকি আজ তুমি এর পরের অমাবস্যা আর পূর্ণিমাতে অন্য দুজন কেউ ব্যাস তা হলেই পিশাচ দেব জুঁইয়ের মধ্য পালিত চন্ডিকা কে শেষ করে দেবেন আর আমি রোদ্দুরকে ফিরে পেয়ে যাবো । সেদিন জুঁইকে বাধ্য হয়ে আবার আমি ঘরে রেখে আসি আর ফেরার পথে রান্নার জোগারে বউটাকে নিয়ে এসে বলি দিয়ে দি । বাবা তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করেছ আজ শেষ বারের মত নিজের প্রানটুকু দিয়ে দাও । কাল সকালে সবাই জানবে তুমি কলকাতা গেছ কদিন পর ফিরে আসবে , এই পূর্ণিমাতে আর পরিকল্পনা মাফিক কেউ হারাবে না তাই সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে আর পাহারা বন্ধ হয়ে যাবে । তার পর বাকি দুটো বলি ঠিকই জোগাড় করে নেব আমি । জমিদার বাবু স্তম্ভিত তিনি শুধু এটুকুই বললেন মিতা মা তোমার জন্য আমি হাসতে হাসতে প্রাণ দিতাম তবে যে কাজ তুমি করেছ বা ভবিষ্যতে করবে তার জন্য তোমার পিতা তোমাকে আশীর্বাদ তো দিতে পারবে না তবে অভিশাপ দিলাম , তুমি সফল হবে না মা চন্ডিকা তোমায় শাস্তি দেবেন , তুমি নরক ভোগ করবে । মিতা রাগে অন্ধ হয়ে চিৎকার করে এক কোপে জমিদার বাবুর মাথাটা খাঁড়ার কোপে দ্বিখন্ডিত করে দেয় । প্রবল ছটপট করতে থাকে দেহটা তার কিছুক্ষণ পর সব শান্ত হয়ে যায় । রোদ্দুর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না , সে ছুটে ওপরে উঠে যায় । এই নৃশংসতা তাকে অস্থির করে তোলে , জমিদার বাবুর পরিণতিতে তার দুগাল বেয়ে নোনা জলের ধরা নামায় । তার পর সে নিজেকে সামলে নেয় , জমিদার বাবুর শরীরটা পিশাচের খাওয়া হয়ে গেলে মিতা ওপরে উঠে আসবে । আর সুযোগ পাবে না রোদ্দুর মিতার ঘর টা সার্চ করার । সে চুপিচুপি মিতার ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তন্ন তন্ন করে দেখে কিছু যদি পাওয়া যায় । এদিক ওদিক দেখে নিরাশ হয়ে সে ফিরেই আসছিল তখনই তার চোখে পড়ে আয়নার পাশে একটা খাম । এই খামটা তো তারই তৈরি , হ্যাঁ এটাই তো সেই খাম যা সে নিজের হাতে তৈরি করে ছিলো পিতাকে কলকাতাতে চিঠি পাঠানোর জন্য । খামটা খুলে সে দেখে চিঠিটা তারই লেখা যা সে ডাক মারফত কলকাতা পাঠিয়ে ছিল । তার মানে পিতার কাছে এই চিঠি পৌঁছায়নি পথেই তা বদলে নিয়েছে পারমিতা । এই জন্যই পিতার তরফ থেকে কোন চিঠি রোদ্দুর এতদিন পাইনি । পিতা নিশ্চিতরূপে তার বিয়ের বিষয়ে এখনো পর্যন্ত অবগত নন । যাই হোক যা যা রোদ্দুর নিচে শুনে এসেছে তা ওকে আবার একবার ভেবে দেখতে হবে সব যেন ওর মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে । ও নিজের ঘরে ফিরে আসে তার পর আরামকেদারা টাতে হেলান দিয়ে দু চোখ বুজে ভাবতে থাকে মিতার বলা কথা গুলো । ওই কথাগুলোই সংকেত দিতে পারে তাকে রক্তবীজ সংহারের ।         


মিতা নিজের পিতাকে যমের দুয়ারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এসেছে । আজ যখন বাড়ির বাইরে লেঠেলরা ঘুরছিল , বেরোনোর কোন উপায় ছিল না মিতা ভেবে ছিল কাজের লোকেদের মধ্য কাউকে তুলে নিয়ে যাবে তার পর মাথায় এলো আজ যদি বাড়ি থেকে রাতে কেউ অপহত হয় সন্দেহ হবে সকলের এ বাড়ির লোকেদের ওপর । বাইরে লেঠেল থাকতে বাইরে থেকে কেউ নিশ্চই বাড়ির মানুষ তুলে নিয়ে যাবে না ঘরের মধ্যেই বিভীষণ আছে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে । তাই প্রথমে খারাপ লাগলেও মিতার নিজের বাবাকে বেঁধে নিয়ে যাওয়াটাই ঠিক মনে হলো । কাল সকলে বাবাকে খোঁজার আগেই সে বলে দেবে বাবা সন্ধ্যা বেলাতেই বিশেষ কাজে কলকাতা রওনা দিয়েছেন । বাবা সন্ধ্যা সাতটায় মধ্য ঘর ঢুকে গেছিলেন তাই তাকে কেউ দেখেনি তার পর , যুক্তিটা খাড়া করা সহজ । আগামী এক মাসে দুটো বলী দরকার সে দুটোর ব্যবস্থা করে নিলেই কাজ শেষ । তার পর সকলে সব কিছু জেনে গেলেও মিতার কিছু আসে যায় না । জুঁইকে রক্তবীজ শেষ করে দেবে আর মিতাকে অনন্ত শক্তির অধিকারিণী বানাবে । তার পর মিতা এ পৃথিবীতে রাজ করবে , এ সব ভাবতে ভাবতে সে লক্ষ্যে করে জুঁই বিছানায় নেই মানে রোদ্দুরের কাছেই আছে ও সারা রাত । ভালোই হয়েছে রোদ্দুর যদি জুঁইকে ফেরত রাখতে আসতো তা হলে মিতাকে ঘরে না পেলে সন্দেহ হতে পারতো ওর । জুঁইকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েও লাভ নেই ওর , নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো মিতা । ওদিকে গ্লানিতে ছটপট করে মরছে রোদ্দুর , সে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে , জন্মের পর পর মাকে হারিয়ে মহিলাহীন বাড়িতে পিতার সাথে বেড়ে ওঠা ওর , বাড়িতে ছোট থেকেই দেখে আসছে কোন মহিলার সেখানে প্রবেশাধিকার নেই । তার পিতা জনার্দন মুন্সি পরম বিষ্ণু ভক্ত আর নিজের ছেলেকেও ভগবানের প্রতি আস্থা রাখতে শিখিয়েছেন । সেই কোন ছোটবেলা থেকেই সে রামায়ণ , মহাভারত , বেদ , পুরান এসবের প্রতি আসক্ত । সে মাত্র তেরো বছর বয়সে লন্ডন চলে যাবার সময় ও বেঁধে নিয়ে যায় কিছু ধর্মীয় গ্রন্থ । বাড়িতে চিরকাল নিরামিষ আহার করা হতো যা বিদেশ গিয়েও সে পালন করে গেছে । লেখাপড়ার পর তার অবসর সময়ে একটাই আগ্রহের জায়গা ছিল তা হলো বিভিন্ন দেবদেবীর বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জানা । দেশে ফিরে এসে যখন পিতা তাকে পারমিতার সাথে বিবাহের প্রস্তাব দেন সে প্রথমে রাজি না হলেও পারমিতার একটি তৈল চিত্ৰ দেখে মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় । চিরকাল বাড়িতে রান্নার পাচক , কাজের লোক , পুরোহিত সব লোকই পুরুষ কোন মহিলাকে সে সামনে থেকে দেখেনি সে ভাবে । লন্ডনে ও সে মহিলা সঙ্গ এড়িয়েই চলতো , কুণ্ঠা আর ভয়ে । এর জন্যই কি তার পারমিতাকে চিন্তে ভুল হয়ে গেল , রূপের মোহে সে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তা বুঝে উঠতে পারেনি ? প্রথম থেকেই রোদ্দুর যখন ধর্ম চর্চা যা ওর প্রিয় বিষয় তা নিয়ে মিতার সাথে আলোচনা করতে চাইলে ও কিন্ত আগ্রহ দেখাত না । ও বিরক্তই হয়েছে বারবার , তার পর লজ্জা যা নারীর ভূষণ তা কোনদিনই মিতার ছিল না । ইদানীং সে তো এই বিয়ের পর একপ্রকার জোর করে রোদ্দুরের সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছিল । এর পর রোদ্দুরকে প্রথমেই যেটা করতে হবে তা হলো ওই গুপ্ত কক্ষে গিয়ে তাকে একবার চারদিকটা দেখে আসতে হবে যদি কিছু পাওয়া যায় যা ভবিষ্যতে রক্তবীজ সংহার করতে সাহায্য করবে । মিতার একটা কথা রোদ্দুরের মাথায় ঢুকছে না সেটা হলো জুঁইকে কেন পিশাচের দেবীর অংশ বলে মনে হচ্ছে ? এই কদিনে রোদ্দুর যতটুকু দেখেছে জুঁইকে তার একবারও তাকে সাধারণ মানুষ ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি ।এবার আর ভাবার সময় নেই তাকে এই রহস্যর উদ্ঘাটন করতেই হবে যে ভাবেই হোক । আপাতত ওই ঘরে তো হট করে যাওয়া যায় না , রক্তবীজ তাকে দেখতে পেল নিশ্চই ছেড়ে দেবে না । প্রথমেই তাকে জানতে হবে কি করে এই পিশাচকে মারা যায় , আর তার জন্য সাহায্য করতে পারে কালিকা পুরান । দ্বিতীয় বিষয় হলো মিতার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে আবার সেটা মিতাকে বুঝতে দিলেও হবে না । ওর সঙ্গ রোদ্দুরের মনে একটা কামনার প্রবৃত্তি আনছে , এটা ওর অশুভ শক্তির ফলেই হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই আর এখন । তৃতীয় কাজ যে ভাবেই হোক না কেন আগামী অমাবস্যাতে বলী আটকাতেই হবে , যত টুকু সে শুনেছে তাতে আর দুটো বলী পেলেই সম্পূর্ণ শক্তি পাবে পিশাচ তার আগে নয় । এর অর্থ বলী আটকানোর ফলে এমনিতেই সে ওই ঘরের বাইরে আর বেরোতে পারবে না । এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন সকাল হয়ে গেছে রোদ্দুর বুঝতে পারে না , সে ওই আরাম কেদারাতেই ঘুমিয়ে পড়ে ভোরের দিকে । যখন তার ঘুম ভেঙ্গে যায় সে দেখে জুঁই বিছানায় নেই , ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে । কাল রাতে যা রোদ্দুর দেখে নিয়েছে তার পর আর এই বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয় তবু এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে এখানে থাকতেই হবে তাকে । জুঁইকে খুঁজতে হবে কোথায় আছে ও তার পর ওকে সুরক্ষিত রাখতে চোখে চোখে রাখতেই হবে ।       

কালিকা পুরান নিয়ে বসলো রোদ্দুর , তখন সন্ধ্যার সময় । জুঁইকে সে জানিয়েছে তার সাথে তার ঘরেই রাতে থাকতে এখন থেকে । সেই মত জুঁই গত রাত থেকে রোদ্দুরের ঘরেই আছে যদিও তার বালিকা মনের সংশয় দূর করতে সে তার মা নীরুপমার কাছে গিয়েছিল । জুঁই কান্না শুরু করে তার মায়ের কাছে গিয়ে তাকে কেন মিতা দিদির ঘর থেকে ওই গোমরা মুখো স্বামী টি নিজের ঘরে নিয়ে গেছে ? ওর ভালো লাগে না স্বামীর সঙ্গে এক ঘরে থাকতে , মানুষটা যে বড্ড বেশি চুপচাপ । তার মায়ের হাসি পায় সব শুনে তবু মেয়েকে তিনি কোলের কাছে নিয়ে আদরের সাথে বোঝান যেহেতু রোদ্দুর বাবু এখন তার স্বামী তাই ওনার সাথেই জুঁইকে থাকা উচিত । নীরুপমার মনে সংশয় হয় তবে কি জামাই এখনই জুঁইয়ের সাথে দাম্পত্য জীবন শুরু করতে চাইছে ? যদিও তার বিশ্বাস জামাই বিবেচক মানুষ সে এমন ভাবে তাড়াহুড়ো কখনই করবে না আর যদি করেন ও তবু তাকে বাধা দেবার অধিকার বা সামর্থ্য নীরুপমার নেই । সেদিন রোদ্দুরের জন্যই জুঁইয়ের প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিল নীরুপমা , এর পর জুঁইয়ের ভাগ্য এই ভেবে তিনি মেয়েকে তার স্বামীর সঙ্গে থাকতে বলেন । মিতার রাগ হলেও সে চুপ করে সব সহ্য করে নিলো কারণ এই সময় তার এক থাকাই ভালো । জুঁইয়ের রোদ্দুরের সাথে এক ঘরে থাকাটা মিতার বুকে সূলের মত বিঁধেছে । ভয়াবহ রাতের পর সকালে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মিতাকে ঘুরে বেড়াতে দেখে রোদ্দুরের খুব অবাক লাগল কি করে একটা মেয়ে তার পিতার মৃত্যুর পর এত স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে । উত্তর ও রোদ্দুরের জানা , সে জানে মিতা দেহে মানবী হলেই বা সে আসলে অন্তর থেকে পিশাচিনি । ইচ্ছা করেই রোদ্দুর মিতার কাছে জমিদার বাবুর খোঁজ করে , মিতা বলে বাবামশাই ব্যবসার কাজে ভোর ভোর বেরিয়ে গেছে কলকাতা । রোদ্দুর আবার ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে উনি কি একাই গেছেন ? মিতা বলে না তো উনি কলের গাড়িতে গেছেন সাথে চালক বাবুলাল ও গেছে । রোদ্দুর জানে জমিদার বাবু আর নেই তা হলে কলের গাড়িটা আর চালক বাবুলাল ? মানে মিতা তার বাবার কলকাতা যাবার প্রমান রাখতে গাড়ি সহ বাবুলাল কেও সরিয়েছে কোথাও । সে বেঁচে আছে কিনা তাও সন্দেহ ! রোদ্দুর পুরানের বিভিন্ন পাদটিকা গুলি পরে দেখে , তার পর সে শাস্ত্র সমন্ধিত আরো কিছু বই পরে । জুঁই স্বামীর এই দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশোনা দেখে কৌতূহল বসত প্রশ্ন করেই ফেলে যে রোদ্দুর এত মন দিয়ে কি জানতে চায় ? রোদ্দুরের মাথায় আসে গতকালে মিতার বলা কথা গুলো যে জুঁইয়ের মধ্যেই চন্ডিকার বাস , এই তো সময় জুঁইকে বাজিয়ে দেখার তাই রোদ্দুর বলে দেখ না তখন থেকে অসুর রাজ রক্তবীজের সমন্ধে জানতে চাইছি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিনা । জুঁইয়ের সরল মুখটা হটাৎ রক্তবীজের নামে কঠিন রাগান্বিত হয়ে ওঠে । তার পর আবার শান্ত হয়ে যায় জুঁই , সে বলে কেন কি হবে ওই অসুরের সম্বন্ধে জেনে ? রোদ্দুর বলে ' না , মানে যদি ঐ অসুর আবার বেঁচে ফিরে আসে তা হলে তাকে মারবে কে বা কি করে তাই জানতে চাইছিলাম ?' জুঁই কেমন উত্তেজিত হয়ে যায় , সে বির বির করে বলে তখন আমি কালি রক্তবীজ দৈত্যবধে দেবী পার্বতীকে সহায়তা করি । রক্তবীজের রক্ত মাটিতে পড়লে সহস্র সহস্র রক্তবীজ অসুরের সৃষ্টি হত। কৃৃৃৃষ্ণবর্ণা দেবী আমি রক্তবীজের রক্ত পান করি । এই সময় ভূপতিত রক্ত থেকে সৃষ্ট অসুরদের ধ্বংস করে আমি কালিকা এবং শেষে রক্তবীজকেও বধ করি । প্রাচীন স্কন্দ পুরাণেও এর বর্ণনা রয়েছে। এই পুরাণে আরও বলা হয়েছে যে দেবী পার্বতী দেহসম্ভুুুতা এক দেবী চন্ড ও মুন্ড নামক অসুরদ্বয়কে বধ করেন এবং এর থেকে তার নাম হয় চামুন্ডা।এই চামুুন্ডা বা কালিকা দেবীর চন্ডীরই অপর রূপ।

আমি মানব শরীরের মধ্যে বর্তমানে বাস করি সেই মহাশক্তি চন্ডিকা । বাস্তবে আমি ত্রিনয়না, আমার কপালে অর্ধচন্দ্র শোভিত। মূল রূপে বহু হাতে বহু প্রকার অস্ত্র, গাত্রে বহুমূল্য অলংকার ও মালা। যা সকলই দেবগণ আমায় উপহার দিয়েছিলেন। মূল রূপে আমার সোনার অঙ্গ সহস্র সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল। এইরূপে আমি সিংহবাহিনী দেবী চণ্ডী হয়ে উঠেছি বিশ্বশক্তির মূর্তিস্বরূপ। রোদ্দুর হতবাক হয়ে সব শুনছিলো যে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে যে তার বালিকা স্ত্রী জুঁই নয় সে দেবী দুর্গার রূপ চন্ডিকা । রোদ্দুর পায়ে পড়তে যায় দেবীর , দেবী সরে দাঁড়ান , রোদ্দুর কে বলেন ,' আমি তোমার প্রণাম স্বীকার করতে পারিনা যতক্ষণ আমি তোমার স্ত্রীর শরীরে বাস করছি ' । রোদ্দুর সাহস সঞ্চয় করে বলে হে দেবী আপনি জানেন না এখানে কি ঘটছে , আপনার সাহায্য প্রাথনা করি । দেবী স্মিত হেসে বলেন আমি সব জানি , জানে না তোমার স্ত্রী । আমাকে তার মধ্যে জাগ্রত করে তুলতে হবে তোমাকে , তার জন্য কিছু বিধি পালন করতে হবে আগামী অমাবস্যাতে । রোদ্দুর বলে তার মানে দেবী আগামী অমাবস্যা তেই আরো কাউকে প্রাণ দিতেই হবে পিশাচের হাতে ? দেবী বললেন ' না আর কাউকে মারতে পারবে না ওই নিকৃষ্ট পিশাচ , ওর নাম রক্তবীজ হলেও আর ও আমার দ্বারা বধিত রক্তবীজের প্রতিচ্ছবি মাত্র সে । তার মধ্যে সেই শক্তি নেই যা পূর্বের রক্তবীজের মধ্য ছিল । এ একপ্রকার পিশাচ মাত্র , ও ভাবছে আরো দুটো বলি পেলেই ও আমাকে হারাতে পারবে , বেশ সেই ধারণা নিয়েই ও থাকুক না হয় । ' এই পর্যন্ত বলেই জুঁইয়ের মধ্য বাস করা দেবী সত্বা অদৃশ্য হলেন , জুঁই কাটা কলা গাছের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়লো । 


   ধড়মড় করে উঠলো রোদ্দুর , ও তা হলে সে এতক্ষণ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গিয়েছিল তার পর এই স্বপ্ন । আরামকেদারা থেকে উঠে কিসে যেন পা ঠিকল , একি এ তো জুঁই ! মাটিতে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে আছে । তার মানে যা রোদ্দুর এতক্ষণ দেখেছিল সব সত্যি , জুঁই এইখানে চন্ডিকা হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়েই তো ছিল । ওকে তুলে নিয়ে শুইয়ে দেয় রোদ্দুর , তার পর ড্রয়ার থেকে বের করে কিছুদিন আগেই কেনা কিছু ঘুমের বড়ি । বিয়ের পর পর মানসিক চাপ থেকে রাত রাত ঘুম আসতো না । তখনই রোদ্দুর এই বিদেশি ঘুমের ওষুধ গুলো কিনে এনে ছিল তার কিছু এখনো পড়ে ছিল । একখিলি মিঠা পান সেজে তাতে বড়ি গুলো গুঁড়ি করে মিশিয়ে নিলো সে । জমিদার বাড়ির জমিদারী মেজাজ সব ঘরে ঘরে পানের বাটা , রোদ্দুর পান না খেলেও আজ খুব কাজে লাগলো এই পান । রাত সাড়ে বারোটা রোদ্দুর মিতার ঘরের দরজাতে কড়া নাড়লো , কিছুক্ষণ পর মিতা দরজা খুলে সামনে তার আকাঙ্খিত পুরুষকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে । রোদ্দুর ঘরে ঢুকে আসে আর মিতার সাথে নানাবিধ প্রেমের গল্প করতে থাকে । তার পর মিতার মুখে নিজের হাতে তৈরি করে আনা পানটা ভরে দেয় সে । মিতাও আনন্দে মেতে সেটা খেয়েই নেয় তার পর ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে যায় । রোদ্দুর মিতাকে পালঙ্কে শুয়ে দিয়ে তার আঁচল থেকে চাবির গোছাটা খুলে নেয় । তার পর সেখান থেকে সেই মরচে পরা চাবিটা খুলে নিয়ে বেরিয়ে আসে মিতার ঘর থেকে । গুপ্ত কক্ষের কাছে পৌঁছে রোদ্দুর উলঙ্গ হয়ে যায় আর সাথে করে আনা দূর্গা পুজোর নবমীর হোমের ছাই নিজের সারা শরীরে মলে নেয় । তার পর ধীরে ধীরে কক্ষে প্রবেশ করে , ভয়কে জয় করতেই হবে , সে পড়েছে হোমের ছাই উলঙ্গ অবস্থায় মেখে নিলে তাকে কোন অপদেবতা বা পিশাচ দেখতে পাবে না । নিজের হৃদপিণ্ডের চলার আওয়াজ ও পাচ্ছে সে , সারা শরীর ঘামছে । ঘামের ফলে ভস্ম শরীর থেকে গলে গেলে তাকে পিশাচ দেখে ফেলবে তাই নিজেকে শান্ত রাখতে ইস্টদেব রাধামাধবের নাম জপতে শুরু করলো মনে মনে । পিশাচের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে খুব ভালো করে নিরীক্ষন করতে লাগলো রোদ্দুর , পিশাচ কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে । হটাৎ চোখে পড়লো দেওয়ালে কিছু একটা লেখা আছে , এগিয়ে যায় সে খুব ঝাপসা হয়ে যাওয়া একটা সংস্কৃত লেখা । একমনে পড়ে ফেলে পুরোটা , এই তো সেই সুত্র যার মাধ্যমে সে সংহার করবে এই পিশাচ শক্তিকে । এখানে স্পষ্ট ভাবে লেখা আছে কি ভাবে পিশাচকে জাগাতে হবে আর প্রয়োজনে তার সংহার কি ভাবে করতে হবে । লেখার নীচে ঋষি তমগ্ন বলে কারো নাম লেখা আছে , অর্থাৎ মিতার দাদামসাই না এই তথ্যে দিয়েছেন ওই ঋষি । তাকে এত বছর পর আর নিশ্চই খুঁজে পাওয়া যাবে না , তিনি নিশ্চিত এত দিনে দেহ রেখেছেন । যা যা উনি বলে গেছেন তা পালন করেই দেখা যাক , দেবীর আদেশের পর এই আচমকা পাওয়া সূত্র রোদ্দুর ঠিক পথেই যাচ্ছে । এবার ফিরে যেতে হবে , সে কক্ষ টি আবার বন্ধ করে , বাইরে রাখা জামাকাপড় পড়ে নেয় , তার পর উপরে উঠে চাবিটা অচেতন মিতার চাবির গোছে ফেরত রেখে নিজের ঘরে ফিরে আসে । সকাল সকাল আবার রোদ্দুর বেরিয়ে যায় গ্রামের বাইরে এক প্রাচীন মন্দিরে র দিকে । সেখানে থাকেন এক পাগলা সাধু , কেন জানেনা রোদ্দুরের মন বলছে ওই বুড়ো কিছু বলতে পারবে , আসলে সে এখন পুরোটাই মনের সংকেত অনুসারে চলছে । জুঁইয়ের মধ্য এখনো কোন পরিবর্তন নেই , পুরোটাই রোদ্দুরকে দেখতে হচ্ছে হাতে আর দু দিন আছে তার পরই অমাবস্যা । 


ওই মন্দিরে পৌঁছে রোদ্দুর দেখে সেই সাধু বসে বসে কিছু খাচ্ছেন , সামনে এগিয়ে বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে আসে তার । রোদ্দুর পিছিয়ে আসে ঘেন্নায় , সেই সাধু বসে বসে কুকুরের বিষ্ঠা ভক্ষণ করছিলেন তৃপ্তির সাথে । এ সত্যি পাগল , তার এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে , এই ভেবে রোদ্দুর ফিরেই যাচ্ছিল তখনই সেই সাধু বিকট চিৎকার করে উঠলেন , কোথায় যাচ্ছিস রে বেটা ? ভয় পেয়ে যায় রোদ্দুর তবু দাঁড়িয়ে যায় । সাধু এগিয়ে আসে তার দিকে জটাজুট ধারী কৌপিন পরিহিত অবস্থায় থাকা এই আধি ভৌতিক মানুষটার বয়সের আন্দাজ করা সম্ভব নয় তবু একশো র কাছাকাছি তো হবেই । ফোকলা দাঁতে হেসে সাধু বললেন , ' যে কাজে এসেছিস সেটা না করেই ফিরে যাবি নাকি রে ? ' । রোদ্দুর দূরত্ব রেখেই প্রণাম জানায় সাধুকে , তার পর গত কালের সেই দেওয়ালে লেখা সাধু 

তমগ্নর নাম বলে , সে জিজ্ঞাসা করে বাবা আপনি কিছু জানেন এই ঋষির ব্যাপারে ? সাধু নাম শুনেই প্রণামের ভঙ্গিতে কি সব বির বির করে বলে তার পর যা যা বলে সেই সব শুনে রোদ্দুরের সামনে সব পরিষ্কার হয়ে যায় ।     

সাধু র সাথে সেই পুরোন জরাজীর্ণ মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করে রোদ্দুর , একটা কালী মূর্তি তার পাশেই শিব লিঙ্গ । সাধু শিব লিঙ্গের পাশে বসলো আর রোদ্দুরকেও ইশারায় বসতে বললো , রোদ্দুরের বসার পর তিনি করজোড়ে মুদিত নয়নে বির বির করে বলতে শুরু করলেন -----  

নমঃ শিবায় শান্তায় কারুণাত্রায়

হেতবে নিবেদিতামি চাত্মানং ত্বং গত্বিং পরমেশ্বর॥

এর সরলার্থ হলো বেটা :

তিন কারণের (সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশের)

হেতু শান্ত শিবকে প্রণাম ।

হে পরমেশ্বর তুমিই পরমগতি ।

তোমার কাছে নিজেকে সমর্পণ করি ।

"তস্মৈ নমঃ পরমকারণ কারণায় দীপ্তোজ্জ্বলজ্জ

্বলিত পিঙ্গললোচনায়!

নাগেন্দ্রহাররকৃত কুন্ডলভূষণায় ব্রহ্মেন্দ্রবিষ্ণু বরদায় নমঃ শিবায়!!" অর্থাৎ

---যিনি কারণের পরম কারণ, যাঁর অতি উজ্জ্বল দেদীপ্যমান পিঙ্গল নয়ন, কুন্ডলীকৃত সর্পরাজের হার যাঁর কন্ঠভূষণ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং ইন্দ্রাদি দেবতাকে যিনি বর প্রদান করেন, সেই পরম শিবকে আমার প্রনাম!!"

আমি হলাম তোমার খোঁজ করা সেই ঋষি , আসলে আমিই সেই জমিদার শঙ্কর নারায়ণ , মিতার দাদামসাই । রোদ্দুর অবাক , সে ঠিক শুনছে তো ? সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । সাধু তার মনের ভাব বুঝে বলেন কি ভাবছো আমি কি করে জমিদার শঙ্কর নারায়ণ হই তাই না ? সে তো কবেই মরে গেছে । এ কাহিনী যত গভীর ততই রহস্যময় , আমার পুত্র যে কিছুদিন আগেই স্বর্গত হয়েছে সেও জানতো তার পিতা এক সন্তান ছিল বাবা মার , এই বলে ধুতি দিয়ে চোখের জল মুছে নিলেন উনি । রোদ্দুর কৌতূহল চাপতে পারছে না , সে বলেই ফেলে আপনি কি করে জানলেন জমিদার বাবু আর নেই , এই কথা মিতা আর আমি ছাড়া আর তো কেউ জানে না ? হো হো করে হেসে উঠল সাধু , তার পর দম নিয়ে বললেন সব জানি বেটা আমি সব জানি । আমি সমাজের জন্য বাবা মার একমাত্র পুত্র ছিলাম কিন্তু তা সত্যি না , আমার এক যমজ ভাই ছিল হুবুহু আমার মতই দেখতে । সে অন্ধ ছিল বলে পিতা তাকে বরাবরই লোক চক্ষুর অন্তরালে ওই জমিদার বাড়ির নিচের কুঠুরিতে রেখেছিলেন । ক্রোধ তার মধ্যে অশুভ ভাবনার জন্ম দেয় , সে ক্রমে এক নিকৃষ্ট তান্ত্রিকে পরিণত হয় তার পর , তখন আমি বিবাহিত , জমিদারি সামলাচ্ছি । একদিন সে তন্ত্রচার করে আমাকে নিশির দ্বারা নিজের ডেরা পর্যন্ত নিয়ে আসে । এর আগে আমি তার অস্তিত্ব সমন্ধে জানতাম না । হটাৎ মোহ ভঙ্গ হওয়ায় তাকে সামনে পাই । জানতে চাই সে কে ? কি তার পরিচয় ? তার পর সে নিজের পরিচয় দেয় আমাকে , সত্যি বলছি আমি খুব আনন্দ পেয়েছিলাম নিজের সহধর কে পেয়ে কিন্তু সে আমাকে তার পিশাচ ডেরায় নিয়ে এসেছিল অন্য উদ্দেশ্য । পিশাচ সাধনা করে সে নিজের দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিল । সে এবার আমার জীবনটা বাঁচতে চাইছিল , আমার পরিচয় কে নিজের করতে চাইছিল তাই আমাকে সে ওই গুপ্ত প্রকোষ্ঠে বন্দি করে আমার রূপ ধারণ করে সেদিন উপরে উঠে যায় । তার পর দীর্ঘদিন সে ওই ভাবেই আমার স্ত্রী , সন্তানের সাথে দিন কাটিয়ে সে পরলোক গমন করে । মাঝে মাঝে সে ওই কুঠুরির মধ্য আসতো আমাকে কিছুদিনের খাবার জল দিয়ে যেত । প্রতি অমাবস্যা আর পূর্ণিমাতে সে মহিষ , ছাগ বলি দিত পিশাচের উদেশ্য । তবে মিতা যা পেরেছে আমার ভাই তা পারেনি , মিতা পিশাচকে তার রূপে ফিরিয়ে এনেছে নিজের শরীরের বিনিময়ে , আমার ভাই পিশাচ সাধনা করে কিছু মায়া বিদ্যা আর নিজের দৃষ্টি শক্তি ছাড়া আর কিছুই পায়নি । সে পিশাচকে তার নিজস্ব রূপে আনতে পারেনি আর হয়ত আনতে ও চায়নি । সে চেয়েছিল সমাজে আমার স্থান যেটা পেয়ে ও পিশাচের জন্য আর কিছু করেনি , ওখানেই সে বন্ধ করেছিল তন্ত্রচার । ওই বলী টুকু সে দিত পরে বয়সের ভারে সেও বন্ধ করে দেয় সে । ওই কুঠুরিতে আমি প্রায় চব্বিশ বছর ধরে আটকে ছিলাম । খাবার , পানীয় জল কখনো মিলত কখনো মিলতো না । নিজেকে ধীরে ধীরে আদিদেব মহাদেবের পায়ে সপে দি । দীর্ঘ ধ্যান , সাধনা কৃচ্ছ সাধনের ফলে আমি বিপুল শক্তি অর্জন করি । এই পিশাচ সম্পর্কে জানি , তাকে জাগানোর ও তাকে ধ্বংস করার উপায় আমি নিজের রক্ত দিয়ে ওই ঘরের দেয়ালে লিখে রাখি । আমি জানতাম ভবিষ্যতে এ বংশের কেউ না কেউ পিশাচের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবেই তার পর তাকে থামাতে নিশ্চই দেবী চন্ডিকা র আগমন হবে । সেই মনুষ্য শরীর যাতে বাস করেন মা নিজে তাকে কি ভাবে জাগাতে হবে কি করে , কোন তিথিতে রক্তবীজের সংহার করতে হবে তাও আমি লিখে রাখি । তার পর একদিন আমার ভাই যখন আমাকে খাবার দিতে আসে ওর মুখে শুনি আমার স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে সেদিন , আর নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি ওকে ঠিলে ফেলে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে পালাই আমি । জমিদার বাড়ির বাইরে চলে আসি সোজা কারণ ওখানে দাঁড়ালে ভাই আমাকে আবার বন্দি করবে । লুকিয়ে লুকিয়ে চারদিকে দেখি আমার স্ত্রীকে সৎকার করে ছেলে ফিরেছে । ওকে প্রাণ ভরে দেখে গ্রাম ছেড়ে চলে যাই । ভাই আমায় ধরতে পারে না , আমি ঘুরতে ঘুরতে কাশি চলে যাই । ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমার ছেলে একবার কাশী গিয়েছিল , দূর থেকে মনিকর্নিকা ঘাটে ওকে দেখেই চিনতে পারি । খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ভাই গত হয়েছে তার অস্থি দিতে আমার ছেলে কাশী এসেছে । পথ পরিস্কার তাই এবার ফিরে এলাম নিজের গ্রামে , এই ভাঙা মন্দিরে এসে ডেরা নিলাম । তার পর থেকেই এখানে আছি আর সব নজর রেখে চলেছি । আমি এখন ঋষি তমগ্ন , মিতার আসল দাদামসাই । রোদ্দুরের মাথা ভো ভো করছে তবু সে বলল , আপনি বলুন কি করে জুঁইএর মধ্য আমি মা চন্ডিকা কে জাগাবো ? সাধু বললেন , জুঁই মা কে তুমি আজ মধ্য রাত্রে শুদ্ধ বস্ত্রে এই মন্দিরে আনবে তার পর আমি ব্যবস্থা করছি । রোদ্দুর ফিরে আসে জমিদার বাড়ি তার পর জুঁইকে বলে আজ রাতে তারা জুঁইয়ের বাপের বাড়ি তে থাকবে ওখানেই খাবে । কারণ ওদের কলকাতা যাবার সময় হয়ে এসেছে আর এর মধ্য একরাত ও শশুড় বাড়িতে কাটানো হয়নি তো এই নিয়ম রক্ষা টা আজই করে নেবে । জুঁই তার মা নীরুপমাকে সবটা বললে সে নিজে এসে সাদরে মেয়ে জামাইকে নিয়ে যায় নিজের কাছে । রোদ্দুর তার শাশুড়িকে সবটা খুলে বলে , নীরুপমা সব শুনে বলেন , এই জন্যই জুঁই কোন শাস্ত্র না পরেই এত জ্ঞানের অধিকারিণী । তিনি সাহায্য করবেন বলে কথা দেন , তার পর রোদ্দুর রাতে চুপিচুপি নীরুপমা র সাহায্য শুদ্ধ বস্ত্র পরিয়ে ঘুমন্ত জুঁইকে গ্রামের বাইরে সেই মন্দিরে নিয়ে যায় । রোদ্দুর জানত জমিদার বাড়ি থেকে রাতে এভাবে বেরোনো সহজ হতো না , মিতা দেখে ফেললে সন্দেহ করত ওকে ।

জুঁইকে নিয়ে গিয়ে মন্দিরে শুইয়ে দিয়ে সাধু বাবাকে রোদ্দুর বলে সে তৈরি এবার উনি পথ চলতে সাহায্য করুন । জুঁইকে একটা রক্ত জবার মালা পরিয়ে দেয় সাধুবাবা , তার পর মায়ের মূর্তির হাতের খাঁড়াটা জুঁইয়ের হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দেন । হোমের আগুন জ্বালিয়ে মন্ত্র পাঠ আরম্ভ করেন ।

ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে

ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চ       


কিছুক্ষণ হোম করার পর সাধু উঠে এলেন । দুধ , দই , মধু , গঙ্গা জল যা রোদ্দুর সাধুর আদেশ মত আগেই জোগাড় করে এনে ছিল সেগুলো সাধু মিশিয়ে জুঁইয়ের মুখে ছুঁইয়ে দিলেন । অচৈতন্য জুঁইকে সাধু বাবা পায়ে আলতা পরিয়ে দিলেন , রোদ্দুরের হাতে তুলে দিলেন মায়ের পায়ের মেটে সিঁদুর , রোদ্দুর কাঁপা হাতে তা জুঁইয়ের সিঁথি তে ঢেলে দিল । তার পর জুঁইকে প্রণাম করে জলদগম্ভীর স্বরে মন্ত্রচারণ করতে শুরু করলেন ,

যা দেবী সৰ্ব্বভুতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে ! নমস্তস্তৈ সমস্তস্তৈ নমস্তস্তৈ নমোনমঃ ॥ যা দেবী সৰ্ব্বভুতেষু বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিত। নমস্তস্তৈ নমস্তস্তৈ নমস্তস্তৈ নমোনমঃ ॥ যা দেবী সৰ্ব্বভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিত । নমস্তস্তৈ নমস্তস্তৈ নমস্তস্তৈ নমোনমঃ ॥ যা দেবী সৰ্ব্বভুতেষু ক্ষুধারূপেণ সংস্থিত । নমস্তস্তৈ নমস্তহৈ নমস্তস্তৈ নমোনমঃ ॥ যা দেবী সর্বভুতেষু ছায়ারূপেণ সংস্থিতা ! নমস্তস্তৈ নমস্তস্তৈ নমস্তস্মৈ নমোনমঃ ॥ যা দেবী সৰ্ব্বভুতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা ! নমস্তস্তৈ নমস্তস্তৈ নমস্তহৈ নমোনমঃ ॥


মন্ত্রচারণের সাথে সাথে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বাজ পড়তে শুরু করে , শন শন করে তীব্র হিমেল বাতাস সারা শরীরে কাঁটা ফুটিয়ে যাচ্ছে এমন সময়

জুঁই উঠে বসলো । লাল পেরে সাদা শাড়ি , পায়ে আলতা , হাতে শাখা পলা , মাথা ভর্তি মেটে সিঁদুর , হাতে ধরা খাঁড়া । স্মিত হেসে উঠল জুঁইয়ের মধ্যেই বাস করা দেবী তার পর আবার জ্ঞান হারিয়ে পরে গেল জুঁই । রোদ্দুর ভয় পেয়ে যায় , সাধু জানান কাজ হয়ে গেছে , জুঁইয়ের ভিতরের দেবী সত্বা জাগ্রত হয়ে গেছে । এখন একে বাড়ি নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেবে । কেউ যেন এর সংস্পর্শে না আসে , দেবী চন্ডিকা খুব ক্রোধান্বিতা দেবী তিনি কাল রাতে অমাবস্যা লাগার আগে পর্যন্ত যেন ঘর ছেড়ে না বেরোতে পারে , মিতা যদি দেবীর সামনে আসে তা হলে তার ফল খুবই খারাপ হবে । মিতাকেই শেষ করে দেবেন দেবী , এই বলে হাঁফাতে লাগলেন সাধু আর ইশারায় রোদ্দুরকে ফিরে যেতে বললেন । রোদ্দুর জুঁইকে নিয়ে নীরুপমার বাড়ি ফিরে এসে একটা ঘরে বন্ধ করে রাখলো । তার পর সকালে ইচ্ছা করেই জমিদার বাড়ি পৌছালো , সেখানে গিয়ে একবার নজরদারি করাই তার উদ্দেশ্য ছিল । সেখানে পৌঁছে সে দেখে কলের গাড়িটা ভদ্রাসনের পাশেই দাঁড়িয়ে সেখানেই বাবুলাল দাঁড়িয়ে । রোদ্দুর ওকে জ্যান্ত আছে দেখে খুশি হয়ে এগিয়েই যাচ্ছিল ওর দিকে তখনই ও দেখলো মিতা ওর জন্য আর এক গর্ত খুঁড়ে রেখেছে ততক্ষণে । রোদ্দুরের এত দিন মনে হয়েছিল কলের গাড়িটা আর চালকটিকে মিতা গুম করে দিয়েছে এই দেখাতে যে ওতে করে জমিদার বাবু কলকাতা গেছেন , যা আদতে উনি যাননি । কিন্তু এখানেই বুদ্ধির দৌড়ে পারমিতার কাছে রবিকান্ত ওরফে রোদ্দুর হেরে গেছে । ও ভাবতে পারেনি নিজের জয় সুনিশ্চিত করতে মিতা এত দূর ভেবে রেখেছে । ওই গাড়িটি বা চালককে সে গুম করেনি , সত্যি সে ওই গাড়ি পাঠিয়ে ছিল কলকাতা তবে তা রোদ্দুরের পিতা জনার্দন মুন্সিকে আনতে । পিতা হাসি মুখে তার দিকে এগিয়ে আসছেন , পিতাকে দেখে আনন্দ প্রকাশ করতে চাইলেও মন তা প্রকাশ করতে পারছে না । সে জানে মিতা এর আগেই চিঠি বদলে দিয়েছিল এখনও পিতা বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানেন না । তিনি আজ এই অমাবস্যার দিন এখানে এসে পৌঁছেছেন মানে নয় মিতা রোদ্দুরের সব কর্মকান্ড সমন্ধে ওয়াকিবহল অথবা আজকের শিকার তার পিতা নিজে । রোদ্দুর মা চন্ডিকার স্মরণ করে তার পিতাকে প্রণাম করে জানিয়ে দিল সে বিবাহ করেছে এই জমিদার বাড়ির নায়েব মশাইয়ের নাতনি জুঁইকে । পিতা অবাক এবং আশাহত হয়ে রোদ্দুরকে প্রশ্ন করলেন 'তুমি এতটাই সাবালক হয়ে উঠেছ রোদ্দুর ! তুমি এত বড় একটা সিদ্ধান্ত এভাবে আমাকে না জিজ্ঞাসা করে নিলে ? তুমি জানো আমাদের পরিবার এক স্ত্রী পালনের রীতি পালন করে , সেই নিয়ম অনুযায়ী তোমাকে ওই ছোট ঘরের মেয়েকে নিয়েই ঘর করে যেতে হবে আ জীবনের জন্য ! তুমি এই মেয়েটির কথা একবারও ভেবে দেখলে না ? পারমিতাকে আমি তোমার জন্য বেছে ছিলাম আর তুমি ছি , আজ জমিদার বাবুর চিঠি সহ তার বাহক আমার বাড়ি থেকে আমাকে না আনলে হয়ত বহুদিন আমি এই সত্যি না জেনেই খুশি হতাম যে আমার ছেলে তার হবু স্ত্রী পারমিতা র সাথে সময় কাটাচ্ছে '। রোদ্দুর পিতার রাগের সামনে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর দেখে পিছনে মিতার ক্রুর হাসি । সে তবু জানায় যে সে বিয়ের বিষয়ে চিঠি লিখে জানিয়েছিল পিতাকে , যদিও সে জানতো চিঠির বদল হয়েছে । পিতা ততধিক রেগে বললেন চিঠি তিনি পেয়েছেন তবে তাতে লেখা ছিল সে (রোদ্দুর ) মিতার সাথে আরও কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরবে কলকাতা , সেখানে বিয়ের কোন কথাই লেখা ছিল না । রোদ্দুর সব জানে কিন্ত সে আজ সব দিক থেকে ফেঁসে গেছে , এদিকে আজ রাতে রক্তবীজ সংহার করতেই হবে আবার পিতাকে ও বাঁচাতে হবে । মিতা নিজের পিতার হাতের লেখা নকল করে ইচ্ছা করে ঠিক আজকে রোদ্দুরের পিতাকে এখানে এনেছে , এতে তার সাথে পিতার ঝামেলা হবে আর এই তালে মিতা নিজের কার্য্য সিদ্ধি করে নেবে । তবু কিছু একটা করতেই হবে , আজ পিতাকে জুঁইয়ের সামনে নিয়ে যাওয়া যাবে না সে এখন নিজের মধ্যেই নেই । এই অবস্থায় পিতা তাকে দেখলে মানসিক ভারসাম্য হীন বলে মনে করতে পারেন আবার মিতার সম্বন্ধে না জানলেও পিতার ক্ষতি হবে তা নিশ্চিত । পিতা জানেন না জমিদার বাবুই আর নেই উনি মৃত , মিতার সামনে কিছুই বলা সম্ভব নয় , তাই আপাতত সে পিতাকে সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে জমিদার বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল ।     

  

মিতা জলখাবার এর জোগাড় করতে গেলে রোদ্দুর তার পিতা জনার্দন বাবুর পায়ে পড়ে যায় , বিরক্ত হয়ে জনার্দন বাবু সরে যান এবং নিজের পুত্রকে আবার তিরস্কার করেন । রোদ্দুর হাতজোড় করে পিতার কাছে অনুরোধ করে উনি যেন দুই মিনিট সময় রোদ্দুরকে দেন কিছু কথা বলার জন্য । জনার্দন বাবু বিরক্ত হলেও বাধ্য হয়েই একপ্রকার রাজি হয়ে যান , রোদ্দুর ওনাকে সব বলে সংক্ষেপে এই সুযোগে । ঘটনা গুলি যা যা রোদ্দুর বলেছে তা নিতান্তই গাঁজাখুরি গল্প মনে হলেও নিজের সন্তানকে জনার্দন বাবু খুব ভালো করেই চেনেন , রোদ্দুর যে মিথ্যা বলবে না এই বিশ্বাস ওনার আছে । তা ছাড়া ঈশ্বর যখন আছেন শয়তানও নিশ্চই আছে আর নিজের একমাত্র পুত্রের এই সংকটের দিনে তিনি যদি বিশ্বাস না রাখেন রোদ্দুরের উপর তো কে রাখবে ? তবে জমিদার বাবুর এই পরিনতি জনার্দন বাবুর মনে গভীর কষ্ট ও শোকের সৃস্টি করে । উনি কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিলেন এমন সময় মিতা লুচি , ছানার ডালনা , মিষ্টি ইত্যাদি নিজের হাতে করে নিয়ে উপস্থিত হওয়াতে বিচক্ষণ জনার্দনবাবু চুপ করে যান । মিতা যত্ন করে ওনাকে খেতে বসান , শ্বেত পাথরের টেবিলে থরে থরে সে সাজিয়ে পরিবেশন করে নানা ধরনের খাবার । ইচ্ছা না থাকলেও জনার্দন বাবু খেতে বসেন , একটুকরা লুচি ও ডালনার সাথে উনি তুলেই ছিলেন এমন সময় হঠাৎ ওনার মনে পড়ে যায় রোদ্দুরের বলা কথা গুলো , কি ভাবে এই মিতা জমিদার বাবুকে বলী দিয়েছিল । হর হর করে বমি করে ফেলেন উনি ঘৃণায় , রোদ্দুর বুঝে যায় কি কারণে তার পিতার এই অবস্থা সে ছুটে গিয়ে জনার্দন বাবুকে ধরে সামলায় । মিতা ভাবে হয়ত উনি এত দূর আসার কারণের অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সে ওনাকে বিশ্রাম নিতে বলে বেরিয়ে আসে । এদিকে নীরুপমা খবর পেয়ে গেছন কলকাতা থেকে বেয়াই এসেছেন , এদিকে জুঁইয়ের মধ্য দেবী সত্বা জাগরিত হয়ে গেছে তাকে ঘরে বন্ধ করে রাখা আছে এখন তার আচরণ স্বাভাবিক নয় । যতক্ষণ দেবী পিশাচ দমন না করছেন ততক্ষণ জুঁইএর শরীর ছেড়ে তিনি যাবেন না । জুঁই ঘরে বন্ধ অবস্থাতেই যোগমুদ্রায় লীন হয়ে আছে । অন্যদিকে নিজের ঘরে বসে মিতা তার বুদ্ধির তারিফ করে চলেছে । কি চালটাই না সে দিলো , সারা গ্রামে মানুষ অপহরণ হওয়াতে মানুষ সাবধান হয়ে গিয়েছিল তাই আগের বার সে নিজের পিতাকেই বলী দিয়ে দেয় তার পর রটিয়ে দেয় জমিদার বাবু কলকাতা গেছেন কাজে । ফলে সেবার কেউ অপহত না হওয়াতে গ্রামবাসীরা নিশ্চিন্ত হয় । আজ ও একটা বলী দরকার আর এবার মিতা বেছে নিয়েছে জনার্দন মুন্সিকে , তাই সে কলের গাড়ি করে বাহক বাবুলাল কে কলকাতা পাঠিয়ে দেয় সাথে জমিদার বাবুর সিলমোহর দেওয়া একটা চিঠি যাতে সে জনার্দন বাবুকে বাবুলালের সাথে আসার অনুরোধ করা ছিল । মিতার আজ একটা বলী চাই আর গ্রামের কাউকে তুললে আবার গ্রামে পাহাড়া শুরু হবে এতে আগামী ও শেষ বলীতে অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে । এমনিতেই জনার্দন বাবু তার পথের কাঁটা , উনি বেঁচে থাকলে উনি ঠিক জানতে পারতেন জুঁইয়ের সাথে রোদ্দুরের বিয়ে হয়ে ছিল তার পর ওই এক বিবাহের প্রথা মেনে উনি জুঁইয়ের মৃত্যুর পরও রোদ্দুরের সাথে মিতার বিয়ে কখনোই দিতেন না । তাই ভালোই হলো আজ উনি এলেন রোদ্দুরকে অপমান করলেন তার পর রাতে ওনাকে তুলে নিয়ে গিয়ে মিতা পিশাচের হাতে তুলে দেবে , আর সকালে বলে দেবে জনার্দন বাবু রোদ্দুরের উপর রাগ করে তাকে ত্যাজ্য করে চলে গেছেন । রোদ্দুর এতে অপমানিত হবে , সে আর কলকাতা ফিরে যাবে না পিতার খোঁজ ও নেবে না তার পর আগামী পূর্ণিমাতে আর একটা বলী দিয়ে রক্তবীজকে দিয়ে মিতা জুঁইকে শেষ করে দেবে , পরে একা হয়ে যাওয়া রোদ্দুরের আর কেই বা থাকবে পারমিতা ছাড়া ? এই পর্যন্ত ভেবেই বিচ্ছিরি ভাবে হেসে উঠলো মিতা । রোদ্দুর তার পিতাকে সামলায় তার পর সে ওনাকে অনুরোধ করেন জুঁইকে একবার হলেও দেখে আসতে , যদিও তার সামনে আজ যাওয়া যাবে না । জনার্দন বাবুর মনে নিজের বৌমাকে দেখার ইচ্ছা থাকলেও লজ্জায় এতক্ষণ নিজে থেকে উনি আগ্রহ প্রকাশ করতে পারছিলেন না এবার সুযোগ পেয়েই তিনি ছুটলেন ওনার বৌমা দেখতে । নীরুপমা বেয়াই মশাই কে আসতে দেখে কুণ্ঠায় লজ্জ্বায় ওনাকে আপ্যায়ন করতেই ভুলে গেল , তখন তার মনের ভাব বুঝতে পেরে যেচেই জনার্দন বাবু বললেন কি বেয়ান চা খাবো তো ? এবার সঙ্কোচ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি নীরুপমা এগিয়ে এসে ওদের বসায় , চা জল খাওয়া হয় কিছু গল্পও হয় তার পর জনার্দন বাবু নিজের বৌমাকে দেখতে চান । সামনা সামনি যাওয়া সম্ভব নয় তাই জানালা দিয়েই জুঁইকে দেখেন উনি ।


যোগমুদ্রায় লীন জুঁইকে দেখে অজান্তেই ওনার দুই হাত জোড় হয়ে যায় । ওনাকে প্রণাম করতে দেখে নীরুপমা বলে ও কি বেয়াই মশাই জুঁই যে আপনার পুত্র বধূ আপনি না ও আপনাকে প্রণাম করবে । জনার্দন বাবু বলেন , এ জন্মে কিছু ভাল কাজ করেছিলাম কি ? হয়ত করেছি না হলে মা আমার সামনে আজ , ওনাকে প্রণাম করবো না ? জুঁই মায়ের মধ্য জগৎ মাতা বাস করছেন ওর শরীরটাই যে মন্দির । আমাকে বেয়ান বাধা দেবেন না , মা কে তার ছেলে প্রণাম করছে । মা চন্ডী ও আমার মা আর আমার বৌমা জুঁই মাও আমার মা আমি যে ওর অধম ছেলে । তার পর রোদ্দুরের হাত দুটো ধরে জনার্দন বাবু ক্ষমা চান ওনার সকালের কথা গুলো জন্য । সন্ধ্যা আগত তাই ওরা ফিরে আসে জমিদার বাড়ি , বড় যুদ্ধে নামতে হবে কয়েক প্রহর পরেই ।জনার্দন বাবু আর রোদ্দুর যখন জমিদার বাড়ির ভদ্রাসনের মধ্য প্রবেশ করেন তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে , ওরা দেখলো পারমিতা এক কালো শাড়ি পরে সারা বাড়িতে ধুনোর ধোঁয়া দিচ্ছিল । জনার্দন বাবু মুখ ফসকে বলেই ফেলেছিল কালো কাপড়ে কি কেউ সন্ধ্যা প্রদীপ দেয় ? রোদ্দুর ওনাকে ইশারা করে কিছু বলতে মানা করে দেয় । তার পর রাত গড়িয়ে আসে , রাতের খাবার খাওয়া হয়ে গেলে সবাই ঘরে শুতে চলে যায় , রোদ্দুরের সাথে তার ঘরেই জনার্দন বাবু শুতে যাচ্ছিলেন এমন সময় মিতা এসে অনুযোগ করে বলে , বাবামসাই আপনি রোদ্দুরের সাথে কেন থাকবেন ? আপনার তো রাতে বরাবর একা শোয়ার অভ্যাস । আপনি আমার বাবার ঘরেই আজ শুয়ে পড়ুন । জনার্দন বাবু রোদ্দুরের দিকে তাকান আর ইশারাতে তার সম্মতি পেয়ে মিতার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান । রোদ্দুর জানতো মিতার উদ্দেশ্য কি , সে কেন তার পিতাকে জমিদার বাবুর ঘরে রাখতে চাইছেন । ওকে পরাজিত করতে হলে এখন সব ওর সুবিধা মত কাজ করতে হবে । ঠিক রাত বারোটা বাজলেই মিতা জনার্দন বাবুকে তুলে নিয়ে যাবে গুপ্ত কক্ষের মধ্য । তাই তার আগেই রোদ্দুর পরিকল্পনা মাফিক জুঁইকে ওই যোগমুদ্রায় থাকা অবস্থাতেই তুলে এনে জমিদার বাড়ির ভিতরে তার পর নিজের ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে দেয় । মিতার দাদামসাই মানে ঋষি তমগ্নও চুপিচুপি পাহাড়া এড়িয়ে ওই গুপ্ত কক্ষের পাশেই এক কোন লুকিয়ে আছে । রোদ্দুরের একটাই ভয় মনে সেই গতকাল থেকে জুঁই জল পর্যন্ত স্পর্শ করেনি , অভুক্ত এই ছোট মেয়েটার শরীর থেকে দেবী যখন অনর্ধান করবেন তখন জুঁই সুস্থ থাকবে তো ? একবার ওর মাথায় হাত বুলাতে গিয়েও দাঁড়িয়ে যায় সে , মনে পড়ে যায় সাধু বাবার সতর্কতা ইনি ক্রোধান্বিতা দেবী । পিতার জন্য চিন্তা হচ্ছে তার , একটু এদিক ওদিক হলেই মৃত্যু হতে পারে পিতার । জনার্দন বাবুর উত্তেজনাতে ঘুম তো আসছেই না উপরন্তু ঘাম হচ্ছে । চুপ করে মটকা মেরে ঘুমের ভান করে পড়ে ছিলেন এমন সময় ক্যাঁচ করে দরজা খোলার আওয়াজ , জনার্দন বাবুর বুকের মধ্যে ধক ধক আওয়াজ মনে হচ্ছে সাড়া ঘরে প্রতিফলিত হচ্ছে । মিতা সেই কালো কাপড় পরে এসে দাঁড়ায় জনার্দন বাবুর বিছানার পাশে । রিন রিনে স্বরে মিতা বললো বাবামসাই চলুন আপনার সময় হয়ে গেছে । জনার্দন বাবু উঠে বসেন , দেখেন কালো শাড়ি পরে আছে মিতা দীর্ঘ খোলা চুল , সারা গায়ে রুপোর অলংকার । যেমন কোমর বিছে , ঝুমকো , মাথায় টিকলি , নাকে নথ , গলায় বড় রুপোর হার । সব জেনেও জনার্দন বাবু বলেন কি মিতা মা কিছু বলছো ? মিতা হেসে বলে বাবামসাই আপনি আমার সাথে চলুন , একজায়গায় যেতে হবে । জনার্দন বাবু আর প্রশ্ন না করে ওর সাথে বেরিয়ে আসে ঘরের বাইরে । ওরা ওই গুপ্ত কুঠুরির দিকে এগিয়ে যায় , মিতা ভাবে জনার্দন বাবু ওকে বিশ্বাস করেন আর ভালোবাসেন তাই ওর এক কথায় ওর সাথে চলে এসেছেন । যাক ভালোই হয়েছে ওনাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে আনতে কষ্টই হত । এদিকে রোদ্দুর জুঁইকে কোলে করে নিয়ে নেমে আসে মাটির গভীরে ওই গুপ্ত ঘরের বাইরে , ওখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছেন ঋষি তমগ্ন । জনার্দন বাবুকে ঘরে এনেই মিতা বলে বাবামসাই আপনি আমাকে একটু বেশি বিশ্বাস করে নিলেন না ! সামনে দেখুন আপনার জন্য কে অপেক্ষা করছে , আপনার মৃত্যু । জনার্দন বাবু সামনে তাকিয়ে দেখলেন আর তার পর ওনার হাত পা কাঁপতে লাগলো । সামনে দাঁড়িয়ে মূর্তিমান শয়তান , সাক্ষাৎ যম । রক্তবীজ এখন প্রায় সম্পূর্ণ , আজ আর আগামী পূর্ণিমা এই দুটো বলী ব্যাস কেউ আটকাতে পারবে না তাকে । জুঁই নামের কাঁটা আর পনেরো দিনের অতিথি কি মিতা রক্তবীজ বলে ওঠে , মিতা বলে প্রভু তা হলে ওনাকে আপনার পায়ে এবার সমর্পণ করি ? পিশাচ হেসে বলে আর দেরি কেন নাও তাড়াতাড়ি করো আমি অভুক্ত । আমার সারা শরীরের পুনর্গঠন হয়ে এসেছে এবার আমি প্রায় মুক্ত আমি কাল রাত থেকে আসে পাশের গ্রামে গিয়ে নিজের শিকার করবো । আমার শরীরের দুটি সিঙের মধ্য একটি শুধু অসমাপ্ত আছে যা আমাকে সম্পূর্ণ শক্তিশালী করবে ওটা হয়ে গেলেই আমি ঐ চন্ডিকা সংহার করবো । এই বলে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে পিশাচ হেসে উঠল , আর বলতে লাগলো কলি যুগে বলি হবে চন্ডী । মিতা এগিয়ে এসে মোটা রশি দিয়ে জনার্দন বাবুকে বাঁধতে যাবে এমন সময় সামনে এসে হাজির হয় রোদ্দুর , ঋষি তমগ্ন আর সজ্ঞানে চন্ডিকার রূপ জুঁই । ওদের দেখে মিতা অবাক হয়ে যায় , রক্তবীজ রাগে ছুটে এসে মিতাকে তুলে শূন্যে ছুড়ে ফেলে দেয় । দেওয়ালে আঘাত পেয়ে কঁকিয়ে ওঠে মিতা , পিশাচ হিসহিসিয়ে বলে ওঠে আমার সাথে এই বেইমানিটা তুই ছাড়া আর কেই বা করতে পারে ? মিতা সমানে বলতে থাকে আমি জানি না এরা কি করে এখানে এলো প্রভু । রক্তবীজ আগে চিৎকার করতে থাকে , ওই চিৎকার জমিদার মহলের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে । বাড়িতে বসবাস করা সব কাজের লোক শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে ওই চোরা কুঠুরি আবিস্কার করে কিন্তু ভয়ে ভিতর থেকে বন্ধ ওই কুঠুরির মধ্য প্রবেশ করার চেষ্টা না করে ওরা গ্রামের লোকজন জোর করে , সকলেই মশাল নিয়ে জমিদার বাড়ি ঘিরে ফেলে চারদিক থেকে । এদিকে কুঠুরির ভিতর পিশাচ মিতার উপর ভরসা না রেখে সোজা এগিয়ে যায় জুঁইয়ের দিকে তাকে হত্যা জন্য । জুঁই অট্টহাসি শুরু করে আর ওর ওই ছোট্ট শরীর সকলের সামনেই বড় হতে হতে বিশাল আকার ধারণ করে । ঋষি তমগ্ন সমানে দেবীর মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকে , ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে ,

         ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে ,

ভয়ে রোদ্দুর আর জনার্দন বাবু এককোনে দাঁড়িয়ে যায় আর দেবীর স্মরণ করতে থাকে । পিশাচ মিতাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াতে ওর পা দুটোই ভেঙে যায় তাই সে এগিয়ে আসতে না পারলেও ওখান থেকেই চিৎকার করে রক্তবীজকে জুঁইয়ের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে মানা করে , সে বার বার বলে পিশাচ দেব আজ আপনি আমাকে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যান , পরের পূর্ণিমাতে আমরা এদের দেখে নেব , আজ অমাবস্যা আজ কালীর দিন আপনার হার নিশ্চিত । পিশাচ মিতার কথা না শুনেই ঝাঁপিয়ে পড়তে যায় দেবীর দিকে দেবী জুঁইয়ের শরীরেই পরিবর্তন করেন নিজের রূপ তিনি এখন কালী রূপে পিশাচের সামনে দণ্ডায়মান তিনি রূপ ধারণ করলেন দক্ষিণাকালীর যিনি করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তার বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুগলে বর ও অভয় মুদ্রা। তার গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। তার গলায় মুণ্ডমালার হার; কর্ণে দুই ভয়ানক শবরূপী কর্ণাবতংস; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। তার দন্ত ভয়ানক; তার স্তনযুগল উন্নত; তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দণ্ডায়মান। তার দক্ষিণপদ শিবের বক্ষে স্থাপিত। তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী। ওনাকে দেখে জনার্দন বাবু আর রোদ্দুর মূর্ছা গেলে ঋষি তমগ্ন ওনার সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম জানিয়ে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে শুরু করে ːওঁ কালিকায়ৈ বিদ্মহে শ্মশানবাসিন্যৈ ধীমহি। তন্নো ঘোরে প্রচোদয়াৎ ওঁ।


পিশাচ তখন রাগে নিজের ভয়াল দাঁত দিয়ে এগিয়ে আসে আর ঋষির পেটে ঢুকিয়ে দেয় , ঋষির পেট ফালা ফালা হয়ে যায় আর নাড়ি ভুঁড়ি বেরিয়ে আসে , তবু নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত উনি দেবীর মন্ত্র জাপ করতে থাকেন । তার পর উনি মাটিতে পড়ে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন । দেবী প্রচন্ড রাগে রক্তবীজকে আঘাত করতে এগিয়ে আসে , রক্তবীজ নিজের একটি ধারালো সিং দিয়ে দেবীর দিকে এগিয়ে যায় দেবী পদাঘাত করে তাকে ভূপতিত করেন । তার পর নিজের দিব্য অস্ত্রের আঘাতে তার দুই সিং এর ঠিক মাঝখানে মাথার ওপর খড়্গ দিয়ে আঘাত করে । পিশাচের মাথা থেকে পুরো শরীর দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । তার পর ত্রিনয়নের দ্বারা তীব্র জ্যোতি নির্গত করে ওই দ্বিখন্ডিত শরীর পুড়িয়ে ছাই করে দেন । এভাবেই রক্তবীজ সংহার হয় , এসবের পর দেবী নিজের কার্য্যসিদ্ধি করেই অদৃশ্য হয়ে যান । ঘরে পরে থাকে অচেতন জুঁই , রোদ্দুর আর জনার্দন বাবু । এর মধ্যেই সাহস সঞ্চয় করে ঘরে ঢুকে পড়ে গ্রামবাসী দের দল তারা দেখে গ্রামের বাইরে সেই মন্দিরের সাধু মৃত অবস্থায় পড়ে সামনে অজস্র ছাই যা কিছু পোড়ানোর ফলে ওখানে পড়ে আছে । আর ঘরের এককোনে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে জুঁইয়ের সাথে তার স্বামী ও শশুর । আর তাদের দিকে বুক ঘষে ঘষে এগিয়ে আসছে জমিদার কন্যা মিতা তার হাতে চন্দ্রোহাস খাঁড়া । গ্রামবাসীরা মনে করে মিতাই সেই যে এত দিন ধরে মানুষ গুম করে , আর আজ কলকাতার এই লোক গুলোকে গুম করে এনে খুন করতে চাইছিল । ওরা সকলে মিতাকে ডাইনি ভাবে আর ওই বেদি যেখানে পিশাচ মূর্তি অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকত সেখানে তুলে নিয়ে গিয়ে বেঁধে ওর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় । চিৎকার করতে করতে প্রবল যন্ত্রণা নিয়ে পুড়ে ছাই হয়ে যায় পারমিতা নামক মানুষরূপী পিশাচিনি । সবাই জুঁই , রোদ্দুর আর জনার্দন বাবুকে তুলে নিয়ে বাইরে বের করে আনে । পরে ওদের জ্ঞান ফিরে এলে রোদ্দুরের মুখে গ্রামের লোকেরা সব শুনতে পায় , রোদ্দুর মিতার শেষ পরিণতি ও গ্রামের লোকেদের কাছে শুনতে পায় । ও তাদের জানায় , মিতার বাবামসাই বর্তমানে জমিদার বাবুর করুন পরিণতির কথা আর ওই মৃত ঋষিই হলেন জমিদার বাবুর পিতা পূর্বের জমিদার বাবু । ভোর বেলায় ওনার পার্থিব শরীরকে সম্মানের সাথে দাহ করা হয় । জুঁই এখন সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় , তাকে আর তার মা নীরুপমাকে নিয়ে রোদ্দুর আর তার পিতা জনার্দন বাবু রওনা দেন কলকাতার উদ্দেশ্যে । গ্রামের বাইরের ওই মন্দিরের সংস্কার করা হয় আর মায়ের মূর্তির সাথে ঋষি তমগ্নর ও এক প্রতিকৃতি বানিয়ে দেওয়া হয় ওনার স্মৃতি রক্ষার্থে । জমিদার বাড়ি পড়ে থাকে জনমানব হীন এক ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে । যুগে যুগে এই ভাবেই পিশাচদের আগমন ঘটে আর কোন না কোন ভালো মানুষের ভক্তির ডাকে মা নিজে আসেন সেই পিশাচের দমন করতে ।


গল্পের শেষ এখানেই









Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror