রায়না ও ডাইনীবুড়ি
রায়না ও ডাইনীবুড়ি
সে এক গহীন বনের ধারে ছোট্ট এক গ্ৰাম ছিল। সেই গ্ৰামে থাকতো ছোট্ট মেয়ে রায়না আর ওর বাবা। ওদের বাড়ির পাশেই একটা সুন্দর ঝিল ছিল। তার ধারে কত রকম নাম না জানা ফুলের গাছ। ঝিলের জলে রঙিন মাছ খেলে বেড়াত, কত পাখি উড়ে এসে গান শোনাত ওদের। ফুলের উপর উড়ে বেড়াত রঙিন প্রজাপতির ঝাঁক। তাই দেখে খুশি হত রায়না। ওদের সাথে খেলেই ওর দিন কাটত।
রায়নার বাবা ছিল খুব গরীব। বাবা রোজ বনে যেত কাঠ কাটতে, বনের থেকে ফল আনত, বাদাম আনত। কাঠ বিক্রি করে খাবার আনত।
রায়না আর ওর ছাগল ছানা কুর্চি বাড়িতে থাকত। আর ছিল রায়নার পোষা টিয়ে মিঠি আর হাঁস পেখম। এদের নিয়েই রায়নার সুখের সংসার ছিল। গরীব হলেও খুব খুশি ছিল রায়না ওদের নিয়ে ।
কিন্তু একদিন ওদের সুখের সংসারে দুঃখের মেঘ ঘনিয়ে এলো। সেদিন যখন আকাশ কালো করে ঝড় উঠল সব লোক বন থেকে পালিয়ে এলো কিন্তু রায়নার বাবা এলো না। ঝড়ের সাথে এলো বৃষ্টি।ছোট্ট রায়না কুর্চিকে জড়িয়ে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল। মিঠি আর পেখম ওর দু পাশে বসেছিল চুপ করে।
এক সময় সব দুর্যোগ কাটিয়ে নতুন দিন শুরু হল। কিন্তু রায়নার বাবা আর ফিরে এলো না।
কেঁদে কেঁদে কচি মেয়ের চোখ লাল হয়ে গেল। রঙিন মাছের ঝাঁক মনের দুঃখে গভীর জলে চলে গেলো। প্রজাপতি আর উড়ল না। পাখির দল গান গেতে এলো না। ফুলের পাপড়ি ঝরে গেলো সব। রায়নার কান্না থামল না।
মিঠি রায়নার দুঃখ দেখে বনের ভেতর উড়ে গেলো। আর বলে গেলো,
''বাবার খোঁজে যাচ্ছি উড়ে
গহীন বনের মাঝে,
ফিরবো তাকে সঙ্গে নিয়ে
সুয্যি ডোবার আগে।''
কিন্তু সুয্যি মামা ডুবে গেলো মিঠি ফিরল না। চাঁদ মামা বিদায় নিয়ে নতুন সূর্যের নরম আলো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। রায়নার মনে গভীর ব্যথা, ও হাসে না আর। তখন পেখম প্যাঁক প্যাঁক করে ডেকে বলল,
''চললেম আমি গহীন বনে
খুঁজতে ওদের তাই,
ফিরব ওদের সঙ্গে নিয়ে
চিন্তা কিছুই নাই।''
কিন্তু দিন শেষ হয়ে আরেকটা রাত নেমে এলো, পেখম ফিরল না। রায়না কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলো কুর্চির গায়ে।
পরদিন কুর্চি বলল সে বনে যাবে বাবা, মিঠি আর পেখমের খোঁজে। কুর্চিকে একা ছাড়তে মন চায়না রায়নার। সেও সঙ্গে যাবে বলল।
কুর্চির পিঠে চড়ে বনের পথে এগিয়ে চলল ও।
বনে ঢুকতেই দেখা হল কালো ভালুক ছানার সাথে। রায়না বলল,
''ভালুক ছানা ছোট্ট সোনা
কেমন আছো ভাই
বাবা,পেখম হারিয়ে গেছে
মিঠির খবর নাই।
ওদের খোঁজে বনের মাঝে
এলাম মোরা তাই,
দেখেছো কি ওদের তুমি
কোথায় খুঁজে পাই?''
ভালুক ছানা ভয়ে ভয়ে বলল,
''বনের মাঝে কাঠের ঘরে
ডাইনি বুড়ির বাস,
সেথায় সবাই আটকা আছে
ভীষণ সর্বনাশ।''
রায়না কুর্চিকে বলল সে যাবে ঐ ডাইনি-বুড়ির কাছে। সবাইকে ছাড়িয়ে আনবে।
গহীন বনের ফাঁকে মেঘ আর কুয়াশার জমাট বাঁধা অন্ধকার। সূর্যের আলো ঢোকে না। কুর্চি আর রায়না সে পথে এগিয়ে চলল। এবার দেখা হল সাদা হাতির ছানার সাথে। রায়না বলল,
''ছোট্ট সাদা হাতির রাজা
কেমন আছো ভাই?
ডাইনি-বুড়ির ঘরটি কোথায়
বলতে পারো তাই?''
হাতির ছানা শুঁড় দুলিয়ে বলল,
''গহীন বনে কাঠের ঘরে
ডাইনি বুড়ি থাকে,
ওদিকে যে যায়, ডাইনি-বুড়ি
আটকে তাকে রাখে।
খবরদার এগিয়ো না আর
দেখতে যদি পায়,
বন্দী হবে তোমরা দুজন
ফেরার যে পথ নাই।''
রায়না তবুও কুর্চিকে নিয়ে চলতে থাকল। এবার বন আরও গভীর হল, ওরা হলুদ বাঘের ছানাকে দেখত পেলো। রায়না বলল,
''হলদে পানা বাঘের ছানা
কেমন আছো ভাই?
ডাইনি-বুড়ির বাড়ি কোথায়
পথ খুঁজে না পাই।
বন্ধুরা মোর আটকে আছে
বাবার খবর নাই,
সেথায় গিয়ে সবাইকে যে
ছাড়িয়ে আনতে চাই।''
বাঘের ছানা ওর কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠল। বলল,
''ঐ যে দূরে বনের মাঝে
বুড়ো ছাতিম গাছ,
ওর পাশেতেই কাঠের ঘরে
ডাইনি বুড়ির বাস।
খবরদার যেও না তুমি
ওদিক পানে আর।
ডাইনি তোমায় দেখতে পেলেই
হবে সর্বনাশ।''
কিন্তু রায়না বারণ শুনল না। ও যে সবাইকে খুঁজতে এসেছে। এক দৌড়ে ও বুড়ো ছাতিম গাছের তলায় চলে এলো। কাঠের নড়বড়ে বাড়িটার দরজায় গিয়ে বলল,
''ও বুড়ি মা সোনা মা
দরজা একটু খোলো না।
আমি তোমার নাতনী হই
তোমার সঙ্গে থাকতে চাই।''
ডাইনি বুড়ি তো কচি গলা শুনে অবাক! ওর ভয়ে কেউ এদিক পানে আসে না। তবে শেষ তিনদিন বেশ কিছু খাবার পেয়েছে বলে মনটা খুশি ছিল। দরজা খুলেই দেখে একটা টুকটুকে মেয়ে আর বেশ নধর কচি ছাগল। ডাইনি বুড়ি ওদের ঘরে ঢুকিয়ে নেয়।ডাইনি-বুড়ির বাড়ির দরজাটা ভারি মজার। বুড়ি মন্ত্র না বললে খোলে না। কেউ পালাতে পারবে না।
ওদের একটু ফল আর দুধ খেতে দিল ডাইনি-বুড়ি। তারপর মনের আনন্দে খাঁচা থেকে টিয়া পাখিটাকে বার করে আনল। বলল,
"কি মজা কি মজা,
আজ খাবো পাখি ভাজা।"
মিঠিকে দেখে রায়নার বুক কেঁপে উঠল। ও বলল,
''ও বুড়ি-মা আমায় দাও। আমি রেঁধে দেই। তুমি বরং ঘুমাও।''
ডাইনি বুড়ি বেশ খুশি হল। মিঠিকে ওর হাতে দিয়ে ঘুমোতে চলে গেলো। রায়না চুপিচুপি মিঠিকে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উড়িয়ে দিল। আর ময়দা চিনি দুধ দিয়ে একটা টিয়া পাখি বানিয়ে ভেজে রাখল। বুড়ি তো সেই ময়দার পাখি ভাজা খেয়ে খুব খুশি। এমন মিষ্টি পাখি বুড়ি আগে খায়নি।
পরদিন বুড়ি খাঁচা থেকে হাঁস বের করে আনল খাবে বলে। পেখমকে দেখে চোখে জল এসে গেছিল রায়নার। ও তাড়াতাড়ি বলল,
''আমায় দাও বুড়ি মা। আমি রান্না করে দেই।''
বুড়ি ওর হাতে হাঁসটা দিয়ে মনের সুখে ঘুমাতে গেল। রায়না পেখমকে জানালা দিয়ে উড়িয়ে দিল। আর বুড়ির জন্য ডিম আর বেসন দিয়ে হাঁস বানিয়ে ভেজে রাখল। বুড়িতো এমন সুস্বাদু খাবার পেয়ে খুব খুশি। রায়নাকে অনেক আদর করল বুড়ি।
পরদিন বুড়ি রায়নার বাবাকে বার করে আনল খাঁচা থেকে। বাবাকে দেখে রায়না ফুঁপিয়ে উঠেছিল। অনেক কষ্টে কান্না চেপে বুড়িকে ঘুমাতে পাঠিয়ে ও বাবাকে বলল জানালা দিয়ে চলে যেতে। কিন্তু বাবা তো ওকে ছেড়ে কিছুতেই যাবে না। রায়না জোড় করে বাবাকে পাঠিয়ে দিল জানালা দিয়ে। বলল সে নিজেও বুদ্ধি করে পালিয়ে আসবে শিগগিরি। আর আলু সেদ্ধ করে চালের গুড়ো মিশিয়ে মানুষের মত বানিয়ে ভেজে রাখল বুড়ির জন্য।
বুড়ি এমন সুন্দর খাবার কখনো খায়নি। রায়নাকে কোলে নিয়ে নেচেই নিলো এক পাক সে।
পরদিন কুর্চিকে খাবে বলে বুড়ি ছাল ছাড়াতে বসেছিল। রায়না ছুটে এসে বলল,
''কর কি বুড়ি মা!! আমায় দাও। তুমি গিয়ে ঘুমাও।"
কুর্চিকে জানালার বাইরে ছেড়ে রায়না সুজি আর ডালিয়া গুলে নুন চিনি মিশিয়ে ভেজে রাখল। বুড়ি তো খেয়ে খুব খুশি। রায়নাকে বলল,
''রোজ তুই কত কি রান্না করিস আমার জন্য,আজ বল তোর কি চাই?"
রায়না বলল,
''আমি কতদিন বাইরে যাই না। আকাশ দেখি না। পাখি দেখি না, গাছ, ফুল দেখি না। আজ একটু ঘুরতে যেতে চাই। ফেরার পথে খাবার আনবো তোমায় জন্য।''
বুড়ি তো খুব খুশি। মেয়েটা তো ভারি মজার। ও তো নিজেই এসেছিল।তাই ওকে দরজা খুলে দিল বুড়ি। রায়না বেরিয়েই একছুট। বনের মাঝে ওর বাবা, মিঠি, পেখম, কুর্চির সঙ্গে অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। ও আসতেই সবাই মিলে বনের বাইরে বেরিয়ে আসল। ডাইনি-বুড়ি টেরটি পায়নি কিছুই। ওরা আবার সুখে থাকতে শুরু করল। শুধু বাবাকে আর বনের গহীনে যেতে দিত না রায়না।